শাশ্বত অনুষঙ্গে ‘মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর’

ওবায়েদ আকাশ

মানুষের জীবনে কবিতার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। আর এই ধারাতেই এই শিল্পমাধ্যমটি সাড়ম্বড়ে বিকশিত হয়ে চলেছে। এই প্রবহমানতাকে বেগবান যাঁরা করেন, কিংবা যাঁরা সবকিছু দিয়ে কবিতাকে ভালবেসে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে কবিতা রচনা করেন, তাঁরা কবি। তাঁরা প্রবল উপস্থিতির মধ্যে সাধারণ হয়েও অসাধারণ, পরিচিত হয়েও অপরিচিত। প্রচলিত মানুষ হয়েও একজন শিল্প স্রষ্টা এবং অন্য মানুষদের মতো হয়েও তিনি অনন্য। কারণ শিল্প বা কবিতা অনন্য। তার আবেদন সৌন্দর্যের সবটুকুজুড়ে। কবিতা সৌন্দর্যের বিকাশে কিংবা নন্দনের উৎর্ষতায় অতি উচ্চমার্গীয় একটি ধারা। কবি তাঁর বোধে ও ভাবনায় এই উচ্চতাকে ধারণ করেন। শব্দ বাক্য আর বিন্যাসের সুসমন্বয়ে কবির কল্পনারাজ্যে বাস করে কবিতা। কবি তাকে ভূমিষ্ঠ করেন। এর আনন্দ সীমাহীন। একে বলে সৃষ্টিসুখ। এই আনন্দ যিনি লাভ করেন, তাঁকে আর কখনো পরিপূর্ণভাবে বিষয়জাত জীবনে কিংবা আটপৌরে জীবনে পাওয়া যায় না। তখন তিনি ¯্রষ্টা। অজ¯্র কাজের ফাঁকেও সৃষ্টি করতে পারেন মহার্ঘ কল্পনাগাথা। যাকে আমরা কবিতা বলি।

এত কথা বললাম একজন পরিচিত কবিকে আরও একবার চেনানোর জন্য। নাম শুনলেই অনেকে চিনে ফেলবেন আবার আজকের প্রজন্ম হয়তো অনেকে তাঁকে নাও চিনতে পারেন। সমসাময়িক বাংলা কবিতার বলিষ্ঠ এই কণ্ঠস্বর কবি মিহির মুসাকী। কবিতা লিখছেন বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এখনো অবধি। বহু প্রতিভার অধিকারী এই কবি যে একজন নিমগ্ন শিল্পস্রষ্টা, এটা বোঝা যায় তাঁর কবিতায় অবগাহন করে। ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সীমাহীন ব্যস্ততা আর রাষ্ট্রীয় কাজকে নিজের দায়িত্ব মনে করে কাজ করে গেলেও, শিল্প তাঁকে ছাড়ে না। কবিতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে নিয়ে যায় লেখার টেবিলে।

তাঁর কবিতার বইগুলোর পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে কিছু শিশুতোষ কবিতাগ্রন্থও। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি কিশোরোপযোগী কবিতার বই ‘মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর’। এই নামকরণের মধ্যেও তিনি অসামান্য দুটি চিত্রকল্প রচনা করেছেন। এটি যে কোনো প্রাজ্ঞ কবির বইয়ের শিরোনাম, তা উচ্চারণমাত্র বোঝা যায়। গ্রন্থটির প্রতিটি কবিতাই ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার মতো আবেদনময়। কিশু-কিশোর মনে কবিতাগুলোর অনুরণন প্রভাবিত করবে, সন্দেহ নাই। কবিতার চিত্র ও চিত্রকল্প, দৃশ্য ও দৃশ্যকল্প, যুগপৎ ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার, অন্ত্যমিলের চমৎকরিত্ব, শব্দ নির্বাচনের দক্ষতা, উপমা-রূপকের যথার্থ ব্যবহার কবিতাগুলোকে বিশিষ্ট ও সাবলীল করে তুলেছে। প্রতিটি কবিতাই এত বেশি গভীরতা ও প্রখরতা ধারণ করেছে, এবং বর্ণনার সাবলীলতা এতটাই সহজাত যে, গ্রন্থটি একবার কেউ পড়তে শুরু করলে শেষ না করে আর ছাড়বেন না। কবিতায় যে বিষয়টিকেই তিনি ধারণ করেছেন, তা ডিটেইল ও অনুপুঙ্খ বর্ণনাবদ্ধ করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। ‘আমাদের নদী’ নামে প্রথম যে কবিতাটি গ্রন্থিত হয়েছে, সেখানে তিনি নদীর বেদনা ও কবির বেদনাকে একাকার করে উপস্থাপন করেছেন।

আমাদের নদীগুলো যেন গেছে মরে,

কোথা ছিল জল আহা কোথা গেল সরে।

কত বড় চর আজ পদ্মার বুকে

জল ছাড়া মাছগুলো মরে ধুঁকে ধুঁকে

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে নদীদের কান্না শুনতে পেয়েছিলেন। সেই তখনও নদীদের প্রবহমানতা ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু শিল্পমনের আয়নায় দেখা যায় তার আগামী। এটা এমনই এক হৃদয়ক্ষরিত বিষয় যে, আজ এত বছর পরও তা কবির চোখ এড়াতে পারছেন না। কবিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার বেদনা যারপরনাই উদ্বেলিত করেছে। তিনি নদীর ক্ষীণকায়া শরীর আর সরু ধারা দেখে বিস্মিত, তিনি হারানো নদীকে ফিরে পেতে চান। তিনি জাহাজ ভেড়া নদী দেখতে চান, ভাটিয়ালি জারিসারি গাওয়া নদী দেখতে চান, এমনকি নদীকে নিয়ে ছড়াগান লিখতে চান। তাই তিনি নদী খুঁজে ফেরেন- ‘রূপালি নদীর খোঁজে চোখ চিক্ চিক্ / এই দেশ হোক ফের নদীমাতৃক’। কবি মিহির মুসাকী বাংলাদেশকে প্রকৃতার্থেই নদীমাতৃক দেশ হিসেবে দেখতে চান। দুই পৃষ্ঠার এই কবিতায় হাজার পৃষ্ঠার আবেদন ছড়িয়েছেন। ষোলো কোটি মানুষের শাশ্বত দাবিকে তুলে ধরেছেন। নদী হারানোর বেদনাকে তুলে ধরেছেন। এই চিরন্তনতা কবি মিহির মুসাকীকে ভীষণভাবে তাড়িত করেছে। তাঁকে তাড়িত করেছে বাংলার প্রকৃতি ও কিশোরবেলা।

এছাড়াও এ গ্রন্থে যে কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে সেগুলো হলো- ‘বোশেখ তুমি আসো’, ‘বৃক্ষ এবং আমি’, ‘ছাদের মতো স্বাধীন হবো’, ‘ছোট্ট শহর’, ‘দেয়ালের কান’, ‘এই প্রকৃতি বন্ধু তোমার’, ‘গভীর রাতে ট্রেনের সাথে’, ‘কন্যা, তোমাকে’, ‘মেঘ ও রোদের খুনসুটি’, ‘পুত্র, তোমাকে’, ‘রাতের কাছে চিঠি’, ‘শোনো হে চিলেকোঠা’, ‘শোনো জাদুকর’ ও ‘সুতো-বোনা ভাবনার জাল’।

আমরা প্রায়ই বলে থাকি বৃক্ষের মতো উদার হও। জ্ঞানী হও। স্থিতধী হও। সত্যি বলতে বৃক্ষের কাছ থেকে আমাদের শেখার অন্ত নেই। বৃক্ষের কাছ থেকে আমাদের পাওয়ার অন্ত নেই। বৃক্ষ আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে যেমন, তেমনি আমরা বৃক্ষের কাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। ঝড়বৃষ্টিবাদলে বৃক্ষের কাছে আশ্রয় নেই। বৃক্ষের ছায়ায় প্রাণ শীতল করি। মানুষের মতো বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। কিন্তু মানুষ বৃক্ষ নয়, চঞ্চল সে। বৃক্ষ মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও, মানুষ তো বৃক্ষের ক্ষতিই করে চলেছে। কবি মিহির মুসাকী এই চিরন্তন বিষয়টাকে তাঁর ‘বৃক্ষ এবং আমি’ কবিতায় ধারণ করেছেন। এই কবিতায় তিনি মানুষ ও বৃক্ষের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। চরিত্রের দৈততা খুঁজে পেয়েছেন।

ও বৃক্ষ, তোমার সাথে আমার অনেক ফারাক

আমি যেন উড়ন্ত আর দুরন্ত এক প্রজাপতি,

ছুটতে গিয়ে এটা ভাঙি ওটা ভাঙি

করি আরও কত্তো ক্ষতি!

কবি মনে করেন, বৃক্ষের একটা শেকড় আছে কিন্তু মানুষের তা নেই বলে মানুষ বৃক্ষের মতো স্থিত হতে পারে না। কত সহজ আর প্রাত্যহিক এই বিষয়। কিন্তু আমরা কবির মতো করে উপলব্ধি করি না। বৃক্ষ কবিতাটি পাঠ করলে বৃক্ষ আর মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো এতটাই প্রকটভাবে আমাদের মধ্যে রেখাপাত করবে যে, আমাদের মনে হবে- আমরা জেনেবুঝেও এতদিন কেন তা শনাক্ত করিনি। এখানেই সাধারণের সঙ্গে কবির পার্থক্য বিদ্যমান। কবির দৃষ্টি প্রখর। তার দৃষ্টি প্রকৃতিকে, মানুষকে বিদ্ধ করে যায়।

আবার প্রকৃতির আরো আরো অনুষঙ্গ- পাখপাখালি, মাছ-মৌমাছি, পোকামাকড়- এসব কিছু আমাদেরকে কীভাবে আলোড়িত করছে, তা নানাভাবে ‘এই প্রকৃতি বন্ধু তোমার’ কবিতায় মিহির মুসাকী নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। এমন বর্ণনায় যেন শৈশবে ফিরে যাবার অনুষঙ্গ তৈরি হয়। কৈশরে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর আস্বাদ মেলে।

জলের ভেতর কাটছে সাঁতার মাছরা ঝাঁকে ঝাঁকে

কেমন ওদের জগৎ ওরা জলে কেমন থাকে।

কোন ভাষাতে কথা বলে কী করে পথ চেনে?

এই আমাদের মতো ওরা জামাকাপড় কেনে?

কবির কিশোর মনে প্রকৃতির নানা সৃষ্টিকে ঘিরে এমন নানা প্রশ্নের উদয় হয়, আবার কবিকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে এই প্রকৃতির খেলা। এভাবে তিনি হেঁটে হেঁটে অপার প্রকৃতি পাড়ি দিতে গিয়ে দেখেন নানান প্রজাতির নানান খেলা, মুখরতা।

পোকামাকড় আসল আমার সামনে বেঁধে সারি

গাছের কোটর মাটির ঢিঁবি ওদের সুখের বাড়ি।

আমার সামনে নৃত্য করে রঙিন প্রজাপতি,

পিঁপড়ে বলে আমরা তোমার করব না তো ক্ষতি।

দৃশ্যমান পৃথবীর অলঙ্কার, আমাদের চারপাশের বিপুল নিসর্গভাণ্ডার তারা কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। আমরা নিজেরাই একটা বিভাজন করে পার্থক্য রচনা করি। প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবি। প্রকারান্তরে সব কিছুই তো মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন ¯্রষ্টা। একটি পিঁপড়ের কাছেও শুনতে পান কবি, যে, সে মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না। এসব উত্থাপনের ভেতর দিয়ে কবি তার প্রকৃতিপ্রেমকে উদ্ভাসিত করেছেন। বাংলার নিসর্গমুগ্ধতাকে বর্ণনা করেছেন এবং নিজেদের ঐতিহ্য ও শেকড়ের প্রতি মানুষের প্রেমকে আহ্বান করেছেন। এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই এভাবে শাশ^ত অনুষঙ্গে লেখা। প্রতিটি কবিতা নিয়েই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আলোচনা করা যায়, সন্দেহ নেই। কবি মিহির মুসাকী যে শুধু বড়দের কবি নন, তিনি যে একজন উত্তীর্ণ শিশুকিশোর সাহিত্য রচয়িতা তা তাঁর এ জাতীয় গ্রন্থগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। কবি বলেছেন, ‘এই আছি বেশ আলোর রথে ভালোর পথে আমি।’ তিনি তাই থাকুন, আরো আরো এমন গ্রন্থ রচনা করে পাঠককেও নিয়ে যান আলোর পথে, ভালোর পথে।

মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর ॥ মিহির মুসাকী ॥ প্রকাশক: বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ॥ প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ॥ প্রচ্ছদ ও ছবি: অভিজিৎ রায় চৌধুরী ॥ মূল্য : ১০৫ টাকা।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২ , ৯ আষাড় ১৪২৮ ২৩ জিলকদ ১৪৪৩

শাশ্বত অনুষঙ্গে ‘মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর’

ওবায়েদ আকাশ

image

মানুষের জীবনে কবিতার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। আর এই ধারাতেই এই শিল্পমাধ্যমটি সাড়ম্বড়ে বিকশিত হয়ে চলেছে। এই প্রবহমানতাকে বেগবান যাঁরা করেন, কিংবা যাঁরা সবকিছু দিয়ে কবিতাকে ভালবেসে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে কবিতা রচনা করেন, তাঁরা কবি। তাঁরা প্রবল উপস্থিতির মধ্যে সাধারণ হয়েও অসাধারণ, পরিচিত হয়েও অপরিচিত। প্রচলিত মানুষ হয়েও একজন শিল্প স্রষ্টা এবং অন্য মানুষদের মতো হয়েও তিনি অনন্য। কারণ শিল্প বা কবিতা অনন্য। তার আবেদন সৌন্দর্যের সবটুকুজুড়ে। কবিতা সৌন্দর্যের বিকাশে কিংবা নন্দনের উৎর্ষতায় অতি উচ্চমার্গীয় একটি ধারা। কবি তাঁর বোধে ও ভাবনায় এই উচ্চতাকে ধারণ করেন। শব্দ বাক্য আর বিন্যাসের সুসমন্বয়ে কবির কল্পনারাজ্যে বাস করে কবিতা। কবি তাকে ভূমিষ্ঠ করেন। এর আনন্দ সীমাহীন। একে বলে সৃষ্টিসুখ। এই আনন্দ যিনি লাভ করেন, তাঁকে আর কখনো পরিপূর্ণভাবে বিষয়জাত জীবনে কিংবা আটপৌরে জীবনে পাওয়া যায় না। তখন তিনি ¯্রষ্টা। অজ¯্র কাজের ফাঁকেও সৃষ্টি করতে পারেন মহার্ঘ কল্পনাগাথা। যাকে আমরা কবিতা বলি।

এত কথা বললাম একজন পরিচিত কবিকে আরও একবার চেনানোর জন্য। নাম শুনলেই অনেকে চিনে ফেলবেন আবার আজকের প্রজন্ম হয়তো অনেকে তাঁকে নাও চিনতে পারেন। সমসাময়িক বাংলা কবিতার বলিষ্ঠ এই কণ্ঠস্বর কবি মিহির মুসাকী। কবিতা লিখছেন বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এখনো অবধি। বহু প্রতিভার অধিকারী এই কবি যে একজন নিমগ্ন শিল্পস্রষ্টা, এটা বোঝা যায় তাঁর কবিতায় অবগাহন করে। ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সীমাহীন ব্যস্ততা আর রাষ্ট্রীয় কাজকে নিজের দায়িত্ব মনে করে কাজ করে গেলেও, শিল্প তাঁকে ছাড়ে না। কবিতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে নিয়ে যায় লেখার টেবিলে।

তাঁর কবিতার বইগুলোর পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে কিছু শিশুতোষ কবিতাগ্রন্থও। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি কিশোরোপযোগী কবিতার বই ‘মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর’। এই নামকরণের মধ্যেও তিনি অসামান্য দুটি চিত্রকল্প রচনা করেছেন। এটি যে কোনো প্রাজ্ঞ কবির বইয়ের শিরোনাম, তা উচ্চারণমাত্র বোঝা যায়। গ্রন্থটির প্রতিটি কবিতাই ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার মতো আবেদনময়। কিশু-কিশোর মনে কবিতাগুলোর অনুরণন প্রভাবিত করবে, সন্দেহ নাই। কবিতার চিত্র ও চিত্রকল্প, দৃশ্য ও দৃশ্যকল্প, যুগপৎ ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার, অন্ত্যমিলের চমৎকরিত্ব, শব্দ নির্বাচনের দক্ষতা, উপমা-রূপকের যথার্থ ব্যবহার কবিতাগুলোকে বিশিষ্ট ও সাবলীল করে তুলেছে। প্রতিটি কবিতাই এত বেশি গভীরতা ও প্রখরতা ধারণ করেছে, এবং বর্ণনার সাবলীলতা এতটাই সহজাত যে, গ্রন্থটি একবার কেউ পড়তে শুরু করলে শেষ না করে আর ছাড়বেন না। কবিতায় যে বিষয়টিকেই তিনি ধারণ করেছেন, তা ডিটেইল ও অনুপুঙ্খ বর্ণনাবদ্ধ করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। ‘আমাদের নদী’ নামে প্রথম যে কবিতাটি গ্রন্থিত হয়েছে, সেখানে তিনি নদীর বেদনা ও কবির বেদনাকে একাকার করে উপস্থাপন করেছেন।

আমাদের নদীগুলো যেন গেছে মরে,

কোথা ছিল জল আহা কোথা গেল সরে।

কত বড় চর আজ পদ্মার বুকে

জল ছাড়া মাছগুলো মরে ধুঁকে ধুঁকে

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে নদীদের কান্না শুনতে পেয়েছিলেন। সেই তখনও নদীদের প্রবহমানতা ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু শিল্পমনের আয়নায় দেখা যায় তার আগামী। এটা এমনই এক হৃদয়ক্ষরিত বিষয় যে, আজ এত বছর পরও তা কবির চোখ এড়াতে পারছেন না। কবিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার বেদনা যারপরনাই উদ্বেলিত করেছে। তিনি নদীর ক্ষীণকায়া শরীর আর সরু ধারা দেখে বিস্মিত, তিনি হারানো নদীকে ফিরে পেতে চান। তিনি জাহাজ ভেড়া নদী দেখতে চান, ভাটিয়ালি জারিসারি গাওয়া নদী দেখতে চান, এমনকি নদীকে নিয়ে ছড়াগান লিখতে চান। তাই তিনি নদী খুঁজে ফেরেন- ‘রূপালি নদীর খোঁজে চোখ চিক্ চিক্ / এই দেশ হোক ফের নদীমাতৃক’। কবি মিহির মুসাকী বাংলাদেশকে প্রকৃতার্থেই নদীমাতৃক দেশ হিসেবে দেখতে চান। দুই পৃষ্ঠার এই কবিতায় হাজার পৃষ্ঠার আবেদন ছড়িয়েছেন। ষোলো কোটি মানুষের শাশ্বত দাবিকে তুলে ধরেছেন। নদী হারানোর বেদনাকে তুলে ধরেছেন। এই চিরন্তনতা কবি মিহির মুসাকীকে ভীষণভাবে তাড়িত করেছে। তাঁকে তাড়িত করেছে বাংলার প্রকৃতি ও কিশোরবেলা।

এছাড়াও এ গ্রন্থে যে কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে সেগুলো হলো- ‘বোশেখ তুমি আসো’, ‘বৃক্ষ এবং আমি’, ‘ছাদের মতো স্বাধীন হবো’, ‘ছোট্ট শহর’, ‘দেয়ালের কান’, ‘এই প্রকৃতি বন্ধু তোমার’, ‘গভীর রাতে ট্রেনের সাথে’, ‘কন্যা, তোমাকে’, ‘মেঘ ও রোদের খুনসুটি’, ‘পুত্র, তোমাকে’, ‘রাতের কাছে চিঠি’, ‘শোনো হে চিলেকোঠা’, ‘শোনো জাদুকর’ ও ‘সুতো-বোনা ভাবনার জাল’।

আমরা প্রায়ই বলে থাকি বৃক্ষের মতো উদার হও। জ্ঞানী হও। স্থিতধী হও। সত্যি বলতে বৃক্ষের কাছ থেকে আমাদের শেখার অন্ত নেই। বৃক্ষের কাছ থেকে আমাদের পাওয়ার অন্ত নেই। বৃক্ষ আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে যেমন, তেমনি আমরা বৃক্ষের কাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। ঝড়বৃষ্টিবাদলে বৃক্ষের কাছে আশ্রয় নেই। বৃক্ষের ছায়ায় প্রাণ শীতল করি। মানুষের মতো বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। কিন্তু মানুষ বৃক্ষ নয়, চঞ্চল সে। বৃক্ষ মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও, মানুষ তো বৃক্ষের ক্ষতিই করে চলেছে। কবি মিহির মুসাকী এই চিরন্তন বিষয়টাকে তাঁর ‘বৃক্ষ এবং আমি’ কবিতায় ধারণ করেছেন। এই কবিতায় তিনি মানুষ ও বৃক্ষের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। চরিত্রের দৈততা খুঁজে পেয়েছেন।

ও বৃক্ষ, তোমার সাথে আমার অনেক ফারাক

আমি যেন উড়ন্ত আর দুরন্ত এক প্রজাপতি,

ছুটতে গিয়ে এটা ভাঙি ওটা ভাঙি

করি আরও কত্তো ক্ষতি!

কবি মনে করেন, বৃক্ষের একটা শেকড় আছে কিন্তু মানুষের তা নেই বলে মানুষ বৃক্ষের মতো স্থিত হতে পারে না। কত সহজ আর প্রাত্যহিক এই বিষয়। কিন্তু আমরা কবির মতো করে উপলব্ধি করি না। বৃক্ষ কবিতাটি পাঠ করলে বৃক্ষ আর মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো এতটাই প্রকটভাবে আমাদের মধ্যে রেখাপাত করবে যে, আমাদের মনে হবে- আমরা জেনেবুঝেও এতদিন কেন তা শনাক্ত করিনি। এখানেই সাধারণের সঙ্গে কবির পার্থক্য বিদ্যমান। কবির দৃষ্টি প্রখর। তার দৃষ্টি প্রকৃতিকে, মানুষকে বিদ্ধ করে যায়।

আবার প্রকৃতির আরো আরো অনুষঙ্গ- পাখপাখালি, মাছ-মৌমাছি, পোকামাকড়- এসব কিছু আমাদেরকে কীভাবে আলোড়িত করছে, তা নানাভাবে ‘এই প্রকৃতি বন্ধু তোমার’ কবিতায় মিহির মুসাকী নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। এমন বর্ণনায় যেন শৈশবে ফিরে যাবার অনুষঙ্গ তৈরি হয়। কৈশরে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর আস্বাদ মেলে।

জলের ভেতর কাটছে সাঁতার মাছরা ঝাঁকে ঝাঁকে

কেমন ওদের জগৎ ওরা জলে কেমন থাকে।

কোন ভাষাতে কথা বলে কী করে পথ চেনে?

এই আমাদের মতো ওরা জামাকাপড় কেনে?

কবির কিশোর মনে প্রকৃতির নানা সৃষ্টিকে ঘিরে এমন নানা প্রশ্নের উদয় হয়, আবার কবিকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে এই প্রকৃতির খেলা। এভাবে তিনি হেঁটে হেঁটে অপার প্রকৃতি পাড়ি দিতে গিয়ে দেখেন নানান প্রজাতির নানান খেলা, মুখরতা।

পোকামাকড় আসল আমার সামনে বেঁধে সারি

গাছের কোটর মাটির ঢিঁবি ওদের সুখের বাড়ি।

আমার সামনে নৃত্য করে রঙিন প্রজাপতি,

পিঁপড়ে বলে আমরা তোমার করব না তো ক্ষতি।

দৃশ্যমান পৃথবীর অলঙ্কার, আমাদের চারপাশের বিপুল নিসর্গভাণ্ডার তারা কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। আমরা নিজেরাই একটা বিভাজন করে পার্থক্য রচনা করি। প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবি। প্রকারান্তরে সব কিছুই তো মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন ¯্রষ্টা। একটি পিঁপড়ের কাছেও শুনতে পান কবি, যে, সে মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না। এসব উত্থাপনের ভেতর দিয়ে কবি তার প্রকৃতিপ্রেমকে উদ্ভাসিত করেছেন। বাংলার নিসর্গমুগ্ধতাকে বর্ণনা করেছেন এবং নিজেদের ঐতিহ্য ও শেকড়ের প্রতি মানুষের প্রেমকে আহ্বান করেছেন। এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই এভাবে শাশ^ত অনুষঙ্গে লেখা। প্রতিটি কবিতা নিয়েই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আলোচনা করা যায়, সন্দেহ নেই। কবি মিহির মুসাকী যে শুধু বড়দের কবি নন, তিনি যে একজন উত্তীর্ণ শিশুকিশোর সাহিত্য রচয়িতা তা তাঁর এ জাতীয় গ্রন্থগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। কবি বলেছেন, ‘এই আছি বেশ আলোর রথে ভালোর পথে আমি।’ তিনি তাই থাকুন, আরো আরো এমন গ্রন্থ রচনা করে পাঠককেও নিয়ে যান আলোর পথে, ভালোর পথে।

মেঘের নূপুর পায়ে দুপুর ॥ মিহির মুসাকী ॥ প্রকাশক: বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ॥ প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ॥ প্রচ্ছদ ও ছবি: অভিজিৎ রায় চৌধুরী ॥ মূল্য : ১০৫ টাকা।