পদ্মা সেতু : বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও গৌরবের প্রতীক

শেখর ভট্টাচার্য

স্বপ্নের কথা উঠলেই আমার ভারতের বিজ্ঞানী, লেখক, রাষ্ট্রপতি এ, পি, জে আবুল কালামের কথা মনে হয়। তিনি স্বভাবগতভাবে স্বপ্নচারী ছিলেন। তার স্বপ্নকে আরও উসকে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন শৈশবের শিক্ষক শিব সুব্রামনিয়াম আয়ার। শিক্ষক আয়ার এক দিন শ্রেণী কক্ষের বোর্ডে একটি পাখি এঁকে জানতে চাইলেন পাখির মতো উড়তে পারবে কে? ওড়ার বিষয়টি স্বপ্নচারী আবুল কালামের মনের ভেতরে বেশ ধাক্কা দিল। তিনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, পাখির মতো তিনি উড়ছেন আকাশে। পাখির মতো ওড়ার জন্য যুদ্ধবিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলেন স্বপ্নচারী বিজ্ঞানী আবুল কালাম। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি দমে যাননি। পরবর্তী সময়ে হয়েছিলেন রকেট বিজ্ঞানী। বিমান প্রকৌশলে পড়াশোনা করে ভারতের প্রথম মহাকাশযান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। ওই মহাকাশযান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মূল পরীক্ষা চালানোর পর দীর্ঘ ২৪ বছরে ভারতের এটাই ছিল প্রথম সফল পারমাণবিক পরীক্ষা। এ কারণেই তিনি পরিচিতি পান ভারতের ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে।

স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্ন দেখানো কঠিন কাজ। মহৎ মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং স্বপ্ন দেখাতেও পারেন। স্বপ্নচারী আবুল কালাম বিশ্বাস করতেন, ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নবাজরা সব সময় সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন।’ তাই তিনি সবাইকে স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্নের পেছনে তাড়া করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কারণ, ‘স্বপ্ন না দেখলে-তো তা’ সত্যি হবে না’। তার মতে, ‘স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ, স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে।’ এই যে চিন্তাকে কর্মে পরিণত করা, তা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর মধ্যেই সাধারণ ও অসাধারণের পার্থক্যের সীমা রেখা চিহ্নিত হয়ে যায়।

বাঙালিদের মধ্যে স্বপ্ন ও দুরদৃষ্টি ছিল যার সীমাহীন, তিনি হলেন বাঙালির অন্তরে অনুক্ষণ বসবাসকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। আটচল্লিশ সালের মার্চ মাসে যখন দ্বিজাতিতত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত হানা শুরু করেন পাকিস্তানের বড়লাট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’ তখন থেকেই তার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের পথে। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি মুসলিম লীগের সদস্য হিসাবে প্রাণপণ লড়াই করেছেন সে পাকিস্তান তাকে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য, নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। স্বপ্নের পাকিস্তানের মাটিতে তার প্রথম কারাবরণ ১৯৪৮ সালের মার্চের ১১ তারিখে। তার এই কারাভোগ ছিল দূরবর্তী স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীকী মাইলস্টোন।

আমাজনের পর পদ্মা নদীই বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবহমান নদী। যে নদীর অববাহিকায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে রাজনীতি করা হচ্ছে। প্রবল স্রোতধারাকে শাসন করে এ রকম সেতু নির্মাণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। এটি এক অসম্ভব স্বপ্ন। বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনীতিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পদ্মা সেতু সে রকম একটি প্রতিশ্রুতির নাম। বাস্তব সত্য এখন ভিন্ন। প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতুর স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মা নদীর ওপর প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু এখন পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান। দিন গুনছে মানুষ, ২৫ জুনের জন্য, যে দিন উদ্বোধন হবে পদ্মা সেতু। যারা বলেছিলেন পদ্মার বুকে সেতু হবে না, তারাও বিস্মিতÑবাঙালি তার অসীম সাহস ও অদম্য ইচ্ছা দিয়ে সব স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে এটিই প্রমাণিত হলো স্রোতস্বিনী পদ্মার বুকে।

যেদিন বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে এসেছিল, সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক পরিচিতি। বিশ্ববাসী জেনেছে বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের সক্ষমতার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার কারণেই দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে পদ্মার বুকে নির্মিত হলো সেতু।

পদ্মা সেতু কী শুধু একটি সেতু? মোটেও নয়Ñএটি বাঙালির সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং গৌরবের প্রতীক। একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মার তীর থেকে দেখা যাচ্ছে পিলারের দীর্ঘ সারি। পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৭ কোটি মানুষের হৃদয়ের আবেগ, আশা ও অনুভূতি। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ এই পদ্মা সেতু। নির্মিত সেতুটি উন্মুক্ত করেছে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুয়ার। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরও তিনটি সংস্থা; এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

পরের ইতিহাস আমাদের জানা। কথায় আছে ‘রক্ত কথা বলে’। সাহসী পিতার সাহসী কন্যা সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেন। কেটে যায় জাতির ভাগ্যাকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা। দিগন্ত আলোকিত করে বাংলার আকাশে হেসে উঠে বিজয়ের সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে যারা বাস্তব রূপ দিতে চাননি, যারা চক্রান্ত করেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তারা স্তব্ধ হয়ে যান ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারক আয়ান নর্ডেইমারের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়। ভেস্তে যায় কুচক্রীদের সব ষড়যন্ত্র। স্বপ্নের পদ্মা সেতু যেমন আজ বাস্তব, ঠিক তেমনি বাস্তব কানাডার ডাউন টাউন টরন্টোর ৩৬১ ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউয়ের ২৪১ নম্বর কক্ষে সংরক্ষিত ফাইল নম্বর ৩-৯০০০০৭২৭-০০০০। কারণ এই ফাইলটিই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির বানোয়াট অভিযোগ খ-নের সাক্ষী বহন করছে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে দেশি-বিদেশি খলনায়কগণ এই ভেবে নিশ্চিত ছিলেন যে, পদ্মা সেতুর নির্মা?ণ পরিকল্পনা কখনই আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছরের ওপর। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয় পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।

সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরুর পর বিভাগীয় শহর খুলনা ও বরিশাল, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা ঘিরে বাড়বে পর্যটন সম্ভাবনা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নবদ্বার উন্মোচিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সংযোগ ঘটবে। এতে কাঁচামাল সরবরাহসহ পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। বদলে যাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় অর্থনীতিবীদরা দেখিয়েছেন, এ সেতু নির্মিত হলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০, মাছের চাহিদা ১০, ইউটিলিটি সেবার চাহিদা ৫ ও পরিবহন চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে। অমিত সম্ভাবনা আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী দিনের উন্নয়ন। বদলে যাবে নদী-মেঘলা সবুজ-শ্যামল প্রিয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে নদীতীরের মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে শুরু করেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সেতু হবে অন্যতম চালিকাশক্তি, সামর্থ্যরে সোনালি ঠিকানা। স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

বাঙালি যে দুর্জয়কে জয় করতে পারে, যে কোন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, বাংলাদেশেরও যে সক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশ যে এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সেটা প্রমাণের জন্য এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে অহংকারের প্রতীক হয়ে মূর্তমান হয়ে আছে বাস্তবের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এ সময়ে কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,

“শাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

পদ্মা সেতু : বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও গৌরবের প্রতীক

শেখর ভট্টাচার্য

image

স্বপ্নের কথা উঠলেই আমার ভারতের বিজ্ঞানী, লেখক, রাষ্ট্রপতি এ, পি, জে আবুল কালামের কথা মনে হয়। তিনি স্বভাবগতভাবে স্বপ্নচারী ছিলেন। তার স্বপ্নকে আরও উসকে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন শৈশবের শিক্ষক শিব সুব্রামনিয়াম আয়ার। শিক্ষক আয়ার এক দিন শ্রেণী কক্ষের বোর্ডে একটি পাখি এঁকে জানতে চাইলেন পাখির মতো উড়তে পারবে কে? ওড়ার বিষয়টি স্বপ্নচারী আবুল কালামের মনের ভেতরে বেশ ধাক্কা দিল। তিনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, পাখির মতো তিনি উড়ছেন আকাশে। পাখির মতো ওড়ার জন্য যুদ্ধবিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলেন স্বপ্নচারী বিজ্ঞানী আবুল কালাম। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি দমে যাননি। পরবর্তী সময়ে হয়েছিলেন রকেট বিজ্ঞানী। বিমান প্রকৌশলে পড়াশোনা করে ভারতের প্রথম মহাকাশযান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। ওই মহাকাশযান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মূল পরীক্ষা চালানোর পর দীর্ঘ ২৪ বছরে ভারতের এটাই ছিল প্রথম সফল পারমাণবিক পরীক্ষা। এ কারণেই তিনি পরিচিতি পান ভারতের ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে।

স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্ন দেখানো কঠিন কাজ। মহৎ মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং স্বপ্ন দেখাতেও পারেন। স্বপ্নচারী আবুল কালাম বিশ্বাস করতেন, ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নবাজরা সব সময় সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন।’ তাই তিনি সবাইকে স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্নের পেছনে তাড়া করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কারণ, ‘স্বপ্ন না দেখলে-তো তা’ সত্যি হবে না’। তার মতে, ‘স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ, স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে।’ এই যে চিন্তাকে কর্মে পরিণত করা, তা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর মধ্যেই সাধারণ ও অসাধারণের পার্থক্যের সীমা রেখা চিহ্নিত হয়ে যায়।

বাঙালিদের মধ্যে স্বপ্ন ও দুরদৃষ্টি ছিল যার সীমাহীন, তিনি হলেন বাঙালির অন্তরে অনুক্ষণ বসবাসকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। আটচল্লিশ সালের মার্চ মাসে যখন দ্বিজাতিতত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত হানা শুরু করেন পাকিস্তানের বড়লাট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’ তখন থেকেই তার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের পথে। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি মুসলিম লীগের সদস্য হিসাবে প্রাণপণ লড়াই করেছেন সে পাকিস্তান তাকে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য, নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। স্বপ্নের পাকিস্তানের মাটিতে তার প্রথম কারাবরণ ১৯৪৮ সালের মার্চের ১১ তারিখে। তার এই কারাভোগ ছিল দূরবর্তী স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীকী মাইলস্টোন।

আমাজনের পর পদ্মা নদীই বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবহমান নদী। যে নদীর অববাহিকায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে রাজনীতি করা হচ্ছে। প্রবল স্রোতধারাকে শাসন করে এ রকম সেতু নির্মাণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। এটি এক অসম্ভব স্বপ্ন। বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনীতিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পদ্মা সেতু সে রকম একটি প্রতিশ্রুতির নাম। বাস্তব সত্য এখন ভিন্ন। প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতুর স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মা নদীর ওপর প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু এখন পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান। দিন গুনছে মানুষ, ২৫ জুনের জন্য, যে দিন উদ্বোধন হবে পদ্মা সেতু। যারা বলেছিলেন পদ্মার বুকে সেতু হবে না, তারাও বিস্মিতÑবাঙালি তার অসীম সাহস ও অদম্য ইচ্ছা দিয়ে সব স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে এটিই প্রমাণিত হলো স্রোতস্বিনী পদ্মার বুকে।

যেদিন বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে এসেছিল, সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক পরিচিতি। বিশ্ববাসী জেনেছে বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের সক্ষমতার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার কারণেই দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে পদ্মার বুকে নির্মিত হলো সেতু।

পদ্মা সেতু কী শুধু একটি সেতু? মোটেও নয়Ñএটি বাঙালির সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং গৌরবের প্রতীক। একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মার তীর থেকে দেখা যাচ্ছে পিলারের দীর্ঘ সারি। পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৭ কোটি মানুষের হৃদয়ের আবেগ, আশা ও অনুভূতি। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ এই পদ্মা সেতু। নির্মিত সেতুটি উন্মুক্ত করেছে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুয়ার। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরও তিনটি সংস্থা; এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

পরের ইতিহাস আমাদের জানা। কথায় আছে ‘রক্ত কথা বলে’। সাহসী পিতার সাহসী কন্যা সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেন। কেটে যায় জাতির ভাগ্যাকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা। দিগন্ত আলোকিত করে বাংলার আকাশে হেসে উঠে বিজয়ের সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে যারা বাস্তব রূপ দিতে চাননি, যারা চক্রান্ত করেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তারা স্তব্ধ হয়ে যান ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারক আয়ান নর্ডেইমারের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়। ভেস্তে যায় কুচক্রীদের সব ষড়যন্ত্র। স্বপ্নের পদ্মা সেতু যেমন আজ বাস্তব, ঠিক তেমনি বাস্তব কানাডার ডাউন টাউন টরন্টোর ৩৬১ ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউয়ের ২৪১ নম্বর কক্ষে সংরক্ষিত ফাইল নম্বর ৩-৯০০০০৭২৭-০০০০। কারণ এই ফাইলটিই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির বানোয়াট অভিযোগ খ-নের সাক্ষী বহন করছে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে দেশি-বিদেশি খলনায়কগণ এই ভেবে নিশ্চিত ছিলেন যে, পদ্মা সেতুর নির্মা?ণ পরিকল্পনা কখনই আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছরের ওপর। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয় পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।

সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরুর পর বিভাগীয় শহর খুলনা ও বরিশাল, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা ঘিরে বাড়বে পর্যটন সম্ভাবনা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল ও ভোমরা ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নবদ্বার উন্মোচিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সংযোগ ঘটবে। এতে কাঁচামাল সরবরাহসহ পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। বদলে যাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চালচিত্র।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় অর্থনীতিবীদরা দেখিয়েছেন, এ সেতু নির্মিত হলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০, মাছের চাহিদা ১০, ইউটিলিটি সেবার চাহিদা ৫ ও পরিবহন চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে। অমিত সম্ভাবনা আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী দিনের উন্নয়ন। বদলে যাবে নদী-মেঘলা সবুজ-শ্যামল প্রিয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে নদীতীরের মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে শুরু করেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সেতু হবে অন্যতম চালিকাশক্তি, সামর্থ্যরে সোনালি ঠিকানা। স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

বাঙালি যে দুর্জয়কে জয় করতে পারে, যে কোন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, বাংলাদেশেরও যে সক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশ যে এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সেটা প্রমাণের জন্য এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে অহংকারের প্রতীক হয়ে মূর্তমান হয়ে আছে বাস্তবের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এ সময়ে কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,

“শাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]