পদ্মা সেতু : বদলে যাবে কুয়াকাটা

বাঙালির অহংকার, গৌরব ও আবেগ জড়িত পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে কাল। উদ্বোধনের পর পাল্টে যাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ১৯ জেলার দৃশ্যপট। খরস্রোতা পদ্মা জয়ের আনন্দের ঢেউ এসে লেগেছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা সৈকতে। দেশের অন্যতম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আনন্দে উদ্বেলিত। আর এই স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে বদলে যাবে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের পণ্য পরিবহনসহ সহজে আসা যাওয়ার সুযোগ দেশের এবং দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বড় প্রাপ্তির প্রতিফলন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে রোমাঞ্চ বয়ে যাচ্ছে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সবার মুখেই এখন একটিই নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত উপভোগ করতে ২৫ জুন কুয়াকাটাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কয়েক লাখ মানুষ যাবে পদ্মার পাড়ে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে চায় তারা এমনই প্রত্যাশা নিয়ে অধীর আগ্রহে দিনক্ষণ গুনছেন উৎফুল্ল মানুষ। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে নিজেদের স্বরণীয় করে রাখতে চান। দেশের এমন অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি নিজেদের স্বশরীরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অনেকেই আগে থেকেই বাস, মাইক্রোবাস, পরিবহন ঠিক করে রেখেছে। উপকূলবাসীর এমন প্রত্যাশাকে ঘিরে কুয়াকাটা-মাওয়া সড়ক-মহাসড়ক পরিণত হবে জনসমুদ্রে।

কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে অভিজাত মানের ফাইভস্টার হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও বিনোদন কেন্দ্র। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্প কল-কারখানা। মৎস্য, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী গড়ে তোলার। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাজানো হবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে। আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী বিনির্মাণে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে কুয়াকাটা। ফেরি পারাপারে বিলম্বের জন্য লোকসান গুনতে হবে না এখন আর ব্যবসায়ীদের। ন্যায্যমূল্য পাবেন জেলে ও কৃষকরা। পরিবহন সেক্টরেও ফিরে আসবে সুদিন। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও অকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে। বেকারত্ব দূর হবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের এমনটাই মনে করেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে পায়রা বন্দর ও পায়রা তাপ বিদুৎকেন্দ্রের পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বাড়বে বন্দরকেন্দ্রিক বিনিযোগকারীর সংখ্যা।

ঢাকা থেকে আগে যেখানে কুয়াকাটায় আসতে যেতে ১৩টি ফেরি পার হতে হতো। সময় লাগতো ১৪-১৫ ঘণ্টা। সেখানে এখন ৫-৬ ঘণ্টায় কুয়াকাটা আসা যাওয়া করতে পারবেন। ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন অভাবনীয় সুযোগ আসবে তা কখনও ভাবেনি কুয়াকাটা তথা পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকাবাসী।

সরেজমিন দেখা গেছে, পর্যটন খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারী ইউনিক গ্রুপ, ইউএস বাংলাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানের চেইন হোটেল গড়ে তুলতে ক্রয়কৃত জমিতে কাজ চলমান রেখেছে। সেতুকেন্দ্রিক পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের নির্মাণাধীন অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ করছেন। নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় রয়েছে অগণিত আবাসন ব্যবসায়ী। কুয়াকাটায় সর্ব্বোচ্চ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পনি থেমে নেই। আগাম প্রস্তুতি নিতে তাদের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। হু হু করে জমির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। জমিতে বিনিয়োগকারী মধ্যস্বত্বভোগী একাধিক দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, দুই বছর আগে যে জমি তিন লাখ টাকায় শতাংশ কেনা যেত, পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর সেই জমির মূল্য একধাপ বেড়েছিল। এখন শুধুমাত্র পদ্মা সেতু চালুর খবরে শতাংশপ্রতি বেড়েছে ২-৩ লাখ টাকা।

আন্ধারমানিক ট্যুরিজমের পরিচালক কেএম বাচ্চু জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ১২ মাসই পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকবে কুয়াকাটা সৈকত। তখন পর্যটক মৌসুম ও অ-মৌসুম বলতে কিছুই থাকবে না। ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ এ আমূল পরিবর্তন এনে দিবে। বাচ্চু আরও বলেন, ঢাকা থেকে দেশের দুটি সৈকতের দূরত্ব ও সময় বিবেচনায় কুয়াকাটা সৈকত আসতে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।

কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের যাত্রীবাহী বাস চালক মো. বাচ্চু হাওলাদার বলেন, আগে মাওয়া ও কাওরাকান্দি ফেরিঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। অসুস্থ রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পরত। এখন আর দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে পরিবহন সেক্টরে নতুন মাত্রা যোগ হবে। নামি-দামি পরিবহন কোম্পানিগুলো কুয়াকাটা-ঢাকা রুটের রুট পারমিট নিয়ে রেখেছে। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব পরিবহনগুলো নতুন এই রুটে চলবে। ঢাকা ও উত্তারাঞ্চল থেকে পদ্মা সেতু এবং কুয়াকাটায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এখন আর যাত্রী সংকট থাকবে না। এতে পরিবহন মালিকরাও লাভবান হবে।

কুয়াকাটা মেয়র মার্কেটের কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী ইয়াসিন মুসুল্লি জানান, আগে ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের শাক-সবজি, তরকারি কুয়াকাটায় আসত না। এখন দেশের যেকোন স্থান থেকে শাক-সবজি আনা নেয়া সহজ হবে। ন্যায্যমূল্যে সহজেই তাজা শাক-সবজি খেতে পারবে মানুষ।

কুয়াকাটা আশার আলো জেলে সমবায় সমিতির সভাপতি ও মৎস্য আড়তদার নিজাম শেখ জানান, পদ্মা সেতু আমাদের মৎস্যজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন বয়ে আনবে। আগে কুয়াকাটা দেশের বিভিন্ন স্থানে এক থেকে দেড় দিন সময় লাগত। যার কারণে সময়মতো বাজার ধরা যেত না। মাছ পচে যেত। এতে লোকসানের মুখে পড়তে হতো। দেরিতে পৌঁছানোর কারণে বাজারমূল্য সঠিকভাবে পাওয়া যেত না। এখন তারা সহজেই মাছ বাজারজাত করতে পারবেন।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমএ মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতু কুয়াকাটা পর্যটন ব্যবসায়ীদের জন্য আশীর্বাদ। কুয়াকাটায় বর্তমানে ছোট বড় মিলে প্রায় দেড় শতাধিক আবাসিক হোটেল মোটেল রয়েছে। আরও নির্মাণাধীন রয়েছে অর্থ শতাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। পর্যটননির্ভর পাঁচ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবে। আগে কুয়াকাটায় আসতে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। এখন আর কোন পর্যটককে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই ৫-৬ ঘণ্টায় পর্যটকরা ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসতে পারবে। তিনি বলেন, এখন কুয়াকাটায় ১২ মাস পর্যটকদের আগমনে মুখর থাকবে। কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। যার ফলে পর্যটকরা কুয়াকাটাকেই বেছে নিবে। তার মতে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরে আসছে। আর সে সুদিনের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. বারেক মোল্লা বলেন, বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু আমাদের কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের সেতুবন্ধন তৈরি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনচিত্র পাল্টে যাবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এই এলাকার মানুষ উন্নত জীবন-যাপনের সুযোগ পাবে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। শিল্প-কারখানা তৈরি হবে। নতুন নতুন কর্মের সূযোগ তৈরি হবে। এখানকার মানুষ আর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে পদ্মা সেতুও হতো না, আর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যের চাকা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারতো না। পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও কুয়াকাটাবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনন্য উপহার। যার প্রতিদান আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না।

কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য পাল্টে যাবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটাসহ উপকূলবাসী গ্রামে থেকে শহরের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। স্বাবলম্বী হবে এখানকার মানুষ। দারিদ্র্যতা থাকবে না। উপকূলীয় এলাকার কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, শুধু পদ্মা সেতুই নয়, শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল, পটুয়াখালী সেতু, পায়রা সেতু, কীর্তনখোলা নদীর সেতু এবং পায়রা বন্দরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু তৈরির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেরিবিহীন যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এজন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাকে সারা জীবন বুকের মধ্যে ধারণ করে রাখবে।

মেয়র বলেন, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যাবে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

এদিকে কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় অসংখ্য পর্যটকের আগমনের সম্ভাবনাকে ঘিরে জেলা পুলিশের পাশাপাশি কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ সেবা ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় রেখে আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। কুয়াকাটা সৈকতে আগত পর্যটকরা যে নিরাপত্তাজনিত কারণে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি থাকবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২ , ১০ আষাড় ১৪২৮ ২৪ জিলকদ ১৪৪৩

পদ্মা সেতু : বদলে যাবে কুয়াকাটা

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা

image

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। পর্যটকদের আকর্ষণীয় এই সৈকতের বিশেষত্ব হলো ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য -সংবাদ

বাঙালির অহংকার, গৌরব ও আবেগ জড়িত পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে কাল। উদ্বোধনের পর পাল্টে যাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ১৯ জেলার দৃশ্যপট। খরস্রোতা পদ্মা জয়ের আনন্দের ঢেউ এসে লেগেছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা সৈকতে। দেশের অন্যতম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আনন্দে উদ্বেলিত। আর এই স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে বদলে যাবে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের পণ্য পরিবহনসহ সহজে আসা যাওয়ার সুযোগ দেশের এবং দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বড় প্রাপ্তির প্রতিফলন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে রোমাঞ্চ বয়ে যাচ্ছে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সবার মুখেই এখন একটিই নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত উপভোগ করতে ২৫ জুন কুয়াকাটাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কয়েক লাখ মানুষ যাবে পদ্মার পাড়ে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে চায় তারা এমনই প্রত্যাশা নিয়ে অধীর আগ্রহে দিনক্ষণ গুনছেন উৎফুল্ল মানুষ। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে নিজেদের স্বরণীয় করে রাখতে চান। দেশের এমন অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি নিজেদের স্বশরীরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অনেকেই আগে থেকেই বাস, মাইক্রোবাস, পরিবহন ঠিক করে রেখেছে। উপকূলবাসীর এমন প্রত্যাশাকে ঘিরে কুয়াকাটা-মাওয়া সড়ক-মহাসড়ক পরিণত হবে জনসমুদ্রে।

কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে অভিজাত মানের ফাইভস্টার হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও বিনোদন কেন্দ্র। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্প কল-কারখানা। মৎস্য, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী গড়ে তোলার। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাজানো হবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে। আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী বিনির্মাণে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে কুয়াকাটা। ফেরি পারাপারে বিলম্বের জন্য লোকসান গুনতে হবে না এখন আর ব্যবসায়ীদের। ন্যায্যমূল্য পাবেন জেলে ও কৃষকরা। পরিবহন সেক্টরেও ফিরে আসবে সুদিন। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও অকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে। বেকারত্ব দূর হবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের এমনটাই মনে করেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে পায়রা বন্দর ও পায়রা তাপ বিদুৎকেন্দ্রের পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বাড়বে বন্দরকেন্দ্রিক বিনিযোগকারীর সংখ্যা।

ঢাকা থেকে আগে যেখানে কুয়াকাটায় আসতে যেতে ১৩টি ফেরি পার হতে হতো। সময় লাগতো ১৪-১৫ ঘণ্টা। সেখানে এখন ৫-৬ ঘণ্টায় কুয়াকাটা আসা যাওয়া করতে পারবেন। ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন অভাবনীয় সুযোগ আসবে তা কখনও ভাবেনি কুয়াকাটা তথা পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকাবাসী।

সরেজমিন দেখা গেছে, পর্যটন খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারী ইউনিক গ্রুপ, ইউএস বাংলাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানের চেইন হোটেল গড়ে তুলতে ক্রয়কৃত জমিতে কাজ চলমান রেখেছে। সেতুকেন্দ্রিক পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের নির্মাণাধীন অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ করছেন। নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় রয়েছে অগণিত আবাসন ব্যবসায়ী। কুয়াকাটায় সর্ব্বোচ্চ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পনি থেমে নেই। আগাম প্রস্তুতি নিতে তাদের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। হু হু করে জমির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। জমিতে বিনিয়োগকারী মধ্যস্বত্বভোগী একাধিক দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, দুই বছর আগে যে জমি তিন লাখ টাকায় শতাংশ কেনা যেত, পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর সেই জমির মূল্য একধাপ বেড়েছিল। এখন শুধুমাত্র পদ্মা সেতু চালুর খবরে শতাংশপ্রতি বেড়েছে ২-৩ লাখ টাকা।

আন্ধারমানিক ট্যুরিজমের পরিচালক কেএম বাচ্চু জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ১২ মাসই পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকবে কুয়াকাটা সৈকত। তখন পর্যটক মৌসুম ও অ-মৌসুম বলতে কিছুই থাকবে না। ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ এ আমূল পরিবর্তন এনে দিবে। বাচ্চু আরও বলেন, ঢাকা থেকে দেশের দুটি সৈকতের দূরত্ব ও সময় বিবেচনায় কুয়াকাটা সৈকত আসতে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।

কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের যাত্রীবাহী বাস চালক মো. বাচ্চু হাওলাদার বলেন, আগে মাওয়া ও কাওরাকান্দি ফেরিঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। অসুস্থ রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পরত। এখন আর দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে পরিবহন সেক্টরে নতুন মাত্রা যোগ হবে। নামি-দামি পরিবহন কোম্পানিগুলো কুয়াকাটা-ঢাকা রুটের রুট পারমিট নিয়ে রেখেছে। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব পরিবহনগুলো নতুন এই রুটে চলবে। ঢাকা ও উত্তারাঞ্চল থেকে পদ্মা সেতু এবং কুয়াকাটায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এখন আর যাত্রী সংকট থাকবে না। এতে পরিবহন মালিকরাও লাভবান হবে।

কুয়াকাটা মেয়র মার্কেটের কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী ইয়াসিন মুসুল্লি জানান, আগে ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের শাক-সবজি, তরকারি কুয়াকাটায় আসত না। এখন দেশের যেকোন স্থান থেকে শাক-সবজি আনা নেয়া সহজ হবে। ন্যায্যমূল্যে সহজেই তাজা শাক-সবজি খেতে পারবে মানুষ।

কুয়াকাটা আশার আলো জেলে সমবায় সমিতির সভাপতি ও মৎস্য আড়তদার নিজাম শেখ জানান, পদ্মা সেতু আমাদের মৎস্যজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন বয়ে আনবে। আগে কুয়াকাটা দেশের বিভিন্ন স্থানে এক থেকে দেড় দিন সময় লাগত। যার কারণে সময়মতো বাজার ধরা যেত না। মাছ পচে যেত। এতে লোকসানের মুখে পড়তে হতো। দেরিতে পৌঁছানোর কারণে বাজারমূল্য সঠিকভাবে পাওয়া যেত না। এখন তারা সহজেই মাছ বাজারজাত করতে পারবেন।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমএ মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতু কুয়াকাটা পর্যটন ব্যবসায়ীদের জন্য আশীর্বাদ। কুয়াকাটায় বর্তমানে ছোট বড় মিলে প্রায় দেড় শতাধিক আবাসিক হোটেল মোটেল রয়েছে। আরও নির্মাণাধীন রয়েছে অর্থ শতাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। পর্যটননির্ভর পাঁচ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবে। আগে কুয়াকাটায় আসতে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। এখন আর কোন পর্যটককে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই ৫-৬ ঘণ্টায় পর্যটকরা ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসতে পারবে। তিনি বলেন, এখন কুয়াকাটায় ১২ মাস পর্যটকদের আগমনে মুখর থাকবে। কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। যার ফলে পর্যটকরা কুয়াকাটাকেই বেছে নিবে। তার মতে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরে আসছে। আর সে সুদিনের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. বারেক মোল্লা বলেন, বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু আমাদের কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের সেতুবন্ধন তৈরি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনচিত্র পাল্টে যাবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এই এলাকার মানুষ উন্নত জীবন-যাপনের সুযোগ পাবে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। শিল্প-কারখানা তৈরি হবে। নতুন নতুন কর্মের সূযোগ তৈরি হবে। এখানকার মানুষ আর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে পদ্মা সেতুও হতো না, আর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যের চাকা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারতো না। পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও কুয়াকাটাবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনন্য উপহার। যার প্রতিদান আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না।

কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য পাল্টে যাবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটাসহ উপকূলবাসী গ্রামে থেকে শহরের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। স্বাবলম্বী হবে এখানকার মানুষ। দারিদ্র্যতা থাকবে না। উপকূলীয় এলাকার কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, শুধু পদ্মা সেতুই নয়, শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল, পটুয়াখালী সেতু, পায়রা সেতু, কীর্তনখোলা নদীর সেতু এবং পায়রা বন্দরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু তৈরির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেরিবিহীন যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এজন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাকে সারা জীবন বুকের মধ্যে ধারণ করে রাখবে।

মেয়র বলেন, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যাবে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

এদিকে কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় অসংখ্য পর্যটকের আগমনের সম্ভাবনাকে ঘিরে জেলা পুলিশের পাশাপাশি কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ সেবা ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় রেখে আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। কুয়াকাটা সৈকতে আগত পর্যটকরা যে নিরাপত্তাজনিত কারণে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি থাকবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।