বন্যার পানিতে ভাসছে চার জেলা

পরিস্থিতির অবনতি, লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ২১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারা, যাদুকাটা নদীর পানি বৃদ্ধিতে সিলেট ও সুমানগঞ্জের ১০ উপজেলায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও বসত বাড়িগুলো পানিতে নিমজ্জিত। ফসলহানি, নদীভাঙন, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বানভাসী মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এদিকে তিস্তা ও ধরলার পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া ও লালমনিরহাটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শতশত গ্রাম ডুবে গেছে।

সুনামগঞ্জ থেকে লতিফুর রহমান রাজু জানান, সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও গত কদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুনামগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামসুদ্দোহা জানান, ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জে ১৮৫ মিলিমিটার। ফলে সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলার সঙ্গেও দোয়ারাবাজার উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা, খাসিয়ামারা, সোনালী চেলা, চিলাই নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়িঘর, স্কুল, মসজিদে পানি প্রবেশ করেছে। উপ?জেলার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে।

ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, নোয়ারাই, ইসলামপুর, ছাতক সদর ও পৌর এলাকার সড়ক ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ছাতক-সিলেট সড়কের ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের সড়কে ও অন্যান্য স্থানে পানি থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়ন দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের ৪৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নৌকা ছাড়া চলাচলের কোন উপায় নেই।

তাহিরপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন জানান, তাহিরপুর সদর, বালিজুরি, বাদাঘাট উত্তর বড়দল দক্ষিণ বড়দল উত্তর শ্রীপুর দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান কবির জানান, জাদুকাটা, বৌলাই, রক্তি নদীর পানি বেড়ে চলেছে। আমরা সতর্ক রয়েছি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘরিয়া, বড়পাড়া, উত্তর আরপিননগর, সবজি বাজার, জেল রোড, উকিলপাড়া, কাজির পয়েন্ট ষোলঘর, নবী নগর, সুলতানপুর, ওয়েজখালীসহ পৌর এলাকার ৮০ ভাগ প্লাবিত হয়েছে। শহরের যেসব সড়কে যানবাহন চলাচল করত এখন নৌকা চলে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা হয়েছে। এবারের বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল জানান, গত বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুর রহমান জানান, আমার অফিসে পানি অনেক উপজেলার অফিসে পানি প্রবেশ করেছে। অনেক বিদ্যালয়ে পানি আবার অনেক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে আবার কোন জায়গায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাই পাঠদান বন্ধ রয়েছে ।

অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বিশেষ করে দিনমজুররা খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অধিকাংশ বসতঘর পানিতে নিমজ্জিত থাকায় চুলা ও ডুবে গেছে। ফলে খেয়ে না খেয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

সিলেট প্রতিনিধি আকাশ চৌধুরী জানান, সিলেটের নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সকালে নদীর তীর উপচে নতুন করে বিভিন্ন বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের আশঙ্কা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে জেলার ছোট ছোট অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট নগরের ৮ থেকে ১০টি এলাকা ছাড়াও জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার অন্তত ৫০০ গ্রাম এরই মধ্যে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ফের বন্যাকবলিত হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বানভাসিরা। নগর ও পাঁচটি উপজেলায় অন্তত চার থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন বলে জানা গেছে।

রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল ও গঙ্গাচড়ার সুজন আহাম্মেদ জানান, তিস্তা নদীর পানি মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় এবং দুপুর ৩টায় তা বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মধ্যে চলে এসেছে।

তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫টি বাড়ি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজারসহ শত শত বাড়িঘর।

তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে প্রবল বেগে পানি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী ও দুর্গম চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ৩০টি গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সেখানে দুই থেকে আড়াই ফুট কোথাও কোথাও আরও বেশি পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, ভাঙনকবলিত কোলকন্দ ইউনিয়নের বিনবিনিয়া চর ও লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতির মুখে। তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে এসব এলাকার বাসিন্দারা সমস্যায় পড়েছেন।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ধরলা নদীর পানি লালমনিরহাট সদর উপজেলার শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি দুপুর পর্যন্ত লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমা ৫২ মিটার ৬০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলারে মোগলহাট, কুলাঘাট, বড়বাড়ী, আদিতমারী উপজেলার বড়বাড়ী, হাতীবান্ধার গড্ডিমারি, সানিয়াযান, সিন্দুনা, ডাউয়াবাড়ি, আদিতমারির মহিষখোচা ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের বসতভিটায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মোগলহাট ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রাম।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ধরলাপাড়ে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২ , ৩ আষাড় ১৪২৮ ১৭ জিলকদ ১৪৪৩

বন্যার পানিতে ভাসছে চার জেলা

পরিস্থিতির অবনতি, লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি

সংবাদ ডেস্ক

image

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ২১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারা, যাদুকাটা নদীর পানি বৃদ্ধিতে সিলেট ও সুমানগঞ্জের ১০ উপজেলায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও বসত বাড়িগুলো পানিতে নিমজ্জিত। ফসলহানি, নদীভাঙন, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বানভাসী মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এদিকে তিস্তা ও ধরলার পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া ও লালমনিরহাটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শতশত গ্রাম ডুবে গেছে।

সুনামগঞ্জ থেকে লতিফুর রহমান রাজু জানান, সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও গত কদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুনামগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামসুদ্দোহা জানান, ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জে ১৮৫ মিলিমিটার। ফলে সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলার সঙ্গেও দোয়ারাবাজার উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা, খাসিয়ামারা, সোনালী চেলা, চিলাই নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়িঘর, স্কুল, মসজিদে পানি প্রবেশ করেছে। উপ?জেলার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে।

ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, নোয়ারাই, ইসলামপুর, ছাতক সদর ও পৌর এলাকার সড়ক ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ছাতক-সিলেট সড়কের ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের সড়কে ও অন্যান্য স্থানে পানি থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়ন দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের ৪৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নৌকা ছাড়া চলাচলের কোন উপায় নেই।

তাহিরপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন জানান, তাহিরপুর সদর, বালিজুরি, বাদাঘাট উত্তর বড়দল দক্ষিণ বড়দল উত্তর শ্রীপুর দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান কবির জানান, জাদুকাটা, বৌলাই, রক্তি নদীর পানি বেড়ে চলেছে। আমরা সতর্ক রয়েছি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘরিয়া, বড়পাড়া, উত্তর আরপিননগর, সবজি বাজার, জেল রোড, উকিলপাড়া, কাজির পয়েন্ট ষোলঘর, নবী নগর, সুলতানপুর, ওয়েজখালীসহ পৌর এলাকার ৮০ ভাগ প্লাবিত হয়েছে। শহরের যেসব সড়কে যানবাহন চলাচল করত এখন নৌকা চলে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা হয়েছে। এবারের বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল জানান, গত বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুর রহমান জানান, আমার অফিসে পানি অনেক উপজেলার অফিসে পানি প্রবেশ করেছে। অনেক বিদ্যালয়ে পানি আবার অনেক বিদ্যালয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে আবার কোন জায়গায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাই পাঠদান বন্ধ রয়েছে ।

অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বিশেষ করে দিনমজুররা খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অধিকাংশ বসতঘর পানিতে নিমজ্জিত থাকায় চুলা ও ডুবে গেছে। ফলে খেয়ে না খেয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

সিলেট প্রতিনিধি আকাশ চৌধুরী জানান, সিলেটের নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সকালে নদীর তীর উপচে নতুন করে বিভিন্ন বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের আশঙ্কা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে জেলার ছোট ছোট অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট নগরের ৮ থেকে ১০টি এলাকা ছাড়াও জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার অন্তত ৫০০ গ্রাম এরই মধ্যে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ফের বন্যাকবলিত হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বানভাসিরা। নগর ও পাঁচটি উপজেলায় অন্তত চার থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন বলে জানা গেছে।

রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল ও গঙ্গাচড়ার সুজন আহাম্মেদ জানান, তিস্তা নদীর পানি মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় এবং দুপুর ৩টায় তা বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মধ্যে চলে এসেছে।

তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫টি বাড়ি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজারসহ শত শত বাড়িঘর।

তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে প্রবল বেগে পানি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী ও দুর্গম চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ৩০টি গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সেখানে দুই থেকে আড়াই ফুট কোথাও কোথাও আরও বেশি পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, ভাঙনকবলিত কোলকন্দ ইউনিয়নের বিনবিনিয়া চর ও লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতির মুখে। তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে এসব এলাকার বাসিন্দারা সমস্যায় পড়েছেন।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ধরলা নদীর পানি লালমনিরহাট সদর উপজেলার শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি দুপুর পর্যন্ত লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমা ৫২ মিটার ৬০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলারে মোগলহাট, কুলাঘাট, বড়বাড়ী, আদিতমারী উপজেলার বড়বাড়ী, হাতীবান্ধার গড্ডিমারি, সানিয়াযান, সিন্দুনা, ডাউয়াবাড়ি, আদিতমারির মহিষখোচা ইউনিয়নের প্রায় ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের বসতভিটায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মোগলহাট ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রাম।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ধরলাপাড়ে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।