দিনাজপুরে এ বছর সব ধরনের লিচু বেশি দামে বিত্রিু হচ্ছে। পরপর তিন বছর রমজান মাস ও মহামারী করোনার প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লিচু চাষিরা। এ বছর একদিকে আবহাওয়াগত কারণে লিচুর ফলন হয়েছে কম অন্যদিকে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় চলতি মওসুমে গ্রাহক ও লিচুর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুন বেশি। চায়না থ্রি ও বেদানা জাতের লিচু প্রতিটি ২৫ হতে ২৬ এবং ১৫-১৬ টাকা দামে বিত্রিু হচ্ছে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দামে লিচু বিত্রিু করতে পেরে বাগানি ও লিচু চাষিরা আছেন মহা আনন্দে। জেলায় লিচু বিপণন চলতি মওসুমে ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০ থেকে ১২টি জাতের লিচু পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদে, গন্ধে, রসে, মিষ্টতায় দিনাজপুর সদর উপজেলার ‘বেদানা লিচু’ অতুলনীয়। জেলায় মোট সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ৫০০টি লিচুর বাগান আছে। দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় কমবেশি বেদানা জাতের লিচুর চাষ হলেও দিনাজপুর সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদারগঞ্জ, মহব্বতপুর, উলিপুর গ্রামে উৎকৃষ্ট মানের বেদানা লিচু পাওয়া যায়।
দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের লিচুর মধ্যে বোম্বাই, মাদ্রাজি, মোজাফ্ফরপুরি, চায়না-২, চায়না-৩, চায়না-৪, কাঁঠালি ইত্যাদির মধ্যে বেদানা লিচুর মিষ্টতা এবং শাঁশের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য জাতের লিচুর শাঁশের পরিমাণ যেখানে ১৯ শতাংশ সেখানে বেদানা জাতের লিচুর শাঁশের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ। আকারে গোলাকার, রঙ গোলাপি, খোসা পাতলা, বেশ রসালো এবং এর বীজ ছোট হয়। অন্য জাতের লিচু খোসা খুললে লিচুর রস মাটিতে বা শরীরে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু বেদানা লিচুর খোসা ছাড়ানোর পর রস মাটিতে বা শরীরে পড়ে না। লিচুর শাঁসের মাঝেই ভরাটভাবে জমাট বেঁধে থাকে। মাদ্রাজি লিচু মওসুম শুরুতেই বাজারে এবং বোম্বাই লিচু মওসুমের শেষের দিকে বাজারে আসে। তবে এই দুই জাতের লিচু ফলন তুলনামূলক ফলন বেশি হয়।
দিনাজপুরের সদর উপজেলার মাসিমপুর গ্রামের বাগান মালিক আনিছুর রহমান জানান, বাংলাদেশের সেরা বেদানা লিচু। দিনাজপুরের সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদার, মহব্বতপুর ও উলিপুর এই এলাকায় বেদানা লিচু ভাল ফলন হয়। মান ভালো। স্বাদে মিষ্টি, রসালো ও সুস্বাদু। এ বছর লিচুর ফলন কম, চাহিদা বেশি, আমরা লিচুর ভালো দাম পাচ্ছি।
কোতয়ালি থানার সামনের বাজারে লিচু বিক্রেতা আনোয়ার জানান, এবার বেদানা ও চায়না থ্রি জাত লিচুর চাহিদা বেশি কিন্তু বাজারে সরবরাহ কম। বাগানিরা এবার বেদানা লিচুর ভালো দাম পাচ্ছে। বাজারের বিভিন্ন সাইজের ১০০ বেদানা লিচু ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০০ শত টাকা দরে এবং চায়না থ্রি ২৫০০ হতে ২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিরল উপজেলার মাধবপুর গ্রামের বাগান মালিক মোখলেছুর রহমান জানান, তার বাগানে গত তিন মাসে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। লিচুর দাম বেশি পাওয়ায় এ বছর এক লাখ ৬০ হাজার হতে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভের টাকা ঘরে উঠে আসবে।
ক্রেতারা জানান, বেদানা ও চায়না থ্রি জাতের লিচুর ফলন এবার কম হওয়ার কারণে দাম নাগালের বাইরে। বাজারে এই দুই জাতের লিচু কম হওয়ার কারণে বিক্রেতারা লিচুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও এই লিচু সবচেয়ে সুস্বাদু হওয়ার কারণে কিনতে এসেছি।
দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক এজামুল হক জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা জাতের লিচুর চাষ হচ্ছে। এর সম্প্রসারণ কার্যক্রমও বেড়ে চলেছে। কিন্তু স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানের কারণে দিনাজপুরের সদর উপজেলার বেদানা লিচুর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। দেশের একাধিক ব্যাংক-বীমা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দিনাজপুরের বেদানা লিচু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে দিনাজপুরের বাগান মালিক ও লিচু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, বেদানা লিচু দিনাজপুরের অহংকার। মানুষ এই লিচু পছন্দ করে। দিনাজপুরে যে লিচুগুলো চাষ হয়ে থাকে এর মধ্যে গুণে ও মানে বেদানা লিচু শ্রেষ্ঠ। এর বীজ মান অনেক বেশি। জেলার সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদার অঞ্চলে এই লিচুর চাষ সবচেয়ে ভালো হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হর্টিকালচার সেন্টার এই লিচুর জাতটিকে আরও ছড়িয়ে দেয়ার এবং পরিচর্যায় কাজ করছে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক প্রদীপ কুমার গুহ জানান, আকর্ষণীয় গোলাপি রঙ। দারুণ মজা ও মিষ্টি। আকারেও বড়। চামড়া পাতলা এবং ভেতরে বীজটাও ছোট। খেতে অত্যন্ত রসালো সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। অনন্য এইসব বৈশিষ্টের কারণে দিনাজপুরের বেদানা লিচুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। বেদানা লিচুর আবাদ এলাকা খুবই সামান্য। দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ এলাকা শুধু মাত্র মাসিমপুরেই গুটি কয়েক বাগানে বেদানা লিচুর চাষ হয়। মাটির বৈশিষ্টতার কারণেই এ লিচুর স্বাদে গুণে পার্থক্য রয়েছে। তিনি জানান, নির্দিষ্ট এলাকার মাটির পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। মাটির উপাদান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেই বিশেষ করে দিনাজপুরে বেদানা লিচুর আবাদ এলাকা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, তার জানা মতে গত মওসুমে প্রায় ৪ শ’ কোটি টাকার লিচুর বিপণন হয়েছে। চলতি মওসুমে তা ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২ , ৩ আষাড় ১৪২৮ ১৭ জিলকদ ১৪৪৩
চিত্ত ঘোষ, দিনাজপুর
দিনাজপুরে এ বছর সব ধরনের লিচু বেশি দামে বিত্রিু হচ্ছে। পরপর তিন বছর রমজান মাস ও মহামারী করোনার প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লিচু চাষিরা। এ বছর একদিকে আবহাওয়াগত কারণে লিচুর ফলন হয়েছে কম অন্যদিকে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় চলতি মওসুমে গ্রাহক ও লিচুর চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুন বেশি। চায়না থ্রি ও বেদানা জাতের লিচু প্রতিটি ২৫ হতে ২৬ এবং ১৫-১৬ টাকা দামে বিত্রিু হচ্ছে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দামে লিচু বিত্রিু করতে পেরে বাগানি ও লিচু চাষিরা আছেন মহা আনন্দে। জেলায় লিচু বিপণন চলতি মওসুমে ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০ থেকে ১২টি জাতের লিচু পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদে, গন্ধে, রসে, মিষ্টতায় দিনাজপুর সদর উপজেলার ‘বেদানা লিচু’ অতুলনীয়। জেলায় মোট সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ৫০০টি লিচুর বাগান আছে। দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় কমবেশি বেদানা জাতের লিচুর চাষ হলেও দিনাজপুর সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদারগঞ্জ, মহব্বতপুর, উলিপুর গ্রামে উৎকৃষ্ট মানের বেদানা লিচু পাওয়া যায়।
দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের লিচুর মধ্যে বোম্বাই, মাদ্রাজি, মোজাফ্ফরপুরি, চায়না-২, চায়না-৩, চায়না-৪, কাঁঠালি ইত্যাদির মধ্যে বেদানা লিচুর মিষ্টতা এবং শাঁশের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য জাতের লিচুর শাঁশের পরিমাণ যেখানে ১৯ শতাংশ সেখানে বেদানা জাতের লিচুর শাঁশের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ। আকারে গোলাকার, রঙ গোলাপি, খোসা পাতলা, বেশ রসালো এবং এর বীজ ছোট হয়। অন্য জাতের লিচু খোসা খুললে লিচুর রস মাটিতে বা শরীরে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু বেদানা লিচুর খোসা ছাড়ানোর পর রস মাটিতে বা শরীরে পড়ে না। লিচুর শাঁসের মাঝেই ভরাটভাবে জমাট বেঁধে থাকে। মাদ্রাজি লিচু মওসুম শুরুতেই বাজারে এবং বোম্বাই লিচু মওসুমের শেষের দিকে বাজারে আসে। তবে এই দুই জাতের লিচু ফলন তুলনামূলক ফলন বেশি হয়।
দিনাজপুরের সদর উপজেলার মাসিমপুর গ্রামের বাগান মালিক আনিছুর রহমান জানান, বাংলাদেশের সেরা বেদানা লিচু। দিনাজপুরের সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদার, মহব্বতপুর ও উলিপুর এই এলাকায় বেদানা লিচু ভাল ফলন হয়। মান ভালো। স্বাদে মিষ্টি, রসালো ও সুস্বাদু। এ বছর লিচুর ফলন কম, চাহিদা বেশি, আমরা লিচুর ভালো দাম পাচ্ছি।
কোতয়ালি থানার সামনের বাজারে লিচু বিক্রেতা আনোয়ার জানান, এবার বেদানা ও চায়না থ্রি জাত লিচুর চাহিদা বেশি কিন্তু বাজারে সরবরাহ কম। বাগানিরা এবার বেদানা লিচুর ভালো দাম পাচ্ছে। বাজারের বিভিন্ন সাইজের ১০০ বেদানা লিচু ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০০ শত টাকা দরে এবং চায়না থ্রি ২৫০০ হতে ২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিরল উপজেলার মাধবপুর গ্রামের বাগান মালিক মোখলেছুর রহমান জানান, তার বাগানে গত তিন মাসে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। লিচুর দাম বেশি পাওয়ায় এ বছর এক লাখ ৬০ হাজার হতে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভের টাকা ঘরে উঠে আসবে।
ক্রেতারা জানান, বেদানা ও চায়না থ্রি জাতের লিচুর ফলন এবার কম হওয়ার কারণে দাম নাগালের বাইরে। বাজারে এই দুই জাতের লিচু কম হওয়ার কারণে বিক্রেতারা লিচুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারপরও এই লিচু সবচেয়ে সুস্বাদু হওয়ার কারণে কিনতে এসেছি।
দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক এজামুল হক জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা জাতের লিচুর চাষ হচ্ছে। এর সম্প্রসারণ কার্যক্রমও বেড়ে চলেছে। কিন্তু স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানের কারণে দিনাজপুরের সদর উপজেলার বেদানা লিচুর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। দেশের একাধিক ব্যাংক-বীমা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দিনাজপুরের বেদানা লিচু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে দিনাজপুরের বাগান মালিক ও লিচু ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, বেদানা লিচু দিনাজপুরের অহংকার। মানুষ এই লিচু পছন্দ করে। দিনাজপুরে যে লিচুগুলো চাষ হয়ে থাকে এর মধ্যে গুণে ও মানে বেদানা লিচু শ্রেষ্ঠ। এর বীজ মান অনেক বেশি। জেলার সদর উপজেলার মাশিমপুর, শিকদার অঞ্চলে এই লিচুর চাষ সবচেয়ে ভালো হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হর্টিকালচার সেন্টার এই লিচুর জাতটিকে আরও ছড়িয়ে দেয়ার এবং পরিচর্যায় কাজ করছে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক প্রদীপ কুমার গুহ জানান, আকর্ষণীয় গোলাপি রঙ। দারুণ মজা ও মিষ্টি। আকারেও বড়। চামড়া পাতলা এবং ভেতরে বীজটাও ছোট। খেতে অত্যন্ত রসালো সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। অনন্য এইসব বৈশিষ্টের কারণে দিনাজপুরের বেদানা লিচুর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। বেদানা লিচুর আবাদ এলাকা খুবই সামান্য। দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ এলাকা শুধু মাত্র মাসিমপুরেই গুটি কয়েক বাগানে বেদানা লিচুর চাষ হয়। মাটির বৈশিষ্টতার কারণেই এ লিচুর স্বাদে গুণে পার্থক্য রয়েছে। তিনি জানান, নির্দিষ্ট এলাকার মাটির পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। মাটির উপাদান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেই বিশেষ করে দিনাজপুরে বেদানা লিচুর আবাদ এলাকা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, তার জানা মতে গত মওসুমে প্রায় ৪ শ’ কোটি টাকার লিচুর বিপণন হয়েছে। চলতি মওসুমে তা ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।