ত্রাণের আশায় ছুটছে মানুষ

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকায়

‘সবাই কেবল মূল সড়কের আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। আমাদের দুর্গম এলাকায় কেউ আসতে চায় না। আমরা খাবারের খুব সংকটে আছি। ছয় দিন ধরে পানিবন্দী। এর মধ্যে মাত্র একদিন কিছু শুকনো খাবার পেয়েছি’ বলছিলেন সিলেটের বাহাদুর গ্রামের বশির মিয়া। তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল অনেকের কাছেই।

সিলেটের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ বাড়িঘরে ফিরলেও ত্রাণের আশায় ছুটছেন তারা। খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সংকটে ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই। শিশুখাদ্যের পাশাপাশি খাওয়ার পানিরও সংকট রয়েছে।

ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। এখনও কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ চললেও তা অনেকটা অপ্রতুল। সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেক মানুষ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কোম্পানীগঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী শাহ আরেফিন টিলার পাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন মানুষ। পানিবন্দী থাকায় অনেকেই আবার আসতে পারছেন না। তারা ঘর থেকেই নৌকাকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিচ্ছেন। আবার অনেকে ঘরে থাকা ছোট নৌকা নিয়ে ঘিরে ধরছেন বড় নৌকায় করে আসা আগন্তুকদের। ত্রাণের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন তারা।

পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ। তাই নৌকাই এখন ওই এলাকার একমাত্র বাহন। কোম্পানীগঞ্জের তেলিবাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এখন যেতে হয় বাহাদুরপুরে। এতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা।

বাহাদুর গ্রামের আসকর আলীর নিজস্ব নৌকা আছে। তিনিও খাবার সংকটে আছেন বলে জানান। আসকর বলেন, ‘আমার ছোট নৌকা নিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে যাওয়া যায়। দূরের পথ পাড়ি দেয়া যায় না। এছাড়া হাওরের বড় বড় ঢেউয়ে ডুবে মরার ভয়ও আছে। তাই নৌকা থাকলেও খাবার আনতে পারছি না।’

বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ভাত খাইনি বাবা। আমরা গরিব মানুষ। কিন্তু জীবনে ভাত না খেয়ে থাকতে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ভাতের অভাবে মারা যাব।’ তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি উঠার পর প্রথমে একদিন রান্না করা খাবার দিয়ে গিয়েছিল একদল লোক। পরে আরেক দল এসে শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। এই নিয়েই ছয়-সাত দিন ধরে চলছে।’

বাহাদুরপুরের পাশের গ্রামই জালিয়ারগাঁও। ওই গ্রামের একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভিড়তেই ঘরবাড়ি থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ঘিরে ধরেন নৌকাটিকে। গ্রামের বৃদ্ধ শহিদ আহমদ অভিযোগ করে বলেন, ‘সবাই কেবল রাস্তার পাশেই ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। একটু দূরে ও ভেতরে কেউ আসে না। আমরা বেঁচে আছি কি না তা কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।’

এই গ্রামের শাহেদা বেগম বলেন, ‘আমরা কোন রকম বেঁচে আছি। কিন্তু শিশুদের নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। তারা তো বন্যা বুঝতে চায় না। খাবারের জন্য কান্না করে।’ এলাকাজুড়ে শিশুখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

এলাকায় খাওয়ার পানিরও সংকট রয়েছে জানিয়ে মোশাহিদ আহমদ নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘এলাকায় যে কয়টি নলকূপ ছিল সেগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই বিশুদ্ধ পানিরও সংকট রয়েছে।’

কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক রাজীব রাসেল। তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু এ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে যারা পাচ্ছে তারা প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছেন। আবার অনেকে একেবারেই পাচ্ছেন না, তারা খুব সংকটে রয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘অনেক দুর্গম এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি। আমরা যেসব এলাকায় ত্রাণ দিয়েছি, সেগুলোতে আগে কেউ যায়নি বলে জানিয়েছিল তারা। ত্রাণবাহী নৌকা আমাদের চোখে পড়েনি।’

বন্যার শুরু থেকেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জফির সেতু। তিনি বলেন, ‘উপজেলার অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সহায়তা পৌঁছায়নি।’

তিনি জানান, উপজেলার সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র দিঘলবাঁকের পার-ফেদারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে প্রায় ৯টি গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সরকারি ত্রাণ আসেনি।

পানিবন্দী ঘরে বৃদ্ধের লাশ : সিলেটের বিয়ানীবাজারে পানিবন্দী ঘর থেকে বৃদ্ধের ভাসমান লাশ উদ্ধার করেছেন স্বজনরা। গত বুধবার সকালে উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের বৈরাগীর খশির নয়াগাঁও এলাকায় নিজের ঘরে বাহার উদ্দিনের (৬২) নিথর দেহ দেখতে পান তার স্ত্রী-সন্তানরা।

মখলিছুরের লাশ তিন দিন পর উদ্ধার : বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া মখলিছুরের লাশ তিন দিন পর হাওর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার নাদামপুর গ্রামের পশ্চিমে বিতর গোলাই হাওরে লাশটি ভেসে ওঠে।

শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২ , ১০ আষাড় ১৪২৮ ২৪ জিলকদ ১৪৪৩

ত্রাণের আশায় ছুটছে মানুষ

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকায়

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

image

সিলেট : ঘরে ফিরছে দুর্গত এলাকার মানুষ, কিন্তু ত্রাণের জন্য ছুটছে সর্বত্র, আশ্রয়কেন্দ্রেও ত্রাণের অপেক্ষায় -ইদ্রিস আলী

‘সবাই কেবল মূল সড়কের আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। আমাদের দুর্গম এলাকায় কেউ আসতে চায় না। আমরা খাবারের খুব সংকটে আছি। ছয় দিন ধরে পানিবন্দী। এর মধ্যে মাত্র একদিন কিছু শুকনো খাবার পেয়েছি’ বলছিলেন সিলেটের বাহাদুর গ্রামের বশির মিয়া। তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল অনেকের কাছেই।

সিলেটের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ বাড়িঘরে ফিরলেও ত্রাণের আশায় ছুটছেন তারা। খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সংকটে ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই। শিশুখাদ্যের পাশাপাশি খাওয়ার পানিরও সংকট রয়েছে।

ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। এখনও কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ চললেও তা অনেকটা অপ্রতুল। সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেক মানুষ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কোম্পানীগঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী শাহ আরেফিন টিলার পাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন মানুষ। পানিবন্দী থাকায় অনেকেই আবার আসতে পারছেন না। তারা ঘর থেকেই নৌকাকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিচ্ছেন। আবার অনেকে ঘরে থাকা ছোট নৌকা নিয়ে ঘিরে ধরছেন বড় নৌকায় করে আসা আগন্তুকদের। ত্রাণের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন তারা।

পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ। তাই নৌকাই এখন ওই এলাকার একমাত্র বাহন। কোম্পানীগঞ্জের তেলিবাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এখন যেতে হয় বাহাদুরপুরে। এতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা।

বাহাদুর গ্রামের আসকর আলীর নিজস্ব নৌকা আছে। তিনিও খাবার সংকটে আছেন বলে জানান। আসকর বলেন, ‘আমার ছোট নৌকা নিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে যাওয়া যায়। দূরের পথ পাড়ি দেয়া যায় না। এছাড়া হাওরের বড় বড় ঢেউয়ে ডুবে মরার ভয়ও আছে। তাই নৌকা থাকলেও খাবার আনতে পারছি না।’

বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ভাত খাইনি বাবা। আমরা গরিব মানুষ। কিন্তু জীবনে ভাত না খেয়ে থাকতে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ভাতের অভাবে মারা যাব।’ তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি উঠার পর প্রথমে একদিন রান্না করা খাবার দিয়ে গিয়েছিল একদল লোক। পরে আরেক দল এসে শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। এই নিয়েই ছয়-সাত দিন ধরে চলছে।’

বাহাদুরপুরের পাশের গ্রামই জালিয়ারগাঁও। ওই গ্রামের একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভিড়তেই ঘরবাড়ি থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ঘিরে ধরেন নৌকাটিকে। গ্রামের বৃদ্ধ শহিদ আহমদ অভিযোগ করে বলেন, ‘সবাই কেবল রাস্তার পাশেই ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। একটু দূরে ও ভেতরে কেউ আসে না। আমরা বেঁচে আছি কি না তা কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।’

এই গ্রামের শাহেদা বেগম বলেন, ‘আমরা কোন রকম বেঁচে আছি। কিন্তু শিশুদের নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। তারা তো বন্যা বুঝতে চায় না। খাবারের জন্য কান্না করে।’ এলাকাজুড়ে শিশুখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

এলাকায় খাওয়ার পানিরও সংকট রয়েছে জানিয়ে মোশাহিদ আহমদ নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘এলাকায় যে কয়টি নলকূপ ছিল সেগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই বিশুদ্ধ পানিরও সংকট রয়েছে।’

কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক রাজীব রাসেল। তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু এ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে যারা পাচ্ছে তারা প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছেন। আবার অনেকে একেবারেই পাচ্ছেন না, তারা খুব সংকটে রয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘অনেক দুর্গম এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি। আমরা যেসব এলাকায় ত্রাণ দিয়েছি, সেগুলোতে আগে কেউ যায়নি বলে জানিয়েছিল তারা। ত্রাণবাহী নৌকা আমাদের চোখে পড়েনি।’

বন্যার শুরু থেকেই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জফির সেতু। তিনি বলেন, ‘উপজেলার অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সহায়তা পৌঁছায়নি।’

তিনি জানান, উপজেলার সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র দিঘলবাঁকের পার-ফেদারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে প্রায় ৯টি গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সরকারি ত্রাণ আসেনি।

পানিবন্দী ঘরে বৃদ্ধের লাশ : সিলেটের বিয়ানীবাজারে পানিবন্দী ঘর থেকে বৃদ্ধের ভাসমান লাশ উদ্ধার করেছেন স্বজনরা। গত বুধবার সকালে উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের বৈরাগীর খশির নয়াগাঁও এলাকায় নিজের ঘরে বাহার উদ্দিনের (৬২) নিথর দেহ দেখতে পান তার স্ত্রী-সন্তানরা।

মখলিছুরের লাশ তিন দিন পর উদ্ধার : বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া মখলিছুরের লাশ তিন দিন পর হাওর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার নাদামপুর গ্রামের পশ্চিমে বিতর গোলাই হাওরে লাশটি ভেসে ওঠে।