ছাতকে দেখা দিয়েছে রোগবালাই
বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট, ডুবে মৃত্যু ৮
প্রতিনিধি, ছাতক (সুনামগঞ্জ)
সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমতে শুরু হওয়ায় স্বাভাবিক হচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রা। বন্যাশ্রয় কেন্দ্র গুলো থেকে অনেকেই বাসা বাড়ীতে ফিরতে দেখা গেছে। রয়েছে খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে শতশত ঘরবাড়ী, গবাদি পশু, সকল খামারের মাছ। বন্যার পানিতে এখন লাশের গন্ধ ভেসে আসছে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা মিলছে ভাসমান লাশ। স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে ৮ জনের সলিল সমাধি ঘটে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানির ¯্রােতে তলিয়ে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
জানা গেছে, গত ১৬ জুন থেকে ২৩ জুন বৃহস্পতিবারের মধ্যে এক শিশুসহ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় ৮টি তাজা প্রাণ। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় হাওর থেকে মখলিছুর রহমানের (৪৬) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি উত্তর খুরমা ইউনিয়নের নাদামপুর গ্রামের রমজান আলীর পুত্র। কালারুকা ইউনিয়নের সুরুজ আলীর পুত্র তমাল আহমদ (১৯), ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের আহমদ আলীর পুত্র খালেদ আহমদ (৩০), দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের জাতুয়া গ্রামের উমেশ দাসের পুত্র অশোক দাস (২০), গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের দিঘলী গ্রামের সুনিল রায়ের পুত্র অজিত রায় (৩৫), সিংচাপইড় ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের শিশু কন্যা হানিফা বেগম (৯), বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের বাসিন্দা সুরুজ আলীর পুত্র হাফিজ আলী (৩২) ও শহরের বাগবাড়ী মহল্লার বাসিন্দা পিযুষ দের (৪২) মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। থানা পুলিশ, হাসপাতাল ও নিহতের পরিবার সূত্রে এসব মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করা হয়। মৃতদের ভাসমান লাশ উদ্ধার করে স্বজনরা দাফন ও দাহ করেন। তবে পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। মৃত্যুর হিসাব আরো বেশী হতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কৈতক ২০ শয্যা হাসপাতাল থেকে পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে চিকিৎসা সেবা। পানিবন্দী লোকজন জানান, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছেন তারা। শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। রাত হলেই ডাকাতরা ইঞ্জিন নৌকায় করে হানা দিচ্ছে বাসা বাড়ীতে। ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন এলাকার লোকজন। শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ ও ৬৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যাশ্রয় কেন্দ্র থাকায় এখনো সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
ছাতকে বন্যার্তদের উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত টিম লিডার মেজর আশাবুর রহমান বলেন, দেশকে রক্ষায় যেভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত তেমনি এখানের দূর্গত এলাকার বন্যার্তদের খাবার, চিকিৎসা ও বন্যা পরবর্তী যে কোনো সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বন্যার অজুহাতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। ওই কারনে বাজার মনিটরিং করতে দেখা গেছে উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) ইসলাম উদ্দিনকে। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিটি জিনিসের মূল্য তালিকা সাঁটিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ক্রেতাদের মূল্য তালিকা যাচাই করে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব চক্রবর্তী জানান, হাসপাতালে ডাইরিয়া, জ্বর, পানিবাহিত রোগ ও শিশু রোগী বেশী আসছেন। প্রয়োজনে মেডিকেল টিম গঠন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা দেয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, বিভিন্ন এলাকায় তিনি ডাকাতি হওয়ার খবর পাচ্ছেন। ওই কারনে এখানে নৌ টহল ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানিয়েছেন, পানি কমতে শুরু হওয়ায় বন্যাশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন বাসাবাড়িতে ফিরছেন। আর কিছু এলাকা রয়েছে নি¤œাঞ্চল। ওইসব এলাকার লোকজন এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। তিনি নিজে এসব বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণসামগ্রী পৌছে দিচ্ছেন। ছাতক-দোয়ারা নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক দৃঢ়চিত্তে বলেন, বন্যার্তরা ত্রাণের অভাবে এখানে না খেয়ে মরবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বন্যার্তদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সরকারিভাবে এখানে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
মৌলভীবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই লক্ষাধিক মানুষ
জেলা বার্তা পরিবেশক, মৌলভীবাজার
নীরব বন্যায় নিমজ্জিত মৌলভীবাজারের বিস্তৃর্ণ জনপথ। কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ও হাকালুকি হাওড়পাড়ের ৪১ টি ইউনিয়ন এলাকা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান প্রেসব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, কুশিয়ারা নদীর পানির প্রবাহ গতকাল দুপুরে কুশিয়ারা নদী উজানে সিলেটের বিয়ানী বাজার উপজেলা শেওলা পয়েন্টে বিপদ সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই কুশিয়ারা নদী ভাটিতে মৌলভীবাজারের শেরপুর পয়েন্টে কখনো বিপদ সীমার সময় বেধে ৫-১০ সেন্টি মিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাবাস কেন্দ্রের অনলাইন তথ্য মতে, কুশিয়ারা নদীর পানিস্তর বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবারে কমার সম্ভাবনা নেই। তাই হাকালুকি হাওড় পাড়ের এবং কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজনকে বন্যার জনিত সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশের সর্ব বৃহৎ হাকালুকি হাওড়ের পানি নিস্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে কুশিয়ারা নদী। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে হাওড়ের পানি বের হতে না পেয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। এতে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি উপজেলার বিস্তৃর্ণ জনপদ বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এই হাকালুকি হাওড়ের পানির কারণে সিলেট জেলার ফেঞ্জুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এলাকায়ও জলাবদ্ধতা জনিত বন্যা বিরাজ করজে।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বৃহস্পতিবার বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, জেলার প্রায় ৮০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে ৫২ হাজার ১১১টি পরিবারের ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৩৭ জন মানুষ। বন্যার পানিতে নিম্মজিত হয়ে প্রায় ৪৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সারা জেলায় ১০১ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২২ হাজার ৩০০ মানুষ ও প্রায় পোনে ২হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। এ পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলায় ৪৪০ মেট্টিক টন চাল, ১ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকার ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ, খলিলপুর ও রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ও উত্তরভাগ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পানিতে নিম্মজিত হয়েছে। কাউয়াদীঘি হাওরের মনু ইরিগেশন প্রকল্পের বাধের বাহিরে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িঘরে পানি রয়েছে। কাশিপুর এলাকার রজব আলী জানান, বন্যার পানি ঘর বাড়িতে থাকায় মানুষ ও গবাদিপুশ নিয়ে বাড়িঘরে থাকা রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উত্তরভাগ ইউনিয়নের কামালপুর, সুরিখাল, সুনামপুর এবং ফতেপুর ইউনিয়নের বিলপাড়ি, তুলাপুর, বেড়কুড়ি, শাহাপুর, জাহিদপুরসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানীয় লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। এসব এলাকার অপেক্ষাকৃত ধনি পরিবারের অনেকে ইতিমধ্যে শহর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবার স্থানান্তর করেছেন। রাজনগরের পানিসাইল গ্রামে কেড়ে উঠা মৌলভীবাজারের সদ্য সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) অ্যাডভোকেট ভূপতি রঞ্জন চৌধুরী জানান, কুশিয়ারা নদীর দুই পাড়ে যে বাধ নির্মাণ করা হয়েছে তাতে হাওড়ের সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে কুশিয়ারা নদীর পানি হাওড়ে প্রবেশ করতে পারছে না। এতে নদীর পানিতে বাধের বাহিরে গ্রামগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে আক্রান্ত করেছে।
কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পানিতে নিমজ্জিত। হাসপাতালে প্রবেশের জন্য অস্থায়ী পাটাতন বসানো হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার বুকশিমইল গ্রাম পুরোপুরিই পানিতে নিমজ্জিত।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ২১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।
জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যার কারণে এ পর্যন্ত জেলার ৭টি উপজেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসাসহ ১৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার বন্যাকবলিত ১৫শ অসহায় পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।
সড়ক-হাওর
জলে একাকার
প্রতিনিধি, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার)
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-অরুয়াইল সড়ক। উপজেলার সবচেয়ে জনসম্পৃক্ত এই সড়কটির ৩টি পয়েন্ট পানিতে ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে। প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জনজীবনে।
ঝুঁকি আর দুর্ভোগকে সঙ্গী করে এই সড়ক দিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহন পানির উপর দিয়ে চলাচল করছে। তবে যান চলাচল আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৩টি পয়েন্টে সড়কের উপর দিয়ে প্রবল গ্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে বন্যার পানি। কোথাও কোথাও বুঝবার উপায় নেই এটি সড়ক নাকি হাওর। তীব্র গ্রোতের কারণে উভয় পাশ দিয়ে ভাঙছে সড়ক। ভাঙন অব্যাহত থাকলে সড়কটি হাওরে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলার চুন্টা গ্রামের মোড়ে সড়কটির একটি অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চুন্টা ও লোপাড়া গ্রাম পেরিয়ে ভূইশ্বর বাজার থেকে কালিশিমুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে হাঁটু সমান পানি। পানি উপচে সড়ক-হাওর একাকার হয়ে যাওয়ায় এখন সড়ক চেনা দায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পানি উন্নয়নন বোর্ডের তথ্যমতে, তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে নাসিরনগর, সরাইল ও নবীনগর এলাকার নি¤œাঞ্চল বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এলজিইডির সরাইল উপজেলা প্রকৌশলী নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, ‘সড়কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। আমরা এটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছি। প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর কর্তৃপক্ষ বন্যা পরবর্তীতে সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেবে।’
শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩
ছাতকে দেখা দিয়েছে রোগবালাই
বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট, ডুবে মৃত্যু ৮
প্রতিনিধি, ছাতক (সুনামগঞ্জ)
সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমতে শুরু হওয়ায় স্বাভাবিক হচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রা। বন্যাশ্রয় কেন্দ্র গুলো থেকে অনেকেই বাসা বাড়ীতে ফিরতে দেখা গেছে। রয়েছে খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে শতশত ঘরবাড়ী, গবাদি পশু, সকল খামারের মাছ। বন্যার পানিতে এখন লাশের গন্ধ ভেসে আসছে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা মিলছে ভাসমান লাশ। স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে ৮ জনের সলিল সমাধি ঘটে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানির ¯্রােতে তলিয়ে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
জানা গেছে, গত ১৬ জুন থেকে ২৩ জুন বৃহস্পতিবারের মধ্যে এক শিশুসহ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় ৮টি তাজা প্রাণ। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় হাওর থেকে মখলিছুর রহমানের (৪৬) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি উত্তর খুরমা ইউনিয়নের নাদামপুর গ্রামের রমজান আলীর পুত্র। কালারুকা ইউনিয়নের সুরুজ আলীর পুত্র তমাল আহমদ (১৯), ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের আহমদ আলীর পুত্র খালেদ আহমদ (৩০), দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের জাতুয়া গ্রামের উমেশ দাসের পুত্র অশোক দাস (২০), গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের দিঘলী গ্রামের সুনিল রায়ের পুত্র অজিত রায় (৩৫), সিংচাপইড় ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের নুরুজ্জামানের শিশু কন্যা হানিফা বেগম (৯), বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের বাসিন্দা সুরুজ আলীর পুত্র হাফিজ আলী (৩২) ও শহরের বাগবাড়ী মহল্লার বাসিন্দা পিযুষ দের (৪২) মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। থানা পুলিশ, হাসপাতাল ও নিহতের পরিবার সূত্রে এসব মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করা হয়। মৃতদের ভাসমান লাশ উদ্ধার করে স্বজনরা দাফন ও দাহ করেন। তবে পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। মৃত্যুর হিসাব আরো বেশী হতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কৈতক ২০ শয্যা হাসপাতাল থেকে পানি নেমে যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে চিকিৎসা সেবা। পানিবন্দী লোকজন জানান, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছেন তারা। শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। রাত হলেই ডাকাতরা ইঞ্জিন নৌকায় করে হানা দিচ্ছে বাসা বাড়ীতে। ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন এলাকার লোকজন। শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ ও ৬৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যাশ্রয় কেন্দ্র থাকায় এখনো সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
ছাতকে বন্যার্তদের উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত টিম লিডার মেজর আশাবুর রহমান বলেন, দেশকে রক্ষায় যেভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত তেমনি এখানের দূর্গত এলাকার বন্যার্তদের খাবার, চিকিৎসা ও বন্যা পরবর্তী যে কোনো সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বন্যার অজুহাতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। ওই কারনে বাজার মনিটরিং করতে দেখা গেছে উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) ইসলাম উদ্দিনকে। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিটি জিনিসের মূল্য তালিকা সাঁটিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ক্রেতাদের মূল্য তালিকা যাচাই করে পণ্য ক্রয়ের পরামর্শ দেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব চক্রবর্তী জানান, হাসপাতালে ডাইরিয়া, জ্বর, পানিবাহিত রোগ ও শিশু রোগী বেশী আসছেন। প্রয়োজনে মেডিকেল টিম গঠন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা দেয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, বিভিন্ন এলাকায় তিনি ডাকাতি হওয়ার খবর পাচ্ছেন। ওই কারনে এখানে নৌ টহল ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানিয়েছেন, পানি কমতে শুরু হওয়ায় বন্যাশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন বাসাবাড়িতে ফিরছেন। আর কিছু এলাকা রয়েছে নি¤œাঞ্চল। ওইসব এলাকার লোকজন এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। তিনি নিজে এসব বন্যাশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণসামগ্রী পৌছে দিচ্ছেন। ছাতক-দোয়ারা নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক দৃঢ়চিত্তে বলেন, বন্যার্তরা ত্রাণের অভাবে এখানে না খেয়ে মরবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বন্যার্তদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সরকারিভাবে এখানে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
মৌলভীবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই লক্ষাধিক মানুষ
জেলা বার্তা পরিবেশক, মৌলভীবাজার
নীরব বন্যায় নিমজ্জিত মৌলভীবাজারের বিস্তৃর্ণ জনপথ। কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ও হাকালুকি হাওড়পাড়ের ৪১ টি ইউনিয়ন এলাকা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান প্রেসব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, কুশিয়ারা নদীর পানির প্রবাহ গতকাল দুপুরে কুশিয়ারা নদী উজানে সিলেটের বিয়ানী বাজার উপজেলা শেওলা পয়েন্টে বিপদ সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই কুশিয়ারা নদী ভাটিতে মৌলভীবাজারের শেরপুর পয়েন্টে কখনো বিপদ সীমার সময় বেধে ৫-১০ সেন্টি মিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাবাস কেন্দ্রের অনলাইন তথ্য মতে, কুশিয়ারা নদীর পানিস্তর বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবারে কমার সম্ভাবনা নেই। তাই হাকালুকি হাওড় পাড়ের এবং কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজনকে বন্যার জনিত সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশের সর্ব বৃহৎ হাকালুকি হাওড়ের পানি নিস্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে কুশিয়ারা নদী। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে হাওড়ের পানি বের হতে না পেয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। এতে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি উপজেলার বিস্তৃর্ণ জনপদ বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এই হাকালুকি হাওড়ের পানির কারণে সিলেট জেলার ফেঞ্জুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এলাকায়ও জলাবদ্ধতা জনিত বন্যা বিরাজ করজে।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বৃহস্পতিবার বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, জেলার প্রায় ৮০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে ৫২ হাজার ১১১টি পরিবারের ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৩৭ জন মানুষ। বন্যার পানিতে নিম্মজিত হয়ে প্রায় ৪৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সারা জেলায় ১০১ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২২ হাজার ৩০০ মানুষ ও প্রায় পোনে ২হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। এ পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলায় ৪৪০ মেট্টিক টন চাল, ১ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকার ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ, খলিলপুর ও রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ও উত্তরভাগ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পানিতে নিম্মজিত হয়েছে। কাউয়াদীঘি হাওরের মনু ইরিগেশন প্রকল্পের বাধের বাহিরে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িঘরে পানি রয়েছে। কাশিপুর এলাকার রজব আলী জানান, বন্যার পানি ঘর বাড়িতে থাকায় মানুষ ও গবাদিপুশ নিয়ে বাড়িঘরে থাকা রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উত্তরভাগ ইউনিয়নের কামালপুর, সুরিখাল, সুনামপুর এবং ফতেপুর ইউনিয়নের বিলপাড়ি, তুলাপুর, বেড়কুড়ি, শাহাপুর, জাহিদপুরসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানীয় লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। এসব এলাকার অপেক্ষাকৃত ধনি পরিবারের অনেকে ইতিমধ্যে শহর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবার স্থানান্তর করেছেন। রাজনগরের পানিসাইল গ্রামে কেড়ে উঠা মৌলভীবাজারের সদ্য সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) অ্যাডভোকেট ভূপতি রঞ্জন চৌধুরী জানান, কুশিয়ারা নদীর দুই পাড়ে যে বাধ নির্মাণ করা হয়েছে তাতে হাওড়ের সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে কুশিয়ারা নদীর পানি হাওড়ে প্রবেশ করতে পারছে না। এতে নদীর পানিতে বাধের বাহিরে গ্রামগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে আক্রান্ত করেছে।
কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পানিতে নিমজ্জিত। হাসপাতালে প্রবেশের জন্য অস্থায়ী পাটাতন বসানো হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার বুকশিমইল গ্রাম পুরোপুরিই পানিতে নিমজ্জিত।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ২১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।
জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যার কারণে এ পর্যন্ত জেলার ৭টি উপজেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসাসহ ১৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার বন্যাকবলিত ১৫শ অসহায় পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।
সড়ক-হাওর
জলে একাকার
প্রতিনিধি, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার)
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-অরুয়াইল সড়ক। উপজেলার সবচেয়ে জনসম্পৃক্ত এই সড়কটির ৩টি পয়েন্ট পানিতে ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে। প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জনজীবনে।
ঝুঁকি আর দুর্ভোগকে সঙ্গী করে এই সড়ক দিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহন পানির উপর দিয়ে চলাচল করছে। তবে যান চলাচল আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৩টি পয়েন্টে সড়কের উপর দিয়ে প্রবল গ্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে বন্যার পানি। কোথাও কোথাও বুঝবার উপায় নেই এটি সড়ক নাকি হাওর। তীব্র গ্রোতের কারণে উভয় পাশ দিয়ে ভাঙছে সড়ক। ভাঙন অব্যাহত থাকলে সড়কটি হাওরে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলার চুন্টা গ্রামের মোড়ে সড়কটির একটি অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চুন্টা ও লোপাড়া গ্রাম পেরিয়ে ভূইশ্বর বাজার থেকে কালিশিমুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়কে হাঁটু সমান পানি। পানি উপচে সড়ক-হাওর একাকার হয়ে যাওয়ায় এখন সড়ক চেনা দায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পানি উন্নয়নন বোর্ডের তথ্যমতে, তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে নাসিরনগর, সরাইল ও নবীনগর এলাকার নি¤œাঞ্চল বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এলজিইডির সরাইল উপজেলা প্রকৌশলী নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, ‘সড়কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। আমরা এটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছি। প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর কর্তৃপক্ষ বন্যা পরবর্তীতে সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেবে।’