সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সোয়া ৪ লাখ পরিবার

পানি কমছে ধীরে, নগরে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে সোয়া ৪ লাখ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসল, স্বাস্থ্য খাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের। সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম জানান, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

তিনি জানান, ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে।

বন্যাকবলিত এলাকার জন্য এখন অবধি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ এক কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানা গেছে।

প্রাণিসম্পদের ক্ষতি

সিলেট জেলায় প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাই বন্যায় তলিয়ে যায়। বন্যার পানিতে হাজার হাজার হাঁস-মুরগি এবং বেশ কয়েকটি গরু-ছাগল মারা পড়েছে। হাজার হাজার টন খড় ভেসে গেছে, না হয় পচে বিনষ্ট হয়েছে। সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেটে প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৭ হাজার ৩৫৪ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। এখনও সিংহভাগ চারণভূমি তলিয়ে আছে পানিতে।

বন্যায় ৭২১টি গবাদিপশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট জেলায়। এক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এদিকে ৩৬৮টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

জেলায় ২ হাজার ৯১ মেট্রিক টন খড় বিনষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে, যেখানে ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন ঘাস পচে বিনষ্ট হয়ে গেছে, এখানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা।

এদিকে বন্যার কারণে ১১টি গরু, ৬টি মহিষ, ২১টি ছাগল ও ১৬টি ভেড়া অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। এছাড়া ৪ হাজার ৯৬৩টি মুরগি ও এক হাজার ২৮৪টি হাঁস মারা গেছে এবারের বন্যার কবলে পড়ে। এ বাবদ ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় অসুস্থ হয়ে পড়া ৯ হাজার ১৫৪টি গবাদিপশু এবং ১২ হাজারের বেশি হাঁস-মুরগিকে টিকা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ১০ সহস্রাধিক গবাদিপশু এবং ২৭ সহস্রাধিক হাঁস-মুরগিকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিস্তীর্ণ গোচারণভূমি এখনও পানিতে নিমজ্জিত থাকায় গবাদিপশুর মালিকেরা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। পর্যাপ্ত গো-খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কচুরিপানা খাইয়ে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।

সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রুস্তম আলী বলেন, ‘পর্যাপ্ত ঘাস মিলছে না। কারণ বন্যাকবলিত এলাকায় বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি আর গবাদিপশুর আবাসস্থল তলিয়ে গেছে। যেসব ঘাস চাষ করা হয়েছিল, সেগুলোও রক্ষা করা যায়নি। বিপুল পরিমাণ খড় বিনষ্ট হয়ে গেছে। সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গবাদিপশুর মড়ক ও মৃত্যু প্রতিরোধে টিকাদান ও চিকিৎসার বিষয়টি আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। এ কারণেই মড়ক ও মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।’

স্বাস্থ্য খাতের ক্ষতি

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের নিচতলা প্রায় তিনফুট পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেটর জলমগ্ন হওয়ায় হাসপাতালের বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। নিচতলায় পানি উঠে যাওয়ায় রোগীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। দু’দিনে পানি নামার পর দেখা যায় হাসপাতালটির এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রেডিও থেরাপি মেশিনে পানি ঢুকে গেছে। ফলে এখন বন্ধ রয়েছে এসব সেবা কার্যক্রম।

এবারের বন্যায় শুধু ওসমানী হাসপাতালেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভাগের অনেক সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে বিভাগজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হচ্ছে।

বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উল্লেখ করে সিলেট বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যাকবলিত হয়েছে। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মধ্যে ৩১টিতে পানি ঢুকেছে। সুনামগঞ্জে ২০ শয্যার দুটি হাসপাতালে পানি প্রবেশ করে। এছাড়া ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়।

সিলেট জেলার ৩টি উপজেলা (জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ) বাদ দিয়ে বাকি ১০টি উপজেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন ছিল। কোম্পানীগঞ্জ এবং গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ১০ ফুট পরিমাণ পানি ছিল। স্রোতের কারণে অনেক আসবাবপত্র ভেসে গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের।

সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সব উপদ্রুত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, ইপিআই আইএলআর ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্সরে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্রপাতি কতটা সচল কিংবা অচল তা পানি নেমে না যাওয়ায় যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরও সময় লাগবে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালটির নিচতলা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাসপাতালের নিচতলায় থাকা এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও রেডিওথেরাপি মেশিন জলমগ্ন ছিল। রেডিওথেরাপি মেশিনটি চালুর চেষ্টা চলছে। তবে এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিনের ক্ষতি হয়েছে বেশি। এগুলো ঠিক হবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ রোগীরা সিটিস্ক্যান, এমআরআই, রেডিও থেরাপি সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালের অ্যম্বুল্যান্স, পরিচালকের গাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে। পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

পানি কমছে ধীরগতিতে

বন্যার ১১ দিন হলেও এখনো অনেক স্থানে পানি কমছে খুবই ধীরগতিতে। সিলেট নগরীর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি কমলেও অনেক এলাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমার পানি এখনও বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুশিয়ারা নদীর পানি কার্যত অপরিবর্তিত থাকায় সিলেটে প্রলম্বিত বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ কমছে না।

দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পানি কয়েক দিন ধরে থমকে আছে। বাড়ছেও না, নামছেও না, ৭-৮ দিন ধরে ঘরে পানি। এভাবে কত দিন থাকা যায়?’

ওসমানীনগরের ওমরপুর ইউনিয়নের হাসতনপুর গ্রামের আনফর মিয়া বলেন, এখনও ঘরে হাঁটুপানি। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তার পরিবার। এখন যেভাবে পানি কমছে, তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে। নতুন করে বৃষ্টিপাতও শুরু হয়েছে। তাই পানি বাড়ারও ভয় আছে।

তবে সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সিলেটে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। পানি ধীরগতিতে নামছে। আর বৃষ্টি না হলে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে পানি আরও কমে যাবে।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপশহর, তালতলা সড়কসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোতে পানি রয়ে গেছে। তবে কয়েক দিন ধরে ওই সড়কগুলোতে নৌকা চলাচল করলেও এখন সাধারণ যানবাহন চলাচল করছে। নগরীর যতরপুর, মিরাবাজার, উপশহরের একাংশ, সোবহানীঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, তালতলা, জামতলা, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, কুয়ারপার, লালদিঘীরপার, ছড়ারপার, মাছিমপুর এলাকার পাড়া-মহল্লার পানি ময়লা-আবর্জনায় কালো রং ধারণ করেছে। এসব এলাকায় বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

সরকারি হিসাবে নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৭ হাজার ৫০৭ জন এখনও রয়েছেন। পুরো জেলায় সব মিলে ৬০৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫৯ হাজার ৬৯৯ জন বন্যার্ত মানুষ রয়েছেন। এছাড়া ৪ হাজার ৩৮৮টি গবাদিপশু রয়েছে এখানে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফেরা মানুষের জীবনে নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

জৈন্তাপুর উপজেলার শুকইনপুর গ্রামের বাসিন্দা খলিল আহমদ বলেন, তার বাড়িঘর, আসবাব, এক বস্তা চাল, ধান, শিশুর পড়াশোনার জন্য বই-খাতা সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ ১১ সদস্যের পরিবার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

একই উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের আব্বাস উদ্দিন বলেন, ঘরের সব নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বিপদে আছি গরু-ছাগল নিয়ে। বাড়ির পাশে রাস্তায় এখনও হাঁটুসমান পানি।

ত্রাণ বিতরণে হচ্ছে সমন্বয় কমিটি

সিলেটে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের অভাবে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বেসরকারিভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী এলেও তা বিতরণে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ জানান, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রত্যেক উপজেলায় আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত শনিবার কমিটি করার জন্য সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। সংশ্নিষ্ট জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটির কাজ তদারকি করবে।

সোমবার, ২৭ জুন ২০২২ , ১৩ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সোয়া ৪ লাখ পরিবার

পানি কমছে ধীরে, নগরে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি, সিলেট

image

সিলেট : বানভাসিদের ত্রাণের হাহাকার কমেনি। গতকাল কোম্পানীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে স্থাপিত সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ফিরছে বন্যার্তরা -সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে সোয়া ৪ লাখ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসল, স্বাস্থ্য খাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের। সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম জানান, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

তিনি জানান, ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে।

বন্যাকবলিত এলাকার জন্য এখন অবধি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ এক কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানা গেছে।

প্রাণিসম্পদের ক্ষতি

সিলেট জেলায় প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাই বন্যায় তলিয়ে যায়। বন্যার পানিতে হাজার হাজার হাঁস-মুরগি এবং বেশ কয়েকটি গরু-ছাগল মারা পড়েছে। হাজার হাজার টন খড় ভেসে গেছে, না হয় পচে বিনষ্ট হয়েছে। সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেটে প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৭ হাজার ৩৫৪ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। এখনও সিংহভাগ চারণভূমি তলিয়ে আছে পানিতে।

বন্যায় ৭২১টি গবাদিপশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট জেলায়। এক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এদিকে ৩৬৮টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

জেলায় ২ হাজার ৯১ মেট্রিক টন খড় বিনষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে, যেখানে ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন ঘাস পচে বিনষ্ট হয়ে গেছে, এখানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা।

এদিকে বন্যার কারণে ১১টি গরু, ৬টি মহিষ, ২১টি ছাগল ও ১৬টি ভেড়া অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। এছাড়া ৪ হাজার ৯৬৩টি মুরগি ও এক হাজার ২৮৪টি হাঁস মারা গেছে এবারের বন্যার কবলে পড়ে। এ বাবদ ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় অসুস্থ হয়ে পড়া ৯ হাজার ১৫৪টি গবাদিপশু এবং ১২ হাজারের বেশি হাঁস-মুরগিকে টিকা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ১০ সহস্রাধিক গবাদিপশু এবং ২৭ সহস্রাধিক হাঁস-মুরগিকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিস্তীর্ণ গোচারণভূমি এখনও পানিতে নিমজ্জিত থাকায় গবাদিপশুর মালিকেরা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। পর্যাপ্ত গো-খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কচুরিপানা খাইয়ে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।

সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রুস্তম আলী বলেন, ‘পর্যাপ্ত ঘাস মিলছে না। কারণ বন্যাকবলিত এলাকায় বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি আর গবাদিপশুর আবাসস্থল তলিয়ে গেছে। যেসব ঘাস চাষ করা হয়েছিল, সেগুলোও রক্ষা করা যায়নি। বিপুল পরিমাণ খড় বিনষ্ট হয়ে গেছে। সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গবাদিপশুর মড়ক ও মৃত্যু প্রতিরোধে টিকাদান ও চিকিৎসার বিষয়টি আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। এ কারণেই মড়ক ও মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।’

স্বাস্থ্য খাতের ক্ষতি

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের নিচতলা প্রায় তিনফুট পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেটর জলমগ্ন হওয়ায় হাসপাতালের বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। নিচতলায় পানি উঠে যাওয়ায় রোগীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। দু’দিনে পানি নামার পর দেখা যায় হাসপাতালটির এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রেডিও থেরাপি মেশিনে পানি ঢুকে গেছে। ফলে এখন বন্ধ রয়েছে এসব সেবা কার্যক্রম।

এবারের বন্যায় শুধু ওসমানী হাসপাতালেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভাগের অনেক সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে বিভাগজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হচ্ছে।

বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উল্লেখ করে সিলেট বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যাকবলিত হয়েছে। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মধ্যে ৩১টিতে পানি ঢুকেছে। সুনামগঞ্জে ২০ শয্যার দুটি হাসপাতালে পানি প্রবেশ করে। এছাড়া ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়।

সিলেট জেলার ৩টি উপজেলা (জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ) বাদ দিয়ে বাকি ১০টি উপজেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন ছিল। কোম্পানীগঞ্জ এবং গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ১০ ফুট পরিমাণ পানি ছিল। স্রোতের কারণে অনেক আসবাবপত্র ভেসে গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের।

সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সব উপদ্রুত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, ইপিআই আইএলআর ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্সরে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্রপাতি কতটা সচল কিংবা অচল তা পানি নেমে না যাওয়ায় যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরও সময় লাগবে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালটির নিচতলা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাসপাতালের নিচতলায় থাকা এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও রেডিওথেরাপি মেশিন জলমগ্ন ছিল। রেডিওথেরাপি মেশিনটি চালুর চেষ্টা চলছে। তবে এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিনের ক্ষতি হয়েছে বেশি। এগুলো ঠিক হবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ রোগীরা সিটিস্ক্যান, এমআরআই, রেডিও থেরাপি সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালের অ্যম্বুল্যান্স, পরিচালকের গাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে। পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

পানি কমছে ধীরগতিতে

বন্যার ১১ দিন হলেও এখনো অনেক স্থানে পানি কমছে খুবই ধীরগতিতে। সিলেট নগরীর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি কমলেও অনেক এলাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমার পানি এখনও বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুশিয়ারা নদীর পানি কার্যত অপরিবর্তিত থাকায় সিলেটে প্রলম্বিত বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ কমছে না।

দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পানি কয়েক দিন ধরে থমকে আছে। বাড়ছেও না, নামছেও না, ৭-৮ দিন ধরে ঘরে পানি। এভাবে কত দিন থাকা যায়?’

ওসমানীনগরের ওমরপুর ইউনিয়নের হাসতনপুর গ্রামের আনফর মিয়া বলেন, এখনও ঘরে হাঁটুপানি। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তার পরিবার। এখন যেভাবে পানি কমছে, তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে। নতুন করে বৃষ্টিপাতও শুরু হয়েছে। তাই পানি বাড়ারও ভয় আছে।

তবে সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সিলেটে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। পানি ধীরগতিতে নামছে। আর বৃষ্টি না হলে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে পানি আরও কমে যাবে।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপশহর, তালতলা সড়কসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোতে পানি রয়ে গেছে। তবে কয়েক দিন ধরে ওই সড়কগুলোতে নৌকা চলাচল করলেও এখন সাধারণ যানবাহন চলাচল করছে। নগরীর যতরপুর, মিরাবাজার, উপশহরের একাংশ, সোবহানীঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, তালতলা, জামতলা, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, কুয়ারপার, লালদিঘীরপার, ছড়ারপার, মাছিমপুর এলাকার পাড়া-মহল্লার পানি ময়লা-আবর্জনায় কালো রং ধারণ করেছে। এসব এলাকায় বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

সরকারি হিসাবে নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৭ হাজার ৫০৭ জন এখনও রয়েছেন। পুরো জেলায় সব মিলে ৬০৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫৯ হাজার ৬৯৯ জন বন্যার্ত মানুষ রয়েছেন। এছাড়া ৪ হাজার ৩৮৮টি গবাদিপশু রয়েছে এখানে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফেরা মানুষের জীবনে নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

জৈন্তাপুর উপজেলার শুকইনপুর গ্রামের বাসিন্দা খলিল আহমদ বলেন, তার বাড়িঘর, আসবাব, এক বস্তা চাল, ধান, শিশুর পড়াশোনার জন্য বই-খাতা সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ ১১ সদস্যের পরিবার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

একই উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের আব্বাস উদ্দিন বলেন, ঘরের সব নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বিপদে আছি গরু-ছাগল নিয়ে। বাড়ির পাশে রাস্তায় এখনও হাঁটুসমান পানি।

ত্রাণ বিতরণে হচ্ছে সমন্বয় কমিটি

সিলেটে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের অভাবে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বেসরকারিভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী এলেও তা বিতরণে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ জানান, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রত্যেক উপজেলায় আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত শনিবার কমিটি করার জন্য সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে। সংশ্নিষ্ট জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটির কাজ তদারকি করবে।