সরছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

দিশেহারা বানভাসি মানুষ

সিলেট অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ত্রাণ পৌঁছাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও পানিবন্দী অবস্থায় আছেন লাখ লাখ মানুষ। যেসব এলাকার পানি সরে গেছে সেখানেও দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। নেই বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ সংকটসহ নানা সমস্যা। বানের পানিতে অনেকের ভেসে গেছে সব সম্বল। তারা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেও চোখে হাতাশার ছাপ। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়, অর্থাৎ একবারেই দিশেহারা। যদিও গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বন্যাদুর্গত এলাকা নিজ চোখে দেখে ক্ষতিগ্রস্তদের অভয় দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি এই বন্যায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে রাস্তাঘাট, গবাদিপশু ও মাছের খামার ভেসে যায় বন্যার পানিতে। অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় আটকেপড়া মানুষের কাছে খাবার পৌঁছাতে ও তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।

সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম একটি গ্রাম চটিবহর কোনাগাঁও। এই গ্রামের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কোন উপায় না দেখে ৩২টি পরিবার কিছু খবার নিয়ে বড় কয়েকটি স্টিলের নৌকায় আশ্রয় নেন। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক। এমতাবস্তায় তাদের খাবারও ফুরিয়ে যায়। তাদের এই দুর্দশার খবরও কোথাও বলা যাচ্ছিল না।

অবশেষে মঙ্গলবার মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করায় নৌকায় অবস্থানরত দিনমজুর রহমাত আলীর স্ত্রী হনুফা বেগম বুদ্ধি খাটিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কল করেন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ। সেই কল সংযুক্ত করা হয় সিলেট জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফর রহমানের কাছে। ওই প্রান্ত থেকে নারীর শুধু কান্নার শব্দ আসছিল। পরে তিনি ওই নারীর কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে বিস্তারিত জানেন।

লুৎফুর রহমান বলেন, হনুফা বেগম জানান, তিন দিন ধরে তারা না খেয়ে আছেন। খবরটি পাওয়ার পরই কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে ওই নারী ও গ্রামটির ৩২ পরিবারের জন্য দ্রুত খাবার পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর থানার উপপরিদর্শক মো. আজিজুর রহমান, গোপেশ দাশ ও জাহাঙ্গীর আলমসহ কয়েকজন খাবার নিয়ে নৌকায় করে গ্রামটির উদ্দেশে রওনা দেন। রাত ৮টার দিকে পুলিশ সদস্যরা গ্রামটিতে পৌঁছে অভুক্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনো খাবার তুলে দেন।

লুৎফুর রহমান বলেন, গ্রামটি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অধীনে হলেও এটা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। রাতের অন্ধকারে বন্যার পানি পাড়ি দিয়ে অভুক্ত পরিবারগুলোর হাতে খাবার তুলে দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব হচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতি যেমন

রোববার ও সোমবার পানি অনেকটা কমলেও মঙ্গলবার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত বরং মঙ্গলবার রাতভর ও বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সিলেটে বৃ?ষ্টি হওয়ায় সহসা পানি কমার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে সিলেটের কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারা ও সারি নদীর দুটি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। গতকাল সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিল ১১ দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টার হিসাব অনুযায়ী সেখানে পানি ছিল ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার।

কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। সেখানে গত সোমবার পানি ছিল ১৭ দশমিক ২৯ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৬টায় সেখানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদীর শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। সেখানে সকাল ৯টায় পানি অবস্থান করছে ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে। কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় বিপৎসীমার দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। সেখানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল ৮ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টায় সেখানে ১০ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল।

এছাড়া লুভা নদীর পানি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ১৩ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটারে ছিল। গতকাল সকাল ৯টায় সেটি ১৩ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। সারি নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার এক দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে সিলেট নগরীর তালতলা, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, কুয়ারপাড়, লালাদীঘির পাড়, শিবগঞ্জ, তেররতন, শাহজালাল উপশহর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- এসব এলাকায় পানি আগের অবস্থানে রয়েছে। বন্যাকবলিত নগরীর বাসিন্দারা বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা ট্যাংক বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সামনে এবং আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে অবস্থান করতে দেখা গেছে। নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকায় পানি কিছুটা নামলেও সেখানে নৌকা চলাচল করছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে ৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে সিটি করপোরেশন। সেগুলোতে প্রায় ৭ হাজার বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ করার পাম্পগুলো বন্যার পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পানি সরবরাহের ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকের মাধ্যমে নগরীর বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

তলিয়ে গেছে ৭১০ গবাদিপশুর খামার

গতকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানিতে সিলেট জেলায় হাঁস-মুরগিসহ তিন হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা গেছে। আর ডুবে গেছে গবাদিপশুর ৭১০টি খামার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি কমলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। কোম্পানীগঞ্জের বিলাজুর এলাকার এরশাদ মিয়া বন্যায় হালের গরু ভেসে যাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘বন্যা সব নিয়ে গেছে। ঘরে গরু ও মুরগি ছিল, এগুলোও ভাসিয়ে নিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্রও স্রোতে ভেসে গেছে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। কেবল নিজেরা জীবন নিয়ে কোনোমতে আছি।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১৮৯টি গবাদিপশু মারা গেছে। আর জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট জেলায় ৭১০টি খামার ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে এক হাজার ৯৯১ টন খড় ও ২ হাজার ৯৫৯ টন ঘাস। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত জেলায় প্রাণিসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

চলমান বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। তবে এ উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির কোন তথ্য নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে। অধিপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পানিতে উপজেলা পরিষদ ভবন তলিয়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় এই উপজেলার তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এই ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও পুরো জেলায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গো-চারণভূমি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহজেই এ সংকট কাটবে না।

‘গত শুক্রবার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বন্যা নিয়ে জরুরি সভায়ও গো-খাদ্যের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরাও মন্ত্রলায়ে চাহিদা পাঠিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনও পাওয়া যায়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় সুনামগঞ্জের সঙ্গে আমরা কোন যোগাযোগই করতে পারছি না। একই অবস্থা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জেরও। পানি সম্পূর্ণ নেমে গেলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে।’

এই অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সোমবার পর্যন্ত ২২টি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১১টি, জৈন্তাপুরে ৪টি ও গোয়াইনঘাটে ৭টি। মহিষ মারা গেছে ৭টি। সবগুলোই গোয়াইনঘাটে। ছাগল মারা গেছে ২১টি। এরমধ্যে ২টি জৈন্তাপুরে ও ১৯টি গোয়াইনঘাটে।

বন্যায় এ পর্যন্ত ভেড়া মারা গেছে ১৩টি। এর মধ্যে কানাইঘাটে ৩টি, গোয়াইনঘাট ৮টি ও জৈন্তাপুরে ২টি। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মুরগি। এ পর্যন্ত এর সংখ্যা ২ হাজার ৭১৫। হাঁস মারা গেছে মোট ৩৯১টি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো রুস্তুম আলী বলেন, ‘আমরা আপাতত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া গবাদিপশুকে চিকিৎসা দিচ্ছি। পানি নেমে গেলে যাতে সংক্রামক রোগ দেখা না দেয়, এজন্য ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্লাবিত এলাকায় গো-খাদ্য সরবরাহেরও চেষ্টা করছি আমরা।’

পিতার লাশ নিয়ে দাফনের অপেক্ষা

ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেলে রিকশাচালক ইব্রাহিম মিয়া তার পরিবারের লোকজনদের নিয়ে আশ্রয় নেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত ইব্রাহিমের বাবা আশরাফ আলী (৮৫) আশ্রয়কেন্দ্রেই মারা যান।

আশ্রয়কেন্দ্রে শুরু হয় বিলাপ। অতিবৃষ্টি, ঘনঘন বজ্রপাত এবং মিনিটে মিনিটে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইব্রাহিম মিয়া অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় নৌকা না থাকায় বাবাকে তিনি নিতে পারেননি হাসপাতালে। চারপাশে থইথই পানি। বাবার লাশ নিয়ে অপেক্ষা করেন, বৃষ্টি ও পানি কমলে দাফন করবেন। কিন্তু বৃষ্টি তো কমার দূরের কথা বন্যার পানি আরও বাড়তে থাকে। পরে নিরুপায় হয়ে বাবার মরদেহ পলিথিনে মুড়ে বক্সের ভেতর রেখে কবরস্থানের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন পাঁচ দিন ধরে। পানি কমলে কবরে দাফন করবেন, এই আশায়।

জানা যায়, বন্যার সময় সাধারণত কোনভাবে মরদেহ দাফন করতে না পারলে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু নিজের বাবার মরদেহ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার সাহস হয়নি তার। তাই পলিথিনে মুড়ে বাক্সবন্দী করে অপেক্ষা করছেন তিনি। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জ শহরতলীর সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ইব্রাহিম জানান, গত ১৭ জুন রাত সাড়ে ১২টায় তার বাবা মারা যান। সর্বত্র বন্যার পানি থাকায় বাবার মরদেহ দাফন করতে না পারায় তিনি বাক্সবন্দী করে রেখেছেন।

ইব্রাহিম বলেন, ‘আব্বা মারা গেছেন। আমাদের কবরস্থান পানির নিচে। জানাজাও পড়ছি নৌকার ওপর। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এখন বসে আছি পানি কমলে বাবার লাশ দাফন করবো কবরে।

বিধ্বস্ত তাহিরপুর নতুন করে বানাতে চান ফারাজ

সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ায় ছাতক ও তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

তাহিরপুরের এ দুর্দশার কথা জানতে পেরে এলাকাবাসীর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ফারাজ করিম চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘উজানের ঢলে তাহিরপুর গ্রামের বাড়ি-ঘর সব বিধ্বস্ত হয়েছে। কিছু বাকি নেই। সুতরাং এক আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঘোষণা দিলাম, সেই গ্রামটা আমি পুরোপুরি আবার নতুন করে বানাবো ইনশাআল্লাহ। তার মানে, গ্রামের ১টা-২টা, ৩টা-১০টা, ৩০-৪০-৫০-৮০ আর ১০০টা না, ২০০-৫০০টা বাসাও যদি লাগে পুরো গ্রামটা আমরা বানাবো। কেমনে বানাবো, আল্লাহর ওপর ভরসা আছে। আপনারা আমার সঙ্গে আছেন, মুরুব্বিদের দোয়া আছে, ইনশাআল্লাহ আমি পারবো’।

ফারাজ করিম চৌধুরীর এ বক্তব্য সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। একের পর এক ব্যতিক্রমী কর্মকা- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরে দেশেজুড়ে তিনি অর্জন করেছেন তুমুল জনপ্রিয়তা।

২০১৩ সালে কিংস কলেজ লন্ডন থেকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শেষ করে ২০১৫ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে আসেন এ তরুণ। তখন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকা-ে অংশ নিয়ে বেশ পরিচিতি পান। দেশের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপর্যায়ে চাকরির সুযোগ থাকলেও সে পথে পা বাড়াননি ফারাজ। নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।

ছাতক : সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যার পানি কমছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমায় স্বাভাবিক হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে অনেকেই ফিরছেন বাসা-বাড়িতে। রয়েছে খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এখানে দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ফের বন্যায় তলিয়ে যায় উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।

ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে শত শত ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, সকল খামারের মাছ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, এখনো সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে চিকিৎসাসেবা। তবে কৈতক হাসপাতালে বন্যার পানি রয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে চিকিৎসাসেবা। এদিকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বন্যার অজুহাতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়।

ওই কারণে গত মঙ্গলবার বাজার মনিটরিং করতে দেখা গেছে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইসলাম উদ্দিনকে। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিটি জিনিসের মূল্য তালিকা সাঁটিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ক্রেতাদের মূল্য তালিকা যাচাই করে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দেন। ছাতক-সিলেট ও ছাতক-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে ফকিরটিলা-মাছিমপুর বাজার সড়ক, ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট, কালারুকা ইউনিয়নের মুক্তিরগাঁও, বঙ্গবন্ধু, আমেরতল-ধারন, পালপুর-খুরমা, বোকারভাঙ্গা-সিরাজগঞ্জ সড়ক এখনও পানির নিচে রয়েছে।

এ কারণে শহরের সঙ্গে বর্তমানে ওইসব ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব চক্রবর্তী জানান, হাসপাতালে ডায়রিয়াজনিত ও শিশুরোগী বেশি আসছেন। বন্যা-পরবর্তী প্রয়োজনে মেডিকেল টিম গঠন করে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা দেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানিয়েছেন, পানি কমতে শুরু হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজন বাসা-বাড়িতে ফিরছেন। আবার কিছু এলাকা রয়েছে নি¤œাঞ্চল। ওইসব এলাকার লোকজন সরতে কিছুটা সময় লাগবে। পানিবন্দী লোকজনের জন্য ত্রাণতৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সদরের পানি কিছুটা কমলেও অন্যান্য উপজেলাগুলোতে বেড়েই চলেছে। আটপাড়া, বারহাট্টাসহ নেত্রকোনা সদরের নতুন নতুন এলাকায় পানিবন্দী হচ্ছে মানুষ। বাড়ি থেকে মূল সড়কে যেতে লাগে নৌকা। চিড়া-মুড়ি আনতে গেলেও যাদের নৌকা নেই যেতে হয় কোমড় পানি ভেঙেই। এই অবস্থা গতকাল বিকেল পর্যন্ত জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বমুশিয়া, সুখারী, শুনইসহ প্রায় সব ইউনিয়নে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে তেমন কোন উন্নতি নেই নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির। পুরো এক সপ্তাহে ১০ উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। প্রথম বন্যাকবলিত কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায় সেনাবাহিনীসহ প্রশাসন এবং নানা সংগঠনের উদ্ধার তৎপররা ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালু থাকলেও কংশ নদীর পানির ঢল এখন অন্যান্য এলাকায় ধাবিত হচ্ছে। বাড়ি-ঘর থেকে বের হতে পারছেন না নারী শিশুরা। একমাত্র ভরসা তাদের নৌকা। এক বাড়ির ডিঙি নৌকা এখন কয়েক বাড়ির ভরসা। ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবাইকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নৌকায় চলতে হচ্ছে। চুলাগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আটপাড়া উপজেলার যাদবপুরের অর্ধশত পরিবারে রান্না বন্ধ রয়েছে।

জ¦রে ভুগে স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মাদল গ্রামের আলী উসমানের ছেলে সলিমুদ্দিন (৬৫) মারা গেছেন মঙ্গলবার। কবরস্থানসহ গ্রামীণ সড়কেও পানি থাকায় রান্না ঘরের ভেতর কবর দেয় স্বজনরা। সেখানেও কবরের ভেতর উঠে পড়ে পানি।

মাইঝপাড়া গ্রামের বকুলা আক্তার বারান্দায় চুলা বসিয়ে দুইদিন পর হাঁড়িতে চাল দিয়েছেন। স্বামী সেকান্দর সড়ক দুর্ঘটনায় গত ৪০ দিন আগে মারা গেলে বাড়িতে ৪০ দিনের আয়োজন তো দূরের কথা কোন হুজুরকেও খাওয়াতে পারছেন না। সে কারণে বারান্দায় চুলা পেতে মাদ্রাসার দুই এতিম ছাত্রকে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে যাদবপুর, সিংরাজনা, বিছরাকান্দা, মাদল এলাকার শত শত বাড়িতে হাঁটুসহ কোমড় পরিমাণ পানি জমলেও নেই কোন সহযোগিতা। অনেকের নেই ডুবে যাওয়া সড়ক পেরিয়ে খাবার আনার উপায়। বেশ কিছু মানুষ চলে যাচ্ছেন ট্রলারে চরে অন্যত্র। আবার কিছু পরিবার আটপাড়া নেত্রকোনা মেইন সড়কের পাশে খালি জায়গায় গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবন্দী অসংখ্য মানুষ।

এদিকে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বিভিন্ন দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে প্রায় প্রতিদিন দিচ্ছেন ত্রাণ সহয়াতা। দুর্গাপুরে ত্রাণ সহায়তাসহ উদ্ধার কাজে নেমেছেন ১৯ পদাতিকের জিওসি মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী। নেত্রকোনা পৌরসভার উদ্যোগে বারহাট্টার দশধার এলাকায় দিচ্ছেন ৫০০ প্যাকেট ত্রাণ সহায়তা। আওয়ামী শ্রমিক লীগের উদ্যোগে বড়াইল এলাকায় দেয়া হচ্ছে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার।

জামালপুর : জামালপুরে যমুনার পানি বৃদ্ধি অপরিপর্তিত (স্থিতিশীল) রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার ৭টি উপজেলা ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৩৬টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারসহ গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, ১১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় আমন বীজতলা, আউশ ধান, পাট, সবজি, মরিচ, তিল ও ভুট্টা পানিতে তলিয়ে গেছে।

image

সিলেট : পানি নামছে, ক্ষুধার্ত মানুষ ছুটছে ত্রাণের জন্য। ত্রাণ হাতে পেয়ে পরম সুখে দু’চোখে তার নেমে আসে কান্না, কেটেছে কয়েকদিনের উপোস, পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগের এক করুণ চিত্র। সরকারি, সেনাবাহিনী, বেসরকারি সংস্থা ও দেশবাসী ত্রাণ সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে -সংবাদ

আরও খবর
টোলপ্লাজা ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় বসানো হচ্ছে সিসি ক্যামেরা
‘নিজের ভাঁড় ভালো না, গোয়ালার ঘিয়ের দোষ দিয়ে লাভ কী?’
‘বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, মোকাবিলার প্রস্তুতিও আছে’
আফগানিস্তানে ভূমিকম্প, নিহত হাজার পার
বন্যাকবলিত এলাকায় মৃত্যু বেড়ে ৪২
রাঙ্গামাটিতে গুলিতে নিহত ৩ ‘কুকি চীন’ পার্টি দায় স্বীকার

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০২২ , ৯ আষাড় ১৪২৮ ২৩ জিলকদ ১৪৪৩

সরছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

দিশেহারা বানভাসি মানুষ

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

image

সিলেট : পানি নামছে, ক্ষুধার্ত মানুষ ছুটছে ত্রাণের জন্য। ত্রাণ হাতে পেয়ে পরম সুখে দু’চোখে তার নেমে আসে কান্না, কেটেছে কয়েকদিনের উপোস, পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগের এক করুণ চিত্র। সরকারি, সেনাবাহিনী, বেসরকারি সংস্থা ও দেশবাসী ত্রাণ সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে -সংবাদ

সিলেট অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ত্রাণ পৌঁছাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও পানিবন্দী অবস্থায় আছেন লাখ লাখ মানুষ। যেসব এলাকার পানি সরে গেছে সেখানেও দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। নেই বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ সংকটসহ নানা সমস্যা। বানের পানিতে অনেকের ভেসে গেছে সব সম্বল। তারা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেও চোখে হাতাশার ছাপ। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়, অর্থাৎ একবারেই দিশেহারা। যদিও গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বন্যাদুর্গত এলাকা নিজ চোখে দেখে ক্ষতিগ্রস্তদের অভয় দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি এই বন্যায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে রাস্তাঘাট, গবাদিপশু ও মাছের খামার ভেসে যায় বন্যার পানিতে। অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় আটকেপড়া মানুষের কাছে খাবার পৌঁছাতে ও তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।

সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম একটি গ্রাম চটিবহর কোনাগাঁও। এই গ্রামের রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কোন উপায় না দেখে ৩২টি পরিবার কিছু খবার নিয়ে বড় কয়েকটি স্টিলের নৌকায় আশ্রয় নেন। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক। এমতাবস্তায় তাদের খাবারও ফুরিয়ে যায়। তাদের এই দুর্দশার খবরও কোথাও বলা যাচ্ছিল না।

অবশেষে মঙ্গলবার মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করায় নৌকায় অবস্থানরত দিনমজুর রহমাত আলীর স্ত্রী হনুফা বেগম বুদ্ধি খাটিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কল করেন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ। সেই কল সংযুক্ত করা হয় সিলেট জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফর রহমানের কাছে। ওই প্রান্ত থেকে নারীর শুধু কান্নার শব্দ আসছিল। পরে তিনি ওই নারীর কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে বিস্তারিত জানেন।

লুৎফুর রহমান বলেন, হনুফা বেগম জানান, তিন দিন ধরে তারা না খেয়ে আছেন। খবরটি পাওয়ার পরই কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে ওই নারী ও গ্রামটির ৩২ পরিবারের জন্য দ্রুত খাবার পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর থানার উপপরিদর্শক মো. আজিজুর রহমান, গোপেশ দাশ ও জাহাঙ্গীর আলমসহ কয়েকজন খাবার নিয়ে নৌকায় করে গ্রামটির উদ্দেশে রওনা দেন। রাত ৮টার দিকে পুলিশ সদস্যরা গ্রামটিতে পৌঁছে অভুক্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনো খাবার তুলে দেন।

লুৎফুর রহমান বলেন, গ্রামটি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অধীনে হলেও এটা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। রাতের অন্ধকারে বন্যার পানি পাড়ি দিয়ে অভুক্ত পরিবারগুলোর হাতে খাবার তুলে দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব হচ্ছে।

বন্যা পরিস্থিতি যেমন

রোববার ও সোমবার পানি অনেকটা কমলেও মঙ্গলবার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত বরং মঙ্গলবার রাতভর ও বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সিলেটে বৃ?ষ্টি হওয়ায় সহসা পানি কমার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে সিলেটের কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারা ও সারি নদীর দুটি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। গতকাল সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিল ১১ দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টার হিসাব অনুযায়ী সেখানে পানি ছিল ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার।

কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। সেখানে গত সোমবার পানি ছিল ১৭ দশমিক ২৯ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৬টায় সেখানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদীর শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। সেখানে সকাল ৯টায় পানি অবস্থান করছে ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে। কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় বিপৎসীমার দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ থেকে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। সেখানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল ৮ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টায় সেখানে ১০ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল।

এছাড়া লুভা নদীর পানি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ১৩ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটারে ছিল। গতকাল সকাল ৯টায় সেটি ১৩ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। সারি নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার এক দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে সিলেট নগরীর তালতলা, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, কুয়ারপাড়, লালাদীঘির পাড়, শিবগঞ্জ, তেররতন, শাহজালাল উপশহর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- এসব এলাকায় পানি আগের অবস্থানে রয়েছে। বন্যাকবলিত নগরীর বাসিন্দারা বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা ট্যাংক বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সামনে এবং আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে অবস্থান করতে দেখা গেছে। নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকায় পানি কিছুটা নামলেও সেখানে নৌকা চলাচল করছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে ৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে সিটি করপোরেশন। সেগুলোতে প্রায় ৭ হাজার বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ করার পাম্পগুলো বন্যার পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পানি সরবরাহের ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকের মাধ্যমে নগরীর বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

তলিয়ে গেছে ৭১০ গবাদিপশুর খামার

গতকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানিতে সিলেট জেলায় হাঁস-মুরগিসহ তিন হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা গেছে। আর ডুবে গেছে গবাদিপশুর ৭১০টি খামার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি কমলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। কোম্পানীগঞ্জের বিলাজুর এলাকার এরশাদ মিয়া বন্যায় হালের গরু ভেসে যাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘বন্যা সব নিয়ে গেছে। ঘরে গরু ও মুরগি ছিল, এগুলোও ভাসিয়ে নিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্রও স্রোতে ভেসে গেছে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। কেবল নিজেরা জীবন নিয়ে কোনোমতে আছি।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১৮৯টি গবাদিপশু মারা গেছে। আর জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট জেলায় ৭১০টি খামার ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে এক হাজার ৯৯১ টন খড় ও ২ হাজার ৯৫৯ টন ঘাস। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত জেলায় প্রাণিসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

চলমান বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। তবে এ উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির কোন তথ্য নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে। অধিপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পানিতে উপজেলা পরিষদ ভবন তলিয়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় এই উপজেলার তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এই ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও পুরো জেলায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গো-চারণভূমি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহজেই এ সংকট কাটবে না।

‘গত শুক্রবার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বন্যা নিয়ে জরুরি সভায়ও গো-খাদ্যের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরাও মন্ত্রলায়ে চাহিদা পাঠিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনও পাওয়া যায়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় সুনামগঞ্জের সঙ্গে আমরা কোন যোগাযোগই করতে পারছি না। একই অবস্থা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জেরও। পানি সম্পূর্ণ নেমে গেলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে।’

এই অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সোমবার পর্যন্ত ২২টি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১১টি, জৈন্তাপুরে ৪টি ও গোয়াইনঘাটে ৭টি। মহিষ মারা গেছে ৭টি। সবগুলোই গোয়াইনঘাটে। ছাগল মারা গেছে ২১টি। এরমধ্যে ২টি জৈন্তাপুরে ও ১৯টি গোয়াইনঘাটে।

বন্যায় এ পর্যন্ত ভেড়া মারা গেছে ১৩টি। এর মধ্যে কানাইঘাটে ৩টি, গোয়াইনঘাট ৮টি ও জৈন্তাপুরে ২টি। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মুরগি। এ পর্যন্ত এর সংখ্যা ২ হাজার ৭১৫। হাঁস মারা গেছে মোট ৩৯১টি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো রুস্তুম আলী বলেন, ‘আমরা আপাতত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া গবাদিপশুকে চিকিৎসা দিচ্ছি। পানি নেমে গেলে যাতে সংক্রামক রোগ দেখা না দেয়, এজন্য ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্লাবিত এলাকায় গো-খাদ্য সরবরাহেরও চেষ্টা করছি আমরা।’

পিতার লাশ নিয়ে দাফনের অপেক্ষা

ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেলে রিকশাচালক ইব্রাহিম মিয়া তার পরিবারের লোকজনদের নিয়ে আশ্রয় নেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত ইব্রাহিমের বাবা আশরাফ আলী (৮৫) আশ্রয়কেন্দ্রেই মারা যান।

আশ্রয়কেন্দ্রে শুরু হয় বিলাপ। অতিবৃষ্টি, ঘনঘন বজ্রপাত এবং মিনিটে মিনিটে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইব্রাহিম মিয়া অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় নৌকা না থাকায় বাবাকে তিনি নিতে পারেননি হাসপাতালে। চারপাশে থইথই পানি। বাবার লাশ নিয়ে অপেক্ষা করেন, বৃষ্টি ও পানি কমলে দাফন করবেন। কিন্তু বৃষ্টি তো কমার দূরের কথা বন্যার পানি আরও বাড়তে থাকে। পরে নিরুপায় হয়ে বাবার মরদেহ পলিথিনে মুড়ে বক্সের ভেতর রেখে কবরস্থানের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন পাঁচ দিন ধরে। পানি কমলে কবরে দাফন করবেন, এই আশায়।

জানা যায়, বন্যার সময় সাধারণত কোনভাবে মরদেহ দাফন করতে না পারলে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু নিজের বাবার মরদেহ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার সাহস হয়নি তার। তাই পলিথিনে মুড়ে বাক্সবন্দী করে অপেক্ষা করছেন তিনি। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জ শহরতলীর সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ইব্রাহিম জানান, গত ১৭ জুন রাত সাড়ে ১২টায় তার বাবা মারা যান। সর্বত্র বন্যার পানি থাকায় বাবার মরদেহ দাফন করতে না পারায় তিনি বাক্সবন্দী করে রেখেছেন।

ইব্রাহিম বলেন, ‘আব্বা মারা গেছেন। আমাদের কবরস্থান পানির নিচে। জানাজাও পড়ছি নৌকার ওপর। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। এখন বসে আছি পানি কমলে বাবার লাশ দাফন করবো কবরে।

বিধ্বস্ত তাহিরপুর নতুন করে বানাতে চান ফারাজ

সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ায় ছাতক ও তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

তাহিরপুরের এ দুর্দশার কথা জানতে পেরে এলাকাবাসীর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ফারাজ করিম চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘উজানের ঢলে তাহিরপুর গ্রামের বাড়ি-ঘর সব বিধ্বস্ত হয়েছে। কিছু বাকি নেই। সুতরাং এক আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঘোষণা দিলাম, সেই গ্রামটা আমি পুরোপুরি আবার নতুন করে বানাবো ইনশাআল্লাহ। তার মানে, গ্রামের ১টা-২টা, ৩টা-১০টা, ৩০-৪০-৫০-৮০ আর ১০০টা না, ২০০-৫০০টা বাসাও যদি লাগে পুরো গ্রামটা আমরা বানাবো। কেমনে বানাবো, আল্লাহর ওপর ভরসা আছে। আপনারা আমার সঙ্গে আছেন, মুরুব্বিদের দোয়া আছে, ইনশাআল্লাহ আমি পারবো’।

ফারাজ করিম চৌধুরীর এ বক্তব্য সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। একের পর এক ব্যতিক্রমী কর্মকা- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরে দেশেজুড়ে তিনি অর্জন করেছেন তুমুল জনপ্রিয়তা।

২০১৩ সালে কিংস কলেজ লন্ডন থেকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শেষ করে ২০১৫ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে আসেন এ তরুণ। তখন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকা-ে অংশ নিয়ে বেশ পরিচিতি পান। দেশের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপর্যায়ে চাকরির সুযোগ থাকলেও সে পথে পা বাড়াননি ফারাজ। নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।

ছাতক : সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যার পানি কমছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমায় স্বাভাবিক হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে অনেকেই ফিরছেন বাসা-বাড়িতে। রয়েছে খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এখানে দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ফের বন্যায় তলিয়ে যায় উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।

ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে শত শত ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, সকল খামারের মাছ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, এখনো সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে চিকিৎসাসেবা। তবে কৈতক হাসপাতালে বন্যার পানি রয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে চিকিৎসাসেবা। এদিকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বন্যার অজুহাতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়।

ওই কারণে গত মঙ্গলবার বাজার মনিটরিং করতে দেখা গেছে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইসলাম উদ্দিনকে। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিটি জিনিসের মূল্য তালিকা সাঁটিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ক্রেতাদের মূল্য তালিকা যাচাই করে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দেন। ছাতক-সিলেট ও ছাতক-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে ফকিরটিলা-মাছিমপুর বাজার সড়ক, ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট, কালারুকা ইউনিয়নের মুক্তিরগাঁও, বঙ্গবন্ধু, আমেরতল-ধারন, পালপুর-খুরমা, বোকারভাঙ্গা-সিরাজগঞ্জ সড়ক এখনও পানির নিচে রয়েছে।

এ কারণে শহরের সঙ্গে বর্তমানে ওইসব ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব চক্রবর্তী জানান, হাসপাতালে ডায়রিয়াজনিত ও শিশুরোগী বেশি আসছেন। বন্যা-পরবর্তী প্রয়োজনে মেডিকেল টিম গঠন করে বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা দেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানিয়েছেন, পানি কমতে শুরু হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজন বাসা-বাড়িতে ফিরছেন। আবার কিছু এলাকা রয়েছে নি¤œাঞ্চল। ওইসব এলাকার লোকজন সরতে কিছুটা সময় লাগবে। পানিবন্দী লোকজনের জন্য ত্রাণতৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সদরের পানি কিছুটা কমলেও অন্যান্য উপজেলাগুলোতে বেড়েই চলেছে। আটপাড়া, বারহাট্টাসহ নেত্রকোনা সদরের নতুন নতুন এলাকায় পানিবন্দী হচ্ছে মানুষ। বাড়ি থেকে মূল সড়কে যেতে লাগে নৌকা। চিড়া-মুড়ি আনতে গেলেও যাদের নৌকা নেই যেতে হয় কোমড় পানি ভেঙেই। এই অবস্থা গতকাল বিকেল পর্যন্ত জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বমুশিয়া, সুখারী, শুনইসহ প্রায় সব ইউনিয়নে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে তেমন কোন উন্নতি নেই নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির। পুরো এক সপ্তাহে ১০ উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। প্রথম বন্যাকবলিত কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায় সেনাবাহিনীসহ প্রশাসন এবং নানা সংগঠনের উদ্ধার তৎপররা ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালু থাকলেও কংশ নদীর পানির ঢল এখন অন্যান্য এলাকায় ধাবিত হচ্ছে। বাড়ি-ঘর থেকে বের হতে পারছেন না নারী শিশুরা। একমাত্র ভরসা তাদের নৌকা। এক বাড়ির ডিঙি নৌকা এখন কয়েক বাড়ির ভরসা। ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবাইকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নৌকায় চলতে হচ্ছে। চুলাগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আটপাড়া উপজেলার যাদবপুরের অর্ধশত পরিবারে রান্না বন্ধ রয়েছে।

জ¦রে ভুগে স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মাদল গ্রামের আলী উসমানের ছেলে সলিমুদ্দিন (৬৫) মারা গেছেন মঙ্গলবার। কবরস্থানসহ গ্রামীণ সড়কেও পানি থাকায় রান্না ঘরের ভেতর কবর দেয় স্বজনরা। সেখানেও কবরের ভেতর উঠে পড়ে পানি।

মাইঝপাড়া গ্রামের বকুলা আক্তার বারান্দায় চুলা বসিয়ে দুইদিন পর হাঁড়িতে চাল দিয়েছেন। স্বামী সেকান্দর সড়ক দুর্ঘটনায় গত ৪০ দিন আগে মারা গেলে বাড়িতে ৪০ দিনের আয়োজন তো দূরের কথা কোন হুজুরকেও খাওয়াতে পারছেন না। সে কারণে বারান্দায় চুলা পেতে মাদ্রাসার দুই এতিম ছাত্রকে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিকে যাদবপুর, সিংরাজনা, বিছরাকান্দা, মাদল এলাকার শত শত বাড়িতে হাঁটুসহ কোমড় পরিমাণ পানি জমলেও নেই কোন সহযোগিতা। অনেকের নেই ডুবে যাওয়া সড়ক পেরিয়ে খাবার আনার উপায়। বেশ কিছু মানুষ চলে যাচ্ছেন ট্রলারে চরে অন্যত্র। আবার কিছু পরিবার আটপাড়া নেত্রকোনা মেইন সড়কের পাশে খালি জায়গায় গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবন্দী অসংখ্য মানুষ।

এদিকে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বিভিন্ন দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে প্রায় প্রতিদিন দিচ্ছেন ত্রাণ সহয়াতা। দুর্গাপুরে ত্রাণ সহায়তাসহ উদ্ধার কাজে নেমেছেন ১৯ পদাতিকের জিওসি মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী। নেত্রকোনা পৌরসভার উদ্যোগে বারহাট্টার দশধার এলাকায় দিচ্ছেন ৫০০ প্যাকেট ত্রাণ সহায়তা। আওয়ামী শ্রমিক লীগের উদ্যোগে বড়াইল এলাকায় দেয়া হচ্ছে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার।

জামালপুর : জামালপুরে যমুনার পানি বৃদ্ধি অপরিপর্তিত (স্থিতিশীল) রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার ৭টি উপজেলা ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৩৬টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারসহ গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, ১১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় আমন বীজতলা, আউশ ধান, পাট, সবজি, মরিচ, তিল ও ভুট্টা পানিতে তলিয়ে গেছে।