রংপুরের হাড়িভাঙা আম দেশে উৎপাদিত সব আমের জনপ্রিয়তাকে পেছনে ফেলে এখন দেশসেরা আমের খ্যাতি অর্জন করেছে। দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে সুস্বাদু হাড়িভাঙা আম। গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাড়িভাঙা আম বিক্রি শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমের আড়তদাররা ভিড় করছেন হাড়িভাঙা আমের রাজধানী রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পাদাগঞ্জ হাটে। আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থায়ী ব্যাংকের বুথ, কুরিয়ার সার্ভিস, মালবাহী ট্রাকসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে প্রশাসন। আমচাষিরা আশা করছেন এ বছর তারা ২০০ কোটি টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন।
আমচাষি ও আড়তদাররা জানালেন, এবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ত্রিপুরা আর মহারাষ্ট্রে হাড়িভাঙা আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে এক হাজার টন আমের আগাম অর্ডার পাওয়া গেছে। এছাড়া পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত থেকেও আম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে তারা যোগাযোগ শুরু করেছে। আমের বড় আড়তদার আফজাল হোসেন জানালেন এবার অনেক দেশ থেকে যেভাবে অর্ডার আসছে তাতে এ বছর ১০ হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান জানান, এ বছর রংপুরে এক হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে হাড়িভাঙা আম হয়েছে।
এবার অতিবৃষ্টি আর ঝড়ের কারণে আমের ফলন বাম্পার না হলেও ভালো হয়েছে। তারপরও প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। তিনি আরও জানান, হাড়িভাঙা আম চাষে কোন ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না ফলে দেশবাসীকে নিশ্চিয়তা দিতে পারি। কীটনাশকমুক্ত আম খেতে পারবে দেশে ও বিদেশের মানুষ।
আমচাষিরা বলছেন, এবার অন্যান্য বারের তুলনায় হাড়িভাঙা আমের দাম একটু বেশি। বাগানেই প্রতি মণ আম ২৬০০ থেকে ২৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফলে আড়তদারদের কাছ থেকে ভোক্তাদের কাছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে। দাম আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আড়তদার ব্যবসায়ীরা।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় হাড়িভাঙা আম প্রথম উৎপাদন করে কৃষক সালাম। সম্পূর্ণ আঁশমুক্ত সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন সারাদেশে। এখন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর, কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দ্দারপাড়া সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি পাশে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাড়িভাঙা আমের বাগান গড়ে উঠেছে।
মূলত লাল মাটি এলাকায় হাড়িভাঙা আমের চাষ হয় আর লাল মাটির আম ভীষণ সুস্বাদু। গত বছর আমচাষিরা আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এবার হাড়িভাঙা আমের ফলনও হয়েছে তুলনামূলক ভালো। তবে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিযোগ তারা ন্যায্যমূল্য পান না। যদি আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন বেশি বলে আমচাষিদের অভিযোগ। তারপরও হাড়িভাঙা আম বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে হাড়িভাঙা আম। এই আম চাষ করে তারা এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী।
সরেজমিন রংপুরের বদরগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি আমের বাগান এমনকি প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি, কোন কোন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাড়িভাঙা আমের গাছ। সবগুলো গাছের আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বলে আমচাষিরা জানান। ওই এলাকার কৃষক মমতাজ উদ্দিন, আয়েন উদ্দিন, মোসলেমা বেগমসহ অনেকেই জানালেন, মাত্র ৮-১০ বছর আগেও এসব এলাকায় ছিল অভাবি মানুষ। তিন বেলা তো দূরের কথা এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকত জমি। কিন্তু হাড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২ , ২ আষাড় ১৪২৮ ১৬ জিলকদ ১৪৪৩
লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর
রংপুরের হাড়িভাঙা আম দেশে উৎপাদিত সব আমের জনপ্রিয়তাকে পেছনে ফেলে এখন দেশসেরা আমের খ্যাতি অর্জন করেছে। দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে সুস্বাদু হাড়িভাঙা আম। গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাড়িভাঙা আম বিক্রি শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমের আড়তদাররা ভিড় করছেন হাড়িভাঙা আমের রাজধানী রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পাদাগঞ্জ হাটে। আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থায়ী ব্যাংকের বুথ, কুরিয়ার সার্ভিস, মালবাহী ট্রাকসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে প্রশাসন। আমচাষিরা আশা করছেন এ বছর তারা ২০০ কোটি টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন।
আমচাষি ও আড়তদাররা জানালেন, এবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ত্রিপুরা আর মহারাষ্ট্রে হাড়িভাঙা আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে এক হাজার টন আমের আগাম অর্ডার পাওয়া গেছে। এছাড়া পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত থেকেও আম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে তারা যোগাযোগ শুরু করেছে। আমের বড় আড়তদার আফজাল হোসেন জানালেন এবার অনেক দেশ থেকে যেভাবে অর্ডার আসছে তাতে এ বছর ১০ হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান জানান, এ বছর রংপুরে এক হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে হাড়িভাঙা আম হয়েছে।
এবার অতিবৃষ্টি আর ঝড়ের কারণে আমের ফলন বাম্পার না হলেও ভালো হয়েছে। তারপরও প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। তিনি আরও জানান, হাড়িভাঙা আম চাষে কোন ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না ফলে দেশবাসীকে নিশ্চিয়তা দিতে পারি। কীটনাশকমুক্ত আম খেতে পারবে দেশে ও বিদেশের মানুষ।
আমচাষিরা বলছেন, এবার অন্যান্য বারের তুলনায় হাড়িভাঙা আমের দাম একটু বেশি। বাগানেই প্রতি মণ আম ২৬০০ থেকে ২৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফলে আড়তদারদের কাছ থেকে ভোক্তাদের কাছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে। দাম আরও বাড়বে বলে মনে করছেন আড়তদার ব্যবসায়ীরা।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় হাড়িভাঙা আম প্রথম উৎপাদন করে কৃষক সালাম। সম্পূর্ণ আঁশমুক্ত সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন সারাদেশে। এখন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর, কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দ্দারপাড়া সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি পাশে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাড়িভাঙা আমের বাগান গড়ে উঠেছে।
মূলত লাল মাটি এলাকায় হাড়িভাঙা আমের চাষ হয় আর লাল মাটির আম ভীষণ সুস্বাদু। গত বছর আমচাষিরা আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এবার হাড়িভাঙা আমের ফলনও হয়েছে তুলনামূলক ভালো। তবে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিযোগ তারা ন্যায্যমূল্য পান না। যদি আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন বেশি বলে আমচাষিদের অভিযোগ। তারপরও হাড়িভাঙা আম বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে হাড়িভাঙা আম। এই আম চাষ করে তারা এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী।
সরেজমিন রংপুরের বদরগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি আমের বাগান এমনকি প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি, কোন কোন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাড়িভাঙা আমের গাছ। সবগুলো গাছের আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বলে আমচাষিরা জানান। ওই এলাকার কৃষক মমতাজ উদ্দিন, আয়েন উদ্দিন, মোসলেমা বেগমসহ অনেকেই জানালেন, মাত্র ৮-১০ বছর আগেও এসব এলাকায় ছিল অভাবি মানুষ। তিন বেলা তো দূরের কথা এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকত জমি। কিন্তু হাড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে।