একতা, ন্যায় ও শক্তির প্রেরণা

অমিত রায় চৌধুরী

পদ্মা জয়ের উপচেপড়া উচ্ছ্বাসে ভেসে আসছে বিজয়ের বেশ কিছু দুর্লভ স্মৃতিকতা। মহান বিজয় দিবস, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কিংবা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান বা ভারতকে হারানোর উন্মাদনা! কীভাবে বাঙালির আবেগ বাঁধ ভেঙেছিল, কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় গোটা দেশ হয়ে উঠেছিল একজাতি, একপ্রাণ-তা ভাবলে আজও শিহরিত হই। পদ্মা সেতু নিয়ে আজ সেই অভিমান, সেই অহঙ্কার-বাঙালি মননের গড়ন যাদের চেনা, তাদের মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।

কিন্তু এখানে কি শুধুই দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদী আবেগ? নিশ্চয়ই না, এখানে জড়িয়ে আছে রুটি-রুজির প্রশ্ন। চাকরি, কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা-সবখানেই স্বপ্ন দেখে তারুণ্য। শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য-চারপাশেই সমৃদ্ধির হাতছানি। আবাসন, বিনোদন, জীবনমান এমনকি জাতীয় প্রবৃদ্ধি কোথায় নেই বিস্ময় সেতুর বরাভয়? দক্ষিণ-পশ্চিমের বিবর্ণ মানচিত্রটাকেই ঝাঁ-চকচকে করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি।

সেতু উদ্বোধনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। পদ্মাপাড়ের যে কোন প্রান্তে দাঁড়ালেই নিসর্গের অপার্থিব সৌন্দর্য টেনে নিয়ে যায় রূপকথার জগতে। কূল নেই, কিনারা নেই, এমন বিশাল জলরাশি দেখে মনে হয় নিঃসীম সমুদ্র। নিঝুম নৈঃশব্দের বুক

চিরে যেন অসীম দিগন্তে মিলিয়ে গেছে এই সেতু। হয়তো অজ¯্র সম্ভাবনা নিয়ে অনাগত আগামীর পথে তার অন্তহীন যাত্রা। অনাবৃত প্রকৃতি আর উৎকৃষ্ট প্রযুক্তির অপূর্ব মেলবন্ধন আকৃষ্ট করছে অবিশ্রান্ত জনস্রোত। পদ্মার দুই কূল আজ সেজে উঠেছে মোহনীয় রূপে। দিনের আলোয় ভাসমান গাঙচিল আর বিস্তৃত ধানক্ষেত। সন্ধ্যায় বাহারি আলোর চোখধাঁধানো রোশনাই। খরস্র্রোতা নদী হিসেবে পর্যটকের কাছে পদ্মার জগৎ জোড়া খ্যাতি। আকর্ষণ, ভয় আর মুগ্ধতার এক দুর্লভ মোহনা। জলস্রোতের ক্ষিপ্রতায় বিশ্বে আমাজনের পরই পদ্মার স্থান। কত সহজে এই অজেয় পদ্মাকে জয় করেছে এই সেতু-তা এক অপার বিস্ময়। নির্মাণ শৈলীর পরতে পরতে শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্ক।

দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ সেতু। লম্বা ছয় কিমির বেশি। চওড়া ৭২ ফুট। জলের উচ্চতা থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। সংযোগ সড়ক আরও ১৪ কিমি। দ্বিতল সেতুর ওপরে ৪ লেইনে চলবে যান। নিচে ছুটবে ট্রেন। স্প্যান ৪১টি। পিলার ৪২টি। পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট, ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। অত্যাধুনিক স্ক্রিন গ্রাউন্ডিং ব্যবহার করা হয়েছে; যাতে পাইলিংয়ের সময় নদী গভীরে শক্ত মাটি খুঁজে নিতে অসুবিধা না হয়। ব্যবহৃত এক একটি পাথরের ওজন এক টন। স্টিল ও কংক্রিটের তৈরি এই সেতুতে ফ্রিকশান পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহৃত; যা রিক্টার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। ২১টি জেলাকে যুক্ত করছে এই সেতু। ২৪ সাল নাগাদ প্রতিদিন গাড়ি চলবে ২৪ হাজার। রেল চালু হলে এক দিকে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে, অন্যদিকে গভীর সমুদ্র বন্দরের সংযুক্তি। পুরো দেশ সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর নাগালে। বিনিয়োগ হবে অকল্পনীয়। জিডিপি বাড়বে ২.২৩ (রেল সহ)। টাকার সঞ্চালন হবে দ্রুত হারে। অর্থ-বিজ্ঞানিদের মত-খরচ উঠে আসবে ৩০ বছরে। দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের বাস দক্ষিণ-পশ্চিমের এই অঞ্চলে। অফুরন্ত সম্ভাবনা আজ দোরে দোরে।

খেয়াল করেছি-গৃহস্থ নারী, ছাত্র-শিক্ষক, প্রান্তিক কৃষক, চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ধনী ব্যবসায়ী-সবাই কেমন যেন বদলে যাওয়া দিনেরই প্রত্যাশায়। হাই-ওয়ের মাইল ফলকে লেখা-দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি জনপদ ফকিরহাট থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৪০ কিমি। কিন্তু এই তো সেদিনও-ঢাকা যাওয়ার নাম শুনলেই যাত্রী আঁতকে উঠেছেন। দেড় দশক আগেও কয়েকটি নদী পার হতে হতো। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময়। আরিচা হয়ে গেলেও প্রায় তাই। রাস্তা ভালো হওয়ায় পদ্মা বাদে নদী পারের ঝামেলা ছিল না। রাজধানি যাত্রাও অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মা বলে কথা! কখন যে সে কোন রূপ ধারণ করেÑতা আন্দাজ করা কঠিন। ঝড়-বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।

উত্তাল এই নদী কত লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট এমনকি ফেরি পর্যন্ত হেলাফেলায় ডুবিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্যোগের সংকেত পেলে সারা রাত অপেক্ষা করেছে সারি সারি পরিবহন। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর এ ধৈর্যের পরীক্ষা তো প্রাত্যহিক অনুশীলন। ‘যাত্রাপথে সীমাহীন দুর্ভোগ’-শব্দবন্ধটির মর্মার্থ তাকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব, যার পদ্মাপারের অভিজ্ঞতাটা নেই। শীতকালে কুয়াশার আশঙ্কা তো যাত্রীকে তটস্থ করে রাখতো। আর মাঝ নদীতে যারা ঝড়ের সাক্ষী, শুধু তারাই হয়তো মরণকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। আর বুঝেছে-জীবনকে তারা কত ভালোবাসে। উৎসব বা কোন উপলক্ষ তৈরি হলে পদ্মাপাড় আলাদা চেহারা নিত। রীতিমতো জনবিস্ফোরণ। করোনাকালে মনে আছে-একবার ঈদের ছুটিতে বাংলার নারী-শিশু-যুবা যেভাবে শুধু বেয়ে ফেরিতে সওযার হয়েছিল, তাকে বড়সড় কোন স্পোর্টস ইভেন্ট মনে করলে ভুল হতো না। কত হয়রানি, কত কষ্ট, কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে! পদ্মাপাড়ের প্রায় ৩ কোটি মানুষ তার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। চাকরি, লেখাপড়া, চিকিৎসা বা ব্যবসা-বাণিজ্য-কত জরুরি কাজে মানুষ ঝুঁকি নিয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, শ্রমঘণ্টা, বাণিজ্য, নাগরিক নিরাপত্তা-সব সূচকে। নিমেষেই এই পোষ না মানা পদ্মাকে বশ করে ফেলেছে স্বপ্নের এই সেতু। এক সময় মানুষ তা সহজে বিশ্বাস করতেই পারেনি। ২০১১ সালের কথা। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের লঞ্চে বসেছিলাম। যাত্রীরা খোশগল্পে মেতে উঠেছিল। ‘বার্ড ফ্লু’র পর এলো পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ। গরিষ্ঠ মতোই ছিল এটা অসম্ভব। স্রেফ রাজনৈতিক গালগল্প। আজ সে গল্পটাই ইতিহাস হতে চলেছে।

এক সময় বাংলা ছিল ঐশ্বর্যের লীলাভূমি। গোটা বিশ্বের নজর ছিল বাংলায়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির কাছে বাঙালি কখনই মাথানত করেনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী-সচিবকে পর্যন্ত চকিতে অব্যাহতি দেয়া হয়। পুরো দস্তুর অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে অভিযোগ ভিত্তিহীন। প্রবল জাত্যাভিমান জেগে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন বাঙালি অস্মিতার প্রতীক। ঠিক করে ফেলেন নিজের টাকায় এ সেতু করবেন। শুধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নয়, বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছেÑসবার আবেগ নাড়িয়ে দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। গড়ে ওঠে অভূতপূর্ব আদর্শিক ঐক্য। ২০১৭ সালে কানাডার আদালত অভিযোগকে গুজব বলে প্রত্যাখ্যান করলে বাঙালি দুনিয়া সেদিন আরও একটি বিজয় উদ্যাপন করেছিল।

তাই ২৫ জুন শুধু সেতু উদ্বোধনের দিন নয়, বাঙালির রাজনৈতিক চেতনা পুনর্নির্মাণের দিন। সেতু শুধু আর্থিক সমৃদ্ধি বা যোগাযোগ রক্ষাকারী উপলক্ষ নয়, এর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বার্তা আরও গভীর। দেশ এখন আর ‘বাস্কেট কেইস’ নয়; সম্ভাবনার উদীয়মান বিশ্বে নিশ্চিতভাবেই একটি সম্মানকর পরিচয়। সক্ষমতা, সাহস ও আত্ম মর্যাদার প্রতীক। প্রকৃতি বা মানুষসৃষ্ট যে দুর্যোগই আসুক না কেনÑতাকে রুখে দেয়ার সক্ষমতা এ জাতির মগজে, মজ্জায়। বাঙালির সব সামর্থ্য, সব অহংকারের প্রেরণা হয়ে এ সেতু যেন অনাগত প্রজন্মকে ন্যায়ের সংগ্রামে সব সময় এগিয়ে রাখেÑএমন প্রত্যাশাই থাকবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]

শনিবার, ২৫ জুন ২০২২ , ১১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

একতা, ন্যায় ও শক্তির প্রেরণা

অমিত রায় চৌধুরী

পদ্মা জয়ের উপচেপড়া উচ্ছ্বাসে ভেসে আসছে বিজয়ের বেশ কিছু দুর্লভ স্মৃতিকতা। মহান বিজয় দিবস, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কিংবা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান বা ভারতকে হারানোর উন্মাদনা! কীভাবে বাঙালির আবেগ বাঁধ ভেঙেছিল, কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় গোটা দেশ হয়ে উঠেছিল একজাতি, একপ্রাণ-তা ভাবলে আজও শিহরিত হই। পদ্মা সেতু নিয়ে আজ সেই অভিমান, সেই অহঙ্কার-বাঙালি মননের গড়ন যাদের চেনা, তাদের মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।

কিন্তু এখানে কি শুধুই দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদী আবেগ? নিশ্চয়ই না, এখানে জড়িয়ে আছে রুটি-রুজির প্রশ্ন। চাকরি, কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা-সবখানেই স্বপ্ন দেখে তারুণ্য। শিল্প, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য-চারপাশেই সমৃদ্ধির হাতছানি। আবাসন, বিনোদন, জীবনমান এমনকি জাতীয় প্রবৃদ্ধি কোথায় নেই বিস্ময় সেতুর বরাভয়? দক্ষিণ-পশ্চিমের বিবর্ণ মানচিত্রটাকেই ঝাঁ-চকচকে করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি।

সেতু উদ্বোধনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। পদ্মাপাড়ের যে কোন প্রান্তে দাঁড়ালেই নিসর্গের অপার্থিব সৌন্দর্য টেনে নিয়ে যায় রূপকথার জগতে। কূল নেই, কিনারা নেই, এমন বিশাল জলরাশি দেখে মনে হয় নিঃসীম সমুদ্র। নিঝুম নৈঃশব্দের বুক

চিরে যেন অসীম দিগন্তে মিলিয়ে গেছে এই সেতু। হয়তো অজ¯্র সম্ভাবনা নিয়ে অনাগত আগামীর পথে তার অন্তহীন যাত্রা। অনাবৃত প্রকৃতি আর উৎকৃষ্ট প্রযুক্তির অপূর্ব মেলবন্ধন আকৃষ্ট করছে অবিশ্রান্ত জনস্রোত। পদ্মার দুই কূল আজ সেজে উঠেছে মোহনীয় রূপে। দিনের আলোয় ভাসমান গাঙচিল আর বিস্তৃত ধানক্ষেত। সন্ধ্যায় বাহারি আলোর চোখধাঁধানো রোশনাই। খরস্র্রোতা নদী হিসেবে পর্যটকের কাছে পদ্মার জগৎ জোড়া খ্যাতি। আকর্ষণ, ভয় আর মুগ্ধতার এক দুর্লভ মোহনা। জলস্রোতের ক্ষিপ্রতায় বিশ্বে আমাজনের পরই পদ্মার স্থান। কত সহজে এই অজেয় পদ্মাকে জয় করেছে এই সেতু-তা এক অপার বিস্ময়। নির্মাণ শৈলীর পরতে পরতে শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্ক।

দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ সেতু। লম্বা ছয় কিমির বেশি। চওড়া ৭২ ফুট। জলের উচ্চতা থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। সংযোগ সড়ক আরও ১৪ কিমি। দ্বিতল সেতুর ওপরে ৪ লেইনে চলবে যান। নিচে ছুটবে ট্রেন। স্প্যান ৪১টি। পিলার ৪২টি। পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট, ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। অত্যাধুনিক স্ক্রিন গ্রাউন্ডিং ব্যবহার করা হয়েছে; যাতে পাইলিংয়ের সময় নদী গভীরে শক্ত মাটি খুঁজে নিতে অসুবিধা না হয়। ব্যবহৃত এক একটি পাথরের ওজন এক টন। স্টিল ও কংক্রিটের তৈরি এই সেতুতে ফ্রিকশান পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহৃত; যা রিক্টার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। ২১টি জেলাকে যুক্ত করছে এই সেতু। ২৪ সাল নাগাদ প্রতিদিন গাড়ি চলবে ২৪ হাজার। রেল চালু হলে এক দিকে ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে, অন্যদিকে গভীর সমুদ্র বন্দরের সংযুক্তি। পুরো দেশ সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর নাগালে। বিনিয়োগ হবে অকল্পনীয়। জিডিপি বাড়বে ২.২৩ (রেল সহ)। টাকার সঞ্চালন হবে দ্রুত হারে। অর্থ-বিজ্ঞানিদের মত-খরচ উঠে আসবে ৩০ বছরে। দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের বাস দক্ষিণ-পশ্চিমের এই অঞ্চলে। অফুরন্ত সম্ভাবনা আজ দোরে দোরে।

খেয়াল করেছি-গৃহস্থ নারী, ছাত্র-শিক্ষক, প্রান্তিক কৃষক, চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ধনী ব্যবসায়ী-সবাই কেমন যেন বদলে যাওয়া দিনেরই প্রত্যাশায়। হাই-ওয়ের মাইল ফলকে লেখা-দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি জনপদ ফকিরহাট থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৪০ কিমি। কিন্তু এই তো সেদিনও-ঢাকা যাওয়ার নাম শুনলেই যাত্রী আঁতকে উঠেছেন। দেড় দশক আগেও কয়েকটি নদী পার হতে হতো। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময়। আরিচা হয়ে গেলেও প্রায় তাই। রাস্তা ভালো হওয়ায় পদ্মা বাদে নদী পারের ঝামেলা ছিল না। রাজধানি যাত্রাও অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মা বলে কথা! কখন যে সে কোন রূপ ধারণ করেÑতা আন্দাজ করা কঠিন। ঝড়-বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।

উত্তাল এই নদী কত লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট এমনকি ফেরি পর্যন্ত হেলাফেলায় ডুবিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্যোগের সংকেত পেলে সারা রাত অপেক্ষা করেছে সারি সারি পরিবহন। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর এ ধৈর্যের পরীক্ষা তো প্রাত্যহিক অনুশীলন। ‘যাত্রাপথে সীমাহীন দুর্ভোগ’-শব্দবন্ধটির মর্মার্থ তাকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব, যার পদ্মাপারের অভিজ্ঞতাটা নেই। শীতকালে কুয়াশার আশঙ্কা তো যাত্রীকে তটস্থ করে রাখতো। আর মাঝ নদীতে যারা ঝড়ের সাক্ষী, শুধু তারাই হয়তো মরণকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। আর বুঝেছে-জীবনকে তারা কত ভালোবাসে। উৎসব বা কোন উপলক্ষ তৈরি হলে পদ্মাপাড় আলাদা চেহারা নিত। রীতিমতো জনবিস্ফোরণ। করোনাকালে মনে আছে-একবার ঈদের ছুটিতে বাংলার নারী-শিশু-যুবা যেভাবে শুধু বেয়ে ফেরিতে সওযার হয়েছিল, তাকে বড়সড় কোন স্পোর্টস ইভেন্ট মনে করলে ভুল হতো না। কত হয়রানি, কত কষ্ট, কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে! পদ্মাপাড়ের প্রায় ৩ কোটি মানুষ তার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। চাকরি, লেখাপড়া, চিকিৎসা বা ব্যবসা-বাণিজ্য-কত জরুরি কাজে মানুষ ঝুঁকি নিয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, শ্রমঘণ্টা, বাণিজ্য, নাগরিক নিরাপত্তা-সব সূচকে। নিমেষেই এই পোষ না মানা পদ্মাকে বশ করে ফেলেছে স্বপ্নের এই সেতু। এক সময় মানুষ তা সহজে বিশ্বাস করতেই পারেনি। ২০১১ সালের কথা। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের লঞ্চে বসেছিলাম। যাত্রীরা খোশগল্পে মেতে উঠেছিল। ‘বার্ড ফ্লু’র পর এলো পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ। গরিষ্ঠ মতোই ছিল এটা অসম্ভব। স্রেফ রাজনৈতিক গালগল্প। আজ সে গল্পটাই ইতিহাস হতে চলেছে।

এক সময় বাংলা ছিল ঐশ্বর্যের লীলাভূমি। গোটা বিশ্বের নজর ছিল বাংলায়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির কাছে বাঙালি কখনই মাথানত করেনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী-সচিবকে পর্যন্ত চকিতে অব্যাহতি দেয়া হয়। পুরো দস্তুর অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে অভিযোগ ভিত্তিহীন। প্রবল জাত্যাভিমান জেগে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন বাঙালি অস্মিতার প্রতীক। ঠিক করে ফেলেন নিজের টাকায় এ সেতু করবেন। শুধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া নয়, বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছেÑসবার আবেগ নাড়িয়ে দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। গড়ে ওঠে অভূতপূর্ব আদর্শিক ঐক্য। ২০১৭ সালে কানাডার আদালত অভিযোগকে গুজব বলে প্রত্যাখ্যান করলে বাঙালি দুনিয়া সেদিন আরও একটি বিজয় উদ্যাপন করেছিল।

তাই ২৫ জুন শুধু সেতু উদ্বোধনের দিন নয়, বাঙালির রাজনৈতিক চেতনা পুনর্নির্মাণের দিন। সেতু শুধু আর্থিক সমৃদ্ধি বা যোগাযোগ রক্ষাকারী উপলক্ষ নয়, এর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বার্তা আরও গভীর। দেশ এখন আর ‘বাস্কেট কেইস’ নয়; সম্ভাবনার উদীয়মান বিশ্বে নিশ্চিতভাবেই একটি সম্মানকর পরিচয়। সক্ষমতা, সাহস ও আত্ম মর্যাদার প্রতীক। প্রকৃতি বা মানুষসৃষ্ট যে দুর্যোগই আসুক না কেনÑতাকে রুখে দেয়ার সক্ষমতা এ জাতির মগজে, মজ্জায়। বাঙালির সব সামর্থ্য, সব অহংকারের প্রেরণা হয়ে এ সেতু যেন অনাগত প্রজন্মকে ন্যায়ের সংগ্রামে সব সময় এগিয়ে রাখেÑএমন প্রত্যাশাই থাকবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]