মাদ্রাসার ভেতর হাত-পা চেপে ধরে সাত বছরের ছাত্রকে জবাই

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর একটি মাদ্রাসার ভেতর সাত বছরের শিশু ছাত্র ইফতেকার মালেকুল মাসফিকে হাত-পা চেপে ধরে ও বুকে বসে ধালালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তার রক্তাক্ত লাশ মাদ্রাসার স্টোর রুমে কম্বল ও তোশক দিয়ে মুড়িয়ে ফেলে রাখা হয়। চলতি বছরের গত ৫ মার্চ সকালে এ নির্মম ঘটনা ঘটে।

গত শনিবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়ের) টিম অনুসন্ধান চালিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একই মাদ্রাসার দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বয়স ১৫ বছর।

গ্রেপ্তারকৃত দুই শিশু জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে বলেছে, শিশু মাসফির বাড়ি মাদ্রাসার কাছে অবস্থিত। তাই শিশুটির মা তার আদরের সন্তানের জন্য মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে নানা ধরনের নাস্তা ও খাবার পাঠাত। কিন্তু শিশুটির মায়ের দেয়া খাবার তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অভিযুক্ত দুই শিশু খেয়ে ফেলত।

আর শিশুটি দিনের পর দিন না খেয়ে কান্না করত। ভয়ে কাউকে কিছু বলত না। একদিন তার বড় ভাই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গেলে ভাইকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাবার খেয়ে ফেলার ঘটনা জানিয়ে দেয়। ভাই অভিযুক্ত দুই শিশু ও তাদের একজন শিক্ষককে ঘটনাটি জানিয়েছে। এতে অভিযুক্ত দুইজন, মাসফির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে প্রথমে বলৎকারের চেষ্টা ও পরে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। তারা নিজেদেরকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়ের) মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম জানান, ঘটনার পাঁচ মাস আগে শিশু ইফতেকার মালেকুল মাসফিকে আল্লামা শাহ অছিয়র রহমান মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিম খানায় ভর্তি করেছিল। শিশুটি মাদ্রাসার হেফজ খানার আবাসিকে থেকে লেখাপড়া করত।

চলতি বছরের গত ৫ই মার্চ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মাদ্রাসার শিক্ষক জাফর আহাম্মদ শিশুটির বাড়িতে গিয়ে বাবা মাকে জানান, শিশু মাসফিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ খবর শুনে শিশুটির অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন দ্রুত মাদ্রাসায় গিয়ে মাদ্রাসার আশপাশসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে শিশুটিকে পায়নি।

এক পর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিয়ে মাদ্রাসার দোতলায় স্টোর রুমের ভিতর দক্ষিণ কর্নারে কম্বল ও তোষক দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় তার গলাকাটা রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। এই ঘটনায় শিশুটির মামা মোঃ মাসুদ খাঁন বাদি হয়ে বোয়ালখালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি সবাই অজ্ঞাত।

আলোচিত এই মামলাটি পুলিশ হেডকোয়াটার্সের নির্মেশে গত ১৬ মার্চ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই চট্রগ্রাম জেলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআইয়ের চট্রগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের তদারকিতে মামলাটির জোর তদন্ত শুরু করা হয়। গত ১৮জুন শনিবার পিবিআইয়ের তদন্ত টিম মাদ্রাসার সকল ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদেরকে পিবিআইয়ের জেলা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ১২ বছর বয়সের দুইজন শিশু হত্যাকান্ডে জড়িতদের নাম পিবিআইয়ের কাছে (প্রকাশ) বলে দিয়েছে।

তাদের দেয়া তথ্য মতে, অভিযুক্ত দুই শিশুকে আটক করা হয়েছে। তাদের বয়স ১৫ বছর। তাদের মধ্যে একজনের ছদ্ম নাম আসাদ ও অন্যজনের নাম আহাদ। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত মর্মে স্বীকার করেছে। এরপর পিবিআইয়ের টিম তাদেরকে গ্রেফতার দেখিয়েছে।

হত্যাকান্ডের প্রাথমিক কারন হিসেবে জানা গেছে,মাদ্রাসাটি শিশুটির বাড়ির কাছে অবস্থিত। আর শিশুটির অভিবাবকরা প্রায় সময় বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার ও নাস্তা পাঠাত। কিন্তু শিশুটির জন্য মায়ের পাঠানো খাবার ও নাস্তা গুলো গ্রেফতারকৃত দুই শিশু খেয়ে ফেলত। এ বিষয়টি শিশু মাসফি তার বড় ভাই ইমতিয়াজ মালেকুল মাজেদকে জানিয়েছে। তখন বড় ভাই মাজেদ অভিযুক্ত শিশু আসাদকে খাবার না খেতে নিষেধ করেছে। একই ঘটনা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা জাফর আহম্মদকে বিষয়টি জানিয়েছে। এতে দুই অভিযুক্ত দুই শিশু ক্ষুর্ধ্ব হয়ে উঠে।

এরই জের হিসেবে ঘটনার দিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের সময় শিশুটিকে মাদ্রাসার দোতলায় কম্বল দিয়ে মুখ চেপে ধরে নির্যাতন করে। শিশুটি ভাত খেয়ে ফেলার কথা আর কাউকে কোন দিন বলবে না বলে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন। ওই সময় মাদ্রাসার বারান্দায় দাঁড়ানো অন্য দুই শিশু ঘটনাটি দেখে ফেলায় তাদেরকে নিচে চলে যেতে বলে। আর ঘটনাটি কাউকে যাতে না বলে এই জন্য হুমকি দেয়।

অভিযুক্ত ১৫ বছর বয়সের শিশু আসাদ মাসফিকে মাদ্রাসানর স্টোর রুমে ঢুকিয়ে দেয়ালের সঙ্গে মাথা সজোরে আঘাত করে। শিশূটি মাথায় আঘাত লেগে পড়ে গেলে অভিযুক্ত শিশু আহাদ শিশূ মাসফির পা চেপে ধরে আর আসাদ শিশুটিতে জবাই করে। এরপর কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রেখে আবার মাদ্রাসার নিচ তলায় হেফজ খানায় রুমে চলে যায়।

অভিযুক্ত শিশু আসাদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহ্নত ধারালো ছুরি,কম্বল,ট্রাংক ও লাশ ঢেকে রাখার ব্যানার উদ্ধার ও আলামত হিসেবে জব্দ করেছে।

গত রোববার দুই শিশুকে আদালতে হাজির করলে তারা স্বীকারোক্তি মূণলক জবানবন্দি দেয়। আর প্রত্যক্ষদর্শী শিশু আমান ও শিশু জামান (ছদ্মনাম) তারা আদালতে তাদের সাক্ষ্য দেয়। এই ভাবে মাদ্রাসার ভিতর চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।

এ দিকে গতকাল রাতে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সংবাদকে ফোনে জানান,হত্যার আগে মাদ্রাসার অভিযুক্ত দুই সিনিয়র ছাত্র (শিশু) মাসফিকে দোতলার রুমে চেপে ধরে বলৎকারের চেষ্টা করছে। বলৎকারে বাধা ও ঘটনাটি মাদ্রাসার হুজুরও বড় ভাইকে জানিতে দিবে বললে তাকে দেয়ালের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে শিশু মাসফি অচেতন হয়ে যায়। এরপর অভিযুক্ত এক শিশু তার বুকের উপর বসে চেপে ধরে। আরেক শিশু হাত পা চেপে ধরে জবাই করেছে। শুধু তাই জবাই করার পর লাশ টেনে হেচড়ে আরেক জায়গায় নিয়ে ঘুমকরার উদ্দেশ্যে ফেলে রাখে।

পিবিআই জানান,থানা পুলিশ তদন্ত কালে মাদ্রাসার মাদ্রাসার তিনজন শিক্ষককে (হুজুর) আটক করেছিল। তারা ঘটনায় জড়িত নয়। পিবিআই তদন্ত পেয়ে ১৫ থেকে ১৬ দিনের মাথায় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রকে জিজ্ঞাসবাদ করলে হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসে। আর শিশুকে বলৎকার করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ টেস্ট করার জন্য আলামত ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাইলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আমাদের চট্রগ্রাম অফিস থেকে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নে চরণদ্বীপ দরবার শরীফ মাদ্রাসাটি পরিচালনা করত। নিহত ইফতেখার মালিকুল মাসফি (৭) চরণদ্বীপ ইউনিয়নের ফকিরাখালী গ্রামের প্রবাসী আব্দুল মালেকের ছেলে। সে ওই মাদরাসার হেফজখানা বিভাগের কায়দা শাখার ছাত্র ছিল।

চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানান, তদন্তভার পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তিগত কোনো ক্লু নেই, মাদরাসার সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গত ১৪ জুন পিবিআইয়ের একটি টিম মাদরাসায় গিয়ে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

গত ১৭ জুন পিবিআই টিমের কাছে তথ্য আসে যে, একজন ছাত্র খুনের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন এবং সে বিষয়টি জানাতে রাজি হয়েছে। অভিভাবকের মাধ্যমে গত শুক্রবার রাতে ১০ বছর বয়সী হেফজ বিভাগের ওই ছাত্রকে পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

ওই ছাত্র জানায়, তার সঙ্গে আরও একজন সহপাঠী ঘটনা দেখেছে। অভিভাবকের মাধ্যমে তাকেও এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই টিম। দু’জনের বর্ণনা অভিন্ন হওয়ার পর তাদের তথ্য অনুযায়ী ঘটনায় জড়িত দুই ছাত্রকে শনিবার আটক করে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়। দু’জনের বয়স ১৫ বছর। তারা ওই মাদরাসার সবচেয়ে সিনিয়র তিন ছাত্রের মধ্যে দু’জন এবং দুরুদ বিভাগের ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে দু’জন হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে বলে জানান পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।

হত্যাকান্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই টিমের সদস্য পরিদর্শক মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, দুই ছাত্র জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিহত মাসফি এবং তাদের বাড়ি একই এলাকায়। মাশফির জন্য তার বাসা থেকে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার পাঠাত। এই দু’জন সেই খাবার জোরপূর্বক খেয়ে ফেলত। মাশফি তার বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। তখন বড় ভাই ক্ষুব্ধ হয়ে মাদারাসায় এসে দু’জনকে বকাঝকা করে এবং তিনি বিষয়টি শিক্ষক জাফরকেও জানিয়ে দেন। জাফরও তাদের ধমক দেয়। এতে দু’জনের ক্ষোভ জমে মাশফির ওপর। সেই ক্ষোভ থেকেই হত্যাকান্ড।

পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ঘটনার দিন মাদরাসায় ক্লাস চলছিল। কিন্তু গ্রেফতার দু’জনের একজন মাশফিকে নিয়ে দোতলায় স্টোররুমে যায়। আরেকজন গিয়ে তাদের সেখানে শুয়ে থাকতে দেখে। আমাদের ধারণা, প্রথমজন মাশফিকে জোরপূর্বক বলাৎকার করেছে। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা মুশকিল। বিষয়টি অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকারও করেনি। যা-ই হোক, দ্বিতীয়জন দেখার পর মাশফি লজ্জা পেয়ে বিষয়টি শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। মাশফিকে জবাইয়ে ব্যবহৃত ছোরাটি গ্রেফতারকৃত একজনের পোশাকের বাক্স থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।

##

আরও খবর
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আইনের খসড়া অনুমোদন
পদ্মা সেতু : ভাবতে গেলে তিনটি শব্দ ভেসে উঠে সাহস, সংকল্প ও সমৃদ্ধি
বিএনপি নেতারা বন্যার্তদের পাশে না দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন : তথ্যমন্ত্রী
করোনা : শনাক্তের হার ১০ শতাংশ ছাড়ালো, মৃত্যু ১
অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে সরকার
সুফিয়া কামাল ছিলেন নারীমুক্তিকে মানবমুক্তি হিসেবে দেখার মন্ত্রে দীক্ষিত
নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিপক্ষের হামলা, গুলি ও টেঁটাবিদ্ধ ১৫, গ্রেপ্তার ৮
হবিগঞ্জে বন্যার্তদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ায় চাকরিচ্যুত ৮
তারেকের দুই বন্ধুসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক
আলোচিত স্বপ্ন-পদ্মা-সেতু পেল প্রধানমন্ত্রীর উপহার
জাতীয় স্লোগানে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ যুক্ত চেয়ে আইনি নোটিশ
‘আমারে ফাঁসি দিয়া আসামিগো মুক্তি দিক’
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নাম-পেশা পরিবর্তন করে ৩১ বছর আত্মগোপনে

মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২ , ৭ আষাড় ১৪২৮ ২১ জিলকদ ১৪৪৩

মাদ্রাসার ভেতর হাত-পা চেপে ধরে সাত বছরের ছাত্রকে জবাই

বাকী বিল্লাহ, ঢাকা ও নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর একটি মাদ্রাসার ভেতর সাত বছরের শিশু ছাত্র ইফতেকার মালেকুল মাসফিকে হাত-পা চেপে ধরে ও বুকে বসে ধালালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তার রক্তাক্ত লাশ মাদ্রাসার স্টোর রুমে কম্বল ও তোশক দিয়ে মুড়িয়ে ফেলে রাখা হয়। চলতি বছরের গত ৫ মার্চ সকালে এ নির্মম ঘটনা ঘটে।

গত শনিবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়ের) টিম অনুসন্ধান চালিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একই মাদ্রাসার দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বয়স ১৫ বছর।

গ্রেপ্তারকৃত দুই শিশু জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে বলেছে, শিশু মাসফির বাড়ি মাদ্রাসার কাছে অবস্থিত। তাই শিশুটির মা তার আদরের সন্তানের জন্য মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে নানা ধরনের নাস্তা ও খাবার পাঠাত। কিন্তু শিশুটির মায়ের দেয়া খাবার তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অভিযুক্ত দুই শিশু খেয়ে ফেলত।

আর শিশুটি দিনের পর দিন না খেয়ে কান্না করত। ভয়ে কাউকে কিছু বলত না। একদিন তার বড় ভাই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গেলে ভাইকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাবার খেয়ে ফেলার ঘটনা জানিয়ে দেয়। ভাই অভিযুক্ত দুই শিশু ও তাদের একজন শিক্ষককে ঘটনাটি জানিয়েছে। এতে অভিযুক্ত দুইজন, মাসফির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে প্রথমে বলৎকারের চেষ্টা ও পরে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। তারা নিজেদেরকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়ের) মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম জানান, ঘটনার পাঁচ মাস আগে শিশু ইফতেকার মালেকুল মাসফিকে আল্লামা শাহ অছিয়র রহমান মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিম খানায় ভর্তি করেছিল। শিশুটি মাদ্রাসার হেফজ খানার আবাসিকে থেকে লেখাপড়া করত।

চলতি বছরের গত ৫ই মার্চ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মাদ্রাসার শিক্ষক জাফর আহাম্মদ শিশুটির বাড়িতে গিয়ে বাবা মাকে জানান, শিশু মাসফিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ খবর শুনে শিশুটির অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন দ্রুত মাদ্রাসায় গিয়ে মাদ্রাসার আশপাশসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে শিশুটিকে পায়নি।

এক পর্যায়ে সকাল সোয়া ৮টার দিয়ে মাদ্রাসার দোতলায় স্টোর রুমের ভিতর দক্ষিণ কর্নারে কম্বল ও তোষক দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় তার গলাকাটা রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। এই ঘটনায় শিশুটির মামা মোঃ মাসুদ খাঁন বাদি হয়ে বোয়ালখালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি সবাই অজ্ঞাত।

আলোচিত এই মামলাটি পুলিশ হেডকোয়াটার্সের নির্মেশে গত ১৬ মার্চ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই চট্রগ্রাম জেলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআইয়ের চট্রগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের তদারকিতে মামলাটির জোর তদন্ত শুরু করা হয়। গত ১৮জুন শনিবার পিবিআইয়ের তদন্ত টিম মাদ্রাসার সকল ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদেরকে পিবিআইয়ের জেলা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ১২ বছর বয়সের দুইজন শিশু হত্যাকান্ডে জড়িতদের নাম পিবিআইয়ের কাছে (প্রকাশ) বলে দিয়েছে।

তাদের দেয়া তথ্য মতে, অভিযুক্ত দুই শিশুকে আটক করা হয়েছে। তাদের বয়স ১৫ বছর। তাদের মধ্যে একজনের ছদ্ম নাম আসাদ ও অন্যজনের নাম আহাদ। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত মর্মে স্বীকার করেছে। এরপর পিবিআইয়ের টিম তাদেরকে গ্রেফতার দেখিয়েছে।

হত্যাকান্ডের প্রাথমিক কারন হিসেবে জানা গেছে,মাদ্রাসাটি শিশুটির বাড়ির কাছে অবস্থিত। আর শিশুটির অভিবাবকরা প্রায় সময় বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার ও নাস্তা পাঠাত। কিন্তু শিশুটির জন্য মায়ের পাঠানো খাবার ও নাস্তা গুলো গ্রেফতারকৃত দুই শিশু খেয়ে ফেলত। এ বিষয়টি শিশু মাসফি তার বড় ভাই ইমতিয়াজ মালেকুল মাজেদকে জানিয়েছে। তখন বড় ভাই মাজেদ অভিযুক্ত শিশু আসাদকে খাবার না খেতে নিষেধ করেছে। একই ঘটনা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা জাফর আহম্মদকে বিষয়টি জানিয়েছে। এতে দুই অভিযুক্ত দুই শিশু ক্ষুর্ধ্ব হয়ে উঠে।

এরই জের হিসেবে ঘটনার দিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের সময় শিশুটিকে মাদ্রাসার দোতলায় কম্বল দিয়ে মুখ চেপে ধরে নির্যাতন করে। শিশুটি ভাত খেয়ে ফেলার কথা আর কাউকে কোন দিন বলবে না বলে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন। ওই সময় মাদ্রাসার বারান্দায় দাঁড়ানো অন্য দুই শিশু ঘটনাটি দেখে ফেলায় তাদেরকে নিচে চলে যেতে বলে। আর ঘটনাটি কাউকে যাতে না বলে এই জন্য হুমকি দেয়।

অভিযুক্ত ১৫ বছর বয়সের শিশু আসাদ মাসফিকে মাদ্রাসানর স্টোর রুমে ঢুকিয়ে দেয়ালের সঙ্গে মাথা সজোরে আঘাত করে। শিশূটি মাথায় আঘাত লেগে পড়ে গেলে অভিযুক্ত শিশু আহাদ শিশূ মাসফির পা চেপে ধরে আর আসাদ শিশুটিতে জবাই করে। এরপর কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রেখে আবার মাদ্রাসার নিচ তলায় হেফজ খানায় রুমে চলে যায়।

অভিযুক্ত শিশু আসাদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহ্নত ধারালো ছুরি,কম্বল,ট্রাংক ও লাশ ঢেকে রাখার ব্যানার উদ্ধার ও আলামত হিসেবে জব্দ করেছে।

গত রোববার দুই শিশুকে আদালতে হাজির করলে তারা স্বীকারোক্তি মূণলক জবানবন্দি দেয়। আর প্রত্যক্ষদর্শী শিশু আমান ও শিশু জামান (ছদ্মনাম) তারা আদালতে তাদের সাক্ষ্য দেয়। এই ভাবে মাদ্রাসার ভিতর চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।

এ দিকে গতকাল রাতে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সংবাদকে ফোনে জানান,হত্যার আগে মাদ্রাসার অভিযুক্ত দুই সিনিয়র ছাত্র (শিশু) মাসফিকে দোতলার রুমে চেপে ধরে বলৎকারের চেষ্টা করছে। বলৎকারে বাধা ও ঘটনাটি মাদ্রাসার হুজুরও বড় ভাইকে জানিতে দিবে বললে তাকে দেয়ালের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে শিশু মাসফি অচেতন হয়ে যায়। এরপর অভিযুক্ত এক শিশু তার বুকের উপর বসে চেপে ধরে। আরেক শিশু হাত পা চেপে ধরে জবাই করেছে। শুধু তাই জবাই করার পর লাশ টেনে হেচড়ে আরেক জায়গায় নিয়ে ঘুমকরার উদ্দেশ্যে ফেলে রাখে।

পিবিআই জানান,থানা পুলিশ তদন্ত কালে মাদ্রাসার মাদ্রাসার তিনজন শিক্ষককে (হুজুর) আটক করেছিল। তারা ঘটনায় জড়িত নয়। পিবিআই তদন্ত পেয়ে ১৫ থেকে ১৬ দিনের মাথায় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রকে জিজ্ঞাসবাদ করলে হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসে। আর শিশুকে বলৎকার করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ টেস্ট করার জন্য আলামত ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাইলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আমাদের চট্রগ্রাম অফিস থেকে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নে চরণদ্বীপ দরবার শরীফ মাদ্রাসাটি পরিচালনা করত। নিহত ইফতেখার মালিকুল মাসফি (৭) চরণদ্বীপ ইউনিয়নের ফকিরাখালী গ্রামের প্রবাসী আব্দুল মালেকের ছেলে। সে ওই মাদরাসার হেফজখানা বিভাগের কায়দা শাখার ছাত্র ছিল।

চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানান, তদন্তভার পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তিগত কোনো ক্লু নেই, মাদরাসার সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গত ১৪ জুন পিবিআইয়ের একটি টিম মাদরাসায় গিয়ে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

গত ১৭ জুন পিবিআই টিমের কাছে তথ্য আসে যে, একজন ছাত্র খুনের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন এবং সে বিষয়টি জানাতে রাজি হয়েছে। অভিভাবকের মাধ্যমে গত শুক্রবার রাতে ১০ বছর বয়সী হেফজ বিভাগের ওই ছাত্রকে পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

ওই ছাত্র জানায়, তার সঙ্গে আরও একজন সহপাঠী ঘটনা দেখেছে। অভিভাবকের মাধ্যমে তাকেও এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই টিম। দু’জনের বর্ণনা অভিন্ন হওয়ার পর তাদের তথ্য অনুযায়ী ঘটনায় জড়িত দুই ছাত্রকে শনিবার আটক করে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়। দু’জনের বয়স ১৫ বছর। তারা ওই মাদরাসার সবচেয়ে সিনিয়র তিন ছাত্রের মধ্যে দু’জন এবং দুরুদ বিভাগের ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে দু’জন হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে বলে জানান পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।

হত্যাকান্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই টিমের সদস্য পরিদর্শক মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, দুই ছাত্র জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিহত মাসফি এবং তাদের বাড়ি একই এলাকায়। মাশফির জন্য তার বাসা থেকে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার পাঠাত। এই দু’জন সেই খাবার জোরপূর্বক খেয়ে ফেলত। মাশফি তার বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। তখন বড় ভাই ক্ষুব্ধ হয়ে মাদারাসায় এসে দু’জনকে বকাঝকা করে এবং তিনি বিষয়টি শিক্ষক জাফরকেও জানিয়ে দেন। জাফরও তাদের ধমক দেয়। এতে দু’জনের ক্ষোভ জমে মাশফির ওপর। সেই ক্ষোভ থেকেই হত্যাকান্ড।

পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ঘটনার দিন মাদরাসায় ক্লাস চলছিল। কিন্তু গ্রেফতার দু’জনের একজন মাশফিকে নিয়ে দোতলায় স্টোররুমে যায়। আরেকজন গিয়ে তাদের সেখানে শুয়ে থাকতে দেখে। আমাদের ধারণা, প্রথমজন মাশফিকে জোরপূর্বক বলাৎকার করেছে। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা মুশকিল। বিষয়টি অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকারও করেনি। যা-ই হোক, দ্বিতীয়জন দেখার পর মাশফি লজ্জা পেয়ে বিষয়টি শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। মাশফিকে জবাইয়ে ব্যবহৃত ছোরাটি গ্রেফতারকৃত একজনের পোশাকের বাক্স থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।

##