খুনিদের বাঁচাতে আইন হয় কিন্তু আইনজীবীদের সুরক্ষায় আইন নেই

সিরাজ প্রামাণিক

জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক, বিচারপতি, সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি খুনি, দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে আমাদের দেশে নতুন নতুন আইন তৈরি হলেও আইনজীবীদের সুরক্ষায় অদ্যবধি কোন আইন তৈরি হয়নি। কাজেই নিজে নিরাপদ না হয়ে অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবা হাস্যকরও বটে!

সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের বিরোধ নিয়ে মামলা, হামলা ও রিমান্ড নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফেসবুক, আদালতপাড়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের টক শো থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত চলছে এ আলোচনা। চলাটাই স্বাভাবিক।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশের ভূমিকা যেমন বলে শেষ করা যাবে না; ঠিক তেমনি আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা, বিচার পদ্ধতি ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে আইনজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। আইনজীবীদের অনুপস্থিত বিচারবিভাগ মৃত সন্তানের ন্যায়। বিচারক ও আইনজীবী বিচার ব্যবস্থায় একে অপরের পরিপূরক। বিচারকদের জন্য রয়েছে সুরক্ষা আইন। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। অথচ বিচারিক ও সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইনজীবীর হাতে পড়ছে হাতকড়া।

সম্প্রতি জুরাইনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বিরোধে দুই আইনজীবীকে রিমান্ড, এর আগে মো. ইব্রাহীম খলিলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখে তাকে অমানবিক নির্যাতন, তারও আগে আগে টিসিবির পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বরিশাল জজ কোর্টের আইনজীবী রবিউল ইসলাম রিপনকে সাজা দিয়েছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমূল হুদা। সাজা দেওয়ার সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেটের দম্ভোক্তি ছিল ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’।

তবে হাইকোর্টের আইনজীবী ইব্রাহিম খলিলের ওপর ২০২১ সালে ন্যক্কারজনক ঘটনায় সাবেক আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সে সময়ের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুুল মতিন খসরু এমপি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্টের বাউন্ডারিতে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হোক, আর যেই হোক কেউ যদি অপরাধ করে থাকে আমাদের আইনজীবী সমিতি আছে তাদের জানাতে পারতো। প্রধান বিচারপতিকে জানাতে পারত। সে তো চোর ডাকাত না, সে তো ভেগে যাচ্ছে না, বাড়ি থেকেও তাকে গ্রেপ্তার করা যেত। তাকে কোর্ট আঙিনা থেকে গ্রেপ্তার করা সমীচীন নয়, এটা বেআইনি, এটা ধৃষ্টতা, এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

বাংলাদেশে বলবৎ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৯৭ ধারায় জজ, ম্যাজিস্ট্রেট তথা সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ করলে মামলা করার জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ পত্র দাখিলের আগে সরকারের বা নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

অথচ আইনজীবীদের গ্রেপ্তারে কোন সুরক্ষা আইন নেই। আইনজীবীদের গ্রেফতারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুমতি এখন সময়ের দাবী মাত্র। আইনজীবী ব্যতীত বিচার বিভাগ ও ন্যায়বিচার যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরু দায়িতও বটে।

আইন করে বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তির একটি অপসংস্কৃতি অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে চলছে। এই অপসংস্কৃতির শুরু মুক্তিযুদ্ধের রাজাকার-আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাদের বিচার না করার মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সব ধরনের সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩’ নামে সর্বশেষে ইনডেমিনিটি আইন পাস হয়। বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না।

বলে রাখি এ সবকিছুর আগে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের সকল বেআইনি এবং অসাংবিধানিক কাজের দায়মুক্তি প্রদান অধ্যাদেশও জারি করা হয়। এবার আসি দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি রাহুর মতো চেপে আছে। এখানেও ২০১০ সালে একটি দায়মুক্তি আইন তৈরি হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সব প্রকল্প দরপত্র ছাড়া, বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোন নাগরিক আদালতের দারস্থ হতে পারবে না। এই দায়মুক্তি আইনের জোরেই কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া একের পর এক অসম্ভব ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।

আরেকটি দায়মুক্তি আইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালে। এই আইন অনুযায়ী এই প্রকল্পে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়, তার দায় কোম্পানি বা কোনো কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, জনস্বার্থ নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দায়মুক্তি আইনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সব তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের দায়মুক্তি আইন প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টাকা পাচারের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যই করা হয়েছে। খেতা বালিশ কিনতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে-পত্রিকার পাতার মাধ্যমে সে কেলেঙ্করি প্রকাশিত হয়েছে।

এরপর রয়েছে আমানত সুরক্ষা আইন। ব্যাংকে যত টাকা জমা রাখেন না কেন, ক্ষতিপূরণ পাবেন সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা! বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘আমানত সুরক্ষা আইন’র প্রস্তাবনায় এ কথা লেখা আছে। একজন গ্রাহক হয়ত ব্যাংকে রেখেছেন পাঁচ লাখ টাকা, আরেকজন হয়ত রেখেছেন পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে উভয়ের অবস্থান সমান, পাবেন এক লাখ টাকা করে।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আইনজীবীর ওপর আক্রমণ, অত্যাচার নির্যাতন বেড়েই চলছে। যেহেতু আদালতে বিচারপ্রার্থী বিবাদমান পক্ষদের নিয়ে আইনজীবীদের কাজ করতে হয়, তাই সাধারণভাবে একটা ঝুঁকির বিষয় থেকেই যায়। ইদানীং দেখা যায়, মামলার প্রতিপক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে উকিলের ওপর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে। এই প্রতিশোধের মাত্রা হুমকি, অপহরণ, এমনকি হত্যাকা- পর্যন্ত গড়ায়। উকিলের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, উকিলের পরিবারের ওপরও তারা চড়াও হয়। আর এর মূল্য দিতে হয়, উকিলকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পাতা আছে কি না, যাতে লিখা “খুনিদের বিচার করা যাবে না”! সেটাও আমাদের দেশেই সম্ভব। কাজেই বিজ্ঞ আইনজীবী দের উদ্দেশ্যে বলছি, আগে নিজেদের নিরাপদ করুন, তারপর অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবুন। নতুবা এর খেসারত আইনজীবী সমাজকে দিতেই হবে।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]

শনিবার, ১৮ জুন ২০২২ , ৪ আষাড় ১৪২৮ ১৮ জিলকদ ১৪৪৩

খুনিদের বাঁচাতে আইন হয় কিন্তু আইনজীবীদের সুরক্ষায় আইন নেই

সিরাজ প্রামাণিক

জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক, বিচারপতি, সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি খুনি, দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে আমাদের দেশে নতুন নতুন আইন তৈরি হলেও আইনজীবীদের সুরক্ষায় অদ্যবধি কোন আইন তৈরি হয়নি। কাজেই নিজে নিরাপদ না হয়ে অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবা হাস্যকরও বটে!

সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের বিরোধ নিয়ে মামলা, হামলা ও রিমান্ড নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফেসবুক, আদালতপাড়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের টক শো থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত চলছে এ আলোচনা। চলাটাই স্বাভাবিক।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশের ভূমিকা যেমন বলে শেষ করা যাবে না; ঠিক তেমনি আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা, বিচার পদ্ধতি ও আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে আইনজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। আইনজীবীদের অনুপস্থিত বিচারবিভাগ মৃত সন্তানের ন্যায়। বিচারক ও আইনজীবী বিচার ব্যবস্থায় একে অপরের পরিপূরক। বিচারকদের জন্য রয়েছে সুরক্ষা আইন। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। অথচ বিচারিক ও সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইনজীবীর হাতে পড়ছে হাতকড়া।

সম্প্রতি জুরাইনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বিরোধে দুই আইনজীবীকে রিমান্ড, এর আগে মো. ইব্রাহীম খলিলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখে তাকে অমানবিক নির্যাতন, তারও আগে আগে টিসিবির পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বরিশাল জজ কোর্টের আইনজীবী রবিউল ইসলাম রিপনকে সাজা দিয়েছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমূল হুদা। সাজা দেওয়ার সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেটের দম্ভোক্তি ছিল ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’।

তবে হাইকোর্টের আইনজীবী ইব্রাহিম খলিলের ওপর ২০২১ সালে ন্যক্কারজনক ঘটনায় সাবেক আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সে সময়ের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুুল মতিন খসরু এমপি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্টের বাউন্ডারিতে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হোক, আর যেই হোক কেউ যদি অপরাধ করে থাকে আমাদের আইনজীবী সমিতি আছে তাদের জানাতে পারতো। প্রধান বিচারপতিকে জানাতে পারত। সে তো চোর ডাকাত না, সে তো ভেগে যাচ্ছে না, বাড়ি থেকেও তাকে গ্রেপ্তার করা যেত। তাকে কোর্ট আঙিনা থেকে গ্রেপ্তার করা সমীচীন নয়, এটা বেআইনি, এটা ধৃষ্টতা, এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

বাংলাদেশে বলবৎ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৯৭ ধারায় জজ, ম্যাজিস্ট্রেট তথা সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্ব পালনের সময় অপরাধ করলে মামলা করার জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ পত্র দাখিলের আগে সরকারের বা নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন সরকারি চাকরিজীবীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

অথচ আইনজীবীদের গ্রেপ্তারে কোন সুরক্ষা আইন নেই। আইনজীবীদের গ্রেফতারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুমতি এখন সময়ের দাবী মাত্র। আইনজীবী ব্যতীত বিচার বিভাগ ও ন্যায়বিচার যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরু দায়িতও বটে।

আইন করে বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তির একটি অপসংস্কৃতি অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে চলছে। এই অপসংস্কৃতির শুরু মুক্তিযুদ্ধের রাজাকার-আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাদের বিচার না করার মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সব ধরনের সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩’ নামে সর্বশেষে ইনডেমিনিটি আইন পাস হয়। বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না।

বলে রাখি এ সবকিছুর আগে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের সকল বেআইনি এবং অসাংবিধানিক কাজের দায়মুক্তি প্রদান অধ্যাদেশও জারি করা হয়। এবার আসি দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি রাহুর মতো চেপে আছে। এখানেও ২০১০ সালে একটি দায়মুক্তি আইন তৈরি হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সব প্রকল্প দরপত্র ছাড়া, বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোন নাগরিক আদালতের দারস্থ হতে পারবে না। এই দায়মুক্তি আইনের জোরেই কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া একের পর এক অসম্ভব ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।

আরেকটি দায়মুক্তি আইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালে। এই আইন অনুযায়ী এই প্রকল্পে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়, তার দায় কোম্পানি বা কোনো কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, জনস্বার্থ নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দায়মুক্তি আইনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সব তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের দায়মুক্তি আইন প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টাকা পাচারের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যই করা হয়েছে। খেতা বালিশ কিনতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে-পত্রিকার পাতার মাধ্যমে সে কেলেঙ্করি প্রকাশিত হয়েছে।

এরপর রয়েছে আমানত সুরক্ষা আইন। ব্যাংকে যত টাকা জমা রাখেন না কেন, ক্ষতিপূরণ পাবেন সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা! বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘আমানত সুরক্ষা আইন’র প্রস্তাবনায় এ কথা লেখা আছে। একজন গ্রাহক হয়ত ব্যাংকে রেখেছেন পাঁচ লাখ টাকা, আরেকজন হয়ত রেখেছেন পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে উভয়ের অবস্থান সমান, পাবেন এক লাখ টাকা করে।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আইনজীবীর ওপর আক্রমণ, অত্যাচার নির্যাতন বেড়েই চলছে। যেহেতু আদালতে বিচারপ্রার্থী বিবাদমান পক্ষদের নিয়ে আইনজীবীদের কাজ করতে হয়, তাই সাধারণভাবে একটা ঝুঁকির বিষয় থেকেই যায়। ইদানীং দেখা যায়, মামলার প্রতিপক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে উকিলের ওপর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে। এই প্রতিশোধের মাত্রা হুমকি, অপহরণ, এমনকি হত্যাকা- পর্যন্ত গড়ায়। উকিলের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, উকিলের পরিবারের ওপরও তারা চড়াও হয়। আর এর মূল্য দিতে হয়, উকিলকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পাতা আছে কি না, যাতে লিখা “খুনিদের বিচার করা যাবে না”! সেটাও আমাদের দেশেই সম্ভব। কাজেই বিজ্ঞ আইনজীবী দের উদ্দেশ্যে বলছি, আগে নিজেদের নিরাপদ করুন, তারপর অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবুন। নতুবা এর খেসারত আইনজীবী সমাজকে দিতেই হবে।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]