পদ্মা সেতু : বিএনপির দায় ও সরকারের দায়িত্ব

আব্দুর রহমান

পদ্মা সেতু নির্মাণের মহাযজ্ঞ শেষ হয়েছে। এর উদ্বোধনের অপেক্ষায় দেশের মানুষ। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি অসামান্য অর্জন। বাংলাদেশের বড় অবকাঠামো মানেই বিদেশ ঋণ বা সহায়তা। পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে। কোন প্রেক্ষাপটে সেতুটি নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে তা কম-বেশি সবারই জানা। সেতুটি নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সন্দেহ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত এটি করতে পেরেছে শেখ হাসিনা সরকার। বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে সুবিশাল এই স্থাপনাটির উদ্বোধন এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন। উদ্বোধনের দিন তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে কেমন হবে সেতুটির উদ্বোধনী আয়োজন আর কারাই হবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত? সরকারের পক্ষ থেকে এরিমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে কাদের কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, সে ব্যাপারে আইনানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমনটা জানানোর দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়ে দেনÑখালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে আইনি কোন বাধা নেই। তাই ধরে নেয়া যায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি আমন্ত্রণ চলে যেতে পারে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ‘ফিরোজায়’। আর দল হিসেবে বিএনপিও হয়তো আমন্ত্রণ পাবে।

সরকারি নানা অনুষ্ঠানে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি অনেকটা প্রথার মতো ব্যাপার। তবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী পর্বে আমন্ত্রণ জানানোটা প্রথাগত আর পাঁচটা আমন্ত্রণের মতো সাদামাটা বা সাধারণ কোন বিষয় নয়। সরকার সম্ভবত: বুকে অনেক ব্যথা নিয়েই বিএনপিকে এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবে। তাই বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে কিছু কথা বলে মনের ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রায় প্রতিদিনই তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই সেতুর ‘বিরুদ্ধে’ বিএনপি কত কথাই না বলেছে! সরকার পক্ষের কথাবার্তায় মনে হয় না মাওয়া কিংবা জাজিরা প্রান্তে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বরণ করে নিতে তাদের বিশেষ প্রত্যাশা বা আগ্রহ রয়েছে।

অপরদিকে বিএনপিকে এ ক্ষেত্রে খানিকটা বিব্রত বলেই মনে হচ্ছে। সরকার পক্ষের লাগামহীন অভিযোগের বাণে বিদ্ধ হওয়ায় তারা কি কিছুটা অপরাধবোধে ভুগছে? পদ্মা সেতু প্রশ্নে বিএনপি নেতারা খাপছাড়া কথা বলছেন, সংসদে যে দুজন সোচ্চার তাদের ফোকাস এই সেতু নির্মাণে দুর্নীতির দিকে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দুর্নীতির বিষয়টাকে ঠিক এ মুহূর্তে আমলে নিতে রাজি নয় ‘উৎসব’ এ মেতে ওঠার অপেক্ষায় থাকা দেশবাসী।

যাই হোক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলে বিএনপি তা রক্ষা করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়, দলের মহাসচিব অনানুষ্ঠানিকভাবে নেতিবাচক ধারণার কথা জানালেও দল হিসেবে বিএনপির বক্তব্য জানা যাবে তাদের হাতে আমন্ত্রণের কার্ড পৌঁছার পর। সরকারের আমন্ত্রণে যাওয়া না যাওয়া দুটোর অধিকারই বিএনপির আছে। এ সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবের আবহ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে সরকার। অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতার কেন্দ্র মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর আর মাদারিপুরে হলেও দেশের ৬৪ জেলায়ই হবে অনুষ্ঠান। জেলা প্রশাসন নানা আয়োজন করবে, আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠান শুরুও করে দিয়েছে। ২৫ জুনকে উৎসব-আনন্দে ভরপুর করে দিতে আওয়ামী লীগ আর সরকারের নানা আয়োজনে দিনটি উৎসবমুখর হয়ে উঠবে বলেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

বিএনপি নেতারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না গেলে তা এই অনুষ্ঠানের অসংখ্য সংবাদের ভিড়ে একটি ছোট্ট খবর হয়েই পরের দিন পত্রিকার পাতায় আসবে। তবে তারা এ আয়োজন থেকে তাদের সমর্থকদের তো বটেই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই বিএনপি নেতাদের ভাবতে হবে তারা এ অনুষ্ঠানে না গিয়ে কি পত্রিকার পাতার একটি ছোট্ট খবরের জন্ম দেবেন? নাকি দেশের একটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের দিনে আনন্দে মাতোয়ারা না হলেও সেই আনন্দের সঙ্গেই থাকবেন?

বিএনপি যদি এ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ই, তা কেন নেবে? সেতু নির্মাণে মহাদুর্নীতি হয়েছে সে অভিযোগের জন্য? দুর্নীতির প্রতিবাদে কোন কিছুকে, বিশেষ করে ক্ষমতাধরদের কিছুকে বর্জন করার মানসিক শক্তি এখনও দেশের মানুষের গড়ে ওঠেনি। সুতরাং এ কারণ দেখিয়ে তারা যদি অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন তাহলে তা শুধু অনুষ্ঠানস্থলে দলটির শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিই নিশ্চিত করবে, এর বেশি কিছু নয়। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তারা বলতে পারে ‘অবৈধ’ সরকারের যে অর্জন তা নিয়ে আয়োজিত উৎসবের সঙ্গে তারা একাত্ম হবেন না। নৈতিক বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হতে পারে, তবে এ সরকারের কোন কাজটিকেই বা তারা প্রতিহত করতে পেরেছে বা সরকারকে তাদের ইচ্ছার বাইরে নিতে পেরেছে? বিএনপির যে সব সদস্য সংসদে আছেন তারা সরকারের মন্ত্রী এমপিদের সঙ্গে সংসদে বসছেন, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিচ্ছেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়াটাকে বিশেষভাবে বিবেচনা না করে বা বিশেষ কিছু হিসেবে না দেখে আর দশটা ‘যাওয়ার’ মতো করে দেখলে বিএনপির সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হতে পারে।

বিএনপির অনুষ্ঠানে অংশ নিলে তাদের সমালোচনা করার অধিকার আরও সংহত ও সুযোগকে প্রশস্ত করবে। বিএনপি নেতারা কথায় কথা বলে থাকেন, যমুনা সেতুর কাজ (বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু) উদ্বোধনের দিন আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। পদ্মা সেতু চালুর দিনটিতে যদি বিএনপি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে তাহলে আগামী দিনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে এ সমালোচনার নৈতিক অধিকার হারাবে বিএনপি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়াটা বিএনপির দায়িত্ব না হলেও এ সেতুর ব্যাপারে তাদের যে সব দায় দেয়া হয়, তা দূর করার জন্য হলেও তাদের এ অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দল হিসেবে বিএনপি যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে যে ক’জনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, দলের মহাসচিব বা জ্যেষ্ঠ কোন নেতার নেতৃত্বে তারা অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেন। অথবা বিএনপি তাদের সংসদীয় দলের প্রতিনিধিদের অনুষ্ঠানে পাঠাতে পারেন।

আর সরকার যদি সত্যি সত্যি চায় বিএনপি এ অনুষ্ঠানে আসুক, তাহলে তাদের আসার পথে ঘৃণার কাঁটা ছড়ানো কেন? মনের বিষ ঢেলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে প্রতিদিন কথা বললে পরিস্থিতি বিষাক্তই হবে, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি দূরেই থাকবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশে ঐকতান সৃষ্টির যে আকাক্সক্ষা রয়েছে তা বাস্তবায়নে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগকেই বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

পদ্মা সেতু দুই ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশকে একীভূত করবে। তবে এই সেতু দুই মেরুতে থাকা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক পক্ষকে এক মোহনায় এনে দাঁড় করাবে এতটা কেউ আশা করে না, তারপরও একটি দিনের জন্যও যদি তারা হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়ান পদ্মা সেতুর অর্জন হিসেবে হয়তো সেটাও দীর্ঘদিন ‘রেফারেন্স’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বিএনপি তাদের ‘দায়’ আর সরকার তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে যতœবান হলে ‘ছোট্ট নেতিবাচক’ খবর নয়, দু’দলের নেতাদের হাস্যোজ্জল একটা আলোকচিত্রই হয়তো আসবে ২৬ জুনের পত্রিকার পাতায়, আর দেশের মানুষের প্রত্যাশাও তাই।

[লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক,

ল’রিপোর্টার্স ফোরাম]

সোমবার, ২০ জুন ২০২২ , ৬ আষাড় ১৪২৮ ২০ জিলকদ ১৪৪৩

পদ্মা সেতু : বিএনপির দায় ও সরকারের দায়িত্ব

আব্দুর রহমান

পদ্মা সেতু নির্মাণের মহাযজ্ঞ শেষ হয়েছে। এর উদ্বোধনের অপেক্ষায় দেশের মানুষ। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি অসামান্য অর্জন। বাংলাদেশের বড় অবকাঠামো মানেই বিদেশ ঋণ বা সহায়তা। পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে। কোন প্রেক্ষাপটে সেতুটি নিজস্ব অর্থায়নে হয়েছে তা কম-বেশি সবারই জানা। সেতুটি নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সন্দেহ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত এটি করতে পেরেছে শেখ হাসিনা সরকার। বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে সুবিশাল এই স্থাপনাটির উদ্বোধন এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন। উদ্বোধনের দিন তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে কেমন হবে সেতুটির উদ্বোধনী আয়োজন আর কারাই হবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত? সরকারের পক্ষ থেকে এরিমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে কাদের কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, সে ব্যাপারে আইনানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমনটা জানানোর দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়ে দেনÑখালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে আইনি কোন বাধা নেই। তাই ধরে নেয়া যায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি আমন্ত্রণ চলে যেতে পারে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন ‘ফিরোজায়’। আর দল হিসেবে বিএনপিও হয়তো আমন্ত্রণ পাবে।

সরকারি নানা অনুষ্ঠানে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি অনেকটা প্রথার মতো ব্যাপার। তবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী পর্বে আমন্ত্রণ জানানোটা প্রথাগত আর পাঁচটা আমন্ত্রণের মতো সাদামাটা বা সাধারণ কোন বিষয় নয়। সরকার সম্ভবত: বুকে অনেক ব্যথা নিয়েই বিএনপিকে এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবে। তাই বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর আগে কিছু কথা বলে মনের ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রায় প্রতিদিনই তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই সেতুর ‘বিরুদ্ধে’ বিএনপি কত কথাই না বলেছে! সরকার পক্ষের কথাবার্তায় মনে হয় না মাওয়া কিংবা জাজিরা প্রান্তে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বরণ করে নিতে তাদের বিশেষ প্রত্যাশা বা আগ্রহ রয়েছে।

অপরদিকে বিএনপিকে এ ক্ষেত্রে খানিকটা বিব্রত বলেই মনে হচ্ছে। সরকার পক্ষের লাগামহীন অভিযোগের বাণে বিদ্ধ হওয়ায় তারা কি কিছুটা অপরাধবোধে ভুগছে? পদ্মা সেতু প্রশ্নে বিএনপি নেতারা খাপছাড়া কথা বলছেন, সংসদে যে দুজন সোচ্চার তাদের ফোকাস এই সেতু নির্মাণে দুর্নীতির দিকে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দুর্নীতির বিষয়টাকে ঠিক এ মুহূর্তে আমলে নিতে রাজি নয় ‘উৎসব’ এ মেতে ওঠার অপেক্ষায় থাকা দেশবাসী।

যাই হোক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলে বিএনপি তা রক্ষা করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়, দলের মহাসচিব অনানুষ্ঠানিকভাবে নেতিবাচক ধারণার কথা জানালেও দল হিসেবে বিএনপির বক্তব্য জানা যাবে তাদের হাতে আমন্ত্রণের কার্ড পৌঁছার পর। সরকারের আমন্ত্রণে যাওয়া না যাওয়া দুটোর অধিকারই বিএনপির আছে। এ সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবের আবহ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে সরকার। অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতার কেন্দ্র মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর আর মাদারিপুরে হলেও দেশের ৬৪ জেলায়ই হবে অনুষ্ঠান। জেলা প্রশাসন নানা আয়োজন করবে, আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠান শুরুও করে দিয়েছে। ২৫ জুনকে উৎসব-আনন্দে ভরপুর করে দিতে আওয়ামী লীগ আর সরকারের নানা আয়োজনে দিনটি উৎসবমুখর হয়ে উঠবে বলেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

বিএনপি নেতারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না গেলে তা এই অনুষ্ঠানের অসংখ্য সংবাদের ভিড়ে একটি ছোট্ট খবর হয়েই পরের দিন পত্রিকার পাতায় আসবে। তবে তারা এ আয়োজন থেকে তাদের সমর্থকদের তো বটেই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই বিএনপি নেতাদের ভাবতে হবে তারা এ অনুষ্ঠানে না গিয়ে কি পত্রিকার পাতার একটি ছোট্ট খবরের জন্ম দেবেন? নাকি দেশের একটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের দিনে আনন্দে মাতোয়ারা না হলেও সেই আনন্দের সঙ্গেই থাকবেন?

বিএনপি যদি এ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ই, তা কেন নেবে? সেতু নির্মাণে মহাদুর্নীতি হয়েছে সে অভিযোগের জন্য? দুর্নীতির প্রতিবাদে কোন কিছুকে, বিশেষ করে ক্ষমতাধরদের কিছুকে বর্জন করার মানসিক শক্তি এখনও দেশের মানুষের গড়ে ওঠেনি। সুতরাং এ কারণ দেখিয়ে তারা যদি অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন তাহলে তা শুধু অনুষ্ঠানস্থলে দলটির শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিই নিশ্চিত করবে, এর বেশি কিছু নয়। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তারা বলতে পারে ‘অবৈধ’ সরকারের যে অর্জন তা নিয়ে আয়োজিত উৎসবের সঙ্গে তারা একাত্ম হবেন না। নৈতিক বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হতে পারে, তবে এ সরকারের কোন কাজটিকেই বা তারা প্রতিহত করতে পেরেছে বা সরকারকে তাদের ইচ্ছার বাইরে নিতে পেরেছে? বিএনপির যে সব সদস্য সংসদে আছেন তারা সরকারের মন্ত্রী এমপিদের সঙ্গে সংসদে বসছেন, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিচ্ছেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়াটাকে বিশেষভাবে বিবেচনা না করে বা বিশেষ কিছু হিসেবে না দেখে আর দশটা ‘যাওয়ার’ মতো করে দেখলে বিএনপির সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হতে পারে।

বিএনপির অনুষ্ঠানে অংশ নিলে তাদের সমালোচনা করার অধিকার আরও সংহত ও সুযোগকে প্রশস্ত করবে। বিএনপি নেতারা কথায় কথা বলে থাকেন, যমুনা সেতুর কাজ (বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু) উদ্বোধনের দিন আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। পদ্মা সেতু চালুর দিনটিতে যদি বিএনপি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে তাহলে আগামী দিনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে এ সমালোচনার নৈতিক অধিকার হারাবে বিএনপি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়াটা বিএনপির দায়িত্ব না হলেও এ সেতুর ব্যাপারে তাদের যে সব দায় দেয়া হয়, তা দূর করার জন্য হলেও তাদের এ অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দল হিসেবে বিএনপি যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে যে ক’জনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, দলের মহাসচিব বা জ্যেষ্ঠ কোন নেতার নেতৃত্বে তারা অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেন। অথবা বিএনপি তাদের সংসদীয় দলের প্রতিনিধিদের অনুষ্ঠানে পাঠাতে পারেন।

আর সরকার যদি সত্যি সত্যি চায় বিএনপি এ অনুষ্ঠানে আসুক, তাহলে তাদের আসার পথে ঘৃণার কাঁটা ছড়ানো কেন? মনের বিষ ঢেলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে প্রতিদিন কথা বললে পরিস্থিতি বিষাক্তই হবে, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতি দূরেই থাকবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশে ঐকতান সৃষ্টির যে আকাক্সক্ষা রয়েছে তা বাস্তবায়নে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগকেই বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

পদ্মা সেতু দুই ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশকে একীভূত করবে। তবে এই সেতু দুই মেরুতে থাকা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক পক্ষকে এক মোহনায় এনে দাঁড় করাবে এতটা কেউ আশা করে না, তারপরও একটি দিনের জন্যও যদি তারা হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়ান পদ্মা সেতুর অর্জন হিসেবে হয়তো সেটাও দীর্ঘদিন ‘রেফারেন্স’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বিএনপি তাদের ‘দায়’ আর সরকার তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে যতœবান হলে ‘ছোট্ট নেতিবাচক’ খবর নয়, দু’দলের নেতাদের হাস্যোজ্জল একটা আলোকচিত্রই হয়তো আসবে ২৬ জুনের পত্রিকার পাতায়, আর দেশের মানুষের প্রত্যাশাও তাই।

[লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক,

ল’রিপোর্টার্স ফোরাম]