পদ্মার উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল বেশ কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ : আইনুন নিশাত

পদ্মা নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন এসব কিছুর কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল বেশ কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ।

আর এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। যার জন্য পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও। আর এই নদীকে বাগে এনে এর উপর সেতু নির্মাণে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে সংবাদকে জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য, পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।

তবে ড. নিশাত বলছেন, পদ্মা ‘আসলে খরস্রোতা নয়, প্রবহমান নদী’।

ড. আইনুন নিশাত সংবাদকে বলেন, ‘যদিও পরিবেশের দিকটা দেখার জন্য অন্য একজন (ফিরোজ আহমেদ) দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আর আমি যেহেতু দীর্ঘদিন জীব বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করি, তাই কর্তৃপক্ষ আমাকে জীব বৈচিত্র্যের ওপর নজর দেয়ার বিষয়টা দেখতে বলেন। এ বিষয়টা দেখতে গিয়ে অনেক কিছুই দেখতে হয়।’

পদ্মার গতি-প্রকৃতি থেকে শুরু করে শ্রমিক ব্যবস্থাপনার কোনটাই বাদ যায়নি জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। নরম হওয়ার কারণে নদীর তল অনেক গভীরে চলে যেতে পারে অথবা দুই পাশ ভাঙতে পারে। এ কারণে কাজটা ছিল বেশ কঠিন ও জটিল।’

শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে ১শ’ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর ওই গভীরতায় সেতুর যেসব পাইল বসানো হবে সেগুলোর ফাউন্ডেশন তৈরি করা।

‘আমাদের দেশের নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ভার রাখতে হয় মাটিতে। এ কারণে নদীতে অনেক ভারী পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন ৮শ’ কেজি থেকে এক টন,’ বলেন আইনুন নিশাত।

‘পদ্মার বুকে সেতুর কাজ করতে গিয়ে সব সময় নজরে রাখতে হয়েছে আশপাশের মানুষ ও জীব বৈচিত্র্যের যেন কোন ক্ষতি না হয়,’ বলেন তিনি।

তিনি জানান এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কানাডার একটা কোম্পানি উপদেষ্টা হিসেবে ছিল। আর এ ধরনের প্রকল্প যেহেতু বেশ গভীরভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে, তাই এ ধরনের কাজে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

ড. নিশাত বলেন, ‘যেমন, হাজার দুই শ্রমিক আসলো কাজ করতে, এরা থাকবে কোথায়, খাওয়া-দাওয়ার কী হবে। এদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কী হবে। এসব বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে, এসব বিষয়ও আমাদের দেখতে হয়েছে। একেক সময় চীন থেকে শ্রমিক আসতো দুই থেকে তিন হাজার, আসতো ইঞ্জিনিয়ার তাদের থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তার বিষয়টা দেখতে হতো। কোন সময় কত দেশি কর্মী, বিদেশি কর্মী কাজ করছে তার তথ্য রাখতে হতো।’

শুধু চীনাদের জন্য পদ্মার দুই পারে ছোট-খাটো শহর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। যেখানে সেতুর অংশ বানানো হচ্ছিল, মানে কাজের এলাকার পাশেই বিরাট জায়গা দেয়া হয়। তাদের ঘর বাড়ি তৈরি করে থাকার জন্য। চীনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল। খাবারের জন্য ৫-৬টা রেস্টুরেন্টের মতো ছিল।

সব মিলিয়ে ৪-৫ হাজার শ্রমিক কোথায় খাবে, থাকবে, ময়লা কোথায় ফেলা হবে, কাজের সময় প্রচুর ধুলা হতো সেখানে পানি ছিটানো হচ্ছে কিনা, পরিবেশে যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, ধুলায় যেন মানুষের, জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি না হয় সেসবও দেখতে হতো।

বিরাট এলাকা- গ্রামের মানুষ কোথা দিয়ে ঢুকবে কোথা দিয়ে বেরোবে, নদীর পারে আসতে পারবে কোন দিক দিয়ে তারও ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এখানে লঞ্চঘাট ছিল তার ব্যবস্থাপনা করা, এমনকি যেসব শ্রমিক কাজ করছে তারা কেউ হেলমেটা ছাড়া কাজ করছে কি-না, খালি পায়ে কাজ করছে কি-না এসবও দেখতে হতো।

প্রায় সময় দু-চারশ’ থেকে হাজার খানেক উৎসুক লোক থাকত। দুর্ঘটনা এড়াতে এরপর তারকাঁটা দিয়ে সীমাবদ্ধ করা হয় এলাকাকে।

ড. নিশাত বলেন ‘শুধু তাই নয়, সেতু সংলগ্ন রাস্তায় গাছ লাগানোর সময় বিভিন্ন জাতের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়। কোন গাছ কোথায় লাগাতে হবে তা নিয়ে আলাদা করে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যে কারণে সেতু কর্তৃপক্ষ কিন্তু জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর পর রাস্তা দেখা যাবে না বাইরে থেকে গাছে গাছে ছেয়ে যাবে। চমৎকার বনায়ন করা হয়েছে।

‘পরিবেশ সুস্থ রাখতে পাইলিং করার সময় যে শব্দ হতো, পাইল থেকে ১০০ ফুট, এক কিলোমিটার পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রতিদিন দিনে দুই-তিনবার শব্দ মাপা হতো যাতে শব্দের কারণে ইলিশ মাছের কোন সমস্যা না হয়। যেখানে নদীর গভীরতা ২০ ফুটের বেশি সেখানে ইলিশ মাছ চলাচল করার সময় ওই গভীরতায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে ইলিশ মাছ নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে।’

এছাড়া নদীর পশ্চিম পাশে চর জানাজাতের কাছে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা এবং এক থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া একটি চরে প্রচুর কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এই কচ্ছপগুলোর যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যও তাদের জন্য আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেতুর দক্ষিণে বিশাল আকারের একটি চরকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছসহ অন্য বন্যপ্রাণী কোন জায়গা দিয়ে চলাচল করছে তার ওপরও নজর রাখা হচ্ছে।

ড. নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য নদীর স্বাভাবিক গতিপথে কোন বাধা দেয়া হয়নি। নদীকে কোথাও সঙ্কুচিতও করা হয়নি।’

সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে ২৫ জুন। আপাতদৃষ্টিতে সেতুর কাজ শেষ হয়েছে বলে মনে হলেও আগামী দুই বছর এর তদারকি করবে ঠিকাদার।

ড. নিশাত বলেন, ‘সেতুর ঠিকাদার কাজ শেষ করেছে গতকাল। এখন তাদের কাজ হচ্ছে সামনের দুই বছর তদারকি করা। সেতুর সঙ্গে জড়িত ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলীরা বাড়ি চলে যাচ্ছে। শ্রমিক যারা ছিল তাদেরও কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু সেতু যতদিন থাকবে ততদিন এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।’

‘আমরা কোন কিছু নির্মাণের সময় যতটা তৎপর থাকি তারপর কারও কোন লাখ থাকে না। এই রক্ষণাবেক্ষণ না করার জন্য বহু প্রজেক্ট দশ পনের বছর পর অকেজো হয়ে গেছে। যেমন মেঘনা সেতুর কথা বলা যেতে পারে এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ছিল না। তাই বিশাল এই অর্জনকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন প্রকৌশলীর। নদীশাসন ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে থাকতে হবে।’

ড. নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের অংশে একটা রিক্রিয়েশন সেন্টার করার প্রস্তাব আছে। পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, আশা করি শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। যাই হোক, সবটাই যেন পরিবেশের ওপর হুমকি না হয় সে বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’

পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও, নদীশাসনের কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে বলছেন ড. নিশাত। ‘আরও এক বছর লাগবে। এই নদীশাসনের কাজ শেষ হওয়ার পর এক থেকে দুই বছর ঠিকাদাররাই রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তারপর সেতু কর্তৃপক্ষ হাতে নেবে, তার পদ্ধতি কী হবে সেটাও চূড়ান্ত করে দিচ্ছি’ বলে জানান তিনি।

‘নদ-নদীর গতিপ্রবাহ ঠিক রাখা, নদীর ওপর যেন কোন ইমপ্যাক্ট না পড়ে সেজন্য আমরা নদীশাসন বা নদী ব্যবস্থাপনার কাজ করে আসছি। সমীক্ষাও করা হয়েছে। আশা করি পদ্মার ওপর এই সেতু নির্মাণের কোন মন্দ ইমপ্যাক্ট পড়বে না,’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।

শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

পদ্মার উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল বেশ কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ : আইনুন নিশাত

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

পদ্মা নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন এসব কিছুর কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল বেশ কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ।

আর এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। যার জন্য পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও। আর এই নদীকে বাগে এনে এর উপর সেতু নির্মাণে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে সংবাদকে জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য, পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।

তবে ড. নিশাত বলছেন, পদ্মা ‘আসলে খরস্রোতা নয়, প্রবহমান নদী’।

ড. আইনুন নিশাত সংবাদকে বলেন, ‘যদিও পরিবেশের দিকটা দেখার জন্য অন্য একজন (ফিরোজ আহমেদ) দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আর আমি যেহেতু দীর্ঘদিন জীব বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করি, তাই কর্তৃপক্ষ আমাকে জীব বৈচিত্র্যের ওপর নজর দেয়ার বিষয়টা দেখতে বলেন। এ বিষয়টা দেখতে গিয়ে অনেক কিছুই দেখতে হয়।’

পদ্মার গতি-প্রকৃতি থেকে শুরু করে শ্রমিক ব্যবস্থাপনার কোনটাই বাদ যায়নি জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। নরম হওয়ার কারণে নদীর তল অনেক গভীরে চলে যেতে পারে অথবা দুই পাশ ভাঙতে পারে। এ কারণে কাজটা ছিল বেশ কঠিন ও জটিল।’

শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে ১শ’ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর ওই গভীরতায় সেতুর যেসব পাইল বসানো হবে সেগুলোর ফাউন্ডেশন তৈরি করা।

‘আমাদের দেশের নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ভার রাখতে হয় মাটিতে। এ কারণে নদীতে অনেক ভারী পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন ৮শ’ কেজি থেকে এক টন,’ বলেন আইনুন নিশাত।

‘পদ্মার বুকে সেতুর কাজ করতে গিয়ে সব সময় নজরে রাখতে হয়েছে আশপাশের মানুষ ও জীব বৈচিত্র্যের যেন কোন ক্ষতি না হয়,’ বলেন তিনি।

তিনি জানান এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কানাডার একটা কোম্পানি উপদেষ্টা হিসেবে ছিল। আর এ ধরনের প্রকল্প যেহেতু বেশ গভীরভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে, তাই এ ধরনের কাজে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

ড. নিশাত বলেন, ‘যেমন, হাজার দুই শ্রমিক আসলো কাজ করতে, এরা থাকবে কোথায়, খাওয়া-দাওয়ার কী হবে। এদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কী হবে। এসব বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে, এসব বিষয়ও আমাদের দেখতে হয়েছে। একেক সময় চীন থেকে শ্রমিক আসতো দুই থেকে তিন হাজার, আসতো ইঞ্জিনিয়ার তাদের থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তার বিষয়টা দেখতে হতো। কোন সময় কত দেশি কর্মী, বিদেশি কর্মী কাজ করছে তার তথ্য রাখতে হতো।’

শুধু চীনাদের জন্য পদ্মার দুই পারে ছোট-খাটো শহর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। যেখানে সেতুর অংশ বানানো হচ্ছিল, মানে কাজের এলাকার পাশেই বিরাট জায়গা দেয়া হয়। তাদের ঘর বাড়ি তৈরি করে থাকার জন্য। চীনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল। খাবারের জন্য ৫-৬টা রেস্টুরেন্টের মতো ছিল।

সব মিলিয়ে ৪-৫ হাজার শ্রমিক কোথায় খাবে, থাকবে, ময়লা কোথায় ফেলা হবে, কাজের সময় প্রচুর ধুলা হতো সেখানে পানি ছিটানো হচ্ছে কিনা, পরিবেশে যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, ধুলায় যেন মানুষের, জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি না হয় সেসবও দেখতে হতো।

বিরাট এলাকা- গ্রামের মানুষ কোথা দিয়ে ঢুকবে কোথা দিয়ে বেরোবে, নদীর পারে আসতে পারবে কোন দিক দিয়ে তারও ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এখানে লঞ্চঘাট ছিল তার ব্যবস্থাপনা করা, এমনকি যেসব শ্রমিক কাজ করছে তারা কেউ হেলমেটা ছাড়া কাজ করছে কি-না, খালি পায়ে কাজ করছে কি-না এসবও দেখতে হতো।

প্রায় সময় দু-চারশ’ থেকে হাজার খানেক উৎসুক লোক থাকত। দুর্ঘটনা এড়াতে এরপর তারকাঁটা দিয়ে সীমাবদ্ধ করা হয় এলাকাকে।

ড. নিশাত বলেন ‘শুধু তাই নয়, সেতু সংলগ্ন রাস্তায় গাছ লাগানোর সময় বিভিন্ন জাতের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়। কোন গাছ কোথায় লাগাতে হবে তা নিয়ে আলাদা করে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যে কারণে সেতু কর্তৃপক্ষ কিন্তু জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর পর রাস্তা দেখা যাবে না বাইরে থেকে গাছে গাছে ছেয়ে যাবে। চমৎকার বনায়ন করা হয়েছে।

‘পরিবেশ সুস্থ রাখতে পাইলিং করার সময় যে শব্দ হতো, পাইল থেকে ১০০ ফুট, এক কিলোমিটার পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রতিদিন দিনে দুই-তিনবার শব্দ মাপা হতো যাতে শব্দের কারণে ইলিশ মাছের কোন সমস্যা না হয়। যেখানে নদীর গভীরতা ২০ ফুটের বেশি সেখানে ইলিশ মাছ চলাচল করার সময় ওই গভীরতায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে ইলিশ মাছ নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে।’

এছাড়া নদীর পশ্চিম পাশে চর জানাজাতের কাছে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা এবং এক থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া একটি চরে প্রচুর কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এই কচ্ছপগুলোর যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যও তাদের জন্য আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেতুর দক্ষিণে বিশাল আকারের একটি চরকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছসহ অন্য বন্যপ্রাণী কোন জায়গা দিয়ে চলাচল করছে তার ওপরও নজর রাখা হচ্ছে।

ড. নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য নদীর স্বাভাবিক গতিপথে কোন বাধা দেয়া হয়নি। নদীকে কোথাও সঙ্কুচিতও করা হয়নি।’

সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে ২৫ জুন। আপাতদৃষ্টিতে সেতুর কাজ শেষ হয়েছে বলে মনে হলেও আগামী দুই বছর এর তদারকি করবে ঠিকাদার।

ড. নিশাত বলেন, ‘সেতুর ঠিকাদার কাজ শেষ করেছে গতকাল। এখন তাদের কাজ হচ্ছে সামনের দুই বছর তদারকি করা। সেতুর সঙ্গে জড়িত ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলীরা বাড়ি চলে যাচ্ছে। শ্রমিক যারা ছিল তাদেরও কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু সেতু যতদিন থাকবে ততদিন এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।’

‘আমরা কোন কিছু নির্মাণের সময় যতটা তৎপর থাকি তারপর কারও কোন লাখ থাকে না। এই রক্ষণাবেক্ষণ না করার জন্য বহু প্রজেক্ট দশ পনের বছর পর অকেজো হয়ে গেছে। যেমন মেঘনা সেতুর কথা বলা যেতে পারে এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ছিল না। তাই বিশাল এই অর্জনকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন প্রকৌশলীর। নদীশাসন ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে থাকতে হবে।’

ড. নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের অংশে একটা রিক্রিয়েশন সেন্টার করার প্রস্তাব আছে। পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, আশা করি শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। যাই হোক, সবটাই যেন পরিবেশের ওপর হুমকি না হয় সে বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’

পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও, নদীশাসনের কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে বলছেন ড. নিশাত। ‘আরও এক বছর লাগবে। এই নদীশাসনের কাজ শেষ হওয়ার পর এক থেকে দুই বছর ঠিকাদাররাই রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তারপর সেতু কর্তৃপক্ষ হাতে নেবে, তার পদ্ধতি কী হবে সেটাও চূড়ান্ত করে দিচ্ছি’ বলে জানান তিনি।

‘নদ-নদীর গতিপ্রবাহ ঠিক রাখা, নদীর ওপর যেন কোন ইমপ্যাক্ট না পড়ে সেজন্য আমরা নদীশাসন বা নদী ব্যবস্থাপনার কাজ করে আসছি। সমীক্ষাও করা হয়েছে। আশা করি পদ্মার ওপর এই সেতু নির্মাণের কোন মন্দ ইমপ্যাক্ট পড়বে না,’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।