সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সমষ্টির বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিক্ষাবিদ

আল মাকসুদ

মানুষকে কি বলা যাবে অপরাধপ্রবণ প্রজাতি? না, বলা যাবে না। তবে মানুষের ভেতর ওই যে স্বার্থবুদ্ধি, সেটা কার্যকর রয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে মানুষের ভেতর দু’টি সত্তা রয়েছে- একটি ব্যক্তিগত, অন্যটি সামাজিক। ব্যক্তিগত সত্তা যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন অনেক কিছুই ঘটে, অপরাধ তো ঘটবেই। সামাজিক সত্তাটি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন প্রকারের। সেটি পার হয়ে যেতে চায় ব্যক্তির সীমা, স্বার্থবুদ্ধির বেষ্টনী, যুক্ত হতে চায় অন্যের সঙ্গে, তার ভেতরে থাকে সংবেদনশীলতা। এই যে সামাজিক প্রবৃত্তি, এটি অপরাধপ্রবণতাকে রুখতে পারে। বাইরে থেকে নয়, আইন হিসেবে নয়, একবারেই ভেতর থেকে। (মানুষ অনেক বড় তার অপরাধের চেয়ে : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানুষের ভেতরগত পরিবর্তনটা চেয়েছেন বরাবরই। ব্যক্তির পরিবর্তন সমাজকে প্রভাবিত করে। সমাজ প্রভাবিত হলে পরিবর্তিত হবে রাষ্ট্রের চেহারা। মানবিকবোধের জায়গা থেকে সারস্বত সমাজ গড়ে উঠলে সে সমাজে আর যাই থাকুক একজনকে ল্যাং মেরে আরেকজন ওপরে উঠতে চাইবেন না। পারলে দুজনই অথবা একজনই উঠুক- আরেকজন হবেন তার সহযোগী; সহমর্মীও। এতে সাম্য থাকে। তৈরি হয় সমতা। মানুষের ভেতরের প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। টপকে যাওয়ার নীতি ও রীতি উভয়ই খারাপ এবং ভয়ানক। এতে ব্যক্তির লাভ হতে পারে কিন্তু সমষ্টির হয়ে যায় ব্যাপক অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ তখন সমাজটা হয়ে ওঠে স্বার্থান্ধ। এই স্বার্থান্ধ সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জীবনকে উপলব্ধি করতে হয় বিত্তের মাপকাঠিতে নয়, বৌদ্ধিক চৈতন্যের বিকাশকে সামনে রেখে। পুঁজিবাদ মানুষকে যেমন শিখিয়েছে রুচির পরিবর্তন করো- তেমনি রাষ্ট্রকে শিখিয়েছে এগিয়ে যাও সবকিছু মাড়িয়ে। কারণ তোমার লড়াইটা যে-কোনো মূল্যে টিকে থাকার লড়াই। যখনই টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রশ্ন আসে তখনই প্রকট হয়ে ওঠে ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাবানের অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব; তাঁর ভাষায় এ-সময়টাতে- ‘সমাজের বড় মাছগুলো ছোট মাছগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলতে চায়।’

ব্যক্তির মনঃসমীক্ষা প্রায়শ কেবল আত্মকে বড়ো করে দেখতে শেখায়। এ-শিক্ষা পুঁজিবাদেরও। ফলে মানুষের ঐহিক শ্রেষ্ঠত্ব খাটো হয়ে আসে। উপলব্ধির গভীরতায় চর পড়ে। তবে এটা ঠিক যে চর-পড়া ভোঁতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবুদ্ধি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারতো শিক্ষা। শিক্ষার নৈতিক ও প্রায়োগিক শক্তি অপরিসীম। কিন্তু দুভার্গ্যজনকভাবে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্যকেও আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। বর্তমান শিক্ষা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে রেওয়াজটাই মুখ্য হয়েছে; রূপান্তর ঘটেনি একটুও। বরঞ্চ উল্লাসঘন উল্লম্ফন অস্তিত্বের ভিত্তিভূমি হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রতিবেশ-অন্বিত সর্বমানবিক উত্থানের চিহ্নমাত্র নেই। আছে অনাত্মীয়তা আর বিচ্ছিনতামুখী অভিগমন। এখানে তাঁর সমাজবীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ-

“[...] যে শিক্ষা আমরা এতকাল পেয়ে এসেছি এবং এখনও পাচ্ছি তার মূল মন্ত্রটি হলো তুমি নিজে বড় হও, অন্যের কথা একদম ভেবো না। নিজের চরকায় তেল দাও, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা- এসব প্রবাদ উচ্চ নৈতিকতা তো নয়ই সাধারণ মনুষ্যত্বের কথাও বলে না; এদের উদ্ভব এক ধরনের হতাশা থেকে; শিক্ষার কর্তব্য এসবের অন্তর্গত মূল্যবোধটিকে অপসারিত করে শিক্ষার্থীদের হৃদয়বান ও সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। এটা দেখে আশ্চর্য হবার কথা, কিন্তু আমরা হই না যে, অপসারণ তো অনেক বড় দায়িত্ব, শিক্ষা বরঞ্চ স্বার্থপরতার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই পুষ্ট করছে। অনবরত বলা হচ্ছে তুমি নিজে বড় হও অন্যকে পদদলিত করে।” (আলো কেন আলো নয় : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়- এটি কেবল কথার কথা নয়। এর প্রায়োগিক রূপটাকেও প্রত্যক্ষ করতে হয়। বাস্তবায়ন তো জরুরি আরো। জনাব চৌধুরী দেখিয়েছেন লন্ডনে নির্মিত ‘সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্র্যাল’ আর আগ্রায় নির্মিত ‘তাজমহল’-এর নির্মাণকাল প্রায় কাছাকাছি সময়ের। ‘তাজমহল’ অধিকতর বিস্ময়কর ‘সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্র্যাল’-এর চেয়ে হয়তো। কিন্তু সৃষ্টি প্রেরণায় একটিতে ছিলো ব্যক্তির আনন্দ-প্রেমাবেগ, অন্যটিতে সামাজিক শক্তির উদ্বোধন। অবশ্যই দ্বিতীয়টিতে ধর্ম কার্যকর ছিলো; কারণ সে-সময়ে ধর্ম সব ক্ষেত্রেই ছিলো অনিবার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু দুইয়ের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে উভয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য- জয় হয়েছে শেষ অব্দি সামাজিক শক্তির; ব্যক্তির নয়। তাঁর কথা-

“তাজমহল মৃত্যুর স্মারক। [...] তাজমহল ব্যক্তির স্বার্থে তৈরী, একজন ব্যক্তিকে সে রক্ষা করতে চেয়েছে কালের অমোঘ অবলুপ্তির হাত থেকে- অথবা দু’জন ব্যক্তিকে। [...] তাজমহলের সভ্যতা থেকে বোঝা যায় তার অগ্রগতি ঘটছিল না জীবনের দিকে, বরং সে পিছিয়ে আসছিল মৃত্যুর অভিমুখে। [...] সেন্ট পলস্ জীবনের জন্য তৈরী। [...] ক্যাথিড্র্যাল রাজার স্বার্থে, স্থপতির স্বার্থে, বা কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নির্মিত হয় নি, নির্মিত হয়েছে সমাজের স্বার্থে, সকলের প্রয়োজনে। সেইখানে, অট্টালিকার সেই সামাজিকতায়, উদ্দেশ্যের সেই সর্বজনস্বার্থচেতনায় ও উদ্যমের সেই সমবায়ে জীবন ছিল পরিব্যাপ্ত- ছিল সর্বক্ষণ জীবন্ত।” (জীবনের পথ, মৃত্যুর ছায়া : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

বৈশ্বিকতা বা বিশ্বায়ন কথাটির মাঝে আন্তর্জাতিকতা আছে কিন্তু আন্তরিকতা নেই। যেখানে মূল্যবোধেরই কোনো মূল্যায়ন হয় না- বরং সবকিছু নির্ধারিত হয় সামাজিক প্রতিপত্তির ওপর ভর করে, সেখানে নিজেকে আন্তর্জাতিক ভাবাও হাস্যকর। আন্তরিকতাহীন সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব কখনোই মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কিছু করতে পারে না। হ্যাঁ দলের লাভ হয়; গোষ্ঠী উপকার লাভ করে। আকার বড়ো হয়। অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠে। কিছু মানুষের ভাগ্যের অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে- কিন্তু এটি সর্বার্থে সর্বশ্রেণির মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে না। বলাবাহুল্য অধ্যাপক চৌধুরী ইহজাগতিকতার পক্ষে; তবে তার রূপ ও রূপায়ণটা কেমন- তা জানতে হবে। তাঁর ইহজাগতিকতা হলো সর্বমানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক। ব্যক্তির প্রতি আসক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া মানেই সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সব ধরনের ব্যক্তিক আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সর্বজনীন আসক্তির প্রতি আত্মনিবেদন করেছেন। এটি তাঁর বুদ্ধিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ যেমন তেমনি আদর্শবাদী নৈতিকতারও শক্তি।

আসল কথায় ফসল ফলে না- তবে কি নকল কথায় ফলবে ফসল? বিষয় তা নয়। আমরা আসল কথাটাই আসল জায়গায় উপস্থাপন করতে পারিনি। পারি না- এটাও মিথ্যে নয়। এ-জন্য প্রয়োজন আর্থসামাজিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের নানাবিধ পথের সন্ধান অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর প্রজন্ম-সহ সকল প্রজন্মের কাছেই উন্মুক্ত করেছেন। পথ দেখানো সহজ- কিন্তু তার বাস্তবায়ন কীভাবে ঘটবে তার কি কোনো দাওয়াই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন? এ-কথার জবাবে বলা যায়- পথিক যদি তার পথ চেনে তাহলে সে গন্তবে পৌঁছুবেই। পথিককে পথ চেনানোর কাজটুকু জনাব চৌধুরী নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন; করছেন। তবে পথিক যদি স্বেচ্ছায় গন্তব্যমুখী না হন তাহলে বিপত্তি আসবে- সে বিপত্তি ঠেকাবার সাধ্য কারো নেই। সমাজ বিকলাঙ্গ মানুষকে পছন্দ করে না। আবার অতি সজ্জন গোবেচারা মানুষও সমাজ পরিবর্তনের সারথি হতে পারেন না। পরিবর্তন একটি দ্রোহের নাম। সেই দ্রোহের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে গেলে প্রথমত শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়; দ্বিতীয়ত দৃষ্টিকে করতে হয় উদার, উন্মুক্ত। মনে রাখা আবশ্যক- সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিও উদার উন্নত কিন্তু তারা অপরকে লুণ্ঠন করে নিজের কর্র্তৃত্ব ও প্রজ্ঞা উভয়ই প্রকাশ করতে চায়। প্রকৃত শিক্ষার দৃষ্টি প্রজ্ঞার; কোনোভাবেই কর্তৃত্বের নয়- অপরকে দখল বা লুণ্ঠন তো নয়ই।

সোজাসাপ্টা কথায় সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে ক্রমাগত কথা বলেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলছেন এ-বয়সেও। এই বলাটা দায়িত্ববোধ থেকে ঘটেছে এটি যেমন সত্য তেমনি তাঁর শিক্ষা থেকেও ঘটেছে। তাঁর এ অদম্য সুদৃঢ় শিক্ষার ক্ষেত্রভূমি এই বাংলাদেশই। ভিন্ন কোনো দেশ নয়। তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছেন সত্যকে, বর্জন করতে চেয়েছেন মিথ্যেকে। আপাত খ্যাতির মোহকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। পেশা হিশেবে শিক্ষকতা তাঁকে হয়তো এ-ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়ালে

দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়। দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে গেলে সমাধান দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাই দ্বন্দ্বের ভেতরে থেকেই খুঁজতে হয় সমাধান। ছকবন্দি সীমায়িত জীবনের পক্ষে দুরভিগম্য হয়ে ওঠা সম্ভবপর হয় না। পুঁজিবাদের প্রকাশ্য শত্রু দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদ দ্বন্দ্বকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। কারণ দ্বন্দ্ব মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোলে; বিজ্ঞানমনস্ক করে। পুঁজিবাদও বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে। কতটুকু গ্রহণ করে? শুধু তার স্বার্থের অংশটুকুকেই। বাকিটুকু পড়ে থাকে ভাগাড়ে।

জনগণের মুক্তি শুধু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আসে না- এ-কথা তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন। জনমুক্তির জন্য স্বাধীনতা আবশ্যক এবং অনিবার্য ভিত্তি। স্বাধীনতা যদি গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মহাসরণি হয় তাহলে সে স্বাধীনতা শ্রেণিস্বার্থকেই প্রশ্রয় দেয়। যে স্বাধীনতা সাধারণের মুক্তির কথা বলে না, তাদেরকে নিয়ে ভাবে না তাকে তিনি স্বাধীনতা বলতে চান না। সময় ও ইতিহাসের পথকে সামনে রেখেই সাধারণের মুক্তির কথা, কৃষকের মুক্তির কথা, শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথা, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের কথা, পুঁজির আগ্রাসী চমক থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করার কথা তিনি বলেন সবসময়ই; কারণ এই মুক্তির ভেতর দিয়েই স্বাধীনতার স্বাদ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া যাবে। অন্যথায়, অন্তর্গত পরাভব চিন্তার সৌকর্যকে, ঔদার্যকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে তুলবে। মানুষ হয়ে উঠবে ক্ষমতাধর প্রভুর হাতের ক্রীড়নক। আত্মমুক্তির প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত জাতি অপরের কৃপামুখী হতে বাধ্য হবে। এবং এসব ভাবনা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পীড়িত করে বারংবার। তিনি বিশ্বাস করেন ‘কেবল নিজে বিপ্লবী হওয়া যথেষ্ট নয়, জনগণকে বিপ্লবী করা আবশ্যক’। (বাঙালীকে কে বাঁচাবে)।

লেখকমাত্রই বুদ্ধিজীবী নন। বুদ্ধিজীবী মানেই লেখক তা-ও নয়। বুদ্ধিজীবী হতে হলে লেখক হতে হবে তারও কোনো ভিত্তি নেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিক্ষক। তিন পরিচয়ের বাইরেও আছে তাঁর আরো পরিচয়- তিনি সম্পাদক। বুদ্ধিজীবী শব্দটির সঙ্গে আপসহীনতা যেমন জড়িত তেমনি আপসকামিতাও জড়িত। সুতরাং দ্বৈধ আছে; স্বাতন্ত্র্যও আছে- আছে ব্যতিক্রম। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ব্যতিক্রমীদের একজন। তাঁর লেখক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও এ-কথা সমপ্রযোজ্য। অধ্যাপক চৌধুরী আদর্শবাদী লেখক এবং বুদ্ধিজীবী; এ-জন্য পচন ধরা মেরুদণ্ডহীন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীচেতনাকে ডিঙিয়ে নিজেকে টানটান রাখতে পেরেছেন; তিনি আপসকামিতাকে ঘৃণা করেন মনেপ্রাণে। সুতরাং তাঁর চিন্তা ও মননের সমগ্রতাজুড়ে আদর্শিক লড়াইয়ের ছায়াপাত আছে। এবং সেটি সচেতনভাবেই আছে। সক্রিয়ও ভীষণ। চিন্তার দৌর্বল্য আর দোদুল্যমানতাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন লেখক জীবনের শুরুতেই। সুবিধাবাদীদের দল যতই ভারি আর বাহারি হোক না কেন, তিনি সে পথে পা বাড়াননি। তাঁর লক্ষ্য অন্ধ বিশ্বাস আর দলকানা মনোভাব থেকে তারুণ্যের মুক্তির পথ নির্মাণ করে দেয়া। মেধাবী কিন্তু নির্লোভ এই শ্রেণির তরুণদের ভেতরে স্বপ্নবীজ বপন করে দেয়ার কাজটিই অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এ-পথ দুর্গম; কণ্টকাকীর্ণ। মানবিক সহমর্মিতার প্রতি যার উন্মুখ আগ্রহ তার পক্ষে অবশ্য এ-পথ কঠিন হলেও, অলঙ্ঘ্য নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পরাবাস্তব অনুভবের ভাবসঙ্গী নন। বাস্তবতার আলোয় উদ্ভাসিত আত্মবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী। তিনি লড়তে চান; লড়াইয়ের ময়দানে একা হলেও। অভ্যাসের বশ না হয়ে দায়িত্বের প্রতি আস্থাশীল থেকে দেশপ্রেমকে উচ্চকিত করেছেন। দেশকে ভালোবাসলে নিজেকেই ভালোবাসা হয়; দেশ এগিয়ে গেলে নিজেরও এগিয়ে যাওয়া হয়- এই সামষ্টিকবোধের কাছে তিনি সর্বদা আন্তরিক। নিরাপদ কৌশলের চেয়ে সরাসরি সমাধানের লক্ষ্যে নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। মিছিলে শরিক হয়ে সত্য উচ্চারণে নির্দ্বিধ থেকেছেন। সমাজের পরিবর্তন কিংবা রূপান্তর তিনি চান সবসময়ই; কিন্তু কারা করবেন, কাদেরকে নিয়ে করবেন এ মহাযজ্ঞ তার বিশদ বিবরণ রয়েছে তাঁর সৃষ্ট অসংখ্য রচনায়। শারীরিক অন্ধত্বের চেয়ে মানসিক অন্ধত্বের ভার কঠিন। মানসিক অন্ধত্ব অপসারণের পথ একটাই ‘শিক্ষা’। সে শিক্ষাও যখন নড়বড়ে হয়ে ওঠে তখন শঙ্কা বাড়ে; সন্ধ্যা ঘনায়- বিপদ আসন্ন বলে অনুমান করা যায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এর থেকে মুক্তির জন্য ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ নিতে উৎসাহিত করেন। তিনি বিশ্বাস করেন- ‘অতীতকে বুঝতে, বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতে এবং ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে হলে ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়’ (ভয় পেতে নেই : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২ , ৯ আষাড় ১৪২৮ ২৩ জিলকদ ১৪৪৩

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সমষ্টির বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিক্ষাবিদ

আল মাকসুদ

image

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম : ২৩ জুন ১৯৩৬)

মানুষকে কি বলা যাবে অপরাধপ্রবণ প্রজাতি? না, বলা যাবে না। তবে মানুষের ভেতর ওই যে স্বার্থবুদ্ধি, সেটা কার্যকর রয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে মানুষের ভেতর দু’টি সত্তা রয়েছে- একটি ব্যক্তিগত, অন্যটি সামাজিক। ব্যক্তিগত সত্তা যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন অনেক কিছুই ঘটে, অপরাধ তো ঘটবেই। সামাজিক সত্তাটি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন প্রকারের। সেটি পার হয়ে যেতে চায় ব্যক্তির সীমা, স্বার্থবুদ্ধির বেষ্টনী, যুক্ত হতে চায় অন্যের সঙ্গে, তার ভেতরে থাকে সংবেদনশীলতা। এই যে সামাজিক প্রবৃত্তি, এটি অপরাধপ্রবণতাকে রুখতে পারে। বাইরে থেকে নয়, আইন হিসেবে নয়, একবারেই ভেতর থেকে। (মানুষ অনেক বড় তার অপরাধের চেয়ে : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানুষের ভেতরগত পরিবর্তনটা চেয়েছেন বরাবরই। ব্যক্তির পরিবর্তন সমাজকে প্রভাবিত করে। সমাজ প্রভাবিত হলে পরিবর্তিত হবে রাষ্ট্রের চেহারা। মানবিকবোধের জায়গা থেকে সারস্বত সমাজ গড়ে উঠলে সে সমাজে আর যাই থাকুক একজনকে ল্যাং মেরে আরেকজন ওপরে উঠতে চাইবেন না। পারলে দুজনই অথবা একজনই উঠুক- আরেকজন হবেন তার সহযোগী; সহমর্মীও। এতে সাম্য থাকে। তৈরি হয় সমতা। মানুষের ভেতরের প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। টপকে যাওয়ার নীতি ও রীতি উভয়ই খারাপ এবং ভয়ানক। এতে ব্যক্তির লাভ হতে পারে কিন্তু সমষ্টির হয়ে যায় ব্যাপক অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ তখন সমাজটা হয়ে ওঠে স্বার্থান্ধ। এই স্বার্থান্ধ সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জীবনকে উপলব্ধি করতে হয় বিত্তের মাপকাঠিতে নয়, বৌদ্ধিক চৈতন্যের বিকাশকে সামনে রেখে। পুঁজিবাদ মানুষকে যেমন শিখিয়েছে রুচির পরিবর্তন করো- তেমনি রাষ্ট্রকে শিখিয়েছে এগিয়ে যাও সবকিছু মাড়িয়ে। কারণ তোমার লড়াইটা যে-কোনো মূল্যে টিকে থাকার লড়াই। যখনই টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রশ্ন আসে তখনই প্রকট হয়ে ওঠে ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাবানের অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব; তাঁর ভাষায় এ-সময়টাতে- ‘সমাজের বড় মাছগুলো ছোট মাছগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলতে চায়।’

ব্যক্তির মনঃসমীক্ষা প্রায়শ কেবল আত্মকে বড়ো করে দেখতে শেখায়। এ-শিক্ষা পুঁজিবাদেরও। ফলে মানুষের ঐহিক শ্রেষ্ঠত্ব খাটো হয়ে আসে। উপলব্ধির গভীরতায় চর পড়ে। তবে এটা ঠিক যে চর-পড়া ভোঁতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবুদ্ধি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারতো শিক্ষা। শিক্ষার নৈতিক ও প্রায়োগিক শক্তি অপরিসীম। কিন্তু দুভার্গ্যজনকভাবে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্যকেও আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। বর্তমান শিক্ষা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে রেওয়াজটাই মুখ্য হয়েছে; রূপান্তর ঘটেনি একটুও। বরঞ্চ উল্লাসঘন উল্লম্ফন অস্তিত্বের ভিত্তিভূমি হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রতিবেশ-অন্বিত সর্বমানবিক উত্থানের চিহ্নমাত্র নেই। আছে অনাত্মীয়তা আর বিচ্ছিনতামুখী অভিগমন। এখানে তাঁর সমাজবীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ-

“[...] যে শিক্ষা আমরা এতকাল পেয়ে এসেছি এবং এখনও পাচ্ছি তার মূল মন্ত্রটি হলো তুমি নিজে বড় হও, অন্যের কথা একদম ভেবো না। নিজের চরকায় তেল দাও, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা- এসব প্রবাদ উচ্চ নৈতিকতা তো নয়ই সাধারণ মনুষ্যত্বের কথাও বলে না; এদের উদ্ভব এক ধরনের হতাশা থেকে; শিক্ষার কর্তব্য এসবের অন্তর্গত মূল্যবোধটিকে অপসারিত করে শিক্ষার্থীদের হৃদয়বান ও সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। এটা দেখে আশ্চর্য হবার কথা, কিন্তু আমরা হই না যে, অপসারণ তো অনেক বড় দায়িত্ব, শিক্ষা বরঞ্চ স্বার্থপরতার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই পুষ্ট করছে। অনবরত বলা হচ্ছে তুমি নিজে বড় হও অন্যকে পদদলিত করে।” (আলো কেন আলো নয় : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়- এটি কেবল কথার কথা নয়। এর প্রায়োগিক রূপটাকেও প্রত্যক্ষ করতে হয়। বাস্তবায়ন তো জরুরি আরো। জনাব চৌধুরী দেখিয়েছেন লন্ডনে নির্মিত ‘সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্র্যাল’ আর আগ্রায় নির্মিত ‘তাজমহল’-এর নির্মাণকাল প্রায় কাছাকাছি সময়ের। ‘তাজমহল’ অধিকতর বিস্ময়কর ‘সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্র্যাল’-এর চেয়ে হয়তো। কিন্তু সৃষ্টি প্রেরণায় একটিতে ছিলো ব্যক্তির আনন্দ-প্রেমাবেগ, অন্যটিতে সামাজিক শক্তির উদ্বোধন। অবশ্যই দ্বিতীয়টিতে ধর্ম কার্যকর ছিলো; কারণ সে-সময়ে ধর্ম সব ক্ষেত্রেই ছিলো অনিবার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু দুইয়ের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে উভয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য- জয় হয়েছে শেষ অব্দি সামাজিক শক্তির; ব্যক্তির নয়। তাঁর কথা-

“তাজমহল মৃত্যুর স্মারক। [...] তাজমহল ব্যক্তির স্বার্থে তৈরী, একজন ব্যক্তিকে সে রক্ষা করতে চেয়েছে কালের অমোঘ অবলুপ্তির হাত থেকে- অথবা দু’জন ব্যক্তিকে। [...] তাজমহলের সভ্যতা থেকে বোঝা যায় তার অগ্রগতি ঘটছিল না জীবনের দিকে, বরং সে পিছিয়ে আসছিল মৃত্যুর অভিমুখে। [...] সেন্ট পলস্ জীবনের জন্য তৈরী। [...] ক্যাথিড্র্যাল রাজার স্বার্থে, স্থপতির স্বার্থে, বা কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নির্মিত হয় নি, নির্মিত হয়েছে সমাজের স্বার্থে, সকলের প্রয়োজনে। সেইখানে, অট্টালিকার সেই সামাজিকতায়, উদ্দেশ্যের সেই সর্বজনস্বার্থচেতনায় ও উদ্যমের সেই সমবায়ে জীবন ছিল পরিব্যাপ্ত- ছিল সর্বক্ষণ জীবন্ত।” (জীবনের পথ, মৃত্যুর ছায়া : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।

বৈশ্বিকতা বা বিশ্বায়ন কথাটির মাঝে আন্তর্জাতিকতা আছে কিন্তু আন্তরিকতা নেই। যেখানে মূল্যবোধেরই কোনো মূল্যায়ন হয় না- বরং সবকিছু নির্ধারিত হয় সামাজিক প্রতিপত্তির ওপর ভর করে, সেখানে নিজেকে আন্তর্জাতিক ভাবাও হাস্যকর। আন্তরিকতাহীন সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব কখনোই মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কিছু করতে পারে না। হ্যাঁ দলের লাভ হয়; গোষ্ঠী উপকার লাভ করে। আকার বড়ো হয়। অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠে। কিছু মানুষের ভাগ্যের অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে- কিন্তু এটি সর্বার্থে সর্বশ্রেণির মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে না। বলাবাহুল্য অধ্যাপক চৌধুরী ইহজাগতিকতার পক্ষে; তবে তার রূপ ও রূপায়ণটা কেমন- তা জানতে হবে। তাঁর ইহজাগতিকতা হলো সর্বমানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক। ব্যক্তির প্রতি আসক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া মানেই সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সব ধরনের ব্যক্তিক আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সর্বজনীন আসক্তির প্রতি আত্মনিবেদন করেছেন। এটি তাঁর বুদ্ধিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ যেমন তেমনি আদর্শবাদী নৈতিকতারও শক্তি।

আসল কথায় ফসল ফলে না- তবে কি নকল কথায় ফলবে ফসল? বিষয় তা নয়। আমরা আসল কথাটাই আসল জায়গায় উপস্থাপন করতে পারিনি। পারি না- এটাও মিথ্যে নয়। এ-জন্য প্রয়োজন আর্থসামাজিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের নানাবিধ পথের সন্ধান অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর প্রজন্ম-সহ সকল প্রজন্মের কাছেই উন্মুক্ত করেছেন। পথ দেখানো সহজ- কিন্তু তার বাস্তবায়ন কীভাবে ঘটবে তার কি কোনো দাওয়াই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন? এ-কথার জবাবে বলা যায়- পথিক যদি তার পথ চেনে তাহলে সে গন্তবে পৌঁছুবেই। পথিককে পথ চেনানোর কাজটুকু জনাব চৌধুরী নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন; করছেন। তবে পথিক যদি স্বেচ্ছায় গন্তব্যমুখী না হন তাহলে বিপত্তি আসবে- সে বিপত্তি ঠেকাবার সাধ্য কারো নেই। সমাজ বিকলাঙ্গ মানুষকে পছন্দ করে না। আবার অতি সজ্জন গোবেচারা মানুষও সমাজ পরিবর্তনের সারথি হতে পারেন না। পরিবর্তন একটি দ্রোহের নাম। সেই দ্রোহের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে গেলে প্রথমত শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়; দ্বিতীয়ত দৃষ্টিকে করতে হয় উদার, উন্মুক্ত। মনে রাখা আবশ্যক- সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিও উদার উন্নত কিন্তু তারা অপরকে লুণ্ঠন করে নিজের কর্র্তৃত্ব ও প্রজ্ঞা উভয়ই প্রকাশ করতে চায়। প্রকৃত শিক্ষার দৃষ্টি প্রজ্ঞার; কোনোভাবেই কর্তৃত্বের নয়- অপরকে দখল বা লুণ্ঠন তো নয়ই।

সোজাসাপ্টা কথায় সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে ক্রমাগত কথা বলেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলছেন এ-বয়সেও। এই বলাটা দায়িত্ববোধ থেকে ঘটেছে এটি যেমন সত্য তেমনি তাঁর শিক্ষা থেকেও ঘটেছে। তাঁর এ অদম্য সুদৃঢ় শিক্ষার ক্ষেত্রভূমি এই বাংলাদেশই। ভিন্ন কোনো দেশ নয়। তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছেন সত্যকে, বর্জন করতে চেয়েছেন মিথ্যেকে। আপাত খ্যাতির মোহকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। পেশা হিশেবে শিক্ষকতা তাঁকে হয়তো এ-ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকতে পারে। সত্য-মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়ালে

দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়। দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে গেলে সমাধান দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাই দ্বন্দ্বের ভেতরে থেকেই খুঁজতে হয় সমাধান। ছকবন্দি সীমায়িত জীবনের পক্ষে দুরভিগম্য হয়ে ওঠা সম্ভবপর হয় না। পুঁজিবাদের প্রকাশ্য শত্রু দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদ দ্বন্দ্বকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। কারণ দ্বন্দ্ব মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোলে; বিজ্ঞানমনস্ক করে। পুঁজিবাদও বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে। কতটুকু গ্রহণ করে? শুধু তার স্বার্থের অংশটুকুকেই। বাকিটুকু পড়ে থাকে ভাগাড়ে।

জনগণের মুক্তি শুধু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আসে না- এ-কথা তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন। জনমুক্তির জন্য স্বাধীনতা আবশ্যক এবং অনিবার্য ভিত্তি। স্বাধীনতা যদি গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মহাসরণি হয় তাহলে সে স্বাধীনতা শ্রেণিস্বার্থকেই প্রশ্রয় দেয়। যে স্বাধীনতা সাধারণের মুক্তির কথা বলে না, তাদেরকে নিয়ে ভাবে না তাকে তিনি স্বাধীনতা বলতে চান না। সময় ও ইতিহাসের পথকে সামনে রেখেই সাধারণের মুক্তির কথা, কৃষকের মুক্তির কথা, শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথা, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের কথা, পুঁজির আগ্রাসী চমক থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করার কথা তিনি বলেন সবসময়ই; কারণ এই মুক্তির ভেতর দিয়েই স্বাধীনতার স্বাদ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া যাবে। অন্যথায়, অন্তর্গত পরাভব চিন্তার সৌকর্যকে, ঔদার্যকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে তুলবে। মানুষ হয়ে উঠবে ক্ষমতাধর প্রভুর হাতের ক্রীড়নক। আত্মমুক্তির প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত জাতি অপরের কৃপামুখী হতে বাধ্য হবে। এবং এসব ভাবনা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পীড়িত করে বারংবার। তিনি বিশ্বাস করেন ‘কেবল নিজে বিপ্লবী হওয়া যথেষ্ট নয়, জনগণকে বিপ্লবী করা আবশ্যক’। (বাঙালীকে কে বাঁচাবে)।

লেখকমাত্রই বুদ্ধিজীবী নন। বুদ্ধিজীবী মানেই লেখক তা-ও নয়। বুদ্ধিজীবী হতে হলে লেখক হতে হবে তারও কোনো ভিত্তি নেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিক্ষক। তিন পরিচয়ের বাইরেও আছে তাঁর আরো পরিচয়- তিনি সম্পাদক। বুদ্ধিজীবী শব্দটির সঙ্গে আপসহীনতা যেমন জড়িত তেমনি আপসকামিতাও জড়িত। সুতরাং দ্বৈধ আছে; স্বাতন্ত্র্যও আছে- আছে ব্যতিক্রম। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ব্যতিক্রমীদের একজন। তাঁর লেখক পরিচয়ের ক্ষেত্রেও এ-কথা সমপ্রযোজ্য। অধ্যাপক চৌধুরী আদর্শবাদী লেখক এবং বুদ্ধিজীবী; এ-জন্য পচন ধরা মেরুদণ্ডহীন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীচেতনাকে ডিঙিয়ে নিজেকে টানটান রাখতে পেরেছেন; তিনি আপসকামিতাকে ঘৃণা করেন মনেপ্রাণে। সুতরাং তাঁর চিন্তা ও মননের সমগ্রতাজুড়ে আদর্শিক লড়াইয়ের ছায়াপাত আছে। এবং সেটি সচেতনভাবেই আছে। সক্রিয়ও ভীষণ। চিন্তার দৌর্বল্য আর দোদুল্যমানতাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন লেখক জীবনের শুরুতেই। সুবিধাবাদীদের দল যতই ভারি আর বাহারি হোক না কেন, তিনি সে পথে পা বাড়াননি। তাঁর লক্ষ্য অন্ধ বিশ্বাস আর দলকানা মনোভাব থেকে তারুণ্যের মুক্তির পথ নির্মাণ করে দেয়া। মেধাবী কিন্তু নির্লোভ এই শ্রেণির তরুণদের ভেতরে স্বপ্নবীজ বপন করে দেয়ার কাজটিই অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এ-পথ দুর্গম; কণ্টকাকীর্ণ। মানবিক সহমর্মিতার প্রতি যার উন্মুখ আগ্রহ তার পক্ষে অবশ্য এ-পথ কঠিন হলেও, অলঙ্ঘ্য নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পরাবাস্তব অনুভবের ভাবসঙ্গী নন। বাস্তবতার আলোয় উদ্ভাসিত আত্মবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী। তিনি লড়তে চান; লড়াইয়ের ময়দানে একা হলেও। অভ্যাসের বশ না হয়ে দায়িত্বের প্রতি আস্থাশীল থেকে দেশপ্রেমকে উচ্চকিত করেছেন। দেশকে ভালোবাসলে নিজেকেই ভালোবাসা হয়; দেশ এগিয়ে গেলে নিজেরও এগিয়ে যাওয়া হয়- এই সামষ্টিকবোধের কাছে তিনি সর্বদা আন্তরিক। নিরাপদ কৌশলের চেয়ে সরাসরি সমাধানের লক্ষ্যে নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। মিছিলে শরিক হয়ে সত্য উচ্চারণে নির্দ্বিধ থেকেছেন। সমাজের পরিবর্তন কিংবা রূপান্তর তিনি চান সবসময়ই; কিন্তু কারা করবেন, কাদেরকে নিয়ে করবেন এ মহাযজ্ঞ তার বিশদ বিবরণ রয়েছে তাঁর সৃষ্ট অসংখ্য রচনায়। শারীরিক অন্ধত্বের চেয়ে মানসিক অন্ধত্বের ভার কঠিন। মানসিক অন্ধত্ব অপসারণের পথ একটাই ‘শিক্ষা’। সে শিক্ষাও যখন নড়বড়ে হয়ে ওঠে তখন শঙ্কা বাড়ে; সন্ধ্যা ঘনায়- বিপদ আসন্ন বলে অনুমান করা যায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এর থেকে মুক্তির জন্য ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ নিতে উৎসাহিত করেন। তিনি বিশ্বাস করেন- ‘অতীতকে বুঝতে, বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতে এবং ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে হলে ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়’ (ভয় পেতে নেই : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)।