সিলেট অঞ্চলে বন্যা, বিশেষজ্ঞ মতামত

সিলেট ও সুনামগঞ্জ বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দুটি শহর, পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি পানির নিচে। চারপাশে অথই পানি, আশপাশে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও উপায় নেই বলছেন স্থানীয় মানুষজন।

বরবার বন্যার শিকার হচ্ছেন সিলেটবাসী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ১২২ বছরে ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা। সীমান্তের ওপর থেকে পানি নামছে ভয়াবহভাবে। এই বন্যা কী স্বাভাবিক, এমন প্রশ্নের উত্তরে পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম হচ্ছে আবহাওয়া তো আগের মতো নেই। অনেক অদল-বদল শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। যেমন এ বছর বসন্তকাল ছিল না। মাত্র ১০-১২ দিন, এরপরই গরম শুরু হয়ে গেছে। আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হবে, এটা স্বাভাবিক আর প্রকৃতি তো আর্মির মতো লেফট রাইট করে না। প্রতি বছর ব্যবহারের কিছু ধারাবাহিকতা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্ষা শুরু হয় বরগুনাতে মে মাসের ১৫ তারিখে, ঢাকায় জুন মাসের ১ তারিখে, দিনাজপুরে শুরু হয় জুলাই মাসের ১ তারিখ, সুনামগঞ্জে ও মেঘালয়ে মে মাসের প্রথম থেকে বৃষ্টি নামে। এবার পরপর চার পাঁচ দিন অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়েছে। এই ভারি বৃষ্টির কারণে বন্যা হচ্ছে। বাড়ি ঘর ডুবে যাচ্ছে।’

ড. আইনুন নিশাত আরও বলেন, ‘সিলেট এবং সুনামগঞ্জ শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। কাজেই ওখানে কোন প্রটেকশনও নেই। নদী কানায় কানায় ভর্তি হলেই শহরে পানি ঢুকছে। মানুষের মেমরি তো খুব দুর্বল, এ ধরনের ঘটনা কিন্তু এর আগেও ঘটেছে। পাঁচ বছর, সাত বছর, ১০ বছর পরপর হতো; তবে এখন ঘন ঘন হতে পারে। আমাদের কথার কোন দাম নাই। আমরা যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি নদী ব্যস্থাপনা নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বলছি, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।’

ড্রেজিংয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘শুধু ড্রেজিং করলে কাজে হবে না, বহু বছর ধরে বলে আসছি। তার সঙ্গে নদী ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ড্রেজিং করার পর ‘পলি’ এসে ভরে গেলে তাহলে আর লাভ কী। এখন যেখানেই ড্রেজিং করেন পলি মাপার কিছু কি আছে, আমাদের নাই, তাই কেবল মাত্র ড্রেজিং কোন কজেই আসবে না।’

তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জে সুরমার পানি নামে কালনী দিয়ে। কালনী ড্রেজিং করেছে, কিন্তু কতটুকু উপকার হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বলবে এটা ড্রেজিং করা হয়েছে। কিন্তু সুরমার পলি কোথায গিয়ে পড়ছে সেটাও তো দেখতে হবে।’

ড. নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা তো এ বছর মাত্র এক ডিগ্রি বেড়েছে, এটা ২০৩০ নাগাদ আরও বাড়বে তখন এ ধরনের আনএক্সপেক্টেড ঘটনা আরও বাড়বে। এ বছর মে মাসে বন্যা হয়েছিল এটা আনএক্সপেক্টেড ছিল। কিন্তু এখনকার এটা তো আনএক্সপেক্টেড না। মোট কথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়তে থাকবে, খারাপ হতে থাকবে দিন দিন।

তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে এটাকে মনে রেখে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। আগেকার যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আছে তা কাজে আসবে না। নদী ব্যবস্থাপনাতে যেতে হবে নয়তো সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এবারের বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস খুব খারাপ জানিয়ে ড. নিশাত বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিদিনের পানির লেভেল মাপে। ৩ দিনে কতটা বাড়তে পারে ৫ দিনে কতটা বাড়তে পারে ১০ দিনে কতটা বাড়তে পারে; তার ফোরকাস্ট দেয়। এটা বৃষ্টিপাতের ফোরকাস্টের ওপর নির্ভর করে। একটা ওয়েবসাইটে আছে। যে কেউ দেখতে পারে। তাতে দেখা যাচ্ছে পানি বেড়ে চলছে এবং আগামী ৬-৭ দিন পানি বেড়েই চলবে। তাদের অনুমান বোধহয় চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টি বেশ কয়েকদিন ধরে হবে। তো দেশেও হবে। তারা টোটালি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়াটাতে অবশ্য আমি বিস্মিত হইনি।’

এদিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জে আগামী দুই দিনে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।

রবিবার, ১৯ জুন ২০২২ , ৫ আষাড় ১৪২৮ ১৯ জিলকদ ১৪৪৩

সিলেট অঞ্চলে বন্যা, বিশেষজ্ঞ মতামত

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

সিলেট ও সুনামগঞ্জ বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দুটি শহর, পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি পানির নিচে। চারপাশে অথই পানি, আশপাশে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও উপায় নেই বলছেন স্থানীয় মানুষজন।

বরবার বন্যার শিকার হচ্ছেন সিলেটবাসী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ১২২ বছরে ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা। সীমান্তের ওপর থেকে পানি নামছে ভয়াবহভাবে। এই বন্যা কী স্বাভাবিক, এমন প্রশ্নের উত্তরে পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম হচ্ছে আবহাওয়া তো আগের মতো নেই। অনেক অদল-বদল শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। যেমন এ বছর বসন্তকাল ছিল না। মাত্র ১০-১২ দিন, এরপরই গরম শুরু হয়ে গেছে। আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হবে, এটা স্বাভাবিক আর প্রকৃতি তো আর্মির মতো লেফট রাইট করে না। প্রতি বছর ব্যবহারের কিছু ধারাবাহিকতা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্ষা শুরু হয় বরগুনাতে মে মাসের ১৫ তারিখে, ঢাকায় জুন মাসের ১ তারিখে, দিনাজপুরে শুরু হয় জুলাই মাসের ১ তারিখ, সুনামগঞ্জে ও মেঘালয়ে মে মাসের প্রথম থেকে বৃষ্টি নামে। এবার পরপর চার পাঁচ দিন অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়েছে। এই ভারি বৃষ্টির কারণে বন্যা হচ্ছে। বাড়ি ঘর ডুবে যাচ্ছে।’

ড. আইনুন নিশাত আরও বলেন, ‘সিলেট এবং সুনামগঞ্জ শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। কাজেই ওখানে কোন প্রটেকশনও নেই। নদী কানায় কানায় ভর্তি হলেই শহরে পানি ঢুকছে। মানুষের মেমরি তো খুব দুর্বল, এ ধরনের ঘটনা কিন্তু এর আগেও ঘটেছে। পাঁচ বছর, সাত বছর, ১০ বছর পরপর হতো; তবে এখন ঘন ঘন হতে পারে। আমাদের কথার কোন দাম নাই। আমরা যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি নদী ব্যস্থাপনা নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বলছি, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।’

ড্রেজিংয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘শুধু ড্রেজিং করলে কাজে হবে না, বহু বছর ধরে বলে আসছি। তার সঙ্গে নদী ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ড্রেজিং করার পর ‘পলি’ এসে ভরে গেলে তাহলে আর লাভ কী। এখন যেখানেই ড্রেজিং করেন পলি মাপার কিছু কি আছে, আমাদের নাই, তাই কেবল মাত্র ড্রেজিং কোন কজেই আসবে না।’

তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জে সুরমার পানি নামে কালনী দিয়ে। কালনী ড্রেজিং করেছে, কিন্তু কতটুকু উপকার হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বলবে এটা ড্রেজিং করা হয়েছে। কিন্তু সুরমার পলি কোথায গিয়ে পড়ছে সেটাও তো দেখতে হবে।’

ড. নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা তো এ বছর মাত্র এক ডিগ্রি বেড়েছে, এটা ২০৩০ নাগাদ আরও বাড়বে তখন এ ধরনের আনএক্সপেক্টেড ঘটনা আরও বাড়বে। এ বছর মে মাসে বন্যা হয়েছিল এটা আনএক্সপেক্টেড ছিল। কিন্তু এখনকার এটা তো আনএক্সপেক্টেড না। মোট কথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়তে থাকবে, খারাপ হতে থাকবে দিন দিন।

তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে এটাকে মনে রেখে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। আগেকার যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আছে তা কাজে আসবে না। নদী ব্যবস্থাপনাতে যেতে হবে নয়তো সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এবারের বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস খুব খারাপ জানিয়ে ড. নিশাত বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিদিনের পানির লেভেল মাপে। ৩ দিনে কতটা বাড়তে পারে ৫ দিনে কতটা বাড়তে পারে ১০ দিনে কতটা বাড়তে পারে; তার ফোরকাস্ট দেয়। এটা বৃষ্টিপাতের ফোরকাস্টের ওপর নির্ভর করে। একটা ওয়েবসাইটে আছে। যে কেউ দেখতে পারে। তাতে দেখা যাচ্ছে পানি বেড়ে চলছে এবং আগামী ৬-৭ দিন পানি বেড়েই চলবে। তাদের অনুমান বোধহয় চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টি বেশ কয়েকদিন ধরে হবে। তো দেশেও হবে। তারা টোটালি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়াটাতে অবশ্য আমি বিস্মিত হইনি।’

এদিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জে আগামী দুই দিনে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।