পদ্মা সেতু : বিতর্ক ও রাজনীতি

‘পদ্মা সেতু’ নিয়ে প্রায় একযুগ দেশে নানা রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের পর থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের শুরু। রাজনীতি শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এক সময় মার্কিন পরাশক্তিও প্রকল্পটি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।

স্বার্থের দ্বন্দ্বে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস পদ্মা সেতু প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করতে মার্কিন পরাশক্তির কাছে ধরনা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। সেই প্রেক্ষিতে দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও হয়েছে।

রিস্ক আছে, এই সেতুতে কেউ উঠবেন না : ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কোন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল। এর আগে বিএনপির আমলে দুর্নীতির কারণে একাধিক প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করেছে বলে সংসদে উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ।

২০১২ সালের ১ জুলাই খালেদা জিয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই সরকার বিরাট দুর্নীতি করেছে। তাই এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’

খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, যে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আওয়ামী লীগ সরকার দেখাচ্ছে, তা তাদের আমলে হবে না। এই সেতু জোড়াতালি দিয়ে............ বানানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এই সেতুতে কেউ উঠবেন না, রিস্ক আছে।’

পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর নিয়ে বিতর্ক : প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বলে বক্তব্য দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ৫ জুন ঠাকুরগাঁওয়া সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পদ্মার দুই পাড়েই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া।’ তবে এই বক্তব্যে বিষয়ে তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা বলেন, ‘মির্জা ফখরুলের এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।’ এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবের কাছে খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রমাণ জনসম্মুখে উপস্থাপনের দাবি জানান।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের উপর মার্কিন চাপ: বেআইনীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ ধরে রাখতে না পেরে ড. ইউনূস ‘পদ্মা সেতু’ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করেছেন এবং বিচার নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের কাছে গেছেন বলে অভিযোগ ক্ষমাতসীন দলের।

ইউনূসের অভিযোগের পর মার্কিন প্রশাসন ‘শেখ হাসিনার পরিবারের’ উপর মানিসক যন্ত্রণা চালিয়েছে, এমন কথা নিজেই সংসদে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নানা চাপ দিয়েছে। ড. ইউনূসের এমডি পদ ফিরিয়ে দিতে। বিশ্বব্যাংকের কথামত পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করতে। অন্যথায় জয়ের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবে। জয় বলেছে, তার দূর্নীতি পেলে ব্যবস্থা নিতে। মায়ের কাজে তিনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুল এবং বোন শেখ রেহানেকও নানাভাবে মানসিক চাপ দেওয়া হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করতে ড. ইউনূস ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে অনেক বার ইমেইল করেছেন জানিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, হিলারি ক্লিনটনকে দিয়েও ইমেইল পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া নানা ভাবে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেককেই সে সময় সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ‘এত চাপ, মিথ্যা মামলা’; এসব কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।

২০১৭ সালে কানাডার আদালতের রায়ে ‘পদ্মা সেতু’ প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তকে ‘জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই রায়ের ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাংক এনেছিল, তা থেকে বাংলাদেশ দায়মুক্তি পায়।

আজ ২৫ জুন ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক পথে যুক্ত করবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

প্রকল্প সম্পন্ন হলেও ভোটের রাজনীতিতে ‘পদ্মা সেতু’ আলোচনায় থাকবে আরও অনেক দিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ এর সুবিধাভোগী হবে আর বিএনপিকে ‘কিছুটা’ হলেও মাশুল দিতে হবে।

শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

পদ্মা সেতু : বিতর্ক ও রাজনীতি

ফয়েজ আহমেদ তুষার

‘পদ্মা সেতু’ নিয়ে প্রায় একযুগ দেশে নানা রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের পর থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের শুরু। রাজনীতি শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এক সময় মার্কিন পরাশক্তিও প্রকল্পটি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।

স্বার্থের দ্বন্দ্বে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস পদ্মা সেতু প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করতে মার্কিন পরাশক্তির কাছে ধরনা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। সেই প্রেক্ষিতে দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও হয়েছে।

রিস্ক আছে, এই সেতুতে কেউ উঠবেন না : ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কোন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল। এর আগে বিএনপির আমলে দুর্নীতির কারণে একাধিক প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করেছে বলে সংসদে উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ।

২০১২ সালের ১ জুলাই খালেদা জিয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই সরকার বিরাট দুর্নীতি করেছে। তাই এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’

খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, যে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আওয়ামী লীগ সরকার দেখাচ্ছে, তা তাদের আমলে হবে না। এই সেতু জোড়াতালি দিয়ে............ বানানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এই সেতুতে কেউ উঠবেন না, রিস্ক আছে।’

পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর নিয়ে বিতর্ক : প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বলে বক্তব্য দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ৫ জুন ঠাকুরগাঁওয়া সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পদ্মার দুই পাড়েই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া।’ তবে এই বক্তব্যে বিষয়ে তৎকালিন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা বলেন, ‘মির্জা ফখরুলের এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।’ এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবের কাছে খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রমাণ জনসম্মুখে উপস্থাপনের দাবি জানান।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের উপর মার্কিন চাপ: বেআইনীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ ধরে রাখতে না পেরে ড. ইউনূস ‘পদ্মা সেতু’ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করেছেন এবং বিচার নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের কাছে গেছেন বলে অভিযোগ ক্ষমাতসীন দলের।

ইউনূসের অভিযোগের পর মার্কিন প্রশাসন ‘শেখ হাসিনার পরিবারের’ উপর মানিসক যন্ত্রণা চালিয়েছে, এমন কথা নিজেই সংসদে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নানা চাপ দিয়েছে। ড. ইউনূসের এমডি পদ ফিরিয়ে দিতে। বিশ্বব্যাংকের কথামত পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করতে। অন্যথায় জয়ের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবে। জয় বলেছে, তার দূর্নীতি পেলে ব্যবস্থা নিতে। মায়ের কাজে তিনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুল এবং বোন শেখ রেহানেকও নানাভাবে মানসিক চাপ দেওয়া হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করতে ড. ইউনূস ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে অনেক বার ইমেইল করেছেন জানিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, হিলারি ক্লিনটনকে দিয়েও ইমেইল পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া নানা ভাবে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেককেই সে সময় সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ‘এত চাপ, মিথ্যা মামলা’; এসব কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।

২০১৭ সালে কানাডার আদালতের রায়ে ‘পদ্মা সেতু’ প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তকে ‘জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই রায়ের ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাংক এনেছিল, তা থেকে বাংলাদেশ দায়মুক্তি পায়।

আজ ২৫ জুন ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক পথে যুক্ত করবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

প্রকল্প সম্পন্ন হলেও ভোটের রাজনীতিতে ‘পদ্মা সেতু’ আলোচনায় থাকবে আরও অনেক দিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ এর সুবিধাভোগী হবে আর বিএনপিকে ‘কিছুটা’ হলেও মাশুল দিতে হবে।