বাঁচার লড়াই, ত্রাণের জন্য হাহাকার

অনেকটা অনাহারে, অর্ধহারে দিন কাটছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের। নিম্ন থেকে মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। সেই সঙ্গে চলছে উদ্ধারের জন্য আর্তনাদ সরকার থেকে ত্রাণ বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হলেও প্রশাসন বলছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক হওয়ায় দুর্গত এলাকাগুলোত ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে প্লাবিত এলাকাগুলোত নৌযান ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় নেই। পর্যাপ্ত নৌকাও পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝি বা নৌ মালিকদের অসহযোগিতায় প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সুনামগঞ্জ ও সিলেটের কয়েকটি এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণের প্যাকেট ঢিল মেরে ছুঁড়েছেন। দেখা গেছে, বন্যার্ত মানুষের প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ির দৃশ্য।

বাঁচানোর এ এক ভিন্ন লড়াই শুরু হলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সিলেট আসছেন বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করতে। আগে থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস বন্যার্ত মানুষকে উদ্ধারে ও তাদের সহযোগিতায় মাঠে রয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে গত বুধবার থেকে বন্যার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তা গত একশ’ বছরেও দেখেনি কেউ। ১৯৮৮ কিংবা ২০০৪ সালের বন্যায়ও একসঙ্গে ডুবেনি পুরো জেলা। এত মানুষকে দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি। ভয়াবহ এই বন্যায় পানিবন্দী মানুষের মধ্যে একদিকে চলছে উদ্ধারের জন্য আর্তনাদ, অন্যদিকে খাবারের জন্য হাহাকার। এই অবস্থায় সরকারি অনেক ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয় এবং সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে না। ফলে বানভাসি মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিনই ছুটছেন দুর্গতদের পাশে। ত্রাণ হিসেবে শুকনো ও রান্না করা খাবার দেয়ার পাশাপাশি পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধার করা হচ্ছে। তবে ত্রাণের জন্য হাহাকার থামছে না।

সিলেট নগরীতে অনেক এলাকায় বাসায় দুই তলা ও তিন তলাতে মানুষ আটকা পড়েছেন। তবে উপশহর এলাকায় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে বুক সমান পানিতে নেমে মাইকিং করতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয় সঙ্গে করে তারা নিয়ে যাচ্ছেন পানির বোতলও।

এই দলের একজন সুলায়মান মিয়া বলেন, তার এলাকা একতলা সমান পানিতে ডুবে গেছে। দুই তিন তলায় কেউ আছেন কি-না তারা সেটা খুঁজে দেখছেন এবং তাদের তিনি অন্তত খাবার পানি দিয়ে সাহায্য করতে চান।

তিনি আরও বলেন, এই এলাকাতে বলা যায় বেশ বিত্তবানরা থাকেন। এখানে দুই তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত বাড়িতে মানুষ আটকে আছে। যারা বারান্দা থেকে আমাদের কাছে পানি চাচ্ছেন তাদের দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। আর বেশি দূর যেতেও পারবো না। পানির গভীরতা সেখানে আরও বেশি বলেও জানান তিনি।

এদিকে, সুনামগঞ্জের মতো সিলেটেও এখন মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন তার খবর নিতে পারছেন না পরিবার বা স্বজনরা। এছাড়া সিলেটের বাইরে থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করে সিলেটেই আটকে পড়েছেন এমন অনেকে। তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

রহিম নামের একজন বলেন, আমার স্ত্রী, দুই সন্তান সবাই সুনামগঞ্জে। আমি বন্যার কথা শুনে ঢাকা থেকে এসেছি। এখন তো সুনামগঞ্জে যেতে পারছি না। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। আমি জানি না তারা কোথায় আছে।

আরেকজন বলেন, কুমিল্লা থেকে এসেছি। এখনতো আর কোথাও যেতে পারছি না। পরিবার কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তার খোঁজ এখনও পাইনি। জেলা প্রশাসক সীমিত আকারে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে বলে দাবি করলেও সুনামগঞ্জের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সিলেট শহরের বাসিন্দা থৌদাম বৌলি বলেন, সুনামগঞ্জ এবং সিলেটের আশপাশের এলাকার মানুষজন এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের এলাকায় এখনও পানি আসেনি। তবে আমরা বাইরে বের হয়ে শুকনো খাবার বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছি না। কারণ সব দোকান বন্ধ, আর যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর অনেক দাম। আমার জীবনে আমি এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখিনি কখনো।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, শহর থেকে পানির উচ্চতা কিছুটা কমলেও জেলার ৯০ শতাংশ এখনও পানির নিচে। জেলার ৭০ হাজারের মতো মানুষ ২২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় সীমিত পরিসরে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন সংবাদ-এর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি লতিফুর রহমান রাজু। গতকাল বিকেলে সীমিত সময়ের জন্য তাকে পাওয়া গেল মোবাইলে। পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ওই এলাকার সাবেক একজন সংসদ সদস্যদের বয়স ৮০। তার এই বয়সে এত পানি দেখেননি। তিনি বলেন, তার বাসা সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘুরিয়ায়। কখনও বাসায় পানি ওঠেনি। এবার তার বাসায় পানি ওঠায় হাছন রাজার বংশধর সাবেক এক পৌর চেয়ারম্যানের বাড়িতে নৌকাযেগে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। জানালেন, সুনামগঞ্জে এখনও কোন বিদ্যুৎ নেই। কিছু কিছু স্থানে সামান্য সময়ের জন্য সংযোগ দেয়া হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেক ধনাঢ্য পরিবারও বিপাকে পড়েছে।

এদিকে, পানিবন্দী মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকা। কিন্তু ইঞ্জিন নৌকার বেশিরভাগ মালিকরা মানুষের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দুর্যোগের এই সময়ে ডাকাতের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছেন। আগে যেখানে ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া ছিল, সেখানে ইঞ্জিন নৌকার মাঝিরা ভাড়া হাঁকছেন ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। কেউ কেউ সুযোগ বুঝে ভাড়া হাঁকছেন ৫০ হাজার টাকাও। ফলে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ত্রাণ নিয়ে দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। বৈঠাচালিত ছোট নৌকা দিয়ে দুর্গত এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ত্রাণ দিতে যাওয়া লোকজনকে বাধ্য হয়েই বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সিলেট নগরীতেও একই অবস্থা। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকার মাঝিরা ‘গলা কাটছেন’।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, নৌকার মাঝিরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় মাঝিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের কাছে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব মাঝিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তালিকা করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন বিমানবাহিনী। গতকাল সকালে হেলিকপ্টারযোগে এ ত্রাণ বিতরণ করা হয়। দেখা গেছে, হেলিকপ্টার থেকে সংশ্লিষ্টরা ত্রাণের প্যাকেট নিক্ষেপ করলে বানভাসি লোকজন দৌড়ে এসে তা গ্রহণ করছেন। তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ির দৃশ্যও চোখে পড়ে। বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এলাকাটি খুবই দুর্গম। সেখানে অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার সড়ক ও নৌ পথে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যতটুকু সম্ভব হেলিকপ্টার থেকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই তারা ত্রাণের প্যাকেট নিক্ষেপ করেছেন।

ছয় দিনেও প্রশাসনের ত্রাণ পাইনি

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি আশ্রয় কেন্দ্রের নাম হরিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এর পাশেও রয়েছে হেমু ভাটপড়া খান বাড়ি। এই দুই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। তাদেরই একজন বানভাসি নুর উদ্দিন। জানালেন, গত ৬ দিন ধরে তারা অবস্থান করছেন। আশপাশের লোকজন রান্না করা খাবার কখনো দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। দিনে এক বেলাও তারা খাবার পাচ্ছেন না। প্রশাসনের কেউ এসে ত্রাণ দেয়নি। নুরুন নেছা নামের আরও এক বন্যার্ত জানান, তার ঘরে কোমর পানি। সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। গতকাল সকালে এসে কয়েকটি পরিবার নতুন করে উঠেছে। কিন্তু প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পক্ষ থেকে ত্রাণ দেয়া হয়নি।’

ঠিক এমনই অবস্থা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের। চরম দুর্দিন কাটছে বানভাসিদের। উপজেলার উচু স্থানে থাকা স্বজনদের ঘরে আবার কিছু মানুষ রয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। দিনে এক বেলাও তাদের খাবার জুটছে না। দেখা মিলছে না জনপ্রতিনিধিদেরও। পানিবন্দী মানুষদের জন্য অল্প কিছু ত্রাণ ছিল তা বিতরণ করেছি সব জয়গায় পোছানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জৈন্তপুরের বালিপাড়া এলাকার বাসীন্দা কামাল আহমদ একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনসহ সামাজিক সংগঠনের নাম জানিয়ে বলেন, তাদের পক্ষ থেকে শুকনু খাবার পেয়েছি কিন্তু উপজেলা প্রশাসন কিংবা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কিছু পাইনি, এমন কি একবার খবরও নেয় নি।

স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য জানিয়েছেন, আমার ওয়ার্ডের খাঁনবাড়ি আশ্রয়কেন্দ্রে আবদুল কাদির খাঁনের আর্থায়নে দুই বেলা রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। এখনো সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ আসেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বন্যার্তরা। দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশু ও মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে।

মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২ , ৭ আষাড় ১৪২৮ ২১ জিলকদ ১৪৪৩

বাঁচার লড়াই, ত্রাণের জন্য হাহাকার

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

image

সিলেট অঞ্চলে বানভাসি ও পানিবন্দী মানুষের ত্রাণের জন্য হাহাকারের মুখে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী র্দুগত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে -সংবাদ

অনেকটা অনাহারে, অর্ধহারে দিন কাটছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের। নিম্ন থেকে মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। সেই সঙ্গে চলছে উদ্ধারের জন্য আর্তনাদ সরকার থেকে ত্রাণ বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হলেও প্রশাসন বলছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক হওয়ায় দুর্গত এলাকাগুলোত ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে প্লাবিত এলাকাগুলোত নৌযান ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় নেই। পর্যাপ্ত নৌকাও পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝি বা নৌ মালিকদের অসহযোগিতায় প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সুনামগঞ্জ ও সিলেটের কয়েকটি এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণের প্যাকেট ঢিল মেরে ছুঁড়েছেন। দেখা গেছে, বন্যার্ত মানুষের প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ির দৃশ্য।

বাঁচানোর এ এক ভিন্ন লড়াই শুরু হলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সিলেট আসছেন বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করতে। আগে থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস বন্যার্ত মানুষকে উদ্ধারে ও তাদের সহযোগিতায় মাঠে রয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে গত বুধবার থেকে বন্যার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তা গত একশ’ বছরেও দেখেনি কেউ। ১৯৮৮ কিংবা ২০০৪ সালের বন্যায়ও একসঙ্গে ডুবেনি পুরো জেলা। এত মানুষকে দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি। ভয়াবহ এই বন্যায় পানিবন্দী মানুষের মধ্যে একদিকে চলছে উদ্ধারের জন্য আর্তনাদ, অন্যদিকে খাবারের জন্য হাহাকার। এই অবস্থায় সরকারি অনেক ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয় এবং সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে না। ফলে বানভাসি মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিনই ছুটছেন দুর্গতদের পাশে। ত্রাণ হিসেবে শুকনো ও রান্না করা খাবার দেয়ার পাশাপাশি পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধার করা হচ্ছে। তবে ত্রাণের জন্য হাহাকার থামছে না।

সিলেট নগরীতে অনেক এলাকায় বাসায় দুই তলা ও তিন তলাতে মানুষ আটকা পড়েছেন। তবে উপশহর এলাকায় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে বুক সমান পানিতে নেমে মাইকিং করতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয় সঙ্গে করে তারা নিয়ে যাচ্ছেন পানির বোতলও।

এই দলের একজন সুলায়মান মিয়া বলেন, তার এলাকা একতলা সমান পানিতে ডুবে গেছে। দুই তিন তলায় কেউ আছেন কি-না তারা সেটা খুঁজে দেখছেন এবং তাদের তিনি অন্তত খাবার পানি দিয়ে সাহায্য করতে চান।

তিনি আরও বলেন, এই এলাকাতে বলা যায় বেশ বিত্তবানরা থাকেন। এখানে দুই তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত বাড়িতে মানুষ আটকে আছে। যারা বারান্দা থেকে আমাদের কাছে পানি চাচ্ছেন তাদের দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। আর বেশি দূর যেতেও পারবো না। পানির গভীরতা সেখানে আরও বেশি বলেও জানান তিনি।

এদিকে, সুনামগঞ্জের মতো সিলেটেও এখন মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন তার খবর নিতে পারছেন না পরিবার বা স্বজনরা। এছাড়া সিলেটের বাইরে থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করে সিলেটেই আটকে পড়েছেন এমন অনেকে। তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।

রহিম নামের একজন বলেন, আমার স্ত্রী, দুই সন্তান সবাই সুনামগঞ্জে। আমি বন্যার কথা শুনে ঢাকা থেকে এসেছি। এখন তো সুনামগঞ্জে যেতে পারছি না। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। আমি জানি না তারা কোথায় আছে।

আরেকজন বলেন, কুমিল্লা থেকে এসেছি। এখনতো আর কোথাও যেতে পারছি না। পরিবার কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তার খোঁজ এখনও পাইনি। জেলা প্রশাসক সীমিত আকারে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে বলে দাবি করলেও সুনামগঞ্জের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সিলেট শহরের বাসিন্দা থৌদাম বৌলি বলেন, সুনামগঞ্জ এবং সিলেটের আশপাশের এলাকার মানুষজন এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের এলাকায় এখনও পানি আসেনি। তবে আমরা বাইরে বের হয়ে শুকনো খাবার বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছি না। কারণ সব দোকান বন্ধ, আর যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর অনেক দাম। আমার জীবনে আমি এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখিনি কখনো।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, শহর থেকে পানির উচ্চতা কিছুটা কমলেও জেলার ৯০ শতাংশ এখনও পানির নিচে। জেলার ৭০ হাজারের মতো মানুষ ২২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় সীমিত পরিসরে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলেন সংবাদ-এর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি লতিফুর রহমান রাজু। গতকাল বিকেলে সীমিত সময়ের জন্য তাকে পাওয়া গেল মোবাইলে। পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ওই এলাকার সাবেক একজন সংসদ সদস্যদের বয়স ৮০। তার এই বয়সে এত পানি দেখেননি। তিনি বলেন, তার বাসা সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘুরিয়ায়। কখনও বাসায় পানি ওঠেনি। এবার তার বাসায় পানি ওঠায় হাছন রাজার বংশধর সাবেক এক পৌর চেয়ারম্যানের বাড়িতে নৌকাযেগে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। জানালেন, সুনামগঞ্জে এখনও কোন বিদ্যুৎ নেই। কিছু কিছু স্থানে সামান্য সময়ের জন্য সংযোগ দেয়া হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেক ধনাঢ্য পরিবারও বিপাকে পড়েছে।

এদিকে, পানিবন্দী মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকা। কিন্তু ইঞ্জিন নৌকার বেশিরভাগ মালিকরা মানুষের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দুর্যোগের এই সময়ে ডাকাতের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছেন। আগে যেখানে ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া ছিল, সেখানে ইঞ্জিন নৌকার মাঝিরা ভাড়া হাঁকছেন ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। কেউ কেউ সুযোগ বুঝে ভাড়া হাঁকছেন ৫০ হাজার টাকাও। ফলে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ত্রাণ নিয়ে দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। বৈঠাচালিত ছোট নৌকা দিয়ে দুর্গত এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ত্রাণ দিতে যাওয়া লোকজনকে বাধ্য হয়েই বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সিলেট নগরীতেও একই অবস্থা। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকার মাঝিরা ‘গলা কাটছেন’।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, নৌকার মাঝিরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় মাঝিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের কাছে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব মাঝিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তালিকা করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন বিমানবাহিনী। গতকাল সকালে হেলিকপ্টারযোগে এ ত্রাণ বিতরণ করা হয়। দেখা গেছে, হেলিকপ্টার থেকে সংশ্লিষ্টরা ত্রাণের প্যাকেট নিক্ষেপ করলে বানভাসি লোকজন দৌড়ে এসে তা গ্রহণ করছেন। তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ির দৃশ্যও চোখে পড়ে। বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এলাকাটি খুবই দুর্গম। সেখানে অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার সড়ক ও নৌ পথে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যতটুকু সম্ভব হেলিকপ্টার থেকে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই তারা ত্রাণের প্যাকেট নিক্ষেপ করেছেন।

ছয় দিনেও প্রশাসনের ত্রাণ পাইনি

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি আশ্রয় কেন্দ্রের নাম হরিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এর পাশেও রয়েছে হেমু ভাটপড়া খান বাড়ি। এই দুই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। তাদেরই একজন বানভাসি নুর উদ্দিন। জানালেন, গত ৬ দিন ধরে তারা অবস্থান করছেন। আশপাশের লোকজন রান্না করা খাবার কখনো দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। দিনে এক বেলাও তারা খাবার পাচ্ছেন না। প্রশাসনের কেউ এসে ত্রাণ দেয়নি। নুরুন নেছা নামের আরও এক বন্যার্ত জানান, তার ঘরে কোমর পানি। সন্তানদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। গতকাল সকালে এসে কয়েকটি পরিবার নতুন করে উঠেছে। কিন্তু প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পক্ষ থেকে ত্রাণ দেয়া হয়নি।’

ঠিক এমনই অবস্থা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের। চরম দুর্দিন কাটছে বানভাসিদের। উপজেলার উচু স্থানে থাকা স্বজনদের ঘরে আবার কিছু মানুষ রয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। দিনে এক বেলাও তাদের খাবার জুটছে না। দেখা মিলছে না জনপ্রতিনিধিদেরও। পানিবন্দী মানুষদের জন্য অল্প কিছু ত্রাণ ছিল তা বিতরণ করেছি সব জয়গায় পোছানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জৈন্তপুরের বালিপাড়া এলাকার বাসীন্দা কামাল আহমদ একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনসহ সামাজিক সংগঠনের নাম জানিয়ে বলেন, তাদের পক্ষ থেকে শুকনু খাবার পেয়েছি কিন্তু উপজেলা প্রশাসন কিংবা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কিছু পাইনি, এমন কি একবার খবরও নেয় নি।

স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য জানিয়েছেন, আমার ওয়ার্ডের খাঁনবাড়ি আশ্রয়কেন্দ্রে আবদুল কাদির খাঁনের আর্থায়নে দুই বেলা রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। এখনো সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ আসেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বন্যার্তরা। দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশু ও মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে।