অগ্নিকাণ্ডে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও করণীয়

নাজমুল হুদা খান

আগুন যেমন মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, তেমনি প্রায়শ: হয়ে ওঠে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের উপাদান। প্রাচীন যুগ থেকে আগুনের ধ্বংসলীলা মানুষের সম্পদ ধ্বংস ও জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে। ৬৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে রোম শহরের লোমহর্ষক অগ্নিকাণ্ড আজও পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে। সে অগ্নিকাণ্ডে রোমের দুই-তৃতীয়াংশ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ১৬১০ সালে; সে ঘটনায় তৎকালীন ঢাকা শহরের অর্ধেক পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে প্রান হারিয়েছে অর্ধশত মানুষ, আহত ৫ শতাধিক। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য মতে ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ২ লক্ষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ এবং গত পাঁচ বছরেই সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হিসেবে তাদের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় শতকরা ৪০ ভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারনে, চুলোর আগুন থেকে ১৮ শতাংশ এবং সিগারেটের আগুন থেকে ঘটেছে ১৫ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড। এছাড়া গ্যাস ও বয়লার বিস্ফোরণ, ওয়েল্ডিং মেশিনের যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, সিলিন্ডারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের অরক্ষিত গুদামজাতকরণ, অপরিকল্পিত ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বন্ধ না করা, মোমবাতি, দেয়াশলাইয়ের অনিরাপদ ব্যবহার কিংবা ব্যবহারের পর গ্যাসের চুলা বন্ধ না করা ইত্যাদিও অগ্নিকাণ্ড সূত্রপাতের অন্যতম কারণ।

এসব অগ্নিকাণ্ডে বিষাক্ত কেমিক্যালসমূহ মানুষের দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক; বিশেষ করে, আশেপাশে বসবাসকারী মানুষদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীকর। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো বিস্ফোরক থাকার কথা বলা হচ্ছে। এ কেমিক্যাল অগ্নিকাণ্ডের সময় সংস্পর্শে আসা মানুষের দেহের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে । অগ্নিকাণ্ডের পর আশেপাশের বাতাস, পানি ও মাটিকে দূষিত করে তুলবে। এতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়বে আশেপাশে বসবাসকারী মানুষ।

এছাড়া এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সময় বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মন-অক্সাইড, ফরমালডিহাইড, এক্রোলিন, পলি এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন ও বেনজিনের উপস্থিতি বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বায়ুদূষণে তিন ধরনের দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকে। যথা : ভারী কণা (২.৫-১০ মাইক্রোমিটার), মাঝারি (০.১-২.৫ মাইক্রোমিটার) এবং সূক্ষ্ম (<০.১ মাইক্রোমিটার)। ভারী কণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে না সত্যি, কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে প্রদাহ, গলাব্যথা, কাশি, সাইনোসাইটিস প্রভৃতি উপসর্গ ও রোগের সৃষ্টি করে। মাঝারী কণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করতে সক্ষম। ফুসফুসের টিস্যু ও কোষসমূহে ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করে। সূক্ষ্ম কণাসমূহ ফুসফুসের মাধ্যমে সহজেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ফুসফুস ও রক্তের বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে যথা : হাঁপানি, সিওপিডি, সিসটিক ফাইব্রোসিস ও নানাবিধ হার্টের রোগ ইত্যাদি।

দেশের শপিংমল, কেমিক্যালের গুদাম, গার্মেন্টস, বস্তি এলাকা, মার্কেট, সুউচ্চ ভবনে যেমন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে; তেমনি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতেই আগুনের ঝুঁকি বেড়েছে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত হাসপাতালে এ ঝুঁকি জনস্বাস্থ্য সেবার জন্য আশংকার কারণ। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালগুলোতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের হিসেব মতে গত ২০২০ সালে হাসপাতালের ছোট বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় শতাধিক। ২০১৯ সালে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে সাত শতাধিক। হাসপাতালগুলোর এ অবস্থা নতুন নয়। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরে ৪৪২ হাসপাতালের মধ্যে ৪২২টিই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ঝুঁকিতে আছে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং খুবই ঝুঁকিপুর্নের তালিকায় রয়েছে ৪০ শতাংশ। হাসপাতালগুলোর অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকার কারণ হিসেবে যথাযথ বৈদ্যুতিক লোড ছাড়াই ইলেক্ট্রনিক ও ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, অত্যাধুনিক এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও এক্সরে মেশিন ব্যবহার অন্যতম । অরক্ষিত ও মান নিয়ন্ত্রণহীন অক্সিজেন লাইন ও অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং হাসপাতালের কিচেনে অধিক পুরোনো গ্যাস লাইন দায়ী বলে মত প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। এসব হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের অপর্যাপ্ততা, মান নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির অন্যতম কারণ বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর মনে করে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত হাসপাতালসহ সকল প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর অগ্নিকাণ্ড থেকে নিরাপদ করতে আগুনের উৎস নিয়ন্ত্রণ যথাঃ প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের বৈদ্যুতিকসামগ্রী ব্যবহার, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার রুটিন চেকআপ, বৈদ্যুতিক চুলা ও সরঞ্জাম ব্যবহার শেষে সঠিকভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে দেয়াশলাই ও লাইটারের ব্যবহার এবং ধূমপানে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগুন নেভানোর সকল যন্ত্রপাতির যথাযথ মজুদ ও কার্যক্ষম রাখতে হবে। হাসপাতাল এবং প্রতিষ্ঠানের সবাইকে অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে ধারণা ও মহড়া অনুশীলন এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কার কি দায়িত্ব এবং কি পদক্ষেপ নিতে হবে তার ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অগ্নিকাণ্ড রোধে বিল্ডিং কোড ও নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালস বা বিস্ফোরক দ্রব্য গুদামজাতকরণ ও বিপণন রোধে আইন মেনে চলা, অগ্নিনির্বাপণে সচেতন ভূমিকা পালন এবং আগুন নেভানোতে সক্রিয় সহযোগিতা করতে হবে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও মানুষের সমাবেশ ঘটে এমন স্থান যথাঃ কমিউনিটি সেন্টার এবং অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পর্যাপ্তসংখ্যক রাখা নিশ্চিত করতে হবে।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রশিক্ষন ও অগ্নিনির্বাপর্ণে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা জীবন বাজি

রেখে বীরত্বসূচক ভূমিকা রাখছে। সশস্ত্রবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পাশে দাঁড়াচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সবকিছু ভুলে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে আগুন দুর্ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বার্ন ইউনিট। শুরু থেকে এ প্রতিষ্ঠানের বার্ন, প্লাস্টিক ও একাডেমিক এ তিনটি ইউনিট দেশের অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ৫০০ শয্যার এ হাসপাতাল দগ্ধ রোগীদের নিবিড় সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখানে ২২টি আইসিইউ, ২২টি এইচডিইউ এবং ১২টি অপারেশন থিয়েটার ও অত্যাধুনিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রোগীদের সেবা প্রদান করে আসছে। উপরন্তু আগুনে দগ্ধ রোগীদের প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক ও রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি সেবা প্রদান করছে এ প্রতিথযশা ইনস্টিটিউট। এ ছাড়া দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে এসব রোগীর সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা পর্যায়েও সীমিত পরিসরে এ সেবা পরিচালিত হচ্ছে । সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা আগুন নেভানোর কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিভিন্ন পর্যায়ে বৈদ্যুতিক অব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ সরঞ্জাম, অগ্নিকাণ্ডের কারন জেনেও আগুনের বিভিন্ন উৎসের ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের অরক্ষিত ও অবৈধ গুদামজাত করন ইত্যাদি কারণে অগ্নিকাণ্ডও বেড়ে চলছে। প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ; পঙ্গুত্ববরণ, বিকৃত অবয়ব ও মানসিক বৈকল্য নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে হাজারো জনকে। অগ্নিকাণ্ডের প্রভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বায়ু, পানি ও মাটিসহ পরিবেশ দূষণে জনস্বাস্থ্য হয়ে উঠছে বিপন্ন। একটু সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসলীলা সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলেও সিংহভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

শনিবার, ১৮ জুন ২০২২ , ৪ আষাড় ১৪২৮ ১৮ জিলকদ ১৪৪৩

অগ্নিকাণ্ডে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও করণীয়

নাজমুল হুদা খান

আগুন যেমন মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, তেমনি প্রায়শ: হয়ে ওঠে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের উপাদান। প্রাচীন যুগ থেকে আগুনের ধ্বংসলীলা মানুষের সম্পদ ধ্বংস ও জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে। ৬৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে রোম শহরের লোমহর্ষক অগ্নিকাণ্ড আজও পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে। সে অগ্নিকাণ্ডে রোমের দুই-তৃতীয়াংশ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ১৬১০ সালে; সে ঘটনায় তৎকালীন ঢাকা শহরের অর্ধেক পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে প্রান হারিয়েছে অর্ধশত মানুষ, আহত ৫ শতাধিক। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য মতে ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ২ লক্ষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ এবং গত পাঁচ বছরেই সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হিসেবে তাদের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় শতকরা ৪০ ভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারনে, চুলোর আগুন থেকে ১৮ শতাংশ এবং সিগারেটের আগুন থেকে ঘটেছে ১৫ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড। এছাড়া গ্যাস ও বয়লার বিস্ফোরণ, ওয়েল্ডিং মেশিনের যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, সিলিন্ডারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের অরক্ষিত গুদামজাতকরণ, অপরিকল্পিত ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বন্ধ না করা, মোমবাতি, দেয়াশলাইয়ের অনিরাপদ ব্যবহার কিংবা ব্যবহারের পর গ্যাসের চুলা বন্ধ না করা ইত্যাদিও অগ্নিকাণ্ড সূত্রপাতের অন্যতম কারণ।

এসব অগ্নিকাণ্ডে বিষাক্ত কেমিক্যালসমূহ মানুষের দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক; বিশেষ করে, আশেপাশে বসবাসকারী মানুষদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীকর। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো বিস্ফোরক থাকার কথা বলা হচ্ছে। এ কেমিক্যাল অগ্নিকাণ্ডের সময় সংস্পর্শে আসা মানুষের দেহের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে । অগ্নিকাণ্ডের পর আশেপাশের বাতাস, পানি ও মাটিকে দূষিত করে তুলবে। এতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়বে আশেপাশে বসবাসকারী মানুষ।

এছাড়া এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সময় বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মন-অক্সাইড, ফরমালডিহাইড, এক্রোলিন, পলি এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন ও বেনজিনের উপস্থিতি বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বায়ুদূষণে তিন ধরনের দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকে। যথা : ভারী কণা (২.৫-১০ মাইক্রোমিটার), মাঝারি (০.১-২.৫ মাইক্রোমিটার) এবং সূক্ষ্ম (<০.১ মাইক্রোমিটার)। ভারী কণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে না সত্যি, কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে প্রদাহ, গলাব্যথা, কাশি, সাইনোসাইটিস প্রভৃতি উপসর্গ ও রোগের সৃষ্টি করে। মাঝারী কণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করতে সক্ষম। ফুসফুসের টিস্যু ও কোষসমূহে ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করে। সূক্ষ্ম কণাসমূহ ফুসফুসের মাধ্যমে সহজেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ফুসফুস ও রক্তের বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে যথা : হাঁপানি, সিওপিডি, সিসটিক ফাইব্রোসিস ও নানাবিধ হার্টের রোগ ইত্যাদি।

দেশের শপিংমল, কেমিক্যালের গুদাম, গার্মেন্টস, বস্তি এলাকা, মার্কেট, সুউচ্চ ভবনে যেমন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে; তেমনি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতেই আগুনের ঝুঁকি বেড়েছে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত হাসপাতালে এ ঝুঁকি জনস্বাস্থ্য সেবার জন্য আশংকার কারণ। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালগুলোতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের হিসেব মতে গত ২০২০ সালে হাসপাতালের ছোট বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় শতাধিক। ২০১৯ সালে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে সাত শতাধিক। হাসপাতালগুলোর এ অবস্থা নতুন নয়। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরে ৪৪২ হাসপাতালের মধ্যে ৪২২টিই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ঝুঁকিতে আছে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং খুবই ঝুঁকিপুর্নের তালিকায় রয়েছে ৪০ শতাংশ। হাসপাতালগুলোর অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকার কারণ হিসেবে যথাযথ বৈদ্যুতিক লোড ছাড়াই ইলেক্ট্রনিক ও ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, অত্যাধুনিক এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও এক্সরে মেশিন ব্যবহার অন্যতম । অরক্ষিত ও মান নিয়ন্ত্রণহীন অক্সিজেন লাইন ও অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং হাসপাতালের কিচেনে অধিক পুরোনো গ্যাস লাইন দায়ী বলে মত প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। এসব হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের অপর্যাপ্ততা, মান নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির অন্যতম কারণ বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর মনে করে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত হাসপাতালসহ সকল প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর অগ্নিকাণ্ড থেকে নিরাপদ করতে আগুনের উৎস নিয়ন্ত্রণ যথাঃ প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের বৈদ্যুতিকসামগ্রী ব্যবহার, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার রুটিন চেকআপ, বৈদ্যুতিক চুলা ও সরঞ্জাম ব্যবহার শেষে সঠিকভাবে বন্ধ করে রাখতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে দেয়াশলাই ও লাইটারের ব্যবহার এবং ধূমপানে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগুন নেভানোর সকল যন্ত্রপাতির যথাযথ মজুদ ও কার্যক্ষম রাখতে হবে। হাসপাতাল এবং প্রতিষ্ঠানের সবাইকে অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে ধারণা ও মহড়া অনুশীলন এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কার কি দায়িত্ব এবং কি পদক্ষেপ নিতে হবে তার ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অগ্নিকাণ্ড রোধে বিল্ডিং কোড ও নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালস বা বিস্ফোরক দ্রব্য গুদামজাতকরণ ও বিপণন রোধে আইন মেনে চলা, অগ্নিনির্বাপণে সচেতন ভূমিকা পালন এবং আগুন নেভানোতে সক্রিয় সহযোগিতা করতে হবে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও মানুষের সমাবেশ ঘটে এমন স্থান যথাঃ কমিউনিটি সেন্টার এবং অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পর্যাপ্তসংখ্যক রাখা নিশ্চিত করতে হবে।

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রশিক্ষন ও অগ্নিনির্বাপর্ণে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা জীবন বাজি

রেখে বীরত্বসূচক ভূমিকা রাখছে। সশস্ত্রবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পাশে দাঁড়াচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সবকিছু ভুলে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে আগুন দুর্ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বার্ন ইউনিট। শুরু থেকে এ প্রতিষ্ঠানের বার্ন, প্লাস্টিক ও একাডেমিক এ তিনটি ইউনিট দেশের অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ৫০০ শয্যার এ হাসপাতাল দগ্ধ রোগীদের নিবিড় সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখানে ২২টি আইসিইউ, ২২টি এইচডিইউ এবং ১২টি অপারেশন থিয়েটার ও অত্যাধুনিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রোগীদের সেবা প্রদান করে আসছে। উপরন্তু আগুনে দগ্ধ রোগীদের প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক ও রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি সেবা প্রদান করছে এ প্রতিথযশা ইনস্টিটিউট। এ ছাড়া দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে এসব রোগীর সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা পর্যায়েও সীমিত পরিসরে এ সেবা পরিচালিত হচ্ছে । সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা আগুন নেভানোর কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিভিন্ন পর্যায়ে বৈদ্যুতিক অব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ সরঞ্জাম, অগ্নিকাণ্ডের কারন জেনেও আগুনের বিভিন্ন উৎসের ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের অরক্ষিত ও অবৈধ গুদামজাত করন ইত্যাদি কারণে অগ্নিকাণ্ডও বেড়ে চলছে। প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ; পঙ্গুত্ববরণ, বিকৃত অবয়ব ও মানসিক বৈকল্য নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে হাজারো জনকে। অগ্নিকাণ্ডের প্রভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বায়ু, পানি ও মাটিসহ পরিবেশ দূষণে জনস্বাস্থ্য হয়ে উঠছে বিপন্ন। একটু সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসলীলা সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলেও সিংহভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]