বাংলাদেশের এনজিও ব্যবস্থাপনার মূল সমস্যা কী

ডোরিন চৌধুরী

গত শতাব্দীর শেষভাগ থেকে গোটা বিশ্বেই এনজিওর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশে নিবন্ধন নিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার এনজিও। এসময় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এসব এনজিও অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। বিদেশি এনজিওর আগমনের পাশাপাশি দেশেও বড় হয়েছে অনেক এনজিও, এক্ষেত্রে ব্র্যাকের কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। অনেক সফলতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের এনজিও সেক্টরের ধীরে ধীরে গায়ে লেগেছে অনেক কালিমাও। দেশের এনজিও ব্যবস্থাপনায় ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। বাংলাদেশের এনজিও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সমস্যা গুলো এই মুহূর্তে আসলে কি এবং কতটা মারাত্মক তা জানাটা বেশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনজিওর সঙ্গে জড়িত একটি বড় সমস্যা বিদেশি অর্থায়নের তাবেদারি। বিদেশ থেকে অর্থ আনতে গিয়ে প্রায়ই এনজিওগুলো দাতাদের দেয়া শর্ত ও সংস্কৃতির আমদানি ঘটাচ্ছে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে। ফলে, প্রায়ই এনজিও কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চেতনার সংঘাত দেখা যায়। আবার, কার্যক্রম চলমান রাখতে প্রায়ই সংস্থাগুলো সমস্যা সমাধানের চাইতে জিইয়ে রাখায় বেশি মনোযোগী হয়। যেমনটা দেখা গিয়েছে ভাসানচর প্রকল্পের ক্ষেত্রে। অনেক এনজিওই তাদের কার্যক্রম কমে যেতে পারে এই ভাবনা থেকে প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিল।

এনজিও সম্পর্কে আরেকটি বড় সমালোচনা হলো সংস্থা পরিচালনায় অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা। খোদ রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই এর চিত্র দেখা যায়। এনজিওর কার্যক্রম শুরু পর থেকেই কক্সবাজারে বিলাসবহুল হোটেল এবং রেস্তোরাঁর সংখ্যা বাড়ছে কর্মকর্তাদের আবাসন ও চাহিদা মেটাতে। কর্মকর্তারা যখন দাতা সংস্থার অর্থে টেকনাফের বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন, ঠিক তখন তাদের দেয়া রিলিফের আশায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। দাতাদের কাছে জবাবদিহি থাকলেও জবাবদিহি নেই দান যাদের জন্য আসছে তাদের কাছে।

এনজিও ব্যবস্থাপনায় বেড়েছে স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। সাধারণত, এনজিওগুলোর কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া, লোকাল এনজিওগুলোর অনেকগুলোই অনেকটা পারিবারিক ব্যবসার মতো করে চালানো হয়। ফলে, উপরে বসা বড় কর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকে স্বেচ্ছাচারিতা, মানা হয় না রুটিন মিটিং নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর তথ্যমতে, ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ৮৫% ক্ষেত্রেই আত্মীয়-স্বজনের নিয়োগ, ৯৫% শতাংশ ক্ষেত্রে রুটিন মিটিং না করা এবং ৮৫% ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতার চিত্র দেখা যায়। এছাড়া বড় কর্তাদের দাপট বৃদ্ধির ফলে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রায় ৭৫% ক্ষেত্রেই অধস্তন কর্মকর্তাদের মতামত নেয়া হয় না। এছাড়া, এনজিওগুলোকে জেঁকে বসেছে স্বচ্ছতার অভাব। যদিও প্রতি বছর নিয়মমাফিক প্রায় সব এনজিওই অডিট করে থাকে, তবে সেই অডিট কেবলই নামমাত্র। অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেক সময়ই তাদের মক্কেল হারানোর চিন্তা থেকে অডিটে ছলচাতুরী করতে বাধ্য হয়। একই ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্পের কর্মী হিসেবে দেখিয়ে অর্থ নেয়াও বেশ সাধারণ ঘটনাই হয়ে গেছে। টিআইবির মতে, ৮৫% ক্ষেত্রেই আর্থিক হিসেবের রিপোর্টে অতিরঞ্জন থাকে এবং একাউন্টেন্টরা স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পান না। এছাড়া, দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাবের একটি বড় জায়গা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পগুলো। ঋণের কিস্তি তোলার সময় প্রায়ই নির্মম সব পদ্ধতির পাশাপাশি তোয়াক্কা করা হয় না নীতিমালাকে। এছাড়া, এনজিও ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা অতিরঞ্জন এবং অত্যধিক গোপনীয়তা। জনপরিসরে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো বেশ রূঢ়। ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিগোপনীয়তা। আবার নিজেদের প্রচারণা এবং সুবিধা ভোগের জন্য প্রায়ই এনজিও ব্যুরো এবং গণমাধ্যমকে অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। টিআইবির মতে, ৮৫% ক্ষেত্রেই তথ্যের অভাব রয়েছে এবং প্রায় ৮০% সময় অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন জমা দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। এধরনের ক্ষতিকর চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ায় বাড়ে অর্থনৈতিক দুর্নীতি এবং জন্ম দিতে পারে নিরাপত্তা প্রশ্নের।

সম্প্রতি অধিকারের লাইসেন্স নবায়ন বাতিল প্রসঙ্গেও অনিয়ম আর স্বচ্ছতার অভাবের বাস্তবিক চিত্র দেখা যায়। দেশে বিদেশে অধিকারে পক্ষে ব্যাপক জনমত থাকলেও একথা অস্বীকারে উপায় নেই যে অধিকারে বিরুদ্ধে এনজিও ব্যুরোর আনা অভিযোগ খ-ানো হয়নি এখনো। এনজিও ব্যুরোর দাবি, গত ৭ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও, বেশ কয়েকটি নীতিমালা ভঙ্গেরও অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় না করা, যা এনজিও নীতিমালা-২০১৬-র ৮ ধারার লঙ্ঘন। এছাড়া, অধিকার তার বিরুদ্ধে আনা ৮টি প্রকল্পের অডিট আপত্তির সঠিক জবাব দিতে পারেনি। এছাড়া কর ফাঁকি এবং অর্থ লেনদেনে ব্যক্তিগত একাউন্ট ব্যবহারের অভিযোগও নিষ্পত্তি করেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে হেফাজতের তান্ডবের পর মৃতের সংখ্যা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে এখনো অতিরঞ্জনের অভিযোগে একটি মামলা চলমান রয়েছে।

এনজিও ব্যুরোর দাবি, এনজিও নীতিমালা ২০১৬-এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী তারা অধিকারের গত ১০ বছরের একটি পর্যালোচনা করেছে এবং এসব অভিযোগের ভিত্তিতে নবায়নের আবেদন বাতিল করেছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক বিবেচনার বাহিরেও অধিকারের ক্ষেত্রে এনজিও ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাবের জায়গাটি কোনভাবেই নাকচ করা যায় না। এছাড়াও এনজিওর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ঘুষ প্রদান, অধস্তন কর্মচারীদের চাকরির অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি, নিয়োগ ও পদন্নোতিতে স্বজনপ্রীতি, অস্বাভাবিক মূল্যে প্রতিষ্ঠানের মালামাল ক্রয় এবং বড় কর্তাদের কর ফাঁকি দেয়ার মতো বিষয়গুলো।

প্রখ্যাত উত্তর-উপনিবেশবাদী দার্শনিক মাহমুদ মামদানি একবার বলেছিলেন, এনজিওগুলো আমাদের সুশীল সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভারতীয় অধ্যাপক নীরা চান্দোকিও তার লেখায় এনজিওর স্বচ্ছতার অভাবসহ নানা বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। ক্রিটিকাল স্কুলের দার্শনিকদের এনজিও নিয়ে এমন আলোচনার ফলে এনজিওর ভূমিকা নিয়ে প-িতদের তর্কবিতর্ক এখন আর নতুন নয়। তবুও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওর অবদানের কথা চিন্তা করে বিতর্কগুলোকে আমরা অগ্রাহ্য করতেই পারি। কিন্তু, একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই, গত তিন দশকে এনজিওর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়লেও আমরা তৈরি করতে পারি নি আদর্শ ব্যবস্থাপনা এবং নীতিমালা। ফলে গোটা সেক্টর পড়তে যাচ্ছে হুমকির মুখে। সুশীল সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এনজিওগুলোর উচিত হবে তাদের ব্যাবস্থাপনায় ব্যপক পরিবর্তন আনা, দুর্নীতির পথ বন্ধ করা এবং স্বচ্ছতার জায়গা বিস্তৃত করা। নতুবা, কেবল বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বের এনজিও ব্যবস্থাই হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভবিষ্যতে।

[লেখক : ডক্টরাল গবেষক,

গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]

মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০২২ , ৭ আষাড় ১৪২৮ ২১ জিলকদ ১৪৪৩

বাংলাদেশের এনজিও ব্যবস্থাপনার মূল সমস্যা কী

ডোরিন চৌধুরী

গত শতাব্দীর শেষভাগ থেকে গোটা বিশ্বেই এনজিওর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশে নিবন্ধন নিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার এনজিও। এসময় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এসব এনজিও অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। বিদেশি এনজিওর আগমনের পাশাপাশি দেশেও বড় হয়েছে অনেক এনজিও, এক্ষেত্রে ব্র্যাকের কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। অনেক সফলতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের এনজিও সেক্টরের ধীরে ধীরে গায়ে লেগেছে অনেক কালিমাও। দেশের এনজিও ব্যবস্থাপনায় ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। বাংলাদেশের এনজিও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সমস্যা গুলো এই মুহূর্তে আসলে কি এবং কতটা মারাত্মক তা জানাটা বেশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনজিওর সঙ্গে জড়িত একটি বড় সমস্যা বিদেশি অর্থায়নের তাবেদারি। বিদেশ থেকে অর্থ আনতে গিয়ে প্রায়ই এনজিওগুলো দাতাদের দেয়া শর্ত ও সংস্কৃতির আমদানি ঘটাচ্ছে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে। ফলে, প্রায়ই এনজিও কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চেতনার সংঘাত দেখা যায়। আবার, কার্যক্রম চলমান রাখতে প্রায়ই সংস্থাগুলো সমস্যা সমাধানের চাইতে জিইয়ে রাখায় বেশি মনোযোগী হয়। যেমনটা দেখা গিয়েছে ভাসানচর প্রকল্পের ক্ষেত্রে। অনেক এনজিওই তাদের কার্যক্রম কমে যেতে পারে এই ভাবনা থেকে প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিল।

এনজিও সম্পর্কে আরেকটি বড় সমালোচনা হলো সংস্থা পরিচালনায় অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা। খোদ রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই এর চিত্র দেখা যায়। এনজিওর কার্যক্রম শুরু পর থেকেই কক্সবাজারে বিলাসবহুল হোটেল এবং রেস্তোরাঁর সংখ্যা বাড়ছে কর্মকর্তাদের আবাসন ও চাহিদা মেটাতে। কর্মকর্তারা যখন দাতা সংস্থার অর্থে টেকনাফের বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন, ঠিক তখন তাদের দেয়া রিলিফের আশায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। দাতাদের কাছে জবাবদিহি থাকলেও জবাবদিহি নেই দান যাদের জন্য আসছে তাদের কাছে।

এনজিও ব্যবস্থাপনায় বেড়েছে স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। সাধারণত, এনজিওগুলোর কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া, লোকাল এনজিওগুলোর অনেকগুলোই অনেকটা পারিবারিক ব্যবসার মতো করে চালানো হয়। ফলে, উপরে বসা বড় কর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকে স্বেচ্ছাচারিতা, মানা হয় না রুটিন মিটিং নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর তথ্যমতে, ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ৮৫% ক্ষেত্রেই আত্মীয়-স্বজনের নিয়োগ, ৯৫% শতাংশ ক্ষেত্রে রুটিন মিটিং না করা এবং ৮৫% ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতার চিত্র দেখা যায়। এছাড়া বড় কর্তাদের দাপট বৃদ্ধির ফলে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রায় ৭৫% ক্ষেত্রেই অধস্তন কর্মকর্তাদের মতামত নেয়া হয় না। এছাড়া, এনজিওগুলোকে জেঁকে বসেছে স্বচ্ছতার অভাব। যদিও প্রতি বছর নিয়মমাফিক প্রায় সব এনজিওই অডিট করে থাকে, তবে সেই অডিট কেবলই নামমাত্র। অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেক সময়ই তাদের মক্কেল হারানোর চিন্তা থেকে অডিটে ছলচাতুরী করতে বাধ্য হয়। একই ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্পের কর্মী হিসেবে দেখিয়ে অর্থ নেয়াও বেশ সাধারণ ঘটনাই হয়ে গেছে। টিআইবির মতে, ৮৫% ক্ষেত্রেই আর্থিক হিসেবের রিপোর্টে অতিরঞ্জন থাকে এবং একাউন্টেন্টরা স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পান না। এছাড়া, দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাবের একটি বড় জায়গা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পগুলো। ঋণের কিস্তি তোলার সময় প্রায়ই নির্মম সব পদ্ধতির পাশাপাশি তোয়াক্কা করা হয় না নীতিমালাকে। এছাড়া, এনজিও ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা অতিরঞ্জন এবং অত্যধিক গোপনীয়তা। জনপরিসরে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো বেশ রূঢ়। ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিগোপনীয়তা। আবার নিজেদের প্রচারণা এবং সুবিধা ভোগের জন্য প্রায়ই এনজিও ব্যুরো এবং গণমাধ্যমকে অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। টিআইবির মতে, ৮৫% ক্ষেত্রেই তথ্যের অভাব রয়েছে এবং প্রায় ৮০% সময় অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন জমা দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। এধরনের ক্ষতিকর চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ায় বাড়ে অর্থনৈতিক দুর্নীতি এবং জন্ম দিতে পারে নিরাপত্তা প্রশ্নের।

সম্প্রতি অধিকারের লাইসেন্স নবায়ন বাতিল প্রসঙ্গেও অনিয়ম আর স্বচ্ছতার অভাবের বাস্তবিক চিত্র দেখা যায়। দেশে বিদেশে অধিকারে পক্ষে ব্যাপক জনমত থাকলেও একথা অস্বীকারে উপায় নেই যে অধিকারে বিরুদ্ধে এনজিও ব্যুরোর আনা অভিযোগ খ-ানো হয়নি এখনো। এনজিও ব্যুরোর দাবি, গত ৭ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও, বেশ কয়েকটি নীতিমালা ভঙ্গেরও অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় না করা, যা এনজিও নীতিমালা-২০১৬-র ৮ ধারার লঙ্ঘন। এছাড়া, অধিকার তার বিরুদ্ধে আনা ৮টি প্রকল্পের অডিট আপত্তির সঠিক জবাব দিতে পারেনি। এছাড়া কর ফাঁকি এবং অর্থ লেনদেনে ব্যক্তিগত একাউন্ট ব্যবহারের অভিযোগও নিষ্পত্তি করেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে হেফাজতের তান্ডবের পর মৃতের সংখ্যা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে এখনো অতিরঞ্জনের অভিযোগে একটি মামলা চলমান রয়েছে।

এনজিও ব্যুরোর দাবি, এনজিও নীতিমালা ২০১৬-এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী তারা অধিকারের গত ১০ বছরের একটি পর্যালোচনা করেছে এবং এসব অভিযোগের ভিত্তিতে নবায়নের আবেদন বাতিল করেছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক বিবেচনার বাহিরেও অধিকারের ক্ষেত্রে এনজিও ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাবের জায়গাটি কোনভাবেই নাকচ করা যায় না। এছাড়াও এনজিওর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ঘুষ প্রদান, অধস্তন কর্মচারীদের চাকরির অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি, নিয়োগ ও পদন্নোতিতে স্বজনপ্রীতি, অস্বাভাবিক মূল্যে প্রতিষ্ঠানের মালামাল ক্রয় এবং বড় কর্তাদের কর ফাঁকি দেয়ার মতো বিষয়গুলো।

প্রখ্যাত উত্তর-উপনিবেশবাদী দার্শনিক মাহমুদ মামদানি একবার বলেছিলেন, এনজিওগুলো আমাদের সুশীল সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভারতীয় অধ্যাপক নীরা চান্দোকিও তার লেখায় এনজিওর স্বচ্ছতার অভাবসহ নানা বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। ক্রিটিকাল স্কুলের দার্শনিকদের এনজিও নিয়ে এমন আলোচনার ফলে এনজিওর ভূমিকা নিয়ে প-িতদের তর্কবিতর্ক এখন আর নতুন নয়। তবুও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওর অবদানের কথা চিন্তা করে বিতর্কগুলোকে আমরা অগ্রাহ্য করতেই পারি। কিন্তু, একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই, গত তিন দশকে এনজিওর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়লেও আমরা তৈরি করতে পারি নি আদর্শ ব্যবস্থাপনা এবং নীতিমালা। ফলে গোটা সেক্টর পড়তে যাচ্ছে হুমকির মুখে। সুশীল সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এনজিওগুলোর উচিত হবে তাদের ব্যাবস্থাপনায় ব্যপক পরিবর্তন আনা, দুর্নীতির পথ বন্ধ করা এবং স্বচ্ছতার জায়গা বিস্তৃত করা। নতুবা, কেবল বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বের এনজিও ব্যবস্থাই হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভবিষ্যতে।

[লেখক : ডক্টরাল গবেষক,

গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]