মাদকাসক্তি ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি

অরূপরতন চৌধুরী

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে ২৬ জুন তারিখে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হয়, দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো মাদকাসক্তির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং অবৈধ পাচার বন্ধ করা।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : ‘‘স্বাস্থ্য এবং মানবিক সংকটে ওষুধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা’’

জাতিসংঘ বলছে, অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিকল্প হিসেবে আরও মারাত্মক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে অনেক দেশে হেরোইন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সে সব দেশে এখন এমন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং শরীরের ওপর হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করছে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করছে। ফলে এইচআইভি বা এইডস অথবা হ্যাপাটাইটিস বি কিংবা সি ইত্যাদি রক্তবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে হেরোইন ও কোকেনের সংকট তৈরি হচ্ছে।

জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ (ইউএনওডিসি) বলছে, বিগত করোনাকালীন সময়ে দেশে দেশে লকডাউন চলার কারণে মূলত মাদকদ্রব্যের এই সংকট। এসব এলাকায় বিমান ও সড়কপথে বেশির ভাগ মাদক চালান করা হয়। বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে যে, ইয়াবা গ্রহনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য নেই প্রয়োজনীয় হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র। এদের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোটে ৩৫১টি। এর মধ্যে শতাধিক ঢাকায়। অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোর মোট শয্যাসংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮। এখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদ্রোগসহ অন্য কোন রোগে আক্রান্ত কিনা, তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ইসিজিসহ নানা পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই সেখানে।

বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত মায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে ছয়টি দেশের বাজার সামনে রেখে আইস উৎপাদন করছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

পরিসংখ্যানে জানা যায় দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। অপরিকল্পিত গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ নিয়ে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বাড়লেও, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে তা বাড়েনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে এখনো অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে। সূত্র থেকে জানা যায় আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের ৮৪ ভাগ পুরুষ ১৬ ভাগ নারী এর মধ্যে ৮০ ভাগ তরুণ, ৬০ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত, ৯৮% ভাগ ধূমপায়ী, ৫৭% যৌন অপরাধী এবং ৭% নেশা গ্রহণকারী এইচআইভি আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় নেশা ইয়াবা এবং এই ইয়াবা আসক্তদের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী। ইয়াবা এমনই একটি ধংসাত্মক মাদক যেটা গ্রহণ করলে সাময়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও চরম শারীরিক ও মানসিক অবসাদ হয় এবং সেটা থেকে চরম হতাশা, নৈরাজ্য ও বিষাদে পতিত হয় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে পারে এই ইয়াবা গ্রহণকারী।

সংবাদ মাধ্যমে তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সব কিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব কিন্তু সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে উঠে হিংস্র দানব, নরপশু। সড়ক দুর্ঘটনার ৩৩ ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী চালকের মাদক সেবন।

মেয়েদের মধ্যেও মাদকের নেশা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৫ জন নারী। তাদের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। নারী মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৩ শতাংশ ইয়াবাসেবী। কিছু ভ্রান্ত ধারণা থেকে তারা মাদক নেয় যেমন সিøøম হওয়া যায়, রাত জেগে পড়া যায়, যৌনশক্তি বৃদ্ধি হয়।

কিন্তু সবই ভুল, আসলে তার উল্টোটি হয়। মাদক ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি হ্রাস করে। শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৪৯% ভাগ মানুষ বয়সে তরুণ অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১ কোটি ৫৬ লাখ। মাদক ব্যবসায়ীরা এই কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের ভোক্তা হিসেবে পেতে চায়।

একটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিন দিনই বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে তা গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে ১৫ বছরের বেশি মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির তথ্যমতে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনে একজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এই সত্য ধরে নিলে ৭৫ লাখে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু চারটি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র এবং ২০৯টি বেসরকারী নিরাময় কেন্দ্র মিলে চিকিৎসার সুবিধা আছে পাঁচ হাজারের মতো। বাকি মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা থাকছে চিকিৎসাসেবার বাইরে।

মাদকসক্তি একটি রোগ। তাই মাদকাসক্তদেরকে শাষণ বা ঘৃণা অবহেলা না করে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। সে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসবে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না, বরং তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান, তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। মাদকাসক্তরা সমাজের এই পরিস্থিতির স্বীকার। পাপকে ঘৃনা করুন পাপীকে নয়।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা; সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স]

রবিবার, ২৬ জুন ২০২২ , ১২ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩

মাদকাসক্তি ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি

অরূপরতন চৌধুরী

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে ২৬ জুন তারিখে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হয়, দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো মাদকাসক্তির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং অবৈধ পাচার বন্ধ করা।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : ‘‘স্বাস্থ্য এবং মানবিক সংকটে ওষুধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা’’

জাতিসংঘ বলছে, অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিকল্প হিসেবে আরও মারাত্মক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে অনেক দেশে হেরোইন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সে সব দেশে এখন এমন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং শরীরের ওপর হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করছে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করছে। ফলে এইচআইভি বা এইডস অথবা হ্যাপাটাইটিস বি কিংবা সি ইত্যাদি রক্তবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে হেরোইন ও কোকেনের সংকট তৈরি হচ্ছে।

জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ (ইউএনওডিসি) বলছে, বিগত করোনাকালীন সময়ে দেশে দেশে লকডাউন চলার কারণে মূলত মাদকদ্রব্যের এই সংকট। এসব এলাকায় বিমান ও সড়কপথে বেশির ভাগ মাদক চালান করা হয়। বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে যে, ইয়াবা গ্রহনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য নেই প্রয়োজনীয় হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র। এদের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোটে ৩৫১টি। এর মধ্যে শতাধিক ঢাকায়। অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোর মোট শয্যাসংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮। এখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদ্রোগসহ অন্য কোন রোগে আক্রান্ত কিনা, তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ইসিজিসহ নানা পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই সেখানে।

বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত মায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে ছয়টি দেশের বাজার সামনে রেখে আইস উৎপাদন করছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

পরিসংখ্যানে জানা যায় দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। অপরিকল্পিত গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ নিয়ে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বাড়লেও, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে তা বাড়েনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে এখনো অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে। সূত্র থেকে জানা যায় আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের ৮৪ ভাগ পুরুষ ১৬ ভাগ নারী এর মধ্যে ৮০ ভাগ তরুণ, ৬০ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত, ৯৮% ভাগ ধূমপায়ী, ৫৭% যৌন অপরাধী এবং ৭% নেশা গ্রহণকারী এইচআইভি আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় নেশা ইয়াবা এবং এই ইয়াবা আসক্তদের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী। ইয়াবা এমনই একটি ধংসাত্মক মাদক যেটা গ্রহণ করলে সাময়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও চরম শারীরিক ও মানসিক অবসাদ হয় এবং সেটা থেকে চরম হতাশা, নৈরাজ্য ও বিষাদে পতিত হয় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে পারে এই ইয়াবা গ্রহণকারী।

সংবাদ মাধ্যমে তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সব কিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব কিন্তু সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে উঠে হিংস্র দানব, নরপশু। সড়ক দুর্ঘটনার ৩৩ ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী চালকের মাদক সেবন।

মেয়েদের মধ্যেও মাদকের নেশা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৫ জন নারী। তাদের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। নারী মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৩ শতাংশ ইয়াবাসেবী। কিছু ভ্রান্ত ধারণা থেকে তারা মাদক নেয় যেমন সিøøম হওয়া যায়, রাত জেগে পড়া যায়, যৌনশক্তি বৃদ্ধি হয়।

কিন্তু সবই ভুল, আসলে তার উল্টোটি হয়। মাদক ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি হ্রাস করে। শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৪৯% ভাগ মানুষ বয়সে তরুণ অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১ কোটি ৫৬ লাখ। মাদক ব্যবসায়ীরা এই কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের ভোক্তা হিসেবে পেতে চায়।

একটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিন দিনই বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে তা গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে ১৫ বছরের বেশি মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির তথ্যমতে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনে একজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এই সত্য ধরে নিলে ৭৫ লাখে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু চারটি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র এবং ২০৯টি বেসরকারী নিরাময় কেন্দ্র মিলে চিকিৎসার সুবিধা আছে পাঁচ হাজারের মতো। বাকি মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা থাকছে চিকিৎসাসেবার বাইরে।

মাদকসক্তি একটি রোগ। তাই মাদকাসক্তদেরকে শাষণ বা ঘৃণা অবহেলা না করে তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। সে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসবে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না, বরং তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান, তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। মাদকাসক্তরা সমাজের এই পরিস্থিতির স্বীকার। পাপকে ঘৃনা করুন পাপীকে নয়।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা; সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স]