শিক্ষকের সঙ্গে অভিভাবকও নতুন প্রক্রিয়ার অংশীদার

অমিত রায় চৌধুরী

আসছে বছর থেকেই চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। প্রাক-প্রাথমিক হতে মাধ্যমিকের পরিধি। অনেক প্রস্তুতি নিয়েই সরকার এ কাজে হাত দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন, জনগণের আকাক্সক্ষা বা সমকালীন চাহিদা-সবই গুরুত্ব পেয়েছে বলে ইঙ্গিত আছে। প্রচলিত ধারনা ও চর্চা মস্তিষ্কের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা সহজ নয়। নতুনকে বরণ করতেও মানুষ হয়তো জৈবিকভাবেই অপ্রস্তুত। খাপ খাওয়াতে সময় লাগে। অনলাইন ভর্তি কিংবা ভর্তির জন্য লটারির মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তও বিতর্ক এড়াতে পারেনি। করোনাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভার্চুয়াল সংযুক্তি অচেনা সম্ভাবনার দোর খুলে দিয়েছিল। সাড়াও মিলেছিল ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ কৌশলে।

কিন্তু অভিভাবক সংশয়মুক্ত ছিল-এ কথা বলা যাবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পদ্ধতির পরিমার্জন স্বাভাবিক। আর প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও যে গলদ থেকে যাচ্ছে-তা নিয়েও কানাঘুষা ছিল। মান নিয়ে আক্ষেপের অন্ত ছিল না। অতীতের প্রতি পক্ষপাত হয়তো মানব মনেরই বৈশিষ্ট্য। তবে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে; এ বিষয়ে কোন তর্ক নেই। আর এর দায় যে অনেকটাই বিভক্ত শিক্ষারÑতা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শিক্ষার চরিত্র ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে। সামাজিক সুরক্ষা বলয় মজবুত হয়েছে। শিক্ষা সংস্কারে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। এর মধ্যে প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ ছিল বৈপ্লবিক; যা ব্যবস্থাকে গতিশীল ও স্বচ্ছ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা বা শিক্ষা বেষ্টনী বাড়ানোর মতো কর্মসূচি সফল হয়েছে। কিন্তু সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্য ছোঁয়া যায়নি। সৃজনশীল পদ্ধতি ফলপ্রসু হয়নি। কোচিং-সিন্ডিকেট বা নোট-গাইড নেক্সাস থেকেও মুক্তি মেলেনি। নৈতিক অবক্ষয় বাদ সেধেছে বারবার। দরকার পড়েছে পরিবার থেকে সমাজ-সবার অন্তর্ভুক্তি, পরিপার্শ্বের সমর্থন। জ্ঞান, দক্ষতা ও চিরন্তন মূল্যবোধের জাগরণ। দেশকাল কিংবা জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতা-সবকিছুই শিক্ষা ভাবনায় জায়গা পেয়েছে। তবে পরিকল্পনা রূপায়নে কোন কোন অন্তরায় কতটা নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারেÑসে আলোচনাটাই প্রাসঙ্গিক।

কালের বিবর্তনে শিক্ষা চেতনায়ও নানা বাঁক এসেছে, নানা রূপান্তর এসেছে। পাশ্চাত্য ভাবনাও কখনো কখনো ছায়া ফেলেছে। সে চিন্তা মোড়ক বদলে নিজের জগতেই ধাতস্থ হয়ে ওঠে। কাঠামোগত ও প্রকৃতিগত কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এবারের কারিকুলামকে প্রথামুক্ত করেছে। কলার পাশে বিজ্ঞান, জ্ঞানের পাশে কর্ম, ধর্মের পাশে ইহজাগতিকতা-এমন আপাত বিপরীত সহাবস্থানই হয়তো জ্ঞানের বৃত্তকে সম্পূর্ণ করে। প্রথমত প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটা ধারাবাহিকভাবে সন্নিহিত ও যুক্তিজালে সংযুক্ত। ২০২৩ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে এই শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে ২০২৭-এ শেষ হবে। নতুন পদ্ধতিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন সবচেয়ে বড় পরিমাপক; যা মুখ্যত শ্রেণীকক্ষে সম্পন্ন হবে। পাবলিক পরীক্ষা হবে ৩টি। সনদ ২টি। এসএসসি ও এইচএসসি। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা পরীক্ষা থাকলেও সনদ দ্বাদশে। ৩য় শ্রেণী অবধি কোন পরীক্ষাই নেই। লক্ষণীয় যে, প্রাথমিক শ্রেণীতে সামষ্টিক পরীক্ষা ৩০ শতাংশ। একাদশ-দ্বাদশে তা ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার চাপ বাড়বে। লক্ষ্য নিষ্পাপ শৈশবকে ভারমুক্ত রাখা, আনন্দময় করা।

বিষয় নির্ধারণে থাকছে প্রক্রিয়াগত বৈচিত্র্য, নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। শিক্ষার্থী কোনভাবেই এসএসসির আগে বিষয় অনুযায়ী বিভক্ত হবে না। অর্থাৎ বিজ্ঞান, বাণিজ্য কিংবা কলা-সবাই ভাষা, গণিত, কৃষি, প্রযুক্তি, এমনকি ধর্ম-নৈতিকতার মতো ১০টি বিষয় শিখবে। ন্যূনতম দক্ষতা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য; যাতে প্রয়োজনে শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন করতে পারে। যে কোন একটি পেশার ওপর দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা হবে। সেটা কৃষি, সেবা বা শিল্প খাত, যাই হোক না কেন। বিভাজন তুলে দেয়ার অন্য এক মাত্রা আছে। তা হলো প্রজন্ম চেতনায় বিজ্ঞানের ছাপ। যুক্তি নির্ভর সমাজ গঠনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তবে বিজ্ঞান শিক্ষকের ঘাটতি মেটানো সরকারের অগ্রাধিকার পেতে হবে। অন্যথায় গন্তব্যে পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে যাবে। ১০টি বিষয়ের সঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখার যৌক্তিক সমন্বয়ের কথাও ভাবতে হবে। সবচেয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হবে কর্মকালীন শিখন। এখানেই নির্ভর করছে পুরো উদ্যোগের সাফল্য। বছরব্যাপী চলা এই অনুশীলনের ক্ষেত্র শুধু ক্লাসরুম নয়; পরিবার, সহপাঠী হয়ে সমাজ-সবাই পরস্পরকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। অভিন্ন সামাজিক পরিসরে জ্ঞানের চর্চা শিক্ষার্থীর ভাবনায় ঐক্য আনবে। শুধু রোজগারের বিষয়টি রপ্ত নয়, অভিন্ন মূল্যবোধ গঠনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

রূপকল্প, প্রস্তুতি বা আয়োজন-সবমিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর কালে শিক্ষা ক্ষেত্রে নেয়া এটিই বৃহত্তম উদ্যোগ। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক যে ব্যবস্থার অংশীজন, সেখানে সব ভালোমন্দের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ জারি থাকবে। শুক্র-শনি দুই দিন বন্ধ থাকবে প্রতিষ্ঠান। পরিকল্পনা অনেক মহৎ-কোন সন্দেহ নেই। সৃষ্টিশীলতার জন্য বিশ্রাম দরকার। ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের জন্য। যথাসময়ে পাঠ্যবই প্রণয়ন-মুদ্রণ নিঃসন্দেহে খুব একটা ঠুনকো কাজ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যপুস্তক ইস্যু বিতর্কের বড় পরিসরজুড়ে থেকেছে। আর ঐতিহাসিক এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বড় অবলম্বন পুস্তক প্রণয়নে মুন্সিয়ানা; যা অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিতে পারে। তাই শুধু অভিজ্ঞ, সৎ ও পরিশ্রমী শিক্ষাবিদকে দায়িত্ব দিলেই চলবে না, কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পর্যাপ্ত সময়ও দিতে হবে। এরপর আসবে মোটিভেশন, যা সচেতন করবে সমাজকে। নানা রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও জীবন চর্যা। পেশায় বৈচিত্র্য আসছে। মেয়েরা কাজের বাজারে স্বচ্ছন্দ্য। ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রশ্নে সবাই একমত। শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে লড়াই থাকলেও এক জায়গায় চেতনার ঐক্য আছে। প্রান্তিক কৃষকও তার সন্তানের ভবিষ্যৎ যে কোন মূল্যে নিরাপদ করতে চায়। প্রথম প্রজন্মের বিশাল অংশ এখন কাজের বাজারে। বদলে যাওয়া এই মানসিকতাই দুর্লভ সামাজিক পুঁজি। এই শক্তি সদ্ব্যবহার করতে হলে সমাজকে সম্পৃক্ত করা চাই। আর নতুন উদ্যোগে কার্যকর অংশীদার অভিভাবক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব অভিভাবক, সামাজিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও কাজে আসতে পারে।

এই মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টুলস শিক্ষক-এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমেই শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদার বিষয়টি আরেকবার ভাবতে হবে। নাগরিকের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল কম। কয়েক দশক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল। ৭৫-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অবহেলাও শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত করার জন্য দায়ী। শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা হয়েছে। অপ্রস্তুত বেকার জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয়েছে শিক্ষা; অসুস্থ রাজনীতির পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শিক্ষাঙ্গন। তবে এনটিআরসির মাধ্যমে অথবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নিযুক্ত মেধাবী ছেলেমেয়েরা এই প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। আসলে শিক্ষায় সমতার জন্য গোটা দেশে একরকম ব্যবস্থা দরকার। অথচ শিক্ষার পণ্যায়ন ক্রমাগত বৈষম্যের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। নগরকেন্দ্রিক ধনীক শ্রেণি শিক্ষাবাজারের দখল নিয়েছে। এখন যে বাস্তবতা সেখানে দাঁড়িয়ে যে কোন মহৎ লক্ষ্যজয় কষ্টসাধ্য। মেধার অভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

কিন্তু নৈতিক অবক্ষয়ে আক্রান্ত সমাজকে সুস্থ করা কঠিন। সেজন্য শুধু প্রশিক্ষণ নয়, লাগবে কার্যকর নজরদারি। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। দক্ষতা বৃদ্ধি বা সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে ধাতস্থ হতে চাই নিবিড় মনোযোগ, ঐকান্তিক আগ্রহ ও ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। দেখেছি- সৃজনশীল পদ্ধতি বা কমিউনিকেটিভ ইংরেজি-উভয় উদ্যোগই ভেস্তে গেছে। কারণ, প্রথমত শিক্ষক কষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ ছিল দায়সারা ও স্বল্প মেয়াদি। এবারের কর্ম পরিধি যেমন বিস্তৃত, কাজের প্রকৃতি তেমনই বহুমাত্রিক, গভীর ও স্ব-উদ্ভাবনী। সবকিছু মাথায় রেখেই প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয়েছে মেগা প্রকল্প। আর এ প্রশিক্ষণ চলতে হবে বিরতিহীন ও বাধ্যতামূলক।

প্রশিক্ষণ চলাকালেই শিক্ষকের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করা যাবে। শিখনমূলক মূল্যায়নের সময় পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কমিয়ে আনতে প্রযুক্তির সাহায্যও নেযা যেতে পারে। প্রক্রিয়া অনানুষ্ঠানিক হলেও রেকর্ড রাখতে হবে। ডিজিটাল সার্ভেইলেন্স সব প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করতে পারে। শিক্ষকের ক্লাসরুম পারফরম্যান্স যাতে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে মনিটর করতে পারে তার সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষকের পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে তাকে পদোন্নতি বা শাস্তি দেয়া যেতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষক নির্ভরতা বেশি থাকায় কোচিং যেন জায়গা করে না নেয়Ñতা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। শুধু প্রাইভেট নয়, মননশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়Ñএমন কোন কাজেই শিক্ষকের যুক্ত থাকা সমীচীন নয়। শিক্ষক যাতে একটানা ২ বছরের বেশি একই কর্মস্থলে থাকতে না পারেÑতা নিশ্চিত করাও জরুরি। সবকথার শেষ কথাÑএই উদ্যোগ সফল হলে দেশ নিশ্চয়ই লাভবান হবে। আর সেজন্য প্রাথমিক হতে দ্বাদশ পর্যন্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার কোন বিকল্প দেখি না।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২ , ২ আষাড় ১৪২৮ ১৬ জিলকদ ১৪৪৩

শিক্ষকের সঙ্গে অভিভাবকও নতুন প্রক্রিয়ার অংশীদার

অমিত রায় চৌধুরী

আসছে বছর থেকেই চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। প্রাক-প্রাথমিক হতে মাধ্যমিকের পরিধি। অনেক প্রস্তুতি নিয়েই সরকার এ কাজে হাত দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন, জনগণের আকাক্সক্ষা বা সমকালীন চাহিদা-সবই গুরুত্ব পেয়েছে বলে ইঙ্গিত আছে। প্রচলিত ধারনা ও চর্চা মস্তিষ্কের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা সহজ নয়। নতুনকে বরণ করতেও মানুষ হয়তো জৈবিকভাবেই অপ্রস্তুত। খাপ খাওয়াতে সময় লাগে। অনলাইন ভর্তি কিংবা ভর্তির জন্য লটারির মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তও বিতর্ক এড়াতে পারেনি। করোনাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভার্চুয়াল সংযুক্তি অচেনা সম্ভাবনার দোর খুলে দিয়েছিল। সাড়াও মিলেছিল ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ কৌশলে।

কিন্তু অভিভাবক সংশয়মুক্ত ছিল-এ কথা বলা যাবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পদ্ধতির পরিমার্জন স্বাভাবিক। আর প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও যে গলদ থেকে যাচ্ছে-তা নিয়েও কানাঘুষা ছিল। মান নিয়ে আক্ষেপের অন্ত ছিল না। অতীতের প্রতি পক্ষপাত হয়তো মানব মনেরই বৈশিষ্ট্য। তবে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে; এ বিষয়ে কোন তর্ক নেই। আর এর দায় যে অনেকটাই বিভক্ত শিক্ষারÑতা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শিক্ষার চরিত্র ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে। সামাজিক সুরক্ষা বলয় মজবুত হয়েছে। শিক্ষা সংস্কারে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। এর মধ্যে প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ ছিল বৈপ্লবিক; যা ব্যবস্থাকে গতিশীল ও স্বচ্ছ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা বা শিক্ষা বেষ্টনী বাড়ানোর মতো কর্মসূচি সফল হয়েছে। কিন্তু সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্য ছোঁয়া যায়নি। সৃজনশীল পদ্ধতি ফলপ্রসু হয়নি। কোচিং-সিন্ডিকেট বা নোট-গাইড নেক্সাস থেকেও মুক্তি মেলেনি। নৈতিক অবক্ষয় বাদ সেধেছে বারবার। দরকার পড়েছে পরিবার থেকে সমাজ-সবার অন্তর্ভুক্তি, পরিপার্শ্বের সমর্থন। জ্ঞান, দক্ষতা ও চিরন্তন মূল্যবোধের জাগরণ। দেশকাল কিংবা জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতা-সবকিছুই শিক্ষা ভাবনায় জায়গা পেয়েছে। তবে পরিকল্পনা রূপায়নে কোন কোন অন্তরায় কতটা নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারেÑসে আলোচনাটাই প্রাসঙ্গিক।

কালের বিবর্তনে শিক্ষা চেতনায়ও নানা বাঁক এসেছে, নানা রূপান্তর এসেছে। পাশ্চাত্য ভাবনাও কখনো কখনো ছায়া ফেলেছে। সে চিন্তা মোড়ক বদলে নিজের জগতেই ধাতস্থ হয়ে ওঠে। কাঠামোগত ও প্রকৃতিগত কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এবারের কারিকুলামকে প্রথামুক্ত করেছে। কলার পাশে বিজ্ঞান, জ্ঞানের পাশে কর্ম, ধর্মের পাশে ইহজাগতিকতা-এমন আপাত বিপরীত সহাবস্থানই হয়তো জ্ঞানের বৃত্তকে সম্পূর্ণ করে। প্রথমত প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটা ধারাবাহিকভাবে সন্নিহিত ও যুক্তিজালে সংযুক্ত। ২০২৩ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে এই শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে ২০২৭-এ শেষ হবে। নতুন পদ্ধতিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন সবচেয়ে বড় পরিমাপক; যা মুখ্যত শ্রেণীকক্ষে সম্পন্ন হবে। পাবলিক পরীক্ষা হবে ৩টি। সনদ ২টি। এসএসসি ও এইচএসসি। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা পরীক্ষা থাকলেও সনদ দ্বাদশে। ৩য় শ্রেণী অবধি কোন পরীক্ষাই নেই। লক্ষণীয় যে, প্রাথমিক শ্রেণীতে সামষ্টিক পরীক্ষা ৩০ শতাংশ। একাদশ-দ্বাদশে তা ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার চাপ বাড়বে। লক্ষ্য নিষ্পাপ শৈশবকে ভারমুক্ত রাখা, আনন্দময় করা।

বিষয় নির্ধারণে থাকছে প্রক্রিয়াগত বৈচিত্র্য, নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। শিক্ষার্থী কোনভাবেই এসএসসির আগে বিষয় অনুযায়ী বিভক্ত হবে না। অর্থাৎ বিজ্ঞান, বাণিজ্য কিংবা কলা-সবাই ভাষা, গণিত, কৃষি, প্রযুক্তি, এমনকি ধর্ম-নৈতিকতার মতো ১০টি বিষয় শিখবে। ন্যূনতম দক্ষতা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য; যাতে প্রয়োজনে শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন করতে পারে। যে কোন একটি পেশার ওপর দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা হবে। সেটা কৃষি, সেবা বা শিল্প খাত, যাই হোক না কেন। বিভাজন তুলে দেয়ার অন্য এক মাত্রা আছে। তা হলো প্রজন্ম চেতনায় বিজ্ঞানের ছাপ। যুক্তি নির্ভর সমাজ গঠনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তবে বিজ্ঞান শিক্ষকের ঘাটতি মেটানো সরকারের অগ্রাধিকার পেতে হবে। অন্যথায় গন্তব্যে পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে যাবে। ১০টি বিষয়ের সঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখার যৌক্তিক সমন্বয়ের কথাও ভাবতে হবে। সবচেয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হবে কর্মকালীন শিখন। এখানেই নির্ভর করছে পুরো উদ্যোগের সাফল্য। বছরব্যাপী চলা এই অনুশীলনের ক্ষেত্র শুধু ক্লাসরুম নয়; পরিবার, সহপাঠী হয়ে সমাজ-সবাই পরস্পরকে মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। অভিন্ন সামাজিক পরিসরে জ্ঞানের চর্চা শিক্ষার্থীর ভাবনায় ঐক্য আনবে। শুধু রোজগারের বিষয়টি রপ্ত নয়, অভিন্ন মূল্যবোধ গঠনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

রূপকল্প, প্রস্তুতি বা আয়োজন-সবমিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর কালে শিক্ষা ক্ষেত্রে নেয়া এটিই বৃহত্তম উদ্যোগ। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক যে ব্যবস্থার অংশীজন, সেখানে সব ভালোমন্দের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ জারি থাকবে। শুক্র-শনি দুই দিন বন্ধ থাকবে প্রতিষ্ঠান। পরিকল্পনা অনেক মহৎ-কোন সন্দেহ নেই। সৃষ্টিশীলতার জন্য বিশ্রাম দরকার। ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের জন্য। যথাসময়ে পাঠ্যবই প্রণয়ন-মুদ্রণ নিঃসন্দেহে খুব একটা ঠুনকো কাজ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যপুস্তক ইস্যু বিতর্কের বড় পরিসরজুড়ে থেকেছে। আর ঐতিহাসিক এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বড় অবলম্বন পুস্তক প্রণয়নে মুন্সিয়ানা; যা অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিতে পারে। তাই শুধু অভিজ্ঞ, সৎ ও পরিশ্রমী শিক্ষাবিদকে দায়িত্ব দিলেই চলবে না, কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পর্যাপ্ত সময়ও দিতে হবে। এরপর আসবে মোটিভেশন, যা সচেতন করবে সমাজকে। নানা রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও জীবন চর্যা। পেশায় বৈচিত্র্য আসছে। মেয়েরা কাজের বাজারে স্বচ্ছন্দ্য। ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রশ্নে সবাই একমত। শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে লড়াই থাকলেও এক জায়গায় চেতনার ঐক্য আছে। প্রান্তিক কৃষকও তার সন্তানের ভবিষ্যৎ যে কোন মূল্যে নিরাপদ করতে চায়। প্রথম প্রজন্মের বিশাল অংশ এখন কাজের বাজারে। বদলে যাওয়া এই মানসিকতাই দুর্লভ সামাজিক পুঁজি। এই শক্তি সদ্ব্যবহার করতে হলে সমাজকে সম্পৃক্ত করা চাই। আর নতুন উদ্যোগে কার্যকর অংশীদার অভিভাবক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব অভিভাবক, সামাজিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও কাজে আসতে পারে।

এই মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টুলস শিক্ষক-এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমেই শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদার বিষয়টি আরেকবার ভাবতে হবে। নাগরিকের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল কম। কয়েক দশক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল। ৭৫-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অবহেলাও শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত করার জন্য দায়ী। শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা হয়েছে। অপ্রস্তুত বেকার জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয়েছে শিক্ষা; অসুস্থ রাজনীতির পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শিক্ষাঙ্গন। তবে এনটিআরসির মাধ্যমে অথবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নিযুক্ত মেধাবী ছেলেমেয়েরা এই প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। আসলে শিক্ষায় সমতার জন্য গোটা দেশে একরকম ব্যবস্থা দরকার। অথচ শিক্ষার পণ্যায়ন ক্রমাগত বৈষম্যের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। নগরকেন্দ্রিক ধনীক শ্রেণি শিক্ষাবাজারের দখল নিয়েছে। এখন যে বাস্তবতা সেখানে দাঁড়িয়ে যে কোন মহৎ লক্ষ্যজয় কষ্টসাধ্য। মেধার অভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

কিন্তু নৈতিক অবক্ষয়ে আক্রান্ত সমাজকে সুস্থ করা কঠিন। সেজন্য শুধু প্রশিক্ষণ নয়, লাগবে কার্যকর নজরদারি। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। দক্ষতা বৃদ্ধি বা সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে ধাতস্থ হতে চাই নিবিড় মনোযোগ, ঐকান্তিক আগ্রহ ও ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। দেখেছি- সৃজনশীল পদ্ধতি বা কমিউনিকেটিভ ইংরেজি-উভয় উদ্যোগই ভেস্তে গেছে। কারণ, প্রথমত শিক্ষক কষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ ছিল দায়সারা ও স্বল্প মেয়াদি। এবারের কর্ম পরিধি যেমন বিস্তৃত, কাজের প্রকৃতি তেমনই বহুমাত্রিক, গভীর ও স্ব-উদ্ভাবনী। সবকিছু মাথায় রেখেই প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয়েছে মেগা প্রকল্প। আর এ প্রশিক্ষণ চলতে হবে বিরতিহীন ও বাধ্যতামূলক।

প্রশিক্ষণ চলাকালেই শিক্ষকের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করা যাবে। শিখনমূলক মূল্যায়নের সময় পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কমিয়ে আনতে প্রযুক্তির সাহায্যও নেযা যেতে পারে। প্রক্রিয়া অনানুষ্ঠানিক হলেও রেকর্ড রাখতে হবে। ডিজিটাল সার্ভেইলেন্স সব প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করতে পারে। শিক্ষকের ক্লাসরুম পারফরম্যান্স যাতে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে মনিটর করতে পারে তার সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষকের পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে তাকে পদোন্নতি বা শাস্তি দেয়া যেতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষক নির্ভরতা বেশি থাকায় কোচিং যেন জায়গা করে না নেয়Ñতা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। শুধু প্রাইভেট নয়, মননশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়Ñএমন কোন কাজেই শিক্ষকের যুক্ত থাকা সমীচীন নয়। শিক্ষক যাতে একটানা ২ বছরের বেশি একই কর্মস্থলে থাকতে না পারেÑতা নিশ্চিত করাও জরুরি। সবকথার শেষ কথাÑএই উদ্যোগ সফল হলে দেশ নিশ্চয়ই লাভবান হবে। আর সেজন্য প্রাথমিক হতে দ্বাদশ পর্যন্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার কোন বিকল্প দেখি না।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]