প্রস্তাবিত বাজেট ব্যাংক খাতে কী প্রভাব রাখবে

রেজাউল করিম খোকন

একটি অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিতে গেলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। সারা বছরের আয় দিয়েও আয়কর সীমার মধ্যে আসে না এমন গ্রাহককেও ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু এখন ক্রেডিট কার্ড নিতেও গ্রাহককে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। না হলে ব্যাংক ঋণ দেবে না। কারণ, রিটার্ন ছাড়া ঋণ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে এনবিআর। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এমন প্রস্তাবই রাখা হয়েছে ।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্র্রস্তাবিত বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের ওপর বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন দাখিলের রসিদ জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। আগে বাধ্যতামূলকভাবে টিআইএন জমা দিতে হতো। এ কারণে গ্রাহকরা টিআইএনের কপি জমা দিয়ে ঋণ নিতো। তবে, বছর শেষে বেশির ভাগ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দিতো না। কিন্তু এবার পাঁচ লাখ টাকার ঋণের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। এর ফলে আয়কর সীমার মধ্যে না থেকেও ন্যূনতম অর্থ জমা দিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে গ্রাহককে। রিটার্ন জমা না দিলে ঋণ নিতে পারবেন না গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণে ভাটা পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে । এভাবে বিদ্যমান করের সঙ্গে নতুন করে ব্যাংকিং খাতের ওপর করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর।

ব্যাংকগুলো ২০ হাজার টাকা আয় করেন, এমন ব্যক্তির নামেও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। এদিকে ব্যাংকিং লেনদেনে কাগজের নোটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই ক্রেডিট কার্ড প্রচলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, এ পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ লাখ। যার বড় অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। এই ২৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে বেশির ভাগের আয়ই ৩০ হাজার টাকার নিচে। আগে ক্রেডিট কার্ড নিতে টিআইএন লাগত। কিন্তু রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ক্রেডিট কার্ডের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে।

বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্ন উপায়ে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানতেও বড় ধাক্কা লাগতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট ঋণ ও কম আয়ের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এতে ব্যাংকের ব্যবসা কমবে। দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। চলমান আইনি সংস্কারের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতি চাঙা রাখতে ছোট অঙ্কের ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডে প্রবৃদ্ধি জরুরি। যাঁরা ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন, তাঁরা ছোট ঋণ ও কার্ড নিতে পারেন। এসব সেবা নিতে তাঁরা টিআইএন নেন, তবে রিটার্ন দেন না। এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।

বিদ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আমানত রাখলে ১০ শতাংশ উৎসে আয়কর দিতে হতো। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে দিতে হবে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ব্যাংকের আমানতের বড় একটি অংশই প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। কিন্তু উৎসে আয়কর বাড়ানোর ফলে তাদের নিট আয় কমে যাবে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের আমানত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাবে। আর তাহলে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ আরও কমে যাবে। আমানত প্রবাহ কমলে কমবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের তারল্য প্রবাহে।

দেশে নগদ টাকার লেনদেন কমাতে হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর ছোট ঋণ মেটায় তাৎক্ষণিক চাহিদা। রিটার্ন দিতে হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণও। উৎসে কর ও আবগারি শুল্ক বাড়ালে আমানতও কমতে পারে। এতে ব্যাংকের বাইরে চলে যেতে পারে আমানত। ব্যাংকে যে আমানত আছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। আর পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানতের বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এসব আমানত দীর্ঘমেয়াদি ও বেশি সুদের। সহসাই উত্তোলন করা হয় না। এই আমানতের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো।

এখন এসব আমানত কমে গেলে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনিতে সুদের হার বাড়তে থাকায় আয় কমে যাচ্ছে। সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে। বাজেটে ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সুদের ওপর উৎসে কর বাড়ানো হলে আমানত কিছুটা কমতে পারে। ব্যাংকগুলোয় যে করপোরেট আমানত রয়েছে, তাতে ধাক্কা লাগতে পরে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাতের ওপর বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়নি, বরং সাড়ে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্সই বহাল রাখা হয়েছে। বহাল রাখা হয়েছে প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমের ওপর ট্যাক্স। নানা খাতে করারোপ করায় বছরে মোট আয়ের প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয় নানা করের নামে। তুলনামূলক বেশি হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করে থাকে। নানা সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের পকেট থেকে কেটে রাখা হয় বাড়তি অর্থ।

বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্সের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের উৎসে কর আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ানো হয়েছে। এক দিকে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আবার এ প্রভিশনের ওপরও সরকারকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের খড়গ চাপানো হয়েছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর টিআইএন না থাকলে আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সার্কুলারের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। আয়কর আইনে বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়কর রেয়াতের সুবিধা পায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসাবে আয়কর আইনে গণ্য করে না।

এর ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৫ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগেটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। কারণ, ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার ওপর সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি থাকে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। এখন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ৬৫ কোটি টাকা। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিট লোকসান হবে আড়াই কোটি টাকা। এদিকে ব্যাংকগুলোর সিএসআর কার্যক্রমকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রম উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদ-ের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর করবে মানদ-ের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতাভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সিএসআর কার্যক্রম করলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, কোন অন্ধকে ব্যাংক আর্থিক সুবিধা দিলে তার ওপর কোন ছাড় নেই।

কিন্তু এনবিআরের তালিকাভুক্ত কোন অন্ধদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে দিলে তাতে কর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এরপরেও সাড়ে ৩২ শতাংশ সিএসআর কার্যক্রমে কর দিতে হচ্ছে। এতে দুই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত, ব্যাংক সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে তারা শতভাগ সুবিধা পাচ্ছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত না করায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রম এড়িয়ে চলে। ব্যাংকের ওপর যে কোন ধরনের করারোপ করা হলে ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল থেকে তা পরিশোধ করেনা। একপর্যায়ে তা জনগণের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমন বিনিয়োগকারীদের নানা সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হয়। সব ধরনের গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ চাপানো হয়। সব মিলে শেষ পর্যায়ে সাধারণ জনগণকেই মাশুল দিতে হয়।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ২০ জুন ২০২২ , ৬ আষাড় ১৪২৮ ২০ জিলকদ ১৪৪৩

প্রস্তাবিত বাজেট ব্যাংক খাতে কী প্রভাব রাখবে

রেজাউল করিম খোকন

একটি অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিতে গেলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। সারা বছরের আয় দিয়েও আয়কর সীমার মধ্যে আসে না এমন গ্রাহককেও ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু এখন ক্রেডিট কার্ড নিতেও গ্রাহককে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। না হলে ব্যাংক ঋণ দেবে না। কারণ, রিটার্ন ছাড়া ঋণ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে এনবিআর। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এমন প্রস্তাবই রাখা হয়েছে ।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্র্রস্তাবিত বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের ওপর বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন দাখিলের রসিদ জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। আগে বাধ্যতামূলকভাবে টিআইএন জমা দিতে হতো। এ কারণে গ্রাহকরা টিআইএনের কপি জমা দিয়ে ঋণ নিতো। তবে, বছর শেষে বেশির ভাগ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দিতো না। কিন্তু এবার পাঁচ লাখ টাকার ঋণের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। এর ফলে আয়কর সীমার মধ্যে না থেকেও ন্যূনতম অর্থ জমা দিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে গ্রাহককে। রিটার্ন জমা না দিলে ঋণ নিতে পারবেন না গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণে ভাটা পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে । এভাবে বিদ্যমান করের সঙ্গে নতুন করে ব্যাংকিং খাতের ওপর করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর।

ব্যাংকগুলো ২০ হাজার টাকা আয় করেন, এমন ব্যক্তির নামেও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। এদিকে ব্যাংকিং লেনদেনে কাগজের নোটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ক্রেডিট কার্ডে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই ক্রেডিট কার্ড প্রচলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, এ পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ লাখ। যার বড় অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। এই ২৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে বেশির ভাগের আয়ই ৩০ হাজার টাকার নিচে। আগে ক্রেডিট কার্ড নিতে টিআইএন লাগত। কিন্তু রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ক্রেডিট কার্ডের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে।

বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্ন উপায়ে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানতেও বড় ধাক্কা লাগতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট ঋণ ও কম আয়ের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এতে ব্যাংকের ব্যবসা কমবে। দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। চলমান আইনি সংস্কারের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনীতি চাঙা রাখতে ছোট অঙ্কের ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডে প্রবৃদ্ধি জরুরি। যাঁরা ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন, তাঁরা ছোট ঋণ ও কার্ড নিতে পারেন। এসব সেবা নিতে তাঁরা টিআইএন নেন, তবে রিটার্ন দেন না। এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।

বিদ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আমানত রাখলে ১০ শতাংশ উৎসে আয়কর দিতে হতো। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে দিতে হবে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ব্যাংকের আমানতের বড় একটি অংশই প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। কিন্তু উৎসে আয়কর বাড়ানোর ফলে তাদের নিট আয় কমে যাবে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের আমানত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাবে। আর তাহলে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ আরও কমে যাবে। আমানত প্রবাহ কমলে কমবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের তারল্য প্রবাহে।

দেশে নগদ টাকার লেনদেন কমাতে হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর ছোট ঋণ মেটায় তাৎক্ষণিক চাহিদা। রিটার্ন দিতে হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণও। উৎসে কর ও আবগারি শুল্ক বাড়ালে আমানতও কমতে পারে। এতে ব্যাংকের বাইরে চলে যেতে পারে আমানত। ব্যাংকে যে আমানত আছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। আর পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানতের বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এসব আমানত দীর্ঘমেয়াদি ও বেশি সুদের। সহসাই উত্তোলন করা হয় না। এই আমানতের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো।

এখন এসব আমানত কমে গেলে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনিতে সুদের হার বাড়তে থাকায় আয় কমে যাচ্ছে। সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে। বাজেটে ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সুদের ওপর উৎসে কর বাড়ানো হলে আমানত কিছুটা কমতে পারে। ব্যাংকগুলোয় যে করপোরেট আমানত রয়েছে, তাতে ধাক্কা লাগতে পরে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাতের ওপর বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়নি, বরং সাড়ে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্সই বহাল রাখা হয়েছে। বহাল রাখা হয়েছে প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমের ওপর ট্যাক্স। নানা খাতে করারোপ করায় বছরে মোট আয়ের প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয় নানা করের নামে। তুলনামূলক বেশি হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করে থাকে। নানা সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের পকেট থেকে কেটে রাখা হয় বাড়তি অর্থ।

বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্সের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের উৎসে কর আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ানো হয়েছে। এক দিকে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আবার এ প্রভিশনের ওপরও সরকারকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের খড়গ চাপানো হয়েছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর টিআইএন না থাকলে আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক সার্কুলারের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। আয়কর আইনে বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়কর রেয়াতের সুবিধা পায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসাবে আয়কর আইনে গণ্য করে না।

এর ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৫ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগেটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। কারণ, ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার ওপর সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি থাকে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। এখন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ৬৫ কোটি টাকা। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিট লোকসান হবে আড়াই কোটি টাকা। এদিকে ব্যাংকগুলোর সিএসআর কার্যক্রমকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রম উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদ-ের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর করবে মানদ-ের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতাভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সিএসআর কার্যক্রম করলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, কোন অন্ধকে ব্যাংক আর্থিক সুবিধা দিলে তার ওপর কোন ছাড় নেই।

কিন্তু এনবিআরের তালিকাভুক্ত কোন অন্ধদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে দিলে তাতে কর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এরপরেও সাড়ে ৩২ শতাংশ সিএসআর কার্যক্রমে কর দিতে হচ্ছে। এতে দুই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত, ব্যাংক সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে তারা শতভাগ সুবিধা পাচ্ছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত না করায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রম এড়িয়ে চলে। ব্যাংকের ওপর যে কোন ধরনের করারোপ করা হলে ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল থেকে তা পরিশোধ করেনা। একপর্যায়ে তা জনগণের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমন বিনিয়োগকারীদের নানা সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হয়। সব ধরনের গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ চাপানো হয়। সব মিলে শেষ পর্যায়ে সাধারণ জনগণকেই মাশুল দিতে হয়।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]