ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যম

মোস্তাফা জব্বার

সাত ॥

১৯৮৭ সালে আমি যখন ডিটিপি বিপ্লব শুরু করি, তখন অনেকেই কম্পিউটারের সঙ্গে ডিটিপির সংশ্লিষ্টতাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। একে অনেকেই মুদ্রণ সেবার কাজ বলে মনে করতেন। কিন্তু এখন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এই একটি মাত্র খাত দেশের ভেতরে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে। এই খাতেই আমাদের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ। এই খাতে আমাদের দক্ষতাও বিশ্বমানের। এখানে আমরা বুয়েট থেকে পাস করা সফটওয়্যার প্রকৌশলী ব্যবহার করিনি। বরং সাধারণ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখানে অত্যন্ত চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। আফতাব আইটির যেসব ছেলেকে আমরা (আনন্দ মাল্টিমিডিয়া) প্রশিক্ষণ দিয়েছি তারা সাধারণভাবে লেখাপড়া জানা তরুণ। শুরুতে আফতাব আইটি মনে করেছিল যে, তাদের কোয়ার্ক এক্সপ্রেস শেখানোর জন্য ডেনিস বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে। ডেনমার্ক থেকে তারা বিশেষজ্ঞ নিয়েও এসেছিল।

কিন্তু আমাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের দেখে ডেনিস বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়েছেন। পরবর্তীতে তাদেরকে ডেনিশ ভাষা শেখা এবং ডেনমার্ক সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আফতাব আইটি এদের জন্যই ২.৬৫ কোটি টাকার অনুদান পেয়ে যায়- ডিটিপি খাতের মতো একটি নন কম্পিউটিং খাতে। খুশি হবো, এখান থেকেও আমাদের বিশেষজ্ঞ বা নীতিনির্ধারকগণ যদি শিক্ষাগ্রহণ করেন। অনেকেই সিএসএল সফটওয়্যার রিসোর্স কর্তৃক তৈরি করা মন্টু মিয়ার অভিযান একুশে টিভিতে দেখেছেন। যারা দেখেছেন তারা মন্তব্য করেছেন যে, আমাদের ত্রিমাত্রিক এনিমেশনের কাজও দুর্বল নয়। মন্টু মিয়ার মান নিয়ে প্রচুর প্রশংসা শুনেছি আমরা। মন্টু মিয়ার গল্পগুলো তেমন ভালো ছিল না, কেউ কেউ একথা বললেও এর নির্মাণ ও কারিগরি মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেননি। একুশে তখন বন্ধ না হলে আমরা এক্ষেত্রে একটি ব্যাপক সাফল্যের কাহিনী পেতাম। এটি একদিকে অন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে উৎসাহিত করতো, ত্রিমাত্রিক এনিমেশন প্রচার করার জন্য, অন্যদিকে আমরা এর উপর ভিত্তি করে রপ্তানী বাজারে প্রবেশ করতে পারতাম। তবে একুশে বন্ধ হলেও এক্ষেত্রে হতাশ হবার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। সম্প্রতি বেসিস সভাপতি ও ডাটাসফটের এমডি মাহবুব জামান সাহেব ইউরোপ থেকে ফিরে এসে জানালেন যে, ইউরোপে তারা ব্যাপকভাবে এ ধরনের কাজের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি নিজে যদিও ব্যবসায় সফটওয়্যার নিয়ে এক সময়ে অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন, এখন তার মনে হচ্ছে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনের জগতটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় আর অবশিষ্ট নেই।

অ্যানিমেশনেই সুবর্ণ সময়: বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বড় ধরনের অর্জন তেমন খুব বেশি নেই। আমরা বিস্ময়করভাবে দুয়েকটি কাজ হয়তো করেছি। রিভ সিস্টেমস নামক একটি কোম্পানি তাদের মোবাইলকেন্দ্রিক সফটওয়্যার দিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়েছে। সিঙ্গাপুরে অফিস করে তারা ব্যবসা করছে সারা দুনিয়াতে। আনন্দ কম্পিউটার্স তার বাংলা সফটওয়্যার দিয়ে ভারতের বাংলা ও আসামি ভাষার অঞ্চলসমূহ ও বাংলাদেশি অধ্যুষিত দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এই সফটওয়্যার ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তবে আমরা বোধহয় অনেক বেশি সফলতা পাচ্ছি মাল্টিমিডিয়াতে। আমাদের সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রপ্তানির সিংহভাগ আসে গ্রাফিক্স থেকে। আলাদাভাবে মাল্টিমিডিয়ায় আমাদের অর্জনও একেবারে কম নয়। আমাদের ডিকোড নামক একটি প্রতিষ্ঠান কানাডার জন্য কার্টুন বানিয়েছে। আনন্দ কম্পিউটার্স ডেনমার্কের জন্য শিশুশিক্ষা সফটওয়্যার বানিয়েছে। আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাজশাহী ক্যাম্পাস বানিয়েছে ত্রিমাত্রিক গেম। এই গেমটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিও হয়েছে। আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাঙ্গামাটি ক্যাম্পাস শিশুশিক্ষামূলক সফটওয়্যার বানিয়েছিল। বেসিস তাদেরকে পুরস্কৃতও করেছে।

সম্প্রতি হাতিরঝিল নামের একটি গেম বাজারে এসেছে। ওরা একাত্তরকেও গেম বানাচ্ছে। তবে মাল্টিমিডিয়ার একটি বিশাল কাজ হচ্ছে বিজয় ডিজিটালের হাতে। এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মাঝে বিজয় শিশুশিক্ষা নামে দুটি, বিজয় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নামে একটি ও বিজয় প্রাথমিক শিক্ষা নামে পাঁচটি মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার বানিয়ে শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটাল যাত্রাকে অনেক দূর সামনে নিয়ে গেছে। ত্রিমাত্রিক নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি এখন কানাডার দ্বিমাত্রিক সিনেমা বানিয়েছে। ওরা ১৩ পর্বের একটি দ্বিমাত্রিক সিরিয়ালও তৈরি করেছে। বাংলাদেশের টিভি পর্দায় এখন দেখা যায় অ্যানিমেটেড বিজ্ঞাপন। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, বাংলাদেশের ছেলে নাফিস বিন জাফর সিনেমার জন্য তৈরি করা কম্পিউটারের বিশেষ এফেক্টসের জন্য দুইবার অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন।

এরই মাঝে আপনাদের চোখে পড়তে পারে যে, কার্টুন নেটওয়ার্ক ইন্ডিয়া.কম এবং নিকোলোডিয়ান নামক দুটি টিভি চ্যানেল অবিরত দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক শিশুতোষ চিত্র প্রচার করে এই অঞ্চলে এ ধরনের চলচ্চিত্রের ব্যাপক বাজার তৈরি করে ফেলেছে। বস্তুত বিশ্বব্যাপী এই বাজার এতো বড় যে তার হিসাব করে উঠা কঠিন।

নাসকমের মতে ভারত বিশ্বের একটি বিশাল অ্যানিমেশন বাজারের অতি ক্ষুদ্র অংশ দখল করেছে। জাপান- কোরিয়া, ফিলিপাইন এসব দেশে এ ধরনের কাজ করার ব্যাপক আয়োজন চলছে। বিশেষ করে জাপানে দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন রপ্তানি করার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ¦ল। ভারত যেসব দেশের কাজ করে সেইসব দেশের কাজ করার সম্ভাবনার পাশাপাশি আমাদের নিজেদের দেশের ভেতরের বাজার নিয়েও ভাবা যায়। আমি খুব অবাক হয়েছি এটি অনুভব করে যে, আমাদের দেশের সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর কারও মাথায় দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনভিত্তিক বিনোদনের কথা কেন ভাবেনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যদি শুধুমাত্র টুডি অ্যানিমেশনের শতকরা ৫ ভাগ বাজার দখল করতে পারে তবে এই খাতের আয় বিদ্যমান সকল খাতের চাইতে অনেক বেশি হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেছে যে এই চমৎকার খাতটিকে কেন্দ্র করে আমরা কি যথাযথ উদ্যোগ নিতে পেরেছি?

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যানিমেশন বা গ্রাফিক্স নিয়ে আমাদের আরো একটি বড় সুবিধা হলো যে, এতে তথাকথিত প্রোগ্রামারের প্রয়োজন নেই। অতি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা কেবল তাদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়েই এই খাতে শ্রেষ্ঠতম দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারে।

এই খাতের বাজারও কমছে না। ১১ সেপ্টেম্বরের পর উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব আইসিটি খাতেও পড়ে, কিন্তু এই বাজারটি একদম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং প্রতিদিনই এই বাজারের সীমানা বাড়ছে। কেবলমাত্র তরুণদের জন্য চিত্রনির্মাণ নয়, এই খাতের কাজের সীমানা, বিজ্ঞাপন চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজার সফটওয়্যার ও সেবাখাতের যেকোনটির চেয়ে বেশি হতে যাচ্ছে এই একটি খাতই। কিন্তু আরো বেশি সম্ভাবনা সম্ভবত ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনে হতে পারে।

আমি এখানে ২০১৩ সালে ভারতের অ্যানিমেশন বাজার কেমন ছিল তার একটি সূত্র তুলে ধরছি। এর আকারটার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই খাতে ভারতে ৮০ হাজার মানুষ কর্মরত রয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতে ৬৫০টি অ্যানিমেশন স্টুডিও রয়েছে।

যদিও বাংলাদেশের বাজারের কথা আমরা জানি না এবং ভারতের সঙ্গে তূলনা করার মতো কোন তথ্যই আমাদের নেই তথাপি আমরা আমাদের সম্ভাবনার কথাটি অবশ্যই স্মরণে রাখতে পারি।

আরো সরাসরি বলতে গেলে কম্পিউটার জেনারেটেড অ্যানিমেশন এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। ফাইনাল ফ্যান্টাসি, ডিজিটাল ইটি, মনস্টার ইনক, আইস এজ, জুরাসিক পার্ক-৩, টয় স্টরি, টয় স্টরি- ২, বাগস লাইফ, এন্টজ (এন্ট-জি), প্রিন্স অব ইজিপ্ট, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান ইত্যাদি চলচ্চিত্র বা টাইটানিক, টার্মিনেটর টু, জুরাসিক পার্ক, গডজিলা ইত্যাদি ছবির বদৌলতে আমরা জেনে গেছি যেÑ ক্যামেরা, লাইট, ফিল্ম, এক্টর, এক্ট্রেস এসব ছাড়াই চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। ডিজিটাল মুভি নিয়ে যদি কিছু জানার থাকে তবে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সিমওয়ান ছবিটি দেখা যায়। এমনকি সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত রা ওয়ান ছবির ডিজিটাল এফেক্টস চোখে পড়ার মতো।

প্রতিদিন আমরা মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এমনকি টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান দেখে বুঝতে সক্ষম হচ্ছি যে একটি নতুন দিগন্ত ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। শিশুদের কাছে একসময়ে টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক যেমনি প্রিয় ছিল (এখনো সেসব শিশুদের খুবই প্রিয়) তেমনি এখন পোকেমন, ড্রাগন বল, জ্যাকি চান, ডোরেমন- ইত্যাদি আরো বেশি প্রিয় হচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, একসময়ে এই জগতে যেখানে কেবলমাত্র মার্কিনী চরিত্র বা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল সেখানে জাপানিদের ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এমনকি ভারত পান্ডবাস (পঞ্চ পা-বের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনী) নামক একটি অ্যানিমেশন চিত্র কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে তৈরি হওয়া বুগাবুগা বা কোকো যদি বিশ্ব বাজারে পরিচিত হয়ে উঠে, যদি আমাদের ত্রিমাত্রিক গেম অরুণোদয়ের অগ্নিশিখা (আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাজশাহী ক্যাম্পাসের তৈরি করা) নিউইয়র্কের বাজারে পা ফেলে তবে আমরা অবশ্যই ভাববো কেবল কোড লেখার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে আর বেশি দিন বসে থেকে লাভ নেই।

এক সময়ে কম্পিউটার বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা এলগরিদম, লজিক, গেট, কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ ইত্যাদি নিয়েই কেবল মাথা ঘামাতেন। কিন্তু এখন দেখছি বুয়েটের প্রকৌশলী ছাত্ররা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন শিখছে বা অন্যরাও অ্যানিমেশনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমি তাদের ব্যাপকভাবে মায়া, থ্রিডি- ম্যাক্স, ফটোশপ, ইলাসট্রেটর এসব নিয়ে চর্চা করতে দেখছি। বস্তুত এক প্রবল পরিবর্তনের সূচনা করছে অ্যানিমেশন পরিপ্রেক্ষিত।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী]

মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২ , ৭ আষাড় ১৪২৮ ২১ জিলকদ ১৪৪৩

ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যম

মোস্তাফা জব্বার

সাত ॥

১৯৮৭ সালে আমি যখন ডিটিপি বিপ্লব শুরু করি, তখন অনেকেই কম্পিউটারের সঙ্গে ডিটিপির সংশ্লিষ্টতাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। একে অনেকেই মুদ্রণ সেবার কাজ বলে মনে করতেন। কিন্তু এখন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এই একটি মাত্র খাত দেশের ভেতরে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে। এই খাতেই আমাদের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ। এই খাতে আমাদের দক্ষতাও বিশ্বমানের। এখানে আমরা বুয়েট থেকে পাস করা সফটওয়্যার প্রকৌশলী ব্যবহার করিনি। বরং সাধারণ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখানে অত্যন্ত চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। আফতাব আইটির যেসব ছেলেকে আমরা (আনন্দ মাল্টিমিডিয়া) প্রশিক্ষণ দিয়েছি তারা সাধারণভাবে লেখাপড়া জানা তরুণ। শুরুতে আফতাব আইটি মনে করেছিল যে, তাদের কোয়ার্ক এক্সপ্রেস শেখানোর জন্য ডেনিস বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে। ডেনমার্ক থেকে তারা বিশেষজ্ঞ নিয়েও এসেছিল।

কিন্তু আমাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের দেখে ডেনিস বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়েছেন। পরবর্তীতে তাদেরকে ডেনিশ ভাষা শেখা এবং ডেনমার্ক সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আফতাব আইটি এদের জন্যই ২.৬৫ কোটি টাকার অনুদান পেয়ে যায়- ডিটিপি খাতের মতো একটি নন কম্পিউটিং খাতে। খুশি হবো, এখান থেকেও আমাদের বিশেষজ্ঞ বা নীতিনির্ধারকগণ যদি শিক্ষাগ্রহণ করেন। অনেকেই সিএসএল সফটওয়্যার রিসোর্স কর্তৃক তৈরি করা মন্টু মিয়ার অভিযান একুশে টিভিতে দেখেছেন। যারা দেখেছেন তারা মন্তব্য করেছেন যে, আমাদের ত্রিমাত্রিক এনিমেশনের কাজও দুর্বল নয়। মন্টু মিয়ার মান নিয়ে প্রচুর প্রশংসা শুনেছি আমরা। মন্টু মিয়ার গল্পগুলো তেমন ভালো ছিল না, কেউ কেউ একথা বললেও এর নির্মাণ ও কারিগরি মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেননি। একুশে তখন বন্ধ না হলে আমরা এক্ষেত্রে একটি ব্যাপক সাফল্যের কাহিনী পেতাম। এটি একদিকে অন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে উৎসাহিত করতো, ত্রিমাত্রিক এনিমেশন প্রচার করার জন্য, অন্যদিকে আমরা এর উপর ভিত্তি করে রপ্তানী বাজারে প্রবেশ করতে পারতাম। তবে একুশে বন্ধ হলেও এক্ষেত্রে হতাশ হবার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। সম্প্রতি বেসিস সভাপতি ও ডাটাসফটের এমডি মাহবুব জামান সাহেব ইউরোপ থেকে ফিরে এসে জানালেন যে, ইউরোপে তারা ব্যাপকভাবে এ ধরনের কাজের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি নিজে যদিও ব্যবসায় সফটওয়্যার নিয়ে এক সময়ে অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন, এখন তার মনে হচ্ছে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনের জগতটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় আর অবশিষ্ট নেই।

অ্যানিমেশনেই সুবর্ণ সময়: বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বড় ধরনের অর্জন তেমন খুব বেশি নেই। আমরা বিস্ময়করভাবে দুয়েকটি কাজ হয়তো করেছি। রিভ সিস্টেমস নামক একটি কোম্পানি তাদের মোবাইলকেন্দ্রিক সফটওয়্যার দিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়েছে। সিঙ্গাপুরে অফিস করে তারা ব্যবসা করছে সারা দুনিয়াতে। আনন্দ কম্পিউটার্স তার বাংলা সফটওয়্যার দিয়ে ভারতের বাংলা ও আসামি ভাষার অঞ্চলসমূহ ও বাংলাদেশি অধ্যুষিত দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এই সফটওয়্যার ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তবে আমরা বোধহয় অনেক বেশি সফলতা পাচ্ছি মাল্টিমিডিয়াতে। আমাদের সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রপ্তানির সিংহভাগ আসে গ্রাফিক্স থেকে। আলাদাভাবে মাল্টিমিডিয়ায় আমাদের অর্জনও একেবারে কম নয়। আমাদের ডিকোড নামক একটি প্রতিষ্ঠান কানাডার জন্য কার্টুন বানিয়েছে। আনন্দ কম্পিউটার্স ডেনমার্কের জন্য শিশুশিক্ষা সফটওয়্যার বানিয়েছে। আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাজশাহী ক্যাম্পাস বানিয়েছে ত্রিমাত্রিক গেম। এই গেমটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিও হয়েছে। আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাঙ্গামাটি ক্যাম্পাস শিশুশিক্ষামূলক সফটওয়্যার বানিয়েছিল। বেসিস তাদেরকে পুরস্কৃতও করেছে।

সম্প্রতি হাতিরঝিল নামের একটি গেম বাজারে এসেছে। ওরা একাত্তরকেও গেম বানাচ্ছে। তবে মাল্টিমিডিয়ার একটি বিশাল কাজ হচ্ছে বিজয় ডিজিটালের হাতে। এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মাঝে বিজয় শিশুশিক্ষা নামে দুটি, বিজয় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নামে একটি ও বিজয় প্রাথমিক শিক্ষা নামে পাঁচটি মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার বানিয়ে শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটাল যাত্রাকে অনেক দূর সামনে নিয়ে গেছে। ত্রিমাত্রিক নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি এখন কানাডার দ্বিমাত্রিক সিনেমা বানিয়েছে। ওরা ১৩ পর্বের একটি দ্বিমাত্রিক সিরিয়ালও তৈরি করেছে। বাংলাদেশের টিভি পর্দায় এখন দেখা যায় অ্যানিমেটেড বিজ্ঞাপন। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, বাংলাদেশের ছেলে নাফিস বিন জাফর সিনেমার জন্য তৈরি করা কম্পিউটারের বিশেষ এফেক্টসের জন্য দুইবার অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন।

এরই মাঝে আপনাদের চোখে পড়তে পারে যে, কার্টুন নেটওয়ার্ক ইন্ডিয়া.কম এবং নিকোলোডিয়ান নামক দুটি টিভি চ্যানেল অবিরত দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক শিশুতোষ চিত্র প্রচার করে এই অঞ্চলে এ ধরনের চলচ্চিত্রের ব্যাপক বাজার তৈরি করে ফেলেছে। বস্তুত বিশ্বব্যাপী এই বাজার এতো বড় যে তার হিসাব করে উঠা কঠিন।

নাসকমের মতে ভারত বিশ্বের একটি বিশাল অ্যানিমেশন বাজারের অতি ক্ষুদ্র অংশ দখল করেছে। জাপান- কোরিয়া, ফিলিপাইন এসব দেশে এ ধরনের কাজ করার ব্যাপক আয়োজন চলছে। বিশেষ করে জাপানে দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশন রপ্তানি করার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ¦ল। ভারত যেসব দেশের কাজ করে সেইসব দেশের কাজ করার সম্ভাবনার পাশাপাশি আমাদের নিজেদের দেশের ভেতরের বাজার নিয়েও ভাবা যায়। আমি খুব অবাক হয়েছি এটি অনুভব করে যে, আমাদের দেশের সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর কারও মাথায় দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনভিত্তিক বিনোদনের কথা কেন ভাবেনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যদি শুধুমাত্র টুডি অ্যানিমেশনের শতকরা ৫ ভাগ বাজার দখল করতে পারে তবে এই খাতের আয় বিদ্যমান সকল খাতের চাইতে অনেক বেশি হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেছে যে এই চমৎকার খাতটিকে কেন্দ্র করে আমরা কি যথাযথ উদ্যোগ নিতে পেরেছি?

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যানিমেশন বা গ্রাফিক্স নিয়ে আমাদের আরো একটি বড় সুবিধা হলো যে, এতে তথাকথিত প্রোগ্রামারের প্রয়োজন নেই। অতি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা কেবল তাদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়েই এই খাতে শ্রেষ্ঠতম দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারে।

এই খাতের বাজারও কমছে না। ১১ সেপ্টেম্বরের পর উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব আইসিটি খাতেও পড়ে, কিন্তু এই বাজারটি একদম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং প্রতিদিনই এই বাজারের সীমানা বাড়ছে। কেবলমাত্র তরুণদের জন্য চিত্রনির্মাণ নয়, এই খাতের কাজের সীমানা, বিজ্ঞাপন চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজার সফটওয়্যার ও সেবাখাতের যেকোনটির চেয়ে বেশি হতে যাচ্ছে এই একটি খাতই। কিন্তু আরো বেশি সম্ভাবনা সম্ভবত ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনে হতে পারে।

আমি এখানে ২০১৩ সালে ভারতের অ্যানিমেশন বাজার কেমন ছিল তার একটি সূত্র তুলে ধরছি। এর আকারটার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে এই খাতে ভারতে ৮০ হাজার মানুষ কর্মরত রয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতে ৬৫০টি অ্যানিমেশন স্টুডিও রয়েছে।

যদিও বাংলাদেশের বাজারের কথা আমরা জানি না এবং ভারতের সঙ্গে তূলনা করার মতো কোন তথ্যই আমাদের নেই তথাপি আমরা আমাদের সম্ভাবনার কথাটি অবশ্যই স্মরণে রাখতে পারি।

আরো সরাসরি বলতে গেলে কম্পিউটার জেনারেটেড অ্যানিমেশন এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। ফাইনাল ফ্যান্টাসি, ডিজিটাল ইটি, মনস্টার ইনক, আইস এজ, জুরাসিক পার্ক-৩, টয় স্টরি, টয় স্টরি- ২, বাগস লাইফ, এন্টজ (এন্ট-জি), প্রিন্স অব ইজিপ্ট, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান ইত্যাদি চলচ্চিত্র বা টাইটানিক, টার্মিনেটর টু, জুরাসিক পার্ক, গডজিলা ইত্যাদি ছবির বদৌলতে আমরা জেনে গেছি যেÑ ক্যামেরা, লাইট, ফিল্ম, এক্টর, এক্ট্রেস এসব ছাড়াই চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। ডিজিটাল মুভি নিয়ে যদি কিছু জানার থাকে তবে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সিমওয়ান ছবিটি দেখা যায়। এমনকি সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত রা ওয়ান ছবির ডিজিটাল এফেক্টস চোখে পড়ার মতো।

প্রতিদিন আমরা মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এমনকি টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান দেখে বুঝতে সক্ষম হচ্ছি যে একটি নতুন দিগন্ত ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। শিশুদের কাছে একসময়ে টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক যেমনি প্রিয় ছিল (এখনো সেসব শিশুদের খুবই প্রিয়) তেমনি এখন পোকেমন, ড্রাগন বল, জ্যাকি চান, ডোরেমন- ইত্যাদি আরো বেশি প্রিয় হচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, একসময়ে এই জগতে যেখানে কেবলমাত্র মার্কিনী চরিত্র বা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল সেখানে জাপানিদের ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এমনকি ভারত পান্ডবাস (পঞ্চ পা-বের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনী) নামক একটি অ্যানিমেশন চিত্র কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে তৈরি হওয়া বুগাবুগা বা কোকো যদি বিশ্ব বাজারে পরিচিত হয়ে উঠে, যদি আমাদের ত্রিমাত্রিক গেম অরুণোদয়ের অগ্নিশিখা (আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার রাজশাহী ক্যাম্পাসের তৈরি করা) নিউইয়র্কের বাজারে পা ফেলে তবে আমরা অবশ্যই ভাববো কেবল কোড লেখার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে আর বেশি দিন বসে থেকে লাভ নেই।

এক সময়ে কম্পিউটার বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা এলগরিদম, লজিক, গেট, কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ ইত্যাদি নিয়েই কেবল মাথা ঘামাতেন। কিন্তু এখন দেখছি বুয়েটের প্রকৌশলী ছাত্ররা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন শিখছে বা অন্যরাও অ্যানিমেশনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমি তাদের ব্যাপকভাবে মায়া, থ্রিডি- ম্যাক্স, ফটোশপ, ইলাসট্রেটর এসব নিয়ে চর্চা করতে দেখছি। বস্তুত এক প্রবল পরিবর্তনের সূচনা করছে অ্যানিমেশন পরিপ্রেক্ষিত।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী]