ই-কমার্স খাত উপেক্ষিতই রয়ে গেল

জীশান কিংশুক হক

এবারের বাজেটে আসলে ই-কমার্স খাত উপেক্ষিতই রয়ে গেল। বাজেটে বলা হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে রিসার্চ হবে, নতুন স্টার্টআপ (ই-কমার্স হোক বা না হোক) তৈরির জন্য প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, তাদের জন্য অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স কমিয়ে ০.৬% থেকে ০.১% করা হয়েছে। কিন্তু যারা বর্তমানে ই-কমার্স করছে, করোনার ২ বছর যারা দাঁতে-দাঁত-চেপে, ভ্যাট-ট্যাক্সের জটিলতায় খাবি খেয়ে, রোদ-বৃষ্টি-করোনা উপেক্ষা করে মানুষের কাছে তবুও পণ্য পৌঁছে দিয়েছে, তাদের জন্য বাজেটে আসলে কিছুই নেই। বরং এদের অপারেশন চালানোর, কম্পিউটার আর প্রিন্টারের কালি কেনার খরচ, সেবার ওপর ভ্যাট বেড়ে গেল। একটা অ্যাসোসিয়েশন থেকে ৫টা প্রস্তাব গেল, একটাও আমলে নেয়া হলো না।

মূল সমস্যাটা কোথায়?

মূল সমস্যাটা হচ্ছে, যারা বাজেট তৈরি করছেন, ই-কমার্সের বিষয়ে তাদের মানুষের কাছে নিয়ে আসা হয়নি। এটা আমাদেরই নিয়ে আসতে হবে। তারা যদি আর ১০টা সেক্টর নিয়ে বুঝতে পারেন, তাহলে কেন এই সেক্টরটা নিয়ে বুঝবেন না? আরেকটা যেটা তাদের বোঝানো প্রয়োজন, কীভাবে অঙ্কগুলো মেলানো যায়। যদি ৭% পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়, তাহলে একটা কোম্পানিকে কমপক্ষে ৩২% প্রফিট করতে হয়- কোন ই-কমার্স এই পরিমাণ প্রফিট করে বলে আমার জানা নেই। যদি ডেলিভারির ওপর ১৫% ভ্যাট বসে, আর ১ কেজি আলু যে ডেলিভারি করছে, সেই আলু-বিক্রেতার কাছ থেকে মূসক চায়, তখন দাম খামোখাই বেড়ে যায়। মাঠ-পর্যায়ে এইটার প্রায়োগিকতা হাস্যকর। কাস্টমার তখন বরং ই-কমার্সে না কিনে পাশের দোকান থেকে পণ্য সদাই করে। অথচ, ই-কমার্সে লেনদেন বা বিক্রিটা হলে যে এটা ডিজিটাল হতো, সরকার যে লেনদেনের একটা ফুটপ্রিন্ট পেয়ে যেতেন এবং সেটাতে যে স্বচ্ছতা আসতো, তথ্যের আধার পেয়ে যেতেন, এটা বোঝানো প্রয়োজন।

পনি-ওয়াইজ-পাউন্ড-ফুলিশ

মুহিত স্যারের সঙ্গে কথা বললে অনেক কিছু জানা যেত। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, আমরা বাজেট কিংবা পলিসি তৈরির সময় অনেক কিছু কাগজে লিখে ফেলি। কিন্তু সেগুলো অনেকসময়ই ‘প্র্যাগম্যাটিক’ (তিনি এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন) কি না, ভেবে দেখি না। একটা খাত থেকে রেভিনিউ আনতে গিয়ে যদি অদেখা সমস্যার কারণে সময় এবং সম্পদ অপচয় হয়, যদি গ্রাহক কিংবা জনগণের অসুবিধা হয়, তখন ভেবে দেখা প্রয়োজন যে আসলেই যা করছি, সেটা কতটা ‘কস্ট এফেক্টিভ’। ই-কমার্স খাতের অবস্থা সেটাই। সবাই ভাবছে এইখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়, কিন্তু আসলে কত টাকা হয়, আমরা জানি না। সত্যিকার ব্যবসায়ীরা জানেন, এমন কিছুই হয় না। এটাও জানেন, মূসক লিখতে লিখতে, ১২ টাকার ট্যাক্স দিতে গিয়ে, ৩ হাজার টাকার ডেলিভারি গ্রাহক ফেরত দিয়ে দেন। আমাদের বোঝাতে হবে যে সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তো আরও সমস্যা বাড়াতে চাই না।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের আসল সমস্যা কী?

প্রথম সমস্যা: ট্যাক্স ও ভ্যাট

ভুল বুঝবেন না, ট্যাক্স বা ভ্যাট দিতে কিন্তু সমস্যা নেই- বরং অন্য যে কোন ব্যবসার তুলনায় ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা শিক্ষিত এবং সচেতন। সমস্যা হচ্ছে, ঠিক জায়গার ঠিক ট্যাক্স হচ্ছে কিনা। যেমন- কমিশন কিংবা ভ্যালু অ্যাডিশনের ওপর ৫% ভ্যাট দেয়া হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এটার প্রায়োগিকতা জটিল। না এটা মার্চেন্টরা বোঝেন, না বোঝেন কাস্টমার। মাঝখান দিয়ে, ঠিক মতো ভ্যাটের কাগজপত্র রাখা হয়নি বলে ব্যবসায়ীদের বার বার হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ডেলিভারিতে ১৫% ভ্যাট ধরা আছে। তার মানে, আপনি ট্রাকে করে যশোর থেকে আলু পাঠালে কোন ট্যাক্স নেই, কিন্তু চালডাল ডটকমে সেই একই আলু একজন কাস্টমারকে ডেলিভারি করলে সেটাতে কিন্তু ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। সারাদেশজুড়ে ই-কমার্স ছড়িয়ে দেয়ার এটা প্রধান অন্তরায়। ই-কমার্সে গুদামে মাল না রাখলে, কাস্টমারকে দ্রুত পণ্য দেয়া যায় না। অথচ এই গুদামঘরের ওপরেও ভ্যাট দিতে হয়।

দ্বিতীয় সমস্যা : অর্থায়ন

ই-কমার্স ব্যবসার মডেলটা অন্যান্য ব্যবসার মডেলের মতো নয়। ফলে, এখানে গতানুগতিক টালি-খাতা আর গুদাম দেখে, কোল্যাটেরাল কিংবা জামানত রেখে অর্থায়ন করার সুযোগ থাকে না। এই ব্যবসায় সবচেয়ে বড় পুঁজি হচ্ছে একজন উদ্যোক্তার বুদ্ধি এবং উদ্যম। কোন ব্যাংকে এটা পরিমাপের কোন উপায় নেই। এটা কোন কোল্যাটেরাল না, কিন্তু আবার ব্যক্তিগত সম্মানবোধই কখনো কখনো সবচেয়ে শক্ত কোল্যাটেরাল- যে কারণেই কিন্তু পার্সোনাল গ্যারান্টি নেয়া হয়। ই-কমার্সে গতানুগতিক কিস্তিভিত্তিক ব্যাংক লোনও কাজ করবে নাÑ কিস্তির টাকা দেবে, নাকি কর্মীর বেতন, নাকি মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করবে? সুতরাং, ই-কমার্সে অর্থায়নে ইকুইটি ফাইন্যান্সিং দরকার এবং সাধারণ ব্যাংক-লোনে অন্যরকম ‘এসেসমেন্ট’ দরকার। সরকার থেকে উৎসাহ না আসলে, ব্যাংক কিংবা বিনিয়োগকারীদের কেউই এখানে আসবে না। মজার ব্যাপার হলো, এবারের বাজেটে স্টার্টআপকে উৎসাহিত করা হয়েছে কিন্তু সে ক্ষেত্রে ব্যবসার বয়স ৫ বছরের কম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য। তার মানে, পুরাতন ব্যবসায়ীকে এই সুবিধার বাইরে রেখে দেয়া হল এবং বর্তমান ই-কমার্সের বাইরে থেকে গেল।

তৃতীয় সমস্যা: স্বচ্ছতা এবং পেমেন্ট

২০২১ ই-কমার্সের কালো অধ্যায়। ই-ভ্যালির মতো ব্যবসাগুলোকে না কাস্টমাররা বুঝতে পেরেছেন, না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা রদ করেছেন, না সংগঠন থামিয়েছেন। ই-ক্যাব নিজেই ১ বছরের বেশি সময় নিয়েছে ই-ভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করতে। মার্চেন্ট এবং ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার গ্রাহকের না পণ্য দিয়েছেন, না দিয়েছেন টাকা ফেরত। সেটা ঠিক করতে তাড়াহুড়ো করে আনা হয়েছে এস ক্রো সিস্টেম। সেটাতে যে এখন ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের টাকা আরও বেশি আটকা পড়ে থাকছে, এটা কি বাজেট প্রণয়নকারীরা জানেন? তারা জানলে নিশ্চয়ই ব্যবস্তা নেবেন।

সমস্যাগুলোর তাহলে সমাধান কি বাজেটে কখনোই আসবে না?

অবশ্যই আসবে। তবে এর জন্য সংগঠন (যেমন- ই-ক্যাব) কে পলিসি পর্যায়ে কাজ করতে হবে। আমাদের বেদনার জায়গাগুলো এবং তাতে গ্রাহকদের কি কি ক্ষতি হচ্ছে, এটা যেমন বোঝানো দরকার; তেমনি দরকার নীতি-নির্ধারকদের দেখিয়ে দেয়া যে নম্বর কোথা থেকে আসবে। গত ৭-৮ বছরে আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। গতবার ই-ক্যাব থেকে দেয়া ২৭টি প্রস্তাবের মাত্র ১টা গৃহীত হয়েছে। এবার ৫টি প্রস্তাবের একটিরও প্রতিফলন ঘটেনি বাজেটে। আসলে, প্রস্তাবগুলোর জন্য যৌক্তিকতা তৈরি করতে আমরাই ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি আশাবাদী, সামনে পরিবর্তন আসছে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে ই-কমার্স এখন প্রথম ১০টি খাতের ১টি। এই খাতে দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব। এই খাতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কেনাকাটা এবং লেনদেনকে ডিজিটাল করে ফেলা সম্ভব। এইখাতের উদ্যোক্তারা অপেক্ষকৃত শিক্ষিত, সচেতন তাদের মাধ্যমে সরকারের প্রায়োরিটি বাস্তবায়ন অনেক সহজ।

সুতরাং, ই-কমার্সই আসল ভবিষ্যৎ। সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সংগঠনের সমন্বিত চেষ্টায় দেশটা আরও বহুগুণ এগোবে, এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

[লেখক : কো-ফাউন্ডার, সিন্দাবাদ ডটকম]

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০২২ , ২ আষাড় ১৪২৮ ১৬ জিলকদ ১৪৪৩

ই-কমার্স খাত উপেক্ষিতই রয়ে গেল

জীশান কিংশুক হক

image

এবারের বাজেটে আসলে ই-কমার্স খাত উপেক্ষিতই রয়ে গেল। বাজেটে বলা হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে রিসার্চ হবে, নতুন স্টার্টআপ (ই-কমার্স হোক বা না হোক) তৈরির জন্য প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, তাদের জন্য অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স কমিয়ে ০.৬% থেকে ০.১% করা হয়েছে। কিন্তু যারা বর্তমানে ই-কমার্স করছে, করোনার ২ বছর যারা দাঁতে-দাঁত-চেপে, ভ্যাট-ট্যাক্সের জটিলতায় খাবি খেয়ে, রোদ-বৃষ্টি-করোনা উপেক্ষা করে মানুষের কাছে তবুও পণ্য পৌঁছে দিয়েছে, তাদের জন্য বাজেটে আসলে কিছুই নেই। বরং এদের অপারেশন চালানোর, কম্পিউটার আর প্রিন্টারের কালি কেনার খরচ, সেবার ওপর ভ্যাট বেড়ে গেল। একটা অ্যাসোসিয়েশন থেকে ৫টা প্রস্তাব গেল, একটাও আমলে নেয়া হলো না।

মূল সমস্যাটা কোথায়?

মূল সমস্যাটা হচ্ছে, যারা বাজেট তৈরি করছেন, ই-কমার্সের বিষয়ে তাদের মানুষের কাছে নিয়ে আসা হয়নি। এটা আমাদেরই নিয়ে আসতে হবে। তারা যদি আর ১০টা সেক্টর নিয়ে বুঝতে পারেন, তাহলে কেন এই সেক্টরটা নিয়ে বুঝবেন না? আরেকটা যেটা তাদের বোঝানো প্রয়োজন, কীভাবে অঙ্কগুলো মেলানো যায়। যদি ৭% পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়, তাহলে একটা কোম্পানিকে কমপক্ষে ৩২% প্রফিট করতে হয়- কোন ই-কমার্স এই পরিমাণ প্রফিট করে বলে আমার জানা নেই। যদি ডেলিভারির ওপর ১৫% ভ্যাট বসে, আর ১ কেজি আলু যে ডেলিভারি করছে, সেই আলু-বিক্রেতার কাছ থেকে মূসক চায়, তখন দাম খামোখাই বেড়ে যায়। মাঠ-পর্যায়ে এইটার প্রায়োগিকতা হাস্যকর। কাস্টমার তখন বরং ই-কমার্সে না কিনে পাশের দোকান থেকে পণ্য সদাই করে। অথচ, ই-কমার্সে লেনদেন বা বিক্রিটা হলে যে এটা ডিজিটাল হতো, সরকার যে লেনদেনের একটা ফুটপ্রিন্ট পেয়ে যেতেন এবং সেটাতে যে স্বচ্ছতা আসতো, তথ্যের আধার পেয়ে যেতেন, এটা বোঝানো প্রয়োজন।

পনি-ওয়াইজ-পাউন্ড-ফুলিশ

মুহিত স্যারের সঙ্গে কথা বললে অনেক কিছু জানা যেত। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, আমরা বাজেট কিংবা পলিসি তৈরির সময় অনেক কিছু কাগজে লিখে ফেলি। কিন্তু সেগুলো অনেকসময়ই ‘প্র্যাগম্যাটিক’ (তিনি এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন) কি না, ভেবে দেখি না। একটা খাত থেকে রেভিনিউ আনতে গিয়ে যদি অদেখা সমস্যার কারণে সময় এবং সম্পদ অপচয় হয়, যদি গ্রাহক কিংবা জনগণের অসুবিধা হয়, তখন ভেবে দেখা প্রয়োজন যে আসলেই যা করছি, সেটা কতটা ‘কস্ট এফেক্টিভ’। ই-কমার্স খাতের অবস্থা সেটাই। সবাই ভাবছে এইখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়, কিন্তু আসলে কত টাকা হয়, আমরা জানি না। সত্যিকার ব্যবসায়ীরা জানেন, এমন কিছুই হয় না। এটাও জানেন, মূসক লিখতে লিখতে, ১২ টাকার ট্যাক্স দিতে গিয়ে, ৩ হাজার টাকার ডেলিভারি গ্রাহক ফেরত দিয়ে দেন। আমাদের বোঝাতে হবে যে সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তো আরও সমস্যা বাড়াতে চাই না।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের আসল সমস্যা কী?

প্রথম সমস্যা: ট্যাক্স ও ভ্যাট

ভুল বুঝবেন না, ট্যাক্স বা ভ্যাট দিতে কিন্তু সমস্যা নেই- বরং অন্য যে কোন ব্যবসার তুলনায় ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা শিক্ষিত এবং সচেতন। সমস্যা হচ্ছে, ঠিক জায়গার ঠিক ট্যাক্স হচ্ছে কিনা। যেমন- কমিশন কিংবা ভ্যালু অ্যাডিশনের ওপর ৫% ভ্যাট দেয়া হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এটার প্রায়োগিকতা জটিল। না এটা মার্চেন্টরা বোঝেন, না বোঝেন কাস্টমার। মাঝখান দিয়ে, ঠিক মতো ভ্যাটের কাগজপত্র রাখা হয়নি বলে ব্যবসায়ীদের বার বার হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ডেলিভারিতে ১৫% ভ্যাট ধরা আছে। তার মানে, আপনি ট্রাকে করে যশোর থেকে আলু পাঠালে কোন ট্যাক্স নেই, কিন্তু চালডাল ডটকমে সেই একই আলু একজন কাস্টমারকে ডেলিভারি করলে সেটাতে কিন্তু ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। সারাদেশজুড়ে ই-কমার্স ছড়িয়ে দেয়ার এটা প্রধান অন্তরায়। ই-কমার্সে গুদামে মাল না রাখলে, কাস্টমারকে দ্রুত পণ্য দেয়া যায় না। অথচ এই গুদামঘরের ওপরেও ভ্যাট দিতে হয়।

দ্বিতীয় সমস্যা : অর্থায়ন

ই-কমার্স ব্যবসার মডেলটা অন্যান্য ব্যবসার মডেলের মতো নয়। ফলে, এখানে গতানুগতিক টালি-খাতা আর গুদাম দেখে, কোল্যাটেরাল কিংবা জামানত রেখে অর্থায়ন করার সুযোগ থাকে না। এই ব্যবসায় সবচেয়ে বড় পুঁজি হচ্ছে একজন উদ্যোক্তার বুদ্ধি এবং উদ্যম। কোন ব্যাংকে এটা পরিমাপের কোন উপায় নেই। এটা কোন কোল্যাটেরাল না, কিন্তু আবার ব্যক্তিগত সম্মানবোধই কখনো কখনো সবচেয়ে শক্ত কোল্যাটেরাল- যে কারণেই কিন্তু পার্সোনাল গ্যারান্টি নেয়া হয়। ই-কমার্সে গতানুগতিক কিস্তিভিত্তিক ব্যাংক লোনও কাজ করবে নাÑ কিস্তির টাকা দেবে, নাকি কর্মীর বেতন, নাকি মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করবে? সুতরাং, ই-কমার্সে অর্থায়নে ইকুইটি ফাইন্যান্সিং দরকার এবং সাধারণ ব্যাংক-লোনে অন্যরকম ‘এসেসমেন্ট’ দরকার। সরকার থেকে উৎসাহ না আসলে, ব্যাংক কিংবা বিনিয়োগকারীদের কেউই এখানে আসবে না। মজার ব্যাপার হলো, এবারের বাজেটে স্টার্টআপকে উৎসাহিত করা হয়েছে কিন্তু সে ক্ষেত্রে ব্যবসার বয়স ৫ বছরের কম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য। তার মানে, পুরাতন ব্যবসায়ীকে এই সুবিধার বাইরে রেখে দেয়া হল এবং বর্তমান ই-কমার্সের বাইরে থেকে গেল।

তৃতীয় সমস্যা: স্বচ্ছতা এবং পেমেন্ট

২০২১ ই-কমার্সের কালো অধ্যায়। ই-ভ্যালির মতো ব্যবসাগুলোকে না কাস্টমাররা বুঝতে পেরেছেন, না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা রদ করেছেন, না সংগঠন থামিয়েছেন। ই-ক্যাব নিজেই ১ বছরের বেশি সময় নিয়েছে ই-ভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করতে। মার্চেন্ট এবং ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার গ্রাহকের না পণ্য দিয়েছেন, না দিয়েছেন টাকা ফেরত। সেটা ঠিক করতে তাড়াহুড়ো করে আনা হয়েছে এস ক্রো সিস্টেম। সেটাতে যে এখন ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের টাকা আরও বেশি আটকা পড়ে থাকছে, এটা কি বাজেট প্রণয়নকারীরা জানেন? তারা জানলে নিশ্চয়ই ব্যবস্তা নেবেন।

সমস্যাগুলোর তাহলে সমাধান কি বাজেটে কখনোই আসবে না?

অবশ্যই আসবে। তবে এর জন্য সংগঠন (যেমন- ই-ক্যাব) কে পলিসি পর্যায়ে কাজ করতে হবে। আমাদের বেদনার জায়গাগুলো এবং তাতে গ্রাহকদের কি কি ক্ষতি হচ্ছে, এটা যেমন বোঝানো দরকার; তেমনি দরকার নীতি-নির্ধারকদের দেখিয়ে দেয়া যে নম্বর কোথা থেকে আসবে। গত ৭-৮ বছরে আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। গতবার ই-ক্যাব থেকে দেয়া ২৭টি প্রস্তাবের মাত্র ১টা গৃহীত হয়েছে। এবার ৫টি প্রস্তাবের একটিরও প্রতিফলন ঘটেনি বাজেটে। আসলে, প্রস্তাবগুলোর জন্য যৌক্তিকতা তৈরি করতে আমরাই ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি আশাবাদী, সামনে পরিবর্তন আসছে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে ই-কমার্স এখন প্রথম ১০টি খাতের ১টি। এই খাতে দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব। এই খাতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কেনাকাটা এবং লেনদেনকে ডিজিটাল করে ফেলা সম্ভব। এইখাতের উদ্যোক্তারা অপেক্ষকৃত শিক্ষিত, সচেতন তাদের মাধ্যমে সরকারের প্রায়োরিটি বাস্তবায়ন অনেক সহজ।

সুতরাং, ই-কমার্সই আসল ভবিষ্যৎ। সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সংগঠনের সমন্বিত চেষ্টায় দেশটা আরও বহুগুণ এগোবে, এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

[লেখক : কো-ফাউন্ডার, সিন্দাবাদ ডটকম]