স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা সিলেট ও সুনামগঞ্জে

অভাবনীয় দুর্যোগ, অপরিসীম দুর্ভোগ, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন

একদিন আগেও যে এলাকাগুলো মোটামুটি শুকনো ছিল; রাত পোহাতেই সেই এলাকাগুলোও ডৃবে গেল বন্যা ও অতি বৃষ্টির পানিতে। এক কথায় গোটা সিলেট ও সুনামগঞ্জ এখন বন্যাকবলিত। এমন কোন পাড়া-মহল্লা নেই যেখানে বন্যার ছোঁয়া লাগেনি। একদিকে বন্যার পানি, অন্যদিকে আটকা পড়া মানুষের আহাজারি, এ এক বিভীষিকাময় অবস্থায় রয়েছেন বানবাসী লোকজন। নারী-পুরুষ, শিশুরা ছুটছেন আশ্রয়ের খোঁজে। যারা কখনও ভাবেননি তাদের বাসাবাড়ির সামনে পানি আসতে পারে তারাও আক্রান্ত। নেই বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য।

সংকটে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেল ও মোমবাতির। বন্ধ রয়েছে বিমানবন্দর, বাস, ট্রেন। হাসপাতালে নিহতদের লাশ গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যাচ্ছে না পানির কারণে। বাতিল করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের ছুটি। এমন পরিস্থিতি থেকে কবে উত্তোরণ হতে পারে তার কোন সম্ভাবনা নেই কারো কাছে। এরই মধ্যে সাধারণ প্রশাসনকে সহায়তার জন্য আগেরদিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও গতকাল নৌবাহিনীর সদস্যদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত আছে ডুবুরি দলসহ দুটি হেলিকপ্টার। মানুষের এই অভাবনীয় দুর্যোগ ও অপরিসীম দুর্ভোগে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাত কাটানো হচ্ছে উৎকণ্ঠার মধ্যে। এ এক স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় রূপান্তরিত হয়েছে সিলেট।

পানির নিচে সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা

সিলেটের বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। উজান থেকে আসা ঢলে বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি তিন জেলার শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নি¤œাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। আর সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ উজানে আগামী দুই দিন অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিইউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই। বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় কৃষি কাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে।

এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেরাপুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকাগুলো এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। এবার বঙ্গোপসাগর বেশি উত্তপ্ত থাকায় মেঘ ও মৌসুমি বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিল। যে কারণে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। ফলে এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নদীগুলোকে দ্রুত খনন করে এর পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নয়তো প্রায় বছর আমাদের এ ধরনের বন্যার মুখে পড়তে হবে।’

অভাবনীয় দুর্যোগ, অপরিসীম দুর্ভোগ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল কাদির বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। ২৯ বছরেও এমনটি দেখিনি। কখনই কুমারগাঁও গ্রিড লাইনে পানি ওঠেনি। এবারের পানি ভয়ংকর। একই কথা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পারুয়া গ্রামের সাইদুল হকেরও। তিনি বলেন, ‘এইভাবে পানি আর কখনও হয়নি। পুরো উপজেলা তলিয়ে গেছে। কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নৌকার অভাবে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।’

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট। পানি বেড়েই চলছে। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট নগর ও জেলার সবকটি উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে।

জেলা প্রশাসনের হিসেবে জেলার এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। পানি ঢুকে পড়েছে সবগুলো উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। এ দুই উপজেলার প্রায় শতভাগ পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে দুই উপজেলা কমপ্লেক্সও।

বন্যার কারণে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার মানুষজন। পানিতে উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। নগরের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এ ছাড়া ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক এলাকায়।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার আজির উদ্দিন বলেন, ‘দক্ষিণ সুরমা সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমাদের এলাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটও নেই। একে তো পানিবন্দী অবস্থায় আছি; তার ওপর সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।’

ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের দাঁড়িয়াপাড়ায় আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছেন নগরের কাষ্টঘর এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস। তিনি বলেন, ‘এক মাসের ব্যবধানে দু’বার উদ্বাস্তু হলাম। গত মাসের বন্যায়ও ঘরে পানি ঢুকে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজকে আবার একই দশা।’

বিদ্যুতের অভাবে খাওয়ার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে নগরের বহু এলাকায়। নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত মাসের বন্যায় সাত দিন পানি ছিল না। গোসল করতে পারিনি। এবারও একই সমস্যায় পড়েছি।

নগরের চালিবন্দর এলাকার রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ছড়ারপাড়ের একটি কলোনির বাসিন্দা তেরাব বিবি। তিনি বলেন, ‘এখানে কোন খাবার নেই। রান্নার ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত কেউ কোন ত্রাণও দেয়নি। কেবল মুড়ি ছাড়া সকাল থেকে সন্তানদের কোন খাবার দিতে পারিনি। এ অবস্থায় আমরা এখানে থাকব কী করে?’

তিন দিন ধরে পরিবার নিয়ে পানিবন্দী গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর এলাকার সামুসুদ্দিন আহমদ। বাড়ির টিউবওয়েলও পানিতে ডুবে গেছে। তবু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না তিনি।

একই সমস্যার কথা জানালেন একই উপজেলার হরিপুরের বাসিন্দা চেরাগ মিয়া। বলেন, ‘পানিতে চুলা তলিয়ে গেছে। তাই রান্নাবান্না বন্ধ। ঘরে শুকনা খাবারও নেই। নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানিও পাচ্ছি না। আবার আশপাশে বুক থেকে গলাসমান পানি। ফলে ঘরের বাইরেও যেতে পারছি না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।

সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘অনেক এলাকায় বাহনের অভাবে পানিবন্দী লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করেছে।

‘আমাদের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন ফাঁকা নেই। বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। ফলে নগরের বাইরের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।’

এদিকে ক্যাম্পাসে পানি উঠে যাওয়ায় আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দুই যুগ পর এবার ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎও নেই। তাই ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

এ ছাড়া পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অনেক মানুষ পুরোপুরি ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে কুমারগাঁও সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এটি তলিয়ে যাওয়ায় পুরো সিলেট বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে।

বিদ্যুৎহীন পুরো সিলেট

সিলেট কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পানি উঠে যাওয়ায় আপাতত সাব স্টেশনটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি পানি সেচে দ্রততম সময়ের মধ্যে এটি আবার চালু করতে।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে আত্রাই সাব স্টেশনে পানি উঠতে শুরু করে। শুক্রবার দুপুর থেকে এই কেন্দ্র সচল রাখতে যৌথভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করেন তারা। তবে পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় বন্ধ করে দিতে হলো উপকেন্দ্রটি।

দুর্গতদের উদ্ধারে এবার নৌবাহিনী

সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দী লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী তৎপর রয়েছে। শুক্রবার বিকেল থেকে সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন, ৬টি মেডিকেল টিম ও গতকাল সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

উদ্ধারকাজে নৌবাহিনী সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিকেলে ৬০ জনের আরেকটি দল আরও ক্রুজ ও হেলিকপ্টারসহ উদ্ধার কাজে যুক্ত হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতে সিলেট এসে পৌঁছায়। পরে গতকাল সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের একটি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে।

ফায়ার সার্ভিসের ছুটি বাতিল

ভয়াবহ বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে রাখা হয়েছে।

শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় অফিসকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এর পর থেকে বন্যায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম আরও জোরদার হয়েছে।

জ্বালানি তেল ও মোমবাতি সংকট

গত রাতে সিলেট নগরের রিকাবিবাজার এলাকায় মোমবাতি কিনতে এসেছিলেন নগরের ভাতালিয়া এলাকার আবুল হাসেম। তিনি বেশ কয়েকটি মুদিদোকানে মোমবাতির খোঁজ করলেও না পেয়ে অবশেষে রিকাবিবাজারে এসেছেন বলে জানান।

মুদিদোকানের ব্যবসায়ী মো. জসিম আহমদ বলেন, এখন মোমবাতি ও দেয়াশলাইয়ের চাহিদা বেড়ে গেছে। অনেকে দুই থেকে তিন প্যাকেট করে মোমবাতি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে দাম বাড়েনি বলে জানান তিনি।

উপশহর এলাকার আবদুল জলিল বলেন, গোটা এলাকায় তাদের পানি। সোবহানীঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেও মোমবাতি পাইনি। অবশেষে হজরত শাহজালাল রহ. মাজারের পাশে এসে মোমবাতি পেয়েছি।

যমুনা টেলিভিশনের অফিস সহকারী রুবেল জানান, কালিঘাট এলাকায় পানি উঠে যাওয়ায় দোকানপাট বন্ধ। অনেক স্থানে তাদের অফিসের জেনারেটর চালুর জন্য জ্বালানি তেল খুঁজছিলেন। অনেক দোকান ঘুরে বন্দরবাজারের একটি দোকান থেকে পাঁচ লিটার তেল ক্রয় করেন। তাও কিছুটা বেশি দামে।

২২ জুন পর্যন্ত লন্ডনের ফ্লাইট বাতিল

সিলেট থেকে লন্ডনগামী সব ফ্লাইট বাতিল করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানবন্দরের রানওয়েতে বন্যার পানি চলে আসায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্লাইট বন্ধ থাকবে ২২ জুন পর্যন্ত। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ জানান, ফ্লাইটটি গতকাল সকাল ৮টায় ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। সেটি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে আবার রোববার (আজ) ও বুধবার (২২ জুন) বিমানের ঢাকা-সিলেট-লন্ডন ফ্লাইট রয়েছে। সেগুলোও বাতিল হয়েছে।

বেবিচক জানায়, বাতিল করা ফ্লাইটের তারিখ পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ (জিএম-পিআর) তাহেরা খন্দকার বলেন, পরের ফ্লাইটের বিষয়ে ২১ তারিখে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে শুক্রবার বিকেলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে বন্যার পানি চলে আসায় বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ

গতকাল বিকেলে সিলেট নগরীতে কিছুটা বৃষ্টি থামার পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে শুরু করেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। সকালে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। সব এলাকায় মূল সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে চালিবন্দর, মিরাবাজার, আগপাড়া, শাহী ঈদগাহ, টিবি গেট, কাজল শাহসহ ২০-৩০টি এলাকায় নতুন করে পানি প্রবেশে করেছে। সব মিলিয়ে শতাধিক মহল্লার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

এছাড়া নগরীর চারদিকে থই থই পানি। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত।

শিবগঞ্জের বাসিন্দা সৈয়দ জাকি বলেন, নিচতলার বাসা আমার। বাসায় কোমর সমান পানি। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি দক্ষিণ সুরমায়। সেখানে একটু থাকার বন্দোবস্ত করেছি সপরিবারে।

এদিকে সুনামগঞ্জে তলিয়ে গেছে সব উপজেলা। প্রায় ২৯ লাখ মানুষ এখন বন্যার দুর্ভোগে রয়েছে। জেলার সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের পর এখন ১১ উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎও নেই।

সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে নতুন করে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

ঘর তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার দুর্গত মানুষ স্থানীয় স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিচ্ছেন। তবে তারা ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন।

জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, আমার উপজেলা সদরসহ প্রতিটি গ্রামের বসতবাড়ি এখন পানির নিচে। মানুষ অসহায়। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। সড়ক ও টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে আমরা অসহায় মানুষদের সহায়তা দিতে পারছি না।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারি ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও প্রশাসন উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বন্যা মোকাবিলা করতে হবে।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। উপজেলা দুটির শহর থেকে শুরু করে সবগুলো গ্রামেই বন্যার পানি থই থই করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়ছে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ।

এছাড়া খালিয়াজুরি, সদর, আটপাড়া ও বারহাট্টা উপজেলা মিলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী। জেলার সঙ্গে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ছয়টি উপজেলায় সাড়ে ১৬ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘জেলার ছয়টি উপজেলায় ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ১৬ হাজার ৪৮০ জন মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। বন্যাকবলিত প্রতিটি উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলাসহ মেডিকেল টিম নিয়োজিত হয়েছে। জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবীসহ প্রশাসনের লোকজনসহ গোবাদিপশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় এরই মধ্যে দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ৬০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে ক্রমশ পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ডুবে যাচ্ছে। জেলার সঙ্গে কলমাকান্দার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পযন্ত কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি, পোগলা, সদর, নাজিরপুর ও বড়খাপন ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে সব গ্রামগুলোতেই পানি আর পানি। কলমাকান্দা শহরের সব এলাকায় পানি থই থই করছে। শুকনো ধান, চালসহ ঘরের আসবাপত্র ধরে সব কিছু পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বাসাবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিচ্ছেন। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কলমাকান্দ-ঠাকুরাকোনা নবনির্মিত সড়কের স্থানে স্থানে মানুষ তাবু টানিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। ওই সড়কটির হিরাকান্দা, আশারানী, পাবই, বাহাদুরকান্দাসহ বেশ কিছু স্থান নিচু থাকায় বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সড়কের কোথাও কোথাও কোমর পানি। এতে জেলার সঙ্গে সাড়া উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কলামাকান্দা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়সহ চানপুর, নদীপাড়, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, পূর্ববাজার, কলেজ রোডসহ প্রায় সব এলায় এখন হাঁটুপানি থেকে বুক পানি। বন্যার পানিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গোবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে।

কলমাকান্দার কৈলাটি ইউনিয়নের ঘনিচা গ্রামের ময়না মোড়ল জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর থেকে পানি বেড়ে এখন তার ঘরে কোমর পানি। তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুপুরে অন্যের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও পানি থাকায় সড়কের পাশে একটি বাজারে দোকান ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াদুল্লাহ বলেন, ‘কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টাসহ ছয়টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ছয় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এসব বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত জানান, ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার কংস, মোমেশ্বরী, ধনু, উব্দাখালিসহ কয়েকটি নদ নদীর পানি এখন বিপদসীমার উপরে আছে। শুক্রবার শুধু দুর্গাপুরেই ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। পানি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম বলেন, ‘কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উপজেলায় ৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আড়াই হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসন সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে।’

এদিকে বন্যায় রেললাইন ডুবে যাওয়ায় নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকাল আটটার পর থেকে এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে মোহনগঞ্জ স্টেশনে হাওড় এক্সপ্রেস ও বারহাট্টা স্টেশনে ২৬২ নম্বর লোকাল ডাউন ট্রেন আটকা পড়ে আছে বলে জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

বারহাট্টা স্টেশন মাস্টার গোলাম রব্বানী মোবাইল ফোনে জানান, শ্যামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ রেলপথে বন্যার পানিতে বারহাট্টা-মোহনগঞ্জের মাঝপথে ইসলামপুর এলাকায় একটি বক্স সেতু ভেঙে গেছে। এছাড়া কয়েকটি স্থানের রেললাইন বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তাই ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লোকাল ট্রেনটি বারহাট্টা থেকে ঘুরিয়ে ময়মনসিংহ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

নেত্রকোনায় বন্যার তোড়ে ব্রিজ ভেঙে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

নেত্রকোনা, প্রতিনিধি জানান, গেল এক দশকের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দা-দুর্গাপুরসহ হাওরাঞ্চলের মানুষ। গতকাল সকালে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বারহাট্টার অতীতপুর মোহনগঞ্জ সীমানায় ভেঙে গেছে রেলের কালভার্ট। এতে সকাল থেকেই বিচ্ছিন্ন রয়েছে ঢাকা-মোহনগঞ্জ রেল যোগাযোগ। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অতিরিক্ত পানির চাপে ব্রিজটির দুই সাইডে থাকা গাইড ওয়ালসহ মাটি সরে গেছে। এছাড়া গেল এক সপ্তাহের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী ও কলমাকান্দার উদাখালী নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ৩৯টি ইউনিয়নের অন্তত কয়েক শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।

ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদিপশু, বস্ত্র, সঞ্চিত খাদ্যসামগ্রী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ বানভাসি মানুষ। চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে সব। বানভাসি মানুষ বলছেন, গেল ১০-১৫ বছরে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি তারা।

দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদী পানি উপচে পৌর শহরের ছোট বাজার, তেরি বাজার, চর মোক্তারপাড়া, থানা, উপজেলা পরিষদ পানিতে তলিয়ে গেছে।

এছাড়া উপজেলার গাঁওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া, ক্ল্লুাগড়া ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামেই ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী মানুষদের সামনে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। কলমাকান্দার উপদাখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা সদরসহ প্রায় সবগুলো ইউনিয়ন পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্ধ রয়েছে জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। এছাড়া নেত্রকোনা সদর উপজেলার মগড়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এরই মধ্যে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল।

এদিকে হাওরাঞ্চলে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম। কোনরকমে গরু, ছাগল হাঁস, মুরগি নিয়ে উঁচু সড়ক ও বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। গত শুক্রবার সকাল থেকেই জেলার পানিবন্দী এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে পানিবন্দী এলাকাগুলোতে।

এ অবস্থায় সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে মানবেতর দিন পার করছেন বানভাসি মানুষ। সিলেট সুনামগঞ্জের পাশাপাশি এই কঠিন মুহূর্তে নেত্রকোনাকেও বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করে দ্রুত অসহায়দের সহযোগিতায় সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েনের দাবি করছেন স্থানীয়রা।

হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর প্রায় ৩৪টি বিদ্যালয়কে আশ্রয়ণ কেন্দ্র ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

বালিয়ামারী বর্ডার হাট ৩ ফুট পানির নিচে

প্রতিনিধি, রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) : উজানে ভারী বর্ষণ ও নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢলের পানিতে উপজেলার বালিয়ামারী বর্ডার হাটে পানি উঠে ৩ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে অনেক কাঁচা রাস্তা, ভেঙে গেছে অধিকাংশ রাস্তাঘাট। তলিয়ে গেছে পাট, তিল, শাকসবজি ও বীজতলা। ভোগান্তি বেড়েছে বানভাসী মানুষের। নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে দুই শতাধিক বাড়িঘর।

সরেজমিন ও জনপ্রতিনিধিদের তথ্যমতে, থেমে থেমে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চর রাজীবপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে আরও বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রাজীবপুর সদর ইউনিয়ের বালিয়ামারী, বালিয়ামারী ব্যাপারীপাড়া, পূর্ব ব্যাপারীপাড়া, জালচিড়াপাড়া, মিয়াপাড়া, বাউলপাড়া, করাতিপাড়া, মুন্সিপাড়া, টাঙ্গালিয়াপাড়া, ফাটকপাড়া এলাকার মানুষ গত এক সপ্তাহ যাবত পানিবন্দী জীবনযাপন করছে। বালিয়ামারী ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফরিজল হক জানান, তার বাড়ির সড়কটি পানিতে তলিয়ে গেছে। তার এলাকার অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবী। কাজকর্ম না থাকায় আয় রোজগার নেই। অনেকের অনাহারে অর্ধাহারে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

রাজীবপুর সদর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মিরন মো. ইলিয়াস জানান, বন্যার্তদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। বানভাসিদের পাশে বৃত্তবান সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন।

কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর ছক্কু জানান, তার এলাকার অর্ধেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া শংকর মাধবপুর ও উত্তর কোদালকাটি গ্রামে গত ৩ দিনে প্রায় ২ শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে।

মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম জানান, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় তার এলাকার নয়া চরের সঙ্গে ফকিরপাড়া ও চর নেওয়াজিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বড়বেরচর কীর্তনতারী, সন্যাসীকান্দি এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে।

চর রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আজিজার রহমান জানান, বন্যার্তদের জন্য ৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দ পেয়েছেন। যা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

চর রাজীবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি

জেলা বার্তা পরিবেশক, সিরাজগঞ্জ

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সকাল ৯টায় বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে কাজীপুর পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। যমুনা নদীর পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। এতে তিল, কাউন, বাদাম, পাট ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, জেলার কোথাও কোন ঝুঁকিপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। তবে নদী তীরবর্তী কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানান। তিনি আরও জানান ইতোমধ্যে ভাঙন এলাকায় ৪০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এছাড়া ভাঙন রোধে ৩০ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং ৯৬ হাজার জিও ব্যাগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাঁধসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ত্রিপুরার পাহাড়ি পানির ঢলে আখাউড়ার হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত ইউনিয়ন

প্রতিনিধি আখাউড়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত দুই দিনের ভারী বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়ি পানির ঢলে বাঁধটি ভেঙে যায়। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ।

সরেজমিন দেখা যায়, আখাউড়া-আগরতলা আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন, কাস্টম অফিস এবং আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন, মোগড়া ইউনিয়ন ও মনিয়ন্দ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে। এতে এখানকার ফসলি জমি, পুকুর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ বেশকিছু বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

হাওড়া নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের শফিক মিয়া জানান, শুক্রবারের ভারী বর্ষণে ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলে হাওরা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। তারপর থেকে আস্তে আস্তে নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। পানির নিচে তলিয়ে অনেকের বাড়ি-ঘর। ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকটি পরিবার।

আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অংগ্যজাই মারমা জানান, তিনি হাওড়া বাঁধ ভাঙন এলাকা ও প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, আকস্মিক এ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রসাশন ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছেন, তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তারা এটি দেখছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম হাওড়া নদীর বাঁধ ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, বন্যাপরবর্তী আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট রয়েছে। এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

রবিবার, ১৯ জুন ২০২২ , ৫ আষাড় ১৪২৮ ১৯ জিলকদ ১৪৪৩

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা সিলেট ও সুনামগঞ্জে

অভাবনীয় দুর্যোগ, অপরিসীম দুর্ভোগ, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

image

একদিন আগেও যে এলাকাগুলো মোটামুটি শুকনো ছিল; রাত পোহাতেই সেই এলাকাগুলোও ডৃবে গেল বন্যা ও অতি বৃষ্টির পানিতে। এক কথায় গোটা সিলেট ও সুনামগঞ্জ এখন বন্যাকবলিত। এমন কোন পাড়া-মহল্লা নেই যেখানে বন্যার ছোঁয়া লাগেনি। একদিকে বন্যার পানি, অন্যদিকে আটকা পড়া মানুষের আহাজারি, এ এক বিভীষিকাময় অবস্থায় রয়েছেন বানবাসী লোকজন। নারী-পুরুষ, শিশুরা ছুটছেন আশ্রয়ের খোঁজে। যারা কখনও ভাবেননি তাদের বাসাবাড়ির সামনে পানি আসতে পারে তারাও আক্রান্ত। নেই বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য।

সংকটে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেল ও মোমবাতির। বন্ধ রয়েছে বিমানবন্দর, বাস, ট্রেন। হাসপাতালে নিহতদের লাশ গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যাচ্ছে না পানির কারণে। বাতিল করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের ছুটি। এমন পরিস্থিতি থেকে কবে উত্তোরণ হতে পারে তার কোন সম্ভাবনা নেই কারো কাছে। এরই মধ্যে সাধারণ প্রশাসনকে সহায়তার জন্য আগেরদিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও গতকাল নৌবাহিনীর সদস্যদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত আছে ডুবুরি দলসহ দুটি হেলিকপ্টার। মানুষের এই অভাবনীয় দুর্যোগ ও অপরিসীম দুর্ভোগে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাত কাটানো হচ্ছে উৎকণ্ঠার মধ্যে। এ এক স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় রূপান্তরিত হয়েছে সিলেট।

পানির নিচে সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা

সিলেটের বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। উজান থেকে আসা ঢলে বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি তিন জেলার শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নি¤œাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। আর সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ উজানে আগামী দুই দিন অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিইউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই। বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় কৃষি কাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে।

এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেরাপুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকাগুলো এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। এবার বঙ্গোপসাগর বেশি উত্তপ্ত থাকায় মেঘ ও মৌসুমি বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিল। যে কারণে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। ফলে এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নদীগুলোকে দ্রুত খনন করে এর পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নয়তো প্রায় বছর আমাদের এ ধরনের বন্যার মুখে পড়তে হবে।’

অভাবনীয় দুর্যোগ, অপরিসীম দুর্ভোগ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল কাদির বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। ২৯ বছরেও এমনটি দেখিনি। কখনই কুমারগাঁও গ্রিড লাইনে পানি ওঠেনি। এবারের পানি ভয়ংকর। একই কথা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পারুয়া গ্রামের সাইদুল হকেরও। তিনি বলেন, ‘এইভাবে পানি আর কখনও হয়নি। পুরো উপজেলা তলিয়ে গেছে। কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নৌকার অভাবে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।’

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট। পানি বেড়েই চলছে। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট নগর ও জেলার সবকটি উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে।

জেলা প্রশাসনের হিসেবে জেলার এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। পানি ঢুকে পড়েছে সবগুলো উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। এ দুই উপজেলার প্রায় শতভাগ পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে দুই উপজেলা কমপ্লেক্সও।

বন্যার কারণে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার মানুষজন। পানিতে উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। নগরের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এ ছাড়া ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক এলাকায়।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার আজির উদ্দিন বলেন, ‘দক্ষিণ সুরমা সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমাদের এলাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটও নেই। একে তো পানিবন্দী অবস্থায় আছি; তার ওপর সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।’

ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের দাঁড়িয়াপাড়ায় আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছেন নগরের কাষ্টঘর এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস। তিনি বলেন, ‘এক মাসের ব্যবধানে দু’বার উদ্বাস্তু হলাম। গত মাসের বন্যায়ও ঘরে পানি ঢুকে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজকে আবার একই দশা।’

বিদ্যুতের অভাবে খাওয়ার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে নগরের বহু এলাকায়। নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত মাসের বন্যায় সাত দিন পানি ছিল না। গোসল করতে পারিনি। এবারও একই সমস্যায় পড়েছি।

নগরের চালিবন্দর এলাকার রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ছড়ারপাড়ের একটি কলোনির বাসিন্দা তেরাব বিবি। তিনি বলেন, ‘এখানে কোন খাবার নেই। রান্নার ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত কেউ কোন ত্রাণও দেয়নি। কেবল মুড়ি ছাড়া সকাল থেকে সন্তানদের কোন খাবার দিতে পারিনি। এ অবস্থায় আমরা এখানে থাকব কী করে?’

তিন দিন ধরে পরিবার নিয়ে পানিবন্দী গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর এলাকার সামুসুদ্দিন আহমদ। বাড়ির টিউবওয়েলও পানিতে ডুবে গেছে। তবু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না তিনি।

একই সমস্যার কথা জানালেন একই উপজেলার হরিপুরের বাসিন্দা চেরাগ মিয়া। বলেন, ‘পানিতে চুলা তলিয়ে গেছে। তাই রান্নাবান্না বন্ধ। ঘরে শুকনা খাবারও নেই। নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানিও পাচ্ছি না। আবার আশপাশে বুক থেকে গলাসমান পানি। ফলে ঘরের বাইরেও যেতে পারছি না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।

সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘অনেক এলাকায় বাহনের অভাবে পানিবন্দী লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করেছে।

‘আমাদের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন ফাঁকা নেই। বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। ফলে নগরের বাইরের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।’

এদিকে ক্যাম্পাসে পানি উঠে যাওয়ায় আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দুই যুগ পর এবার ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎও নেই। তাই ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

এ ছাড়া পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অনেক মানুষ পুরোপুরি ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে কুমারগাঁও সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এটি তলিয়ে যাওয়ায় পুরো সিলেট বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে।

বিদ্যুৎহীন পুরো সিলেট

সিলেট কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পানি উঠে যাওয়ায় আপাতত সাব স্টেশনটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি পানি সেচে দ্রততম সময়ের মধ্যে এটি আবার চালু করতে।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে আত্রাই সাব স্টেশনে পানি উঠতে শুরু করে। শুক্রবার দুপুর থেকে এই কেন্দ্র সচল রাখতে যৌথভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করেন তারা। তবে পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় বন্ধ করে দিতে হলো উপকেন্দ্রটি।

দুর্গতদের উদ্ধারে এবার নৌবাহিনী

সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দী লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী তৎপর রয়েছে। শুক্রবার বিকেল থেকে সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন, ৬টি মেডিকেল টিম ও গতকাল সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

উদ্ধারকাজে নৌবাহিনী সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিকেলে ৬০ জনের আরেকটি দল আরও ক্রুজ ও হেলিকপ্টারসহ উদ্ধার কাজে যুক্ত হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতে সিলেট এসে পৌঁছায়। পরে গতকাল সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের একটি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে।

ফায়ার সার্ভিসের ছুটি বাতিল

ভয়াবহ বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে রাখা হয়েছে।

শুক্রবার সকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় অফিসকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এর পর থেকে বন্যায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম আরও জোরদার হয়েছে।

জ্বালানি তেল ও মোমবাতি সংকট

গত রাতে সিলেট নগরের রিকাবিবাজার এলাকায় মোমবাতি কিনতে এসেছিলেন নগরের ভাতালিয়া এলাকার আবুল হাসেম। তিনি বেশ কয়েকটি মুদিদোকানে মোমবাতির খোঁজ করলেও না পেয়ে অবশেষে রিকাবিবাজারে এসেছেন বলে জানান।

মুদিদোকানের ব্যবসায়ী মো. জসিম আহমদ বলেন, এখন মোমবাতি ও দেয়াশলাইয়ের চাহিদা বেড়ে গেছে। অনেকে দুই থেকে তিন প্যাকেট করে মোমবাতি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে দাম বাড়েনি বলে জানান তিনি।

উপশহর এলাকার আবদুল জলিল বলেন, গোটা এলাকায় তাদের পানি। সোবহানীঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেও মোমবাতি পাইনি। অবশেষে হজরত শাহজালাল রহ. মাজারের পাশে এসে মোমবাতি পেয়েছি।

যমুনা টেলিভিশনের অফিস সহকারী রুবেল জানান, কালিঘাট এলাকায় পানি উঠে যাওয়ায় দোকানপাট বন্ধ। অনেক স্থানে তাদের অফিসের জেনারেটর চালুর জন্য জ্বালানি তেল খুঁজছিলেন। অনেক দোকান ঘুরে বন্দরবাজারের একটি দোকান থেকে পাঁচ লিটার তেল ক্রয় করেন। তাও কিছুটা বেশি দামে।

২২ জুন পর্যন্ত লন্ডনের ফ্লাইট বাতিল

সিলেট থেকে লন্ডনগামী সব ফ্লাইট বাতিল করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানবন্দরের রানওয়েতে বন্যার পানি চলে আসায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্লাইট বন্ধ থাকবে ২২ জুন পর্যন্ত। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ জানান, ফ্লাইটটি গতকাল সকাল ৮টায় ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। সেটি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে আবার রোববার (আজ) ও বুধবার (২২ জুন) বিমানের ঢাকা-সিলেট-লন্ডন ফ্লাইট রয়েছে। সেগুলোও বাতিল হয়েছে।

বেবিচক জানায়, বাতিল করা ফ্লাইটের তারিখ পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ (জিএম-পিআর) তাহেরা খন্দকার বলেন, পরের ফ্লাইটের বিষয়ে ২১ তারিখে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে শুক্রবার বিকেলে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে বন্যার পানি চলে আসায় বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ

গতকাল বিকেলে সিলেট নগরীতে কিছুটা বৃষ্টি থামার পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে শুরু করেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। সকালে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। সব এলাকায় মূল সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে চালিবন্দর, মিরাবাজার, আগপাড়া, শাহী ঈদগাহ, টিবি গেট, কাজল শাহসহ ২০-৩০টি এলাকায় নতুন করে পানি প্রবেশে করেছে। সব মিলিয়ে শতাধিক মহল্লার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

এছাড়া নগরীর চারদিকে থই থই পানি। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত।

শিবগঞ্জের বাসিন্দা সৈয়দ জাকি বলেন, নিচতলার বাসা আমার। বাসায় কোমর সমান পানি। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি দক্ষিণ সুরমায়। সেখানে একটু থাকার বন্দোবস্ত করেছি সপরিবারে।

এদিকে সুনামগঞ্জে তলিয়ে গেছে সব উপজেলা। প্রায় ২৯ লাখ মানুষ এখন বন্যার দুর্ভোগে রয়েছে। জেলার সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের পর এখন ১১ উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎও নেই।

সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে নতুন করে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

ঘর তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার দুর্গত মানুষ স্থানীয় স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিচ্ছেন। তবে তারা ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন।

জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, আমার উপজেলা সদরসহ প্রতিটি গ্রামের বসতবাড়ি এখন পানির নিচে। মানুষ অসহায়। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। সড়ক ও টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে আমরা অসহায় মানুষদের সহায়তা দিতে পারছি না।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারি ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও প্রশাসন উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বন্যা মোকাবিলা করতে হবে।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। উপজেলা দুটির শহর থেকে শুরু করে সবগুলো গ্রামেই বন্যার পানি থই থই করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়ছে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ।

এছাড়া খালিয়াজুরি, সদর, আটপাড়া ও বারহাট্টা উপজেলা মিলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী। জেলার সঙ্গে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ছয়টি উপজেলায় সাড়ে ১৬ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘জেলার ছয়টি উপজেলায় ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ১৬ হাজার ৪৮০ জন মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। বন্যাকবলিত প্রতিটি উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলাসহ মেডিকেল টিম নিয়োজিত হয়েছে। জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবীসহ প্রশাসনের লোকজনসহ গোবাদিপশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় এরই মধ্যে দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ৬০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে ক্রমশ পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ডুবে যাচ্ছে। জেলার সঙ্গে কলমাকান্দার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পযন্ত কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি, পোগলা, সদর, নাজিরপুর ও বড়খাপন ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে সব গ্রামগুলোতেই পানি আর পানি। কলমাকান্দা শহরের সব এলাকায় পানি থই থই করছে। শুকনো ধান, চালসহ ঘরের আসবাপত্র ধরে সব কিছু পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বাসাবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিচ্ছেন। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কলমাকান্দ-ঠাকুরাকোনা নবনির্মিত সড়কের স্থানে স্থানে মানুষ তাবু টানিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। ওই সড়কটির হিরাকান্দা, আশারানী, পাবই, বাহাদুরকান্দাসহ বেশ কিছু স্থান নিচু থাকায় বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সড়কের কোথাও কোথাও কোমর পানি। এতে জেলার সঙ্গে সাড়া উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কলামাকান্দা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়সহ চানপুর, নদীপাড়, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, পূর্ববাজার, কলেজ রোডসহ প্রায় সব এলায় এখন হাঁটুপানি থেকে বুক পানি। বন্যার পানিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গোবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে।

কলমাকান্দার কৈলাটি ইউনিয়নের ঘনিচা গ্রামের ময়না মোড়ল জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর থেকে পানি বেড়ে এখন তার ঘরে কোমর পানি। তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুপুরে অন্যের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও পানি থাকায় সড়কের পাশে একটি বাজারে দোকান ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াদুল্লাহ বলেন, ‘কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টাসহ ছয়টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ছয় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এসব বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত জানান, ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার কংস, মোমেশ্বরী, ধনু, উব্দাখালিসহ কয়েকটি নদ নদীর পানি এখন বিপদসীমার উপরে আছে। শুক্রবার শুধু দুর্গাপুরেই ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। পানি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি। কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম বলেন, ‘কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উপজেলায় ৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আড়াই হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসন সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে।’

এদিকে বন্যায় রেললাইন ডুবে যাওয়ায় নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকাল আটটার পর থেকে এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে মোহনগঞ্জ স্টেশনে হাওড় এক্সপ্রেস ও বারহাট্টা স্টেশনে ২৬২ নম্বর লোকাল ডাউন ট্রেন আটকা পড়ে আছে বলে জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

বারহাট্টা স্টেশন মাস্টার গোলাম রব্বানী মোবাইল ফোনে জানান, শ্যামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ রেলপথে বন্যার পানিতে বারহাট্টা-মোহনগঞ্জের মাঝপথে ইসলামপুর এলাকায় একটি বক্স সেতু ভেঙে গেছে। এছাড়া কয়েকটি স্থানের রেললাইন বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তাই ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লোকাল ট্রেনটি বারহাট্টা থেকে ঘুরিয়ে ময়মনসিংহ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

নেত্রকোনায় বন্যার তোড়ে ব্রিজ ভেঙে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

নেত্রকোনা, প্রতিনিধি জানান, গেল এক দশকের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দা-দুর্গাপুরসহ হাওরাঞ্চলের মানুষ। গতকাল সকালে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বারহাট্টার অতীতপুর মোহনগঞ্জ সীমানায় ভেঙে গেছে রেলের কালভার্ট। এতে সকাল থেকেই বিচ্ছিন্ন রয়েছে ঢাকা-মোহনগঞ্জ রেল যোগাযোগ। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অতিরিক্ত পানির চাপে ব্রিজটির দুই সাইডে থাকা গাইড ওয়ালসহ মাটি সরে গেছে। এছাড়া গেল এক সপ্তাহের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী ও কলমাকান্দার উদাখালী নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ৩৯টি ইউনিয়নের অন্তত কয়েক শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।

ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদিপশু, বস্ত্র, সঞ্চিত খাদ্যসামগ্রী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ বানভাসি মানুষ। চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে সব। বানভাসি মানুষ বলছেন, গেল ১০-১৫ বছরে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি তারা।

দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদী পানি উপচে পৌর শহরের ছোট বাজার, তেরি বাজার, চর মোক্তারপাড়া, থানা, উপজেলা পরিষদ পানিতে তলিয়ে গেছে।

এছাড়া উপজেলার গাঁওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া, ক্ল্লুাগড়া ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামেই ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী মানুষদের সামনে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। কলমাকান্দার উপদাখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা সদরসহ প্রায় সবগুলো ইউনিয়ন পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্ধ রয়েছে জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। এছাড়া নেত্রকোনা সদর উপজেলার মগড়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এরই মধ্যে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল।

এদিকে হাওরাঞ্চলে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম। কোনরকমে গরু, ছাগল হাঁস, মুরগি নিয়ে উঁচু সড়ক ও বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। গত শুক্রবার সকাল থেকেই জেলার পানিবন্দী এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে পানিবন্দী এলাকাগুলোতে।

এ অবস্থায় সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে মানবেতর দিন পার করছেন বানভাসি মানুষ। সিলেট সুনামগঞ্জের পাশাপাশি এই কঠিন মুহূর্তে নেত্রকোনাকেও বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণা করে দ্রুত অসহায়দের সহযোগিতায় সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েনের দাবি করছেন স্থানীয়রা।

হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর প্রায় ৩৪টি বিদ্যালয়কে আশ্রয়ণ কেন্দ্র ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

বালিয়ামারী বর্ডার হাট ৩ ফুট পানির নিচে

প্রতিনিধি, রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) : উজানে ভারী বর্ষণ ও নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢলের পানিতে উপজেলার বালিয়ামারী বর্ডার হাটে পানি উঠে ৩ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে অনেক কাঁচা রাস্তা, ভেঙে গেছে অধিকাংশ রাস্তাঘাট। তলিয়ে গেছে পাট, তিল, শাকসবজি ও বীজতলা। ভোগান্তি বেড়েছে বানভাসী মানুষের। নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে দুই শতাধিক বাড়িঘর।

সরেজমিন ও জনপ্রতিনিধিদের তথ্যমতে, থেমে থেমে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চর রাজীবপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে আরও বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রাজীবপুর সদর ইউনিয়ের বালিয়ামারী, বালিয়ামারী ব্যাপারীপাড়া, পূর্ব ব্যাপারীপাড়া, জালচিড়াপাড়া, মিয়াপাড়া, বাউলপাড়া, করাতিপাড়া, মুন্সিপাড়া, টাঙ্গালিয়াপাড়া, ফাটকপাড়া এলাকার মানুষ গত এক সপ্তাহ যাবত পানিবন্দী জীবনযাপন করছে। বালিয়ামারী ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফরিজল হক জানান, তার বাড়ির সড়কটি পানিতে তলিয়ে গেছে। তার এলাকার অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবী। কাজকর্ম না থাকায় আয় রোজগার নেই। অনেকের অনাহারে অর্ধাহারে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

রাজীবপুর সদর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মিরন মো. ইলিয়াস জানান, বন্যার্তদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবার দেয়া প্রয়োজন। বানভাসিদের পাশে বৃত্তবান সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন।

কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর ছক্কু জানান, তার এলাকার অর্ধেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া শংকর মাধবপুর ও উত্তর কোদালকাটি গ্রামে গত ৩ দিনে প্রায় ২ শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে।

মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম জানান, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় তার এলাকার নয়া চরের সঙ্গে ফকিরপাড়া ও চর নেওয়াজিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বড়বেরচর কীর্তনতারী, সন্যাসীকান্দি এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে।

চর রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আজিজার রহমান জানান, বন্যার্তদের জন্য ৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দ পেয়েছেন। যা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

চর রাজীবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি

জেলা বার্তা পরিবেশক, সিরাজগঞ্জ

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সকাল ৯টায় বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে কাজীপুর পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। যমুনা নদীর পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। এতে তিল, কাউন, বাদাম, পাট ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, জেলার কোথাও কোন ঝুঁকিপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। তবে নদী তীরবর্তী কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানান। তিনি আরও জানান ইতোমধ্যে ভাঙন এলাকায় ৪০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এছাড়া ভাঙন রোধে ৩০ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং ৯৬ হাজার জিও ব্যাগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাঁধসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ত্রিপুরার পাহাড়ি পানির ঢলে আখাউড়ার হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত ইউনিয়ন

প্রতিনিধি আখাউড়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের অন্তত আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত দুই দিনের ভারী বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়ি পানির ঢলে বাঁধটি ভেঙে যায়। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ।

সরেজমিন দেখা যায়, আখাউড়া-আগরতলা আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন, কাস্টম অফিস এবং আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন, মোগড়া ইউনিয়ন ও মনিয়ন্দ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে। এতে এখানকার ফসলি জমি, পুকুর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ বেশকিছু বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

হাওড়া নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের শফিক মিয়া জানান, শুক্রবারের ভারী বর্ষণে ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলে হাওরা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। তারপর থেকে আস্তে আস্তে নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। পানির নিচে তলিয়ে অনেকের বাড়ি-ঘর। ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকটি পরিবার।

আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অংগ্যজাই মারমা জানান, তিনি হাওড়া বাঁধ ভাঙন এলাকা ও প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, আকস্মিক এ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রসাশন ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছেন, তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তারা এটি দেখছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম হাওড়া নদীর বাঁধ ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, বন্যাপরবর্তী আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট রয়েছে। এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।