অপ্রেরিত এসএমএস

আসিফ কবীর

(১) চাকরি-অন পেমেন্ট দুটি একসঙ্গে নয়

(২) চাহিদা সংকোচন কর্তব্য: ফি কমাও

(৩) ক্রমেই জিতে নিয়ে সুবিধা লাভ করতে হবে, হাঙ্গামা করে নয়

[এসএমএস]

শফিক ভাই’র কাছে মে’টিকে নিয়ে আলাপ করিয়েছিল ইয়াসীন। মে’টিকে নিয়ে শফিক ভাই’র বসার ঘরে যখন বা যেদিন ইয়াসীন এসেছিল, সেদিন তিনি ঘরোয়া পোশাকে ছিলেন। মে’টি এসে কোনাকুনি বসেছিল একই রকম সোফাসেটের অন্য সারণিতে। মে’টি লম্বা ছিল। লম্বা এবং খুব স্থূল নয়, এমন মানুষ দেখতে ভালোই লাগে। গাঢ় প্রসাধনী করা ছিল। যদিও ইয়াসীন পরে বলেছিল, আসার আগে পথিমধ্যে প্রাইভেট কারে, কফিশপে, দোকানে ড্রেসের মাপ দিতে যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, তা সে হতে পেরেছিল।

তাহলে বিজ্ঞান মতে, বসার ঘরে প্রবেশের পূর্বে কোনো এক সুবিধাজনক বিরতিতে প্রসাধনী রিপেয়ার করে নিতে হয়েছে তাকে। হাতে ব্যাগট্যাগও ছিল। কেনাকাটা করিয়ে নিতে পেরেছে সে, তার প্রমাণ। অন্য ভাষায় ইয়াসীনকে সে সিল মারতে পেরেছে ভালোভাবেই। মে’টির বর্ণনা দিতে গেলে বলতেই হয়, সে ফর্সা ছিল না, যতই রেসিস্ট শোনাক। চুল ছাড়া ছিল, যেমন পোশাকি ভাষায় স্ট্রেইট করা, লাচ্ছা নয়, এমনি সেমাই বা ভার্মিচিলির মতো। মুখের গড়ন অতটা ভালো বলার মতো নয়, তবে প্রসাধনী ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করার সাফল্য মানতে হবে। থ্রিপিস জামা এমন পিচ্ছিল বুননের ছিল না যে, ওড়না বারবার পড়ে যাবে, স্লিপ কেটে, তবু যাচ্ছিল। বসার ঘরটি সুন্দর সাজানো ছিল। শফিক ভাই এমনিতেই আর্টিফিশিয়াল ডেকোরেটিভ পিস সংগ্রহে রাখেন না, তার ঝোঁক সিনথেটিক বা চীনা বাজারে ঘরসজ্জার সামগ্রীর প্রতি একদমই নেই। দেশের মধ্যে বুটিক হাউস, নেপালের থামেলের ছোট ছোট ক্রাফটস শপের, ভারতের নানা রাজ্যের হস্তশিল্পের প্রাধান্য ঘরভর্তি। অপলকভাবে না হলেও মন দিয়েই সেগুলো দেখে মে’টি। সেদিনের দেখাশোনার মধ্য দিয়েই শফিক ভাই’র মোবাইল নম্বর মে’টি পায়। তাদের আলাপ হয়ে যায়। এরপর থেকেই পরস্পরের পরিচিত বলা যায়।

এরপরও শফিক ভাই মে’টির সাথে সরাসরি হননি। আড়ষ্টতা রয়ে গেছিল। ইয়াসীনের সাথে প্রতি সাক্ষাতে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইতেন তার কথা। এর মধ্যে ইয়াসীন যে আপডেট দেয়, তা মোটামুটি এ রকম- পাশের শহর বা জেলা যা-ই বলি, সেখানে তার একটি চাকরি হয়েছে। ট্রেনে করে যায়। আর ছোট একটি বাসাও ভাড়া করেছে। চাকরির চাহিদা মিটে গেছে, যে জন্য শফিক ভাই’র কাছে নিয়ে এসেছিল তাকে। ইয়াসীনের ভাষায়, চাকরিটা যিনি জুটিয়ে দিয়েছেন, তার সাথে মে’টির সবকিছু হয়েছে, চলছে। ইয়াসীনকেও তাই পাত্তা কম দেয় বলে সে মনে করে।

আবার কিছুদিন পর ইয়াসীন খবর বলে, মে’টি তাকে বলেছে কী একটা অপারেশন হয়েছে তার। ইয়াসীনের সন্দেহ অবশ্য অ্যাবরশন। সন্দেহ মানে নিশ্চিতই সে, সেভাবেই জোর দিয়ে বলে শফিক ভাইকে। শফিক ভাই’র অবশ্য বিশ্বাস হয়, আবার হয় না। যখন বা যেদিন হয়, সে মুহূর্তে বড় মায়া হয়। যখন অবিশ্বাস্য ঠেকে, তখন ইয়াসীনের ওপর রাগ হয়। এরপর ইয়াসীন আর কিছু লেটেস্ট বলতে পারেনি। শফিক ভাই’রও মে’টিকে নিয়ে আগ্রহ মরে যেতে লাগল। এমন সময় ইয়াসীন খবর না, কয়েকটি ব্যক্তিগত একক ছবি দেখাল নতুন কেনা মোবাইলের পর্দায়, মানে স্ক্রিনে, ভালো পিক্সেলের, উজ্জ্বল আলোয় এমনিতেই, এডিট ছাড়া। মুখ দেখা যাচ্ছে না, ফোকাস করা স্তনে। স্তনযুগলে। ফর্সা নয় বলে বৃন্তের আবর্তনকারী বৃত্তটি কফি রঙের; যা শফিক ভাইকে বুঝতে সহায়তা করল, মানে চিনতে। ছবিগুলো স্ক্রল করে কেমন যেন একটি চনমনে ভাব হলো শফিক ভাই’র দেহ-মনে। একটু চাঞ্চল্য জাগল। একটু স্বমেহনের ইচ্ছা জেগেছিল কি না, তা ইয়াসীন ঠিক ঠিক ধরতে পারেনি। ঘাড়ের পেছনে টানা টানা চুল ও চুলের রং, মানে হালকা রং করা চুলের রং, শফিক ভাই’র কাছে স্তনের পেছনে অপ্রকাশিত মানুষটিকে সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত করতে বেশি সহায়ক হলো। ছবিটা বাথরুমে তোলা ছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে রেড অক্সাইড করা। এখন টাইলসের যুগ, রেড অক্সাইড আউটডেটেড, চল নেই। যাতে বাড়িঘরের অবস্থা যে জুতের নয়, তা-ও শফিক ভাই’র জানা হয়ে গেল। এরপর থেকে ইয়াসীনের রোল কমে গেল শফিক ভাই ও মে’টির মধ্যে। শফিক ভাই তাকে সরাসরি ফোন ও কথা বলতে শুরু করে। ইয়াসীন এই ইস্যুতে একটু পেছনে পড়ে যায়। শফিক ভাই-ই তাকে এরপর থেকে মে’টি সম্পর্কে বাছাইকৃত খবর দিতে শুরু করে।

বাছাইকৃত মানে বেছে বেছে যা বলতে মন চায়, সেগুলো রাখঢাক করে, হরহর করে সবকিছু না। শফিক ভাই নিজেই ফোন করা শুরু করে, খবরাখবর নিতে। ইয়াসীন তাকে একটি আসক্তিহীন ইংরেজি বলেছিল, তা হলো ‘কম্প্রোমাইজ’ করবে। বিরক্ত হলেও কিছুটা শফিক ভাই বুঝেছিলেন, কী বলতে বা বোঝাতে চায় ইয়াসীন। এক-দুদিন কথা বলার পরই শফিক ভাই হোঁচট খেলেন। মে’টি একদম দর-কষাকষি শুরু করে দিল। তিনি বুঝলেন, ইয়াসীন খুব বুঝমানের মতো হাবভাব করলেও সে বাস্তবতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

শফিক ভাই ফোন করেন। তিনি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার ইস্যুটি বলবেন। তার আগেই মে’টি চাকরি চে’ বসে। টাকার আবদার করে। দর-কষাকষি করে। যশোরে যে চাকরিটি সে করত, তা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে সে ছেড়ে দিয়েছে জানায়। মানতে পারেন না শফিক ভাই। গ্রহণযোগ্য হয় না তার কাছে কারণটি। ঘনিষ্ঠ হতে হলে বিনিময়ে অনেক টাকার কথা বলে। ভিডিও কলের জন্য অপেক্ষাকৃত কম টাকার আবদার করে। শফিক ভাই বুঝতে পারেন যে স্থিরচিত্র দেখে মোবাইলের পর্দায় তিনি অনুরণিত হয়েছেন, স্বমেহনে মেতেছেন, তাই সরাসরি দেখার সুযোগ তিনি পেতে পারেন, যদি আবদারমতো টাকা বিকাশ করে দেন। আবার একদিন মে’টি তাকে বলে, তার জন্মদিন উৎসব। তাকে শফিক ভাই কত কী দেবে জানতে চায়। অঙ্কটা বাড়াতে বলে বসে- তাকে খুলনা শহরের বাস্তবতায় দশ হাজার টাকা হাতখরচ বাড়ি থেকে তো দেয়ই, তাতেও যথেষ্ট হয় না। যদিও শফিক ভাই এটা চাটাম বলে ধরে নিয়ে পুরাই অবিশ্বাস করেন। ওই যে বাথরুমের দেয়ালে অন্যূন মোজাইকও না রেড অক্সাইডের নিট ফিনিশিং দেখে ফেলেছিলেন, সেটা তাকে গুলটি ধরে ফেলতে বড় সাহায্য করে। শফিক ভাই লক্ষ করেন, খালি চাই চাই চাই। কোনো বাস্তব বুদ্ধির বালাই নেই। সারা জীবনের সঞ্চয় যেন এক পরিচয়ে গড়ে তুলতে চায়। সম্পর্ক গভীর বা পুরাতন করে আস্থা বাড়িয়ে চাহিদা মেটানোর ধার ধারে না। প্রতিবারই অ্যাপ ব্যবহার করে মোটামুটি প্রাইভেসি রেখে হওয়া তাদের সিদ্ধান্তহীন কথা, আলোচনা ভেঙে যাওয়ার মতোই দাঁড়ায়। কোনো ফল লাভ ছাড়া। তবু ধৈর্য ধরে যোগাযোগটা রেখে যান শফিক ভাই। তিনি কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া মে’টির আকর্ষণীয় ছবিগুলো নাড়াচাড়া করেন। পুলকিত হন, আপ্লুত বোধ করেন, হাল ছেড়ে দিতে ভেতর থেকে সায় পান না।

শফিক ভাই ফেইসবুকে পোস্ট করা ছবিগুলো স্ক্রল করেন মাঝে মাঝেই তাদের ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই। ছবির মে’টি আরও বেশি আকর্ষণীয়া, নজরকাড়া। ছবিতে দেখে তাকে অনেক দূরবর্তী ও অধরা ভাবতে বাধ্য হয় সকলেই। মডেল ও চিত্রনায়িকাদের অনুকরণ করে তার সাজপোশাক; বিশেষ করে বুক, পিঠ ও বাহুমূলের জায়গার কামিজের ডিজাইন। বক্ষের ঝুল নামানো ডিজাইনে চোখ আটকে যায় যে কারোরই। শফিক ভাই’র মনে পড়ে ছাত্রজীবনে ওই রকম একটি কল্পিত অবস্থাকে ভূগোল বিষয়ের প্রথম পাঠকালে উপত্যকা বলে জ্ঞান করতেন তারা। এসব ভাবনা শফিক ভাইকে আরও বেশি উতলা করা, মিলনোন্মুখ করে। অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।

আজকাল শফিক ভাই-ই ইয়াসীনকে মে’টির বিষয়ে আপডেট দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সময়ে সব বদলে যায়। সবকিছুতে অধিকার হাতছাড়া হয়ে যায়। ইয়াসীনেরও মে’টি-সংক্রান্ত তথ্যের হাতবদল হয়ে যায়। ইয়াসীন তা বুঝতে পারে, নির্বিবাদে মেনে নেয়। এদিকে মে’টি দ্রুতই কথাবার্তায় বুঝিয়ে দেয় সে শফিক ভাইকে যেভাবে চাচ্ছে, তাতে বলাই যায় ‘সুগার ড্যাডি’ বানিয়ে রাখতে চায়। এটা চাই, ওটা চাই, দর-কষাকষি করে শুধু, অনেকটা অযৌক্তিকভাবে। শফিক ভাই বাস্তববাদী মানুষ। মুখের ওপর যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলতে পারেন অবলীলায়। বলেও বসেন, ‘তোমার জন্য একজন এত সব করবে কেন?’ মে’টির ভুল উপস্থাপনায় কথা গড়ায় শুধু, কিছু আদায় হয় না। শফিক ভাই’র সহানুভূতিতে ভাটা পড়ে। এর মধ্যে ইয়াসীন তার কাছে প্রস্তাব তোলে, মে’টির ত্রিশ হাজার টাকা দরকার। তার ইনস্টিটিউটে জমা দিতে হবে। বাসা থেকে পেয়েছিল, খরচ হয়ে গেছে অন্যত্র। এই অপটু মিথ্যাটি শুনে শফিক ভাই আরও খেপে ওঠেন। তিনি এবার ভাবতে শুরু করেন, মে’টিকে ডেকে পাবলিক প্লেসে একটি কফিশপে কথা বলবেন। বোঝাবেন। ভুল পদক্ষেপগুলো ধরিয়ে দেবেন। আসলে কীভাবে চললে, আবদার করলে, কম হোক তবু কিছু পাওয়া হতে পারে, বলবেন। চাওয়ারও তো একটা আর্ট আছে।

কলকাতায় একবার এক আপ-ডাউন রিজার্ভ করা ট্যাক্সিচালক অনেকগুলো অতিরিক্ত টাকা নিয়েও যেমন আরও এক শ টাকা নিয়েছিল এই বলে যে, ‘আমাকে খাওয়ার জন্য বললে তো এরচে’ ঢের বেশি টাকা বিল দিতে হতো, যখন আপনারা খাচ্ছিলেন।’ তখন আর কী করা, টাকাটা সে লক্ষ্যমতো নিয়ে ছাড়ল। তবু অ্যাপ্রোচটা মনে ধরার মতো।

এর মাঝে শফিক ভাই ইয়াসীনকেও জানালেন। তিনি খুবই বিরক্ত। ইয়াসীন যেমন ভদ্রতার ঘেরাটোপে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ভাবত,

তা বিরাটভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো। নিজেকে তার বোকা বোকা লাগল। সে এতটাই মুষড়ে পড়ল যে, শফিক ভাই’র তাকে বোঝাতে হলো। শফিক ভাই ভাবলেন হয়তো ও-ই মে’টিকে পরিচয় করিয়েছিল তার সাথে। এখন নিজের লোকের এত সব কীর্তি নিতে পারছে না। তিনি ইতিহাস-রাজনীতি-দর্শন থেকে রেফারেন্স দেওয়া মানুষ। বললেন, ‘নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসে সুভাষ বসুর বিপরীতে বাপু একজন সভাপতি প্রার্থী দিয়েছিলেন। এমন অবস্থা হলো যে তখন সে প্রার্থী হেরে যায় মানে বাপু হেরে যান। তোমার এমন ভেবে মুখ পাংশু করতে হবে না।’ ইয়াসীন আবার এত গভীরতার মানুষ নয়। তবু সে ভাবল, তারও কিছু বলা দরকার। সে একটি প্রবাদ বলল: অতি লোভে তাঁতী নষ্ট।

এরপর শফিক ভাই একটা সময় ঠিক করে একদিন আসতে বললেন মে’টিকে, বসে কথাবার্তা বলার জন্য শহরের ক্যাফে গুনগুন বেছে নিলেন। প্রেমঘটিত ভেন্যু হিসেবে এর খ্যাতি আছে। একসময় এখানটায় বান্ধবী বা প্রেমিকা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মীমাংসা পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি গোছের কাউকে করতে হয়েছে। শফিক ভাই ভাবলেন, ক্যাপুচিনো বা মোকা কফির সাথে চিজ কেকের স্লাইস আর ব্রাউনি অর্ডার করবেন। কনট্রাস্ট হিসেবে একটা পাস্তা বলে ভাগ করে নেবেন।

শফিক ভাই আরও ভাবলেন, মে’টিকে যতটা সম্মান দেখানো যায়, দেখাবেন। নিজে দাঁড়িয়ে, অর্ডার আসলে আগে সার্ভ করিয়ে, তারও আগে বসার সুবিধা করে দিতে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে। বিদায় বেলায় বাইরে পর্যন্ত কিংবা নিজে ড্রপ করে।

মে’টি ভাবল, সে তো গিয়ে এযাত্রায় নগদ কিছু পাবে না। এটা তো ক্লায়েন্ট অ্যাটেন্ড করা হচ্ছে না। রিকশা ভাড়াটাই গচ্চা। সে এল না।

শফিক ভাই নির্ধারিত সময় গড়িয়ে যাওয়ার অনেক পরে মে’টিকে ফোন করলেন। সে একটি অজুহাতমতো বলল। বাসায় মেহমান এসে পড়েছিল। কিন্তু সেটাই কেন জানিয়ে দেয়নি অপারগতার কারণ বলে, তা সে কিছু বলল না। শফিক ভাইও সে প্রশ্ন করলেন না। আবার আরেক দিন সময় নির্ধারণও হলো না। মে’টি বলল, ‘আপনি যা বলতেন দেখা হলে, এখানে বলুন। ইউ ক্যান সে।’ শফিক ভাই’র মনে হলো, কলটি এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড তো! তবু সংস্কারে বাধল তার। মে’টি ইংরেজি বলে, খুব সস্তা ধরনের শব্দ ও উচ্চারণে, তারচে’ শুদ্ধ বাংলাও অনেক আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে পারত। বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু ইংরেজি সংলাপের মতো ত্রুটিপূর্ণ, শুনে যেমন মনে হয় কৃত্রিম। পাতে না দেওয়ার মতো ইংরেজি সংলাপের উচ্চারণ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে দর্শকদের বিমুখ করার অন্য সব কারণের সাথে ছোট্ট একটি কারণও হয়ে থাকতে পারে। আজও বলল তেমন ইংরেজি কথা। আগেও যেমন হাজার টাকা আবদার করে অঙ্কের পর হাজার না বলে বলেছে টেন কে। প্রাইসকে বলেছে কস্ট। বাজারে বেরিয়ে মার্কেটিংয়ে আসছি। হাউ আর ইউ বা চয়েস, লাইক, ড্রেসিং (প্রকৃতপক্ষে: ড্রেসআপ)। শফিক ভাই কিছুই বলতে পারলেন না। তার মনে হলো, সম্মান, সৌজন্য, সহমর্মিতা তিনি ভুল লোককেই দেখিয়েছেন। হীনমন্যতা ও সংশয় নিয়ে থাকা থেকে তিনি যাকে মুক্ত করতে চান, মুক্তির কোনো আকাক্সক্ষাই তার নেই। চিন্তা-চেতনায় পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে থেকে, দুনিয়ার সবাই আমার মনের কথা জেনে আমায় হেয় করছে ভেবে মন ছোট করে গহিন নিরানন্দে থাকা থেকে বেরিয়ে চাপ লাঘব করে বাঁচার অভিপ্রায়ই তার নেই বুঝি মনে হলো শফিক ভাই’র। তিনি ভালো ভালো কথায় যে আত্মমর্যাদাবোধ ও অপরাধীর মন বিসর্জন দিয়ে চলার আহ্বান জানাতে চে’ছিলেন, তা মাঠে মারা গেল। শফিক ভাই’র মুহূর্তের জন্য মনে হলো ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তিনি তার কায়দায় ১, ২, ৩... করে বাংলা লিপিতে মেসেজ লিখলেন। একটি বাক্যে কোলন ব্যবহার করলেন। মূলকথা তো ওই তিনটি ছিল। খালি সম্মানের খাতিরে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে চে’ছিলেন। পরে আর কী ভেবে পাঠালেন না। অপ্রেরিত বার্তা হয়েই রয়ে গেল তিনটি পয়েন্ট।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২ , ৯ আষাড় ১৪২৮ ২৩ জিলকদ ১৪৪৩

অপ্রেরিত এসএমএস

আসিফ কবীর

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

(১) চাকরি-অন পেমেন্ট দুটি একসঙ্গে নয়

(২) চাহিদা সংকোচন কর্তব্য: ফি কমাও

(৩) ক্রমেই জিতে নিয়ে সুবিধা লাভ করতে হবে, হাঙ্গামা করে নয়

[এসএমএস]

শফিক ভাই’র কাছে মে’টিকে নিয়ে আলাপ করিয়েছিল ইয়াসীন। মে’টিকে নিয়ে শফিক ভাই’র বসার ঘরে যখন বা যেদিন ইয়াসীন এসেছিল, সেদিন তিনি ঘরোয়া পোশাকে ছিলেন। মে’টি এসে কোনাকুনি বসেছিল একই রকম সোফাসেটের অন্য সারণিতে। মে’টি লম্বা ছিল। লম্বা এবং খুব স্থূল নয়, এমন মানুষ দেখতে ভালোই লাগে। গাঢ় প্রসাধনী করা ছিল। যদিও ইয়াসীন পরে বলেছিল, আসার আগে পথিমধ্যে প্রাইভেট কারে, কফিশপে, দোকানে ড্রেসের মাপ দিতে যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, তা সে হতে পেরেছিল।

তাহলে বিজ্ঞান মতে, বসার ঘরে প্রবেশের পূর্বে কোনো এক সুবিধাজনক বিরতিতে প্রসাধনী রিপেয়ার করে নিতে হয়েছে তাকে। হাতে ব্যাগট্যাগও ছিল। কেনাকাটা করিয়ে নিতে পেরেছে সে, তার প্রমাণ। অন্য ভাষায় ইয়াসীনকে সে সিল মারতে পেরেছে ভালোভাবেই। মে’টির বর্ণনা দিতে গেলে বলতেই হয়, সে ফর্সা ছিল না, যতই রেসিস্ট শোনাক। চুল ছাড়া ছিল, যেমন পোশাকি ভাষায় স্ট্রেইট করা, লাচ্ছা নয়, এমনি সেমাই বা ভার্মিচিলির মতো। মুখের গড়ন অতটা ভালো বলার মতো নয়, তবে প্রসাধনী ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করার সাফল্য মানতে হবে। থ্রিপিস জামা এমন পিচ্ছিল বুননের ছিল না যে, ওড়না বারবার পড়ে যাবে, স্লিপ কেটে, তবু যাচ্ছিল। বসার ঘরটি সুন্দর সাজানো ছিল। শফিক ভাই এমনিতেই আর্টিফিশিয়াল ডেকোরেটিভ পিস সংগ্রহে রাখেন না, তার ঝোঁক সিনথেটিক বা চীনা বাজারে ঘরসজ্জার সামগ্রীর প্রতি একদমই নেই। দেশের মধ্যে বুটিক হাউস, নেপালের থামেলের ছোট ছোট ক্রাফটস শপের, ভারতের নানা রাজ্যের হস্তশিল্পের প্রাধান্য ঘরভর্তি। অপলকভাবে না হলেও মন দিয়েই সেগুলো দেখে মে’টি। সেদিনের দেখাশোনার মধ্য দিয়েই শফিক ভাই’র মোবাইল নম্বর মে’টি পায়। তাদের আলাপ হয়ে যায়। এরপর থেকেই পরস্পরের পরিচিত বলা যায়।

এরপরও শফিক ভাই মে’টির সাথে সরাসরি হননি। আড়ষ্টতা রয়ে গেছিল। ইয়াসীনের সাথে প্রতি সাক্ষাতে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইতেন তার কথা। এর মধ্যে ইয়াসীন যে আপডেট দেয়, তা মোটামুটি এ রকম- পাশের শহর বা জেলা যা-ই বলি, সেখানে তার একটি চাকরি হয়েছে। ট্রেনে করে যায়। আর ছোট একটি বাসাও ভাড়া করেছে। চাকরির চাহিদা মিটে গেছে, যে জন্য শফিক ভাই’র কাছে নিয়ে এসেছিল তাকে। ইয়াসীনের ভাষায়, চাকরিটা যিনি জুটিয়ে দিয়েছেন, তার সাথে মে’টির সবকিছু হয়েছে, চলছে। ইয়াসীনকেও তাই পাত্তা কম দেয় বলে সে মনে করে।

আবার কিছুদিন পর ইয়াসীন খবর বলে, মে’টি তাকে বলেছে কী একটা অপারেশন হয়েছে তার। ইয়াসীনের সন্দেহ অবশ্য অ্যাবরশন। সন্দেহ মানে নিশ্চিতই সে, সেভাবেই জোর দিয়ে বলে শফিক ভাইকে। শফিক ভাই’র অবশ্য বিশ্বাস হয়, আবার হয় না। যখন বা যেদিন হয়, সে মুহূর্তে বড় মায়া হয়। যখন অবিশ্বাস্য ঠেকে, তখন ইয়াসীনের ওপর রাগ হয়। এরপর ইয়াসীন আর কিছু লেটেস্ট বলতে পারেনি। শফিক ভাই’রও মে’টিকে নিয়ে আগ্রহ মরে যেতে লাগল। এমন সময় ইয়াসীন খবর না, কয়েকটি ব্যক্তিগত একক ছবি দেখাল নতুন কেনা মোবাইলের পর্দায়, মানে স্ক্রিনে, ভালো পিক্সেলের, উজ্জ্বল আলোয় এমনিতেই, এডিট ছাড়া। মুখ দেখা যাচ্ছে না, ফোকাস করা স্তনে। স্তনযুগলে। ফর্সা নয় বলে বৃন্তের আবর্তনকারী বৃত্তটি কফি রঙের; যা শফিক ভাইকে বুঝতে সহায়তা করল, মানে চিনতে। ছবিগুলো স্ক্রল করে কেমন যেন একটি চনমনে ভাব হলো শফিক ভাই’র দেহ-মনে। একটু চাঞ্চল্য জাগল। একটু স্বমেহনের ইচ্ছা জেগেছিল কি না, তা ইয়াসীন ঠিক ঠিক ধরতে পারেনি। ঘাড়ের পেছনে টানা টানা চুল ও চুলের রং, মানে হালকা রং করা চুলের রং, শফিক ভাই’র কাছে স্তনের পেছনে অপ্রকাশিত মানুষটিকে সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত করতে বেশি সহায়ক হলো। ছবিটা বাথরুমে তোলা ছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে রেড অক্সাইড করা। এখন টাইলসের যুগ, রেড অক্সাইড আউটডেটেড, চল নেই। যাতে বাড়িঘরের অবস্থা যে জুতের নয়, তা-ও শফিক ভাই’র জানা হয়ে গেল। এরপর থেকে ইয়াসীনের রোল কমে গেল শফিক ভাই ও মে’টির মধ্যে। শফিক ভাই তাকে সরাসরি ফোন ও কথা বলতে শুরু করে। ইয়াসীন এই ইস্যুতে একটু পেছনে পড়ে যায়। শফিক ভাই-ই তাকে এরপর থেকে মে’টি সম্পর্কে বাছাইকৃত খবর দিতে শুরু করে।

বাছাইকৃত মানে বেছে বেছে যা বলতে মন চায়, সেগুলো রাখঢাক করে, হরহর করে সবকিছু না। শফিক ভাই নিজেই ফোন করা শুরু করে, খবরাখবর নিতে। ইয়াসীন তাকে একটি আসক্তিহীন ইংরেজি বলেছিল, তা হলো ‘কম্প্রোমাইজ’ করবে। বিরক্ত হলেও কিছুটা শফিক ভাই বুঝেছিলেন, কী বলতে বা বোঝাতে চায় ইয়াসীন। এক-দুদিন কথা বলার পরই শফিক ভাই হোঁচট খেলেন। মে’টি একদম দর-কষাকষি শুরু করে দিল। তিনি বুঝলেন, ইয়াসীন খুব বুঝমানের মতো হাবভাব করলেও সে বাস্তবতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে।

শফিক ভাই ফোন করেন। তিনি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার ইস্যুটি বলবেন। তার আগেই মে’টি চাকরি চে’ বসে। টাকার আবদার করে। দর-কষাকষি করে। যশোরে যে চাকরিটি সে করত, তা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে সে ছেড়ে দিয়েছে জানায়। মানতে পারেন না শফিক ভাই। গ্রহণযোগ্য হয় না তার কাছে কারণটি। ঘনিষ্ঠ হতে হলে বিনিময়ে অনেক টাকার কথা বলে। ভিডিও কলের জন্য অপেক্ষাকৃত কম টাকার আবদার করে। শফিক ভাই বুঝতে পারেন যে স্থিরচিত্র দেখে মোবাইলের পর্দায় তিনি অনুরণিত হয়েছেন, স্বমেহনে মেতেছেন, তাই সরাসরি দেখার সুযোগ তিনি পেতে পারেন, যদি আবদারমতো টাকা বিকাশ করে দেন। আবার একদিন মে’টি তাকে বলে, তার জন্মদিন উৎসব। তাকে শফিক ভাই কত কী দেবে জানতে চায়। অঙ্কটা বাড়াতে বলে বসে- তাকে খুলনা শহরের বাস্তবতায় দশ হাজার টাকা হাতখরচ বাড়ি থেকে তো দেয়ই, তাতেও যথেষ্ট হয় না। যদিও শফিক ভাই এটা চাটাম বলে ধরে নিয়ে পুরাই অবিশ্বাস করেন। ওই যে বাথরুমের দেয়ালে অন্যূন মোজাইকও না রেড অক্সাইডের নিট ফিনিশিং দেখে ফেলেছিলেন, সেটা তাকে গুলটি ধরে ফেলতে বড় সাহায্য করে। শফিক ভাই লক্ষ করেন, খালি চাই চাই চাই। কোনো বাস্তব বুদ্ধির বালাই নেই। সারা জীবনের সঞ্চয় যেন এক পরিচয়ে গড়ে তুলতে চায়। সম্পর্ক গভীর বা পুরাতন করে আস্থা বাড়িয়ে চাহিদা মেটানোর ধার ধারে না। প্রতিবারই অ্যাপ ব্যবহার করে মোটামুটি প্রাইভেসি রেখে হওয়া তাদের সিদ্ধান্তহীন কথা, আলোচনা ভেঙে যাওয়ার মতোই দাঁড়ায়। কোনো ফল লাভ ছাড়া। তবু ধৈর্য ধরে যোগাযোগটা রেখে যান শফিক ভাই। তিনি কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া মে’টির আকর্ষণীয় ছবিগুলো নাড়াচাড়া করেন। পুলকিত হন, আপ্লুত বোধ করেন, হাল ছেড়ে দিতে ভেতর থেকে সায় পান না।

শফিক ভাই ফেইসবুকে পোস্ট করা ছবিগুলো স্ক্রল করেন মাঝে মাঝেই তাদের ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই। ছবির মে’টি আরও বেশি আকর্ষণীয়া, নজরকাড়া। ছবিতে দেখে তাকে অনেক দূরবর্তী ও অধরা ভাবতে বাধ্য হয় সকলেই। মডেল ও চিত্রনায়িকাদের অনুকরণ করে তার সাজপোশাক; বিশেষ করে বুক, পিঠ ও বাহুমূলের জায়গার কামিজের ডিজাইন। বক্ষের ঝুল নামানো ডিজাইনে চোখ আটকে যায় যে কারোরই। শফিক ভাই’র মনে পড়ে ছাত্রজীবনে ওই রকম একটি কল্পিত অবস্থাকে ভূগোল বিষয়ের প্রথম পাঠকালে উপত্যকা বলে জ্ঞান করতেন তারা। এসব ভাবনা শফিক ভাইকে আরও বেশি উতলা করা, মিলনোন্মুখ করে। অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।

আজকাল শফিক ভাই-ই ইয়াসীনকে মে’টির বিষয়ে আপডেট দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সময়ে সব বদলে যায়। সবকিছুতে অধিকার হাতছাড়া হয়ে যায়। ইয়াসীনেরও মে’টি-সংক্রান্ত তথ্যের হাতবদল হয়ে যায়। ইয়াসীন তা বুঝতে পারে, নির্বিবাদে মেনে নেয়। এদিকে মে’টি দ্রুতই কথাবার্তায় বুঝিয়ে দেয় সে শফিক ভাইকে যেভাবে চাচ্ছে, তাতে বলাই যায় ‘সুগার ড্যাডি’ বানিয়ে রাখতে চায়। এটা চাই, ওটা চাই, দর-কষাকষি করে শুধু, অনেকটা অযৌক্তিকভাবে। শফিক ভাই বাস্তববাদী মানুষ। মুখের ওপর যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলতে পারেন অবলীলায়। বলেও বসেন, ‘তোমার জন্য একজন এত সব করবে কেন?’ মে’টির ভুল উপস্থাপনায় কথা গড়ায় শুধু, কিছু আদায় হয় না। শফিক ভাই’র সহানুভূতিতে ভাটা পড়ে। এর মধ্যে ইয়াসীন তার কাছে প্রস্তাব তোলে, মে’টির ত্রিশ হাজার টাকা দরকার। তার ইনস্টিটিউটে জমা দিতে হবে। বাসা থেকে পেয়েছিল, খরচ হয়ে গেছে অন্যত্র। এই অপটু মিথ্যাটি শুনে শফিক ভাই আরও খেপে ওঠেন। তিনি এবার ভাবতে শুরু করেন, মে’টিকে ডেকে পাবলিক প্লেসে একটি কফিশপে কথা বলবেন। বোঝাবেন। ভুল পদক্ষেপগুলো ধরিয়ে দেবেন। আসলে কীভাবে চললে, আবদার করলে, কম হোক তবু কিছু পাওয়া হতে পারে, বলবেন। চাওয়ারও তো একটা আর্ট আছে।

কলকাতায় একবার এক আপ-ডাউন রিজার্ভ করা ট্যাক্সিচালক অনেকগুলো অতিরিক্ত টাকা নিয়েও যেমন আরও এক শ টাকা নিয়েছিল এই বলে যে, ‘আমাকে খাওয়ার জন্য বললে তো এরচে’ ঢের বেশি টাকা বিল দিতে হতো, যখন আপনারা খাচ্ছিলেন।’ তখন আর কী করা, টাকাটা সে লক্ষ্যমতো নিয়ে ছাড়ল। তবু অ্যাপ্রোচটা মনে ধরার মতো।

এর মাঝে শফিক ভাই ইয়াসীনকেও জানালেন। তিনি খুবই বিরক্ত। ইয়াসীন যেমন ভদ্রতার ঘেরাটোপে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ভাবত,

তা বিরাটভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো। নিজেকে তার বোকা বোকা লাগল। সে এতটাই মুষড়ে পড়ল যে, শফিক ভাই’র তাকে বোঝাতে হলো। শফিক ভাই ভাবলেন হয়তো ও-ই মে’টিকে পরিচয় করিয়েছিল তার সাথে। এখন নিজের লোকের এত সব কীর্তি নিতে পারছে না। তিনি ইতিহাস-রাজনীতি-দর্শন থেকে রেফারেন্স দেওয়া মানুষ। বললেন, ‘নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসে সুভাষ বসুর বিপরীতে বাপু একজন সভাপতি প্রার্থী দিয়েছিলেন। এমন অবস্থা হলো যে তখন সে প্রার্থী হেরে যায় মানে বাপু হেরে যান। তোমার এমন ভেবে মুখ পাংশু করতে হবে না।’ ইয়াসীন আবার এত গভীরতার মানুষ নয়। তবু সে ভাবল, তারও কিছু বলা দরকার। সে একটি প্রবাদ বলল: অতি লোভে তাঁতী নষ্ট।

এরপর শফিক ভাই একটা সময় ঠিক করে একদিন আসতে বললেন মে’টিকে, বসে কথাবার্তা বলার জন্য শহরের ক্যাফে গুনগুন বেছে নিলেন। প্রেমঘটিত ভেন্যু হিসেবে এর খ্যাতি আছে। একসময় এখানটায় বান্ধবী বা প্রেমিকা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মীমাংসা পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি গোছের কাউকে করতে হয়েছে। শফিক ভাই ভাবলেন, ক্যাপুচিনো বা মোকা কফির সাথে চিজ কেকের স্লাইস আর ব্রাউনি অর্ডার করবেন। কনট্রাস্ট হিসেবে একটা পাস্তা বলে ভাগ করে নেবেন।

শফিক ভাই আরও ভাবলেন, মে’টিকে যতটা সম্মান দেখানো যায়, দেখাবেন। নিজে দাঁড়িয়ে, অর্ডার আসলে আগে সার্ভ করিয়ে, তারও আগে বসার সুবিধা করে দিতে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে। বিদায় বেলায় বাইরে পর্যন্ত কিংবা নিজে ড্রপ করে।

মে’টি ভাবল, সে তো গিয়ে এযাত্রায় নগদ কিছু পাবে না। এটা তো ক্লায়েন্ট অ্যাটেন্ড করা হচ্ছে না। রিকশা ভাড়াটাই গচ্চা। সে এল না।

শফিক ভাই নির্ধারিত সময় গড়িয়ে যাওয়ার অনেক পরে মে’টিকে ফোন করলেন। সে একটি অজুহাতমতো বলল। বাসায় মেহমান এসে পড়েছিল। কিন্তু সেটাই কেন জানিয়ে দেয়নি অপারগতার কারণ বলে, তা সে কিছু বলল না। শফিক ভাইও সে প্রশ্ন করলেন না। আবার আরেক দিন সময় নির্ধারণও হলো না। মে’টি বলল, ‘আপনি যা বলতেন দেখা হলে, এখানে বলুন। ইউ ক্যান সে।’ শফিক ভাই’র মনে হলো, কলটি এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড তো! তবু সংস্কারে বাধল তার। মে’টি ইংরেজি বলে, খুব সস্তা ধরনের শব্দ ও উচ্চারণে, তারচে’ শুদ্ধ বাংলাও অনেক আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে পারত। বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু ইংরেজি সংলাপের মতো ত্রুটিপূর্ণ, শুনে যেমন মনে হয় কৃত্রিম। পাতে না দেওয়ার মতো ইংরেজি সংলাপের উচ্চারণ সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে দর্শকদের বিমুখ করার অন্য সব কারণের সাথে ছোট্ট একটি কারণও হয়ে থাকতে পারে। আজও বলল তেমন ইংরেজি কথা। আগেও যেমন হাজার টাকা আবদার করে অঙ্কের পর হাজার না বলে বলেছে টেন কে। প্রাইসকে বলেছে কস্ট। বাজারে বেরিয়ে মার্কেটিংয়ে আসছি। হাউ আর ইউ বা চয়েস, লাইক, ড্রেসিং (প্রকৃতপক্ষে: ড্রেসআপ)। শফিক ভাই কিছুই বলতে পারলেন না। তার মনে হলো, সম্মান, সৌজন্য, সহমর্মিতা তিনি ভুল লোককেই দেখিয়েছেন। হীনমন্যতা ও সংশয় নিয়ে থাকা থেকে তিনি যাকে মুক্ত করতে চান, মুক্তির কোনো আকাক্সক্ষাই তার নেই। চিন্তা-চেতনায় পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে থেকে, দুনিয়ার সবাই আমার মনের কথা জেনে আমায় হেয় করছে ভেবে মন ছোট করে গহিন নিরানন্দে থাকা থেকে বেরিয়ে চাপ লাঘব করে বাঁচার অভিপ্রায়ই তার নেই বুঝি মনে হলো শফিক ভাই’র। তিনি ভালো ভালো কথায় যে আত্মমর্যাদাবোধ ও অপরাধীর মন বিসর্জন দিয়ে চলার আহ্বান জানাতে চে’ছিলেন, তা মাঠে মারা গেল। শফিক ভাই’র মুহূর্তের জন্য মনে হলো ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তিনি তার কায়দায় ১, ২, ৩... করে বাংলা লিপিতে মেসেজ লিখলেন। একটি বাক্যে কোলন ব্যবহার করলেন। মূলকথা তো ওই তিনটি ছিল। খালি সম্মানের খাতিরে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে চে’ছিলেন। পরে আর কী ভেবে পাঠালেন না। অপ্রেরিত বার্তা হয়েই রয়ে গেল তিনটি পয়েন্ট।