উৎসবেও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত পদ্মাপারের কর্মজীবীরা

আর মাত্র একদিন বাকি। পারাপারের জন্য উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। লঞ্চে চলাচলকারী পদ্মা পারের মানুষরা এখন অপেক্ষায় দ্রুত সময়ে নদী পার হয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর। তবে পদ্মায় চলাচলকারী লঞ্চমালিক, লঞ্চের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার মানুষ কাজ হারানোর চিন্তায় বিমর্ষ সময় পার করছে।

পদ্মা সেতু চালু হলে মানুষের লঞ্চে পারাপার হতে হবে না। সরাসরি বাস ও অন্য গাড়িতে সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পার হতে পারবে।

মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী হয়ে মাঝিরঘাট সরেজমিন দেখা যায়, লঞ্চঘাটের আশপাশে ও ঘাট সংলগ্ন বাজারটিতে খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান, ফলের দোকান, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকানসহ নিত্যপণ্যের বেশ কয়েকটি দোকান আছে। আরও আছে ভাসমান কিছু মুখরোচক খাবারের ভ্যান। এই লঞ্চঘাটকে কেন্দ্র করে অনেকেই ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

তাদেরই একজন সোলায়মান, পেশায় কুলি। তিনি লঞ্চঘাটে যাত্রীদের ভারী বোঝা, ব্যাগ, ট্রলি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নেন। আর এর বিনিময়ে যাত্রীরা পারিশ্রমিকের পাশাপাশি যে বখশিস দেন সেখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার।

সোলায়মান বলেন, ‘পদ্মা সেতু হইতেছে এইডা খুবই ভালো। কিন্তু আমরা যারা এহানে কাজ করি, আমগোর কি হইবো এইডাই ভাবতাছি।’

সেই ঘাটেই কথা হয় সাত্তার অ্যান্ড সন্স নেভিগেশন লঞ্চের কর্মচারী বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তার কপালেও চিন্তার রেখা। বেলাল বলেন, ‘ছোট থিকা এই লঞ্চে কাজ কইরে বড় হইছি। অন্য কোথাও কাজের চেষ্টা করি নাই। আজ থেকে দশ-পনের দিন আগে থেকেই লঞ্চের যাত্রী কম। যেখানে ২শ’ আড়াইশ’ যাত্রী হইতো, এখন ২০-২৫ জন যাত্রী নিয়া লঞ্চ ছাড়ে। আমাগো বেতন-ভাতা তো এই যাত্রীর ওপরই। সামনে কী হইবো জানি না, তবে কিছু না কিছু হইবো... দেখা যাক।’

মাঝির ঘাটের খাবার হোটেলের মালিক সুমন মিয়া বলেন, ‘জমিজমা বেইচা খাওনের হোটেল দিছি। ব্যবসা ভালোই চলতাছিল। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে এইহান দিয়া মানুষের চলাচল কইমা যাইবো। আসলে এহনো কিছু বুঝতাছি না। কি হইবো। তয় এহনই অনেক হোটেলে খাওয়ার মানুষজন কইমা গেছে।’

লঞ্চমালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘আমি মোট ৭টি লঞ্চ শেয়ারে চালাই। একেকটি লঞ্চে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার করে টাকা আসে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় হঠাৎ যাত্রী কমে যাবে। লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাবে। একেকটি লঞ্চে প্রায় ৪৯ জন কর্মী কাজ করে। তাদের সংসার কী করে চলবে। তাদের কিভাবে কতদিন রাখতে পারবো এইটা ভেবে দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি লঞ্চের দাম সর্বনিম্ন ৬০ লাখ টাকা। এগুলারে তো বসায় রাখা যাবে না।’

লিয়াকত জানান ওই এলাকায় ৮৭টি লঞ্চ চলে, সেখানে কমপক্ষে ৪ হাজার মানুষের কর্মস্থল। ‘আমরা যারা লঞ্চমালিক, লঞ্চের অন্য স্টাফ আছি আমাদের আয় এক প্রকার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আশা করি সরকার আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প কোন ব্যবস্থা করবেন। সরকার যদি আমাদের একটা নৌ রুট করে দেয় তাহলে আমাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে ভাবতে হবে না।’

শিমুলিয়া জোনের লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও লঞ্চমালিক কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনির সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের শুধু একটাই অনুরোধ নতুন নৌ-রুট চালু করা হোক।’

তার মতে এখন পদ্মা পারাপারের জন্য ৮৭টি লঞ্চের মধ্যে হয়ত ১০-১২টি লঞ্চ চলবে।

মনির আরও বলেন, ‘বাহাদুরাবাদ ঘাটে সরকার কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে, কিন্তু কোন ফেরি চলাচল করতে পারতেছে না। এই রুটে বর্তমানে দুইটা লঞ্চ চলে কিন্তু এই রুটে কমপক্ষে ২০-২৫টা লঞ্চ চলাচল করতে পারে। নতুন নৌ-রুটগুলোর মধ্যে গাইবান্ধার বাহাদুরাবাদ থেকে বালাসী ঘাট, চিলমারী টু রৌমারী, চিলমারী টু নয়াবাজার নৌঘাট, সৈয়দপুর টু চাঁদপুর নতুন করে নৌরুট সৃষ্টি করতে পারে।’

শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২ , ১০ আষাড় ১৪২৮ ২৪ জিলকদ ১৪৪৩

উৎসবেও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত পদ্মাপারের কর্মজীবীরা

জাহিদা পারভেজ ছন্দা, পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে এসে

আর মাত্র একদিন বাকি। পারাপারের জন্য উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। লঞ্চে চলাচলকারী পদ্মা পারের মানুষরা এখন অপেক্ষায় দ্রুত সময়ে নদী পার হয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর। তবে পদ্মায় চলাচলকারী লঞ্চমালিক, লঞ্চের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার মানুষ কাজ হারানোর চিন্তায় বিমর্ষ সময় পার করছে।

পদ্মা সেতু চালু হলে মানুষের লঞ্চে পারাপার হতে হবে না। সরাসরি বাস ও অন্য গাড়িতে সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পার হতে পারবে।

মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী হয়ে মাঝিরঘাট সরেজমিন দেখা যায়, লঞ্চঘাটের আশপাশে ও ঘাট সংলগ্ন বাজারটিতে খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান, ফলের দোকান, মুদি দোকান, মিষ্টির দোকানসহ নিত্যপণ্যের বেশ কয়েকটি দোকান আছে। আরও আছে ভাসমান কিছু মুখরোচক খাবারের ভ্যান। এই লঞ্চঘাটকে কেন্দ্র করে অনেকেই ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

তাদেরই একজন সোলায়মান, পেশায় কুলি। তিনি লঞ্চঘাটে যাত্রীদের ভারী বোঝা, ব্যাগ, ট্রলি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নেন। আর এর বিনিময়ে যাত্রীরা পারিশ্রমিকের পাশাপাশি যে বখশিস দেন সেখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার।

সোলায়মান বলেন, ‘পদ্মা সেতু হইতেছে এইডা খুবই ভালো। কিন্তু আমরা যারা এহানে কাজ করি, আমগোর কি হইবো এইডাই ভাবতাছি।’

সেই ঘাটেই কথা হয় সাত্তার অ্যান্ড সন্স নেভিগেশন লঞ্চের কর্মচারী বেলাল হোসেনের সঙ্গে। তার কপালেও চিন্তার রেখা। বেলাল বলেন, ‘ছোট থিকা এই লঞ্চে কাজ কইরে বড় হইছি। অন্য কোথাও কাজের চেষ্টা করি নাই। আজ থেকে দশ-পনের দিন আগে থেকেই লঞ্চের যাত্রী কম। যেখানে ২শ’ আড়াইশ’ যাত্রী হইতো, এখন ২০-২৫ জন যাত্রী নিয়া লঞ্চ ছাড়ে। আমাগো বেতন-ভাতা তো এই যাত্রীর ওপরই। সামনে কী হইবো জানি না, তবে কিছু না কিছু হইবো... দেখা যাক।’

মাঝির ঘাটের খাবার হোটেলের মালিক সুমন মিয়া বলেন, ‘জমিজমা বেইচা খাওনের হোটেল দিছি। ব্যবসা ভালোই চলতাছিল। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে এইহান দিয়া মানুষের চলাচল কইমা যাইবো। আসলে এহনো কিছু বুঝতাছি না। কি হইবো। তয় এহনই অনেক হোটেলে খাওয়ার মানুষজন কইমা গেছে।’

লঞ্চমালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘আমি মোট ৭টি লঞ্চ শেয়ারে চালাই। একেকটি লঞ্চে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার করে টাকা আসে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় হঠাৎ যাত্রী কমে যাবে। লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাবে। একেকটি লঞ্চে প্রায় ৪৯ জন কর্মী কাজ করে। তাদের সংসার কী করে চলবে। তাদের কিভাবে কতদিন রাখতে পারবো এইটা ভেবে দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি লঞ্চের দাম সর্বনিম্ন ৬০ লাখ টাকা। এগুলারে তো বসায় রাখা যাবে না।’

লিয়াকত জানান ওই এলাকায় ৮৭টি লঞ্চ চলে, সেখানে কমপক্ষে ৪ হাজার মানুষের কর্মস্থল। ‘আমরা যারা লঞ্চমালিক, লঞ্চের অন্য স্টাফ আছি আমাদের আয় এক প্রকার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আশা করি সরকার আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প কোন ব্যবস্থা করবেন। সরকার যদি আমাদের একটা নৌ রুট করে দেয় তাহলে আমাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে ভাবতে হবে না।’

শিমুলিয়া জোনের লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও লঞ্চমালিক কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান মনির সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের শুধু একটাই অনুরোধ নতুন নৌ-রুট চালু করা হোক।’

তার মতে এখন পদ্মা পারাপারের জন্য ৮৭টি লঞ্চের মধ্যে হয়ত ১০-১২টি লঞ্চ চলবে।

মনির আরও বলেন, ‘বাহাদুরাবাদ ঘাটে সরকার কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে, কিন্তু কোন ফেরি চলাচল করতে পারতেছে না। এই রুটে বর্তমানে দুইটা লঞ্চ চলে কিন্তু এই রুটে কমপক্ষে ২০-২৫টা লঞ্চ চলাচল করতে পারে। নতুন নৌ-রুটগুলোর মধ্যে গাইবান্ধার বাহাদুরাবাদ থেকে বালাসী ঘাট, চিলমারী টু রৌমারী, চিলমারী টু নয়াবাজার নৌঘাট, সৈয়দপুর টু চাঁদপুর নতুন করে নৌরুট সৃষ্টি করতে পারে।’