সিলেট : বানভাসি ক্ষুধার্তদের দীর্ঘ লাইন

‘আট দিন ধরে চিড়া-মুড়ি খেয়ে আছি। বন্যার পানিতে সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলাম নৌকার মধ্যে। কিছুটা পানি শুকালে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। ঘরে খাবার নেই। এখন সেনাক্যাম্পে আসলাম খাবারের জন্য।’

বলছিলেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের খায়েরগাঁও গ্রামের দেলওয়ার মিয়া। গতকাল দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু হাইটেকপার্কে বানভাসিদের সহায়তার জন্য স্থাপিত সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প-৩৪ বীর-এ কথা হয় তার সঙ্গে। দেখা যায় তার মতো প্রায় হাজারো ক্ষুধার্ত বানভাসি দীর্ঘ লাইন করে বসে আছেন খাবারের জন্য। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তাদের মধ্যে খাবারের প্যাকেট বিতরণ করছিলেন সেনাসদস্যরা।

ক্যাম্পটির কমান্ডার মেজর মুক্তাদির জানান, এই ক্যাম্প থেকে ত্রাণ গ্রহণ ও বিতরণ, মেডিকেল সেবা, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। একপর্যায়ে বানভাসির দীর্ঘ লাইনে গিয়ে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তাদেরই একজন খায়েরগাঁও গ্রামের দেলওয়ার মিয়া। পেশায় গাছ ছাঁটাইকর্মী। তিনি বলেন, বন্যার শুরুতে যখন বাড়িঘর ডুবে গেল তখন বুদ্ধি খাটিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে পাশের একটি নৌকায় আশ্রয় নেই। এখন পানি কমলেও খাবার নেই, কাজ নেই। তবে এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই খাবার নিচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে প্রবেশের পর দেখা যায় সেখানে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণের স্তূপ। বিশুদ্ধ পানি, চাল, ডাল, তেল, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট, বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী রয়েছে সেনাবাহিনীর এই অস্থায়ী ক্যাম্পে। এছাড়া এর দ্বিতীয় তলায় এখনও আশ্রয়ে রয়েছে বেশ কিছু পরিবার। এমনকি তাদের অনেকে পালিত গরু ও মুরগি নিয়েও অবস্থান নিয়েছেন। তাদের অন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণের বাইরেও তিনবেলা বিভিন্ন ধরনের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এই অস্থায়ী ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর বাইরেও অনেকে ত্রাণ সরবরাহ করছেন। তা প্রতিদিনের সাঁটানো তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

এই ক্যাম্পটি গত ১৭ জুন থেকে চালু করা হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের এই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয় এবং এখানে বানভাসির আর্তনাদও বেশি। বর্তমানে যিনি এই ক্যাম্পের কমান্ডার তাকে ২১ জুন থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে তিনি ডুবে যাওয়া সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। ঘুরেছেন নগরের অন্য এলাকায়ও। উপশহর বিদ্যুৎকেন্দ্রও রক্ষা হয়েছে তার নেতৃত্বে।

কথা হলে কমান্ডার মেজর মুক্তাদির বলেন, এই ক্যাম্প থেকে পরিবার, গ্রাম ও ওয়ার্ডের ডাটাবেজ সংগ্রহ করে ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। সেনা সদস্যরা প্রতিদিন বানভাসি প্রতিটি পরিবারকে গিয়ে ত্রাণ সরবরাহ করছেন। এ পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল, ইসাখলস ও পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে ১৩ হাজার ৭০০ পরিবার ও পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন, রুস্তুমপুর ইউনিয়ন এবং তাওয়াকুল ইউনিয়নে ৮ হাজার ৬৫০ পরিবারকে বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়। এর বাইরেও যারা তাদের ক্যাম্পে আসছেন তাদের মধ্যে খাবার ও ত্রাণসামগ্রী এবং মেডিকেল সেবা দেয়া হচ্ছে। গতকালও ১৮০ জনকে মেডিকেল সেবার ও ওষুধ দেয়া হয়।

ক্যাম্পে ত্রাণের জন্য আসা দক্ষিণ রণিখাইল ইউনিয়নের গৌরিনগর গ্রামের আকবর আলী বলেন, তার বাড়িতে এখনও হাঁটু পানি। কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। মাঝখানে একজন শুধু চিড়া দিয়ে এসেছিলেন। আট দিন পর সেনাক্যাম্পে এসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেছেন। একই গ্রামের সাইফুল আলমের স্ত্রী আসমা আক্তার বলেন, বন্যাকবলিত হয়ে তিনি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেনাক্যাম্পে এসে চিকিৎসাসেবা নিয়ে ওষুধ গ্রহণ করেছেন। পরে সবার সঙ্গে তিনি ত্রাণের প্যাকেটও গ্রহণ করেন।

অস্থায়ী এই ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর মুক্তাদির বলেন, ত্রাণের কোন অভাব নেই। প্রতিদিন বাড়ি-বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এবং তাদের ক্যাম্পে যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ মজুদ রয়েছে। এই ক্যাম্পে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ২২ হাজার ৮২৭ প্যাকেট ত্রাণ গ্রহণের পর ১৭ হাজার ৮২৭ প্যাকেট ও বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তির সরবরাহ করা ৮ হাজার ৮৮৯ প্যাকেটের মধ্যে ৭ হাজার ৭৬৬ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

রবিবার, ২৬ জুন ২০২২ , ১২ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩

সিলেট : বানভাসি ক্ষুধার্তদের দীর্ঘ লাইন

আকাশ চৌধুরী, (কোম্পানীগঞ্জ) সিলেট ঘুরে এসে

image

বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের প্রবেশদ্বারে বানভাসি মানুষ ত্রাণের অপেক্ষায় -সংবাদ

‘আট দিন ধরে চিড়া-মুড়ি খেয়ে আছি। বন্যার পানিতে সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলাম নৌকার মধ্যে। কিছুটা পানি শুকালে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। ঘরে খাবার নেই। এখন সেনাক্যাম্পে আসলাম খাবারের জন্য।’

বলছিলেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের খায়েরগাঁও গ্রামের দেলওয়ার মিয়া। গতকাল দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু হাইটেকপার্কে বানভাসিদের সহায়তার জন্য স্থাপিত সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প-৩৪ বীর-এ কথা হয় তার সঙ্গে। দেখা যায় তার মতো প্রায় হাজারো ক্ষুধার্ত বানভাসি দীর্ঘ লাইন করে বসে আছেন খাবারের জন্য। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তাদের মধ্যে খাবারের প্যাকেট বিতরণ করছিলেন সেনাসদস্যরা।

ক্যাম্পটির কমান্ডার মেজর মুক্তাদির জানান, এই ক্যাম্প থেকে ত্রাণ গ্রহণ ও বিতরণ, মেডিকেল সেবা, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। একপর্যায়ে বানভাসির দীর্ঘ লাইনে গিয়ে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তাদেরই একজন খায়েরগাঁও গ্রামের দেলওয়ার মিয়া। পেশায় গাছ ছাঁটাইকর্মী। তিনি বলেন, বন্যার শুরুতে যখন বাড়িঘর ডুবে গেল তখন বুদ্ধি খাটিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে পাশের একটি নৌকায় আশ্রয় নেই। এখন পানি কমলেও খাবার নেই, কাজ নেই। তবে এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই খাবার নিচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে প্রবেশের পর দেখা যায় সেখানে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণের স্তূপ। বিশুদ্ধ পানি, চাল, ডাল, তেল, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট, বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী রয়েছে সেনাবাহিনীর এই অস্থায়ী ক্যাম্পে। এছাড়া এর দ্বিতীয় তলায় এখনও আশ্রয়ে রয়েছে বেশ কিছু পরিবার। এমনকি তাদের অনেকে পালিত গরু ও মুরগি নিয়েও অবস্থান নিয়েছেন। তাদের অন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণের বাইরেও তিনবেলা বিভিন্ন ধরনের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এই অস্থায়ী ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর বাইরেও অনেকে ত্রাণ সরবরাহ করছেন। তা প্রতিদিনের সাঁটানো তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।

এই ক্যাম্পটি গত ১৭ জুন থেকে চালু করা হয়। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের এই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয় এবং এখানে বানভাসির আর্তনাদও বেশি। বর্তমানে যিনি এই ক্যাম্পের কমান্ডার তাকে ২১ জুন থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে তিনি ডুবে যাওয়া সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। ঘুরেছেন নগরের অন্য এলাকায়ও। উপশহর বিদ্যুৎকেন্দ্রও রক্ষা হয়েছে তার নেতৃত্বে।

কথা হলে কমান্ডার মেজর মুক্তাদির বলেন, এই ক্যাম্প থেকে পরিবার, গ্রাম ও ওয়ার্ডের ডাটাবেজ সংগ্রহ করে ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। সেনা সদস্যরা প্রতিদিন বানভাসি প্রতিটি পরিবারকে গিয়ে ত্রাণ সরবরাহ করছেন। এ পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল, ইসাখলস ও পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে ১৩ হাজার ৭০০ পরিবার ও পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন, রুস্তুমপুর ইউনিয়ন এবং তাওয়াকুল ইউনিয়নে ৮ হাজার ৬৫০ পরিবারকে বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়। এর বাইরেও যারা তাদের ক্যাম্পে আসছেন তাদের মধ্যে খাবার ও ত্রাণসামগ্রী এবং মেডিকেল সেবা দেয়া হচ্ছে। গতকালও ১৮০ জনকে মেডিকেল সেবার ও ওষুধ দেয়া হয়।

ক্যাম্পে ত্রাণের জন্য আসা দক্ষিণ রণিখাইল ইউনিয়নের গৌরিনগর গ্রামের আকবর আলী বলেন, তার বাড়িতে এখনও হাঁটু পানি। কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। মাঝখানে একজন শুধু চিড়া দিয়ে এসেছিলেন। আট দিন পর সেনাক্যাম্পে এসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেছেন। একই গ্রামের সাইফুল আলমের স্ত্রী আসমা আক্তার বলেন, বন্যাকবলিত হয়ে তিনি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেনাক্যাম্পে এসে চিকিৎসাসেবা নিয়ে ওষুধ গ্রহণ করেছেন। পরে সবার সঙ্গে তিনি ত্রাণের প্যাকেটও গ্রহণ করেন।

অস্থায়ী এই ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর মুক্তাদির বলেন, ত্রাণের কোন অভাব নেই। প্রতিদিন বাড়ি-বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এবং তাদের ক্যাম্পে যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ মজুদ রয়েছে। এই ক্যাম্পে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ২২ হাজার ৮২৭ প্যাকেট ত্রাণ গ্রহণের পর ১৭ হাজার ৮২৭ প্যাকেট ও বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তির সরবরাহ করা ৮ হাজার ৮৮৯ প্যাকেটের মধ্যে ৭ হাজার ৭৬৬ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।