একজন বিজ্ঞানপ্রেমীর অকাল প্রয়াণ

আলমগীর খান

আজ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অভাব। আর এই সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট বিজ্ঞানশিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানবিষয়-উত্তীর্ণদের মাঝে, অর্থাৎ যারা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করে অর্জিত দক্ষতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেনÑযেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। বরং দেখা যায়, যারা কলা ও মানবিক বিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করে তারা বেশি বিজ্ঞানমনস্ক। এই অবস্থা থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয় যে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই যে নবম শ্রেণি থেকেই খুব মেধাবী বলে প্রমাণ দিতে সক্ষম ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানে ভর্তি করা হয়, আর তার প্রমাণ দিতে অক্ষমদের সাধারণত মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি করা হয়Ñতার ন্যূনতম যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

এ ট্র্যাজিক পরিস্থিতির একাধিক কারণ আছে। মূল কারণ হচ্ছে আমাদের স্কুল-কলেজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ বিজ্ঞানের দর্শন শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেই। তদুপরি মানবিক বিদ্যায় কিছু বৃহৎ জীবনদৃষ্টির উপস্থিতি থাকলেও তথাকথিত ‘বিজ্ঞানশিক্ষা’টা বড়ির মতো করে খেতে দেয়া হয়, তা-ও তেতো, অন্তত হোমিওপ্যাথির গ্লোবিউলের মতো মিষ্টিও নয়। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, ক্যাপসুল আকারে বিজ্ঞান গিলে গিলে আমাদের দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের মতো বড় বড় পেশাদার তৈরি হন। এইসব ক্যাপসুল কিছু দক্ষতা শেখায়। আগের দিনে যেসব দক্ষতা পরিবারিক অভিভাবক বা গুরুর কাছ থেকে শিখতে হতো সেসবÑতবে এখন সরকারি বা ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেÑএ থেকে বিযুক্ত হয় সামাজিক দায়বোধ, যা পূর্বে একইরূপ পেশাদার যথা বৈদ্য ও মিস্ত্রিদের থাকত।

তথাকথিত এসব অত্যাশ্চর্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের আদর্শ পরিণতি পায় উচ্চ-উপার্জনশীল কোনো পেশাদার হওয়ায়। বিজ্ঞান হচ্ছে অসীম কৌতূহল সৃষ্টি ও তা নিবৃত্তির অসীম যাত্রা। অথচ আমাদের তথাকথিত বিজ্ঞানশিক্ষায় যা করা হয়, তা হচ্ছে সেই অমূল্য কৌতূহলের রক্তাক্ত খুন। এ দেশে বিজ্ঞানশিক্ষা শিক্ষার্থীদের মনে শুধু অর্থ-কৌতূহল ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে না। নাবালক বয়স থেকেই বিজ্ঞান-পড়া এইসব অত্যাশ্চর্য মেধাবীরা সাধারণত বিজ্ঞানের জগৎ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরে যায়। তাদের উর্বর জাদুর মাথা থেকে কদাচিৎ আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মতো কিছু বেরোয়Ñসে অধ্যবসায়ও নেই বললে চলে। ঢাকার শহরে দুয়েকটা বাড়ি, ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়তে পাঠানো ও প্রতিষ্ঠা করা এবং মোটা ব্যাংক ব্যালান্সÑ জীবনের সার্থকতার মানে তাদের এই। যাদের কাছে তারা সেবা বিক্রি করে এই সার্থকতা অর্জন করে তারা অধিকাংশই তাদের সেবায় অসন্তুষ্ট। সামাজিক-নৈতিক দায়বোধ দূরে থাকুকÑ কাস্টোমার স্যাটিফ্যাকশন বা খরিদ্দারের তৃপ্তিও তাদের দায়বোধের সীমায় নেই।

এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ সম্প্রতি দেশ হারিয়েছে একজন তরুণ বিজ্ঞানিকে যিনি একজন মেধাবী প্রকৌশলী, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার এসব দোষত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন। সেটিই তার কাল হলো। গাড়ি-বাড়ি, ছেলেকে বিদেশে প্রতিষ্ঠা করা ও ব্যাংক ব্যালান্স ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনিÑ সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃষ্টির আড়ালে। তিনি লেখক, বিজ্ঞান-সাধক ও কাঠের গুঁড়া থেকে বিকল্প জ¦ালানির উদ্ভাবক আনোয়ারুল আজিম খান অঞ্জন। জন্ম ৩০ জুন ১৯৭৬ সালে পাবনায় বেড়া উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে। আর মৃত্যু সম্প্রতি ১৯ মে ঢাকায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত রোগে।

চাকরির দাসত্ব ও কেরানিগিরির জীবনকে পিছনে ফেলে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে ও শিক্ষাকর্মে। উচ্ছিষ্ট থেকে জ¦ালানি তৈরির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯-এ সরকারের পক্ষ থেকে ‘মেধা সম্পদ সুরক্ষা সম্মাননা’ লাভ করেন তিনি। এ জ¦ালানি সম্পর্কে তিনি শিক্ষালোকে (সিদীপের শিক্ষাবিষয়ক বুলেটিন) লিখেছেন, “এটি তৈরির সব যন্ত্রপাতির নক্সা থেকে সংযোজন সবই করেছি আমি, এই বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে। ... প্রথম গবেষণাটি ফেলনা কাঠের গুঁড়া থেকে হলেও আমার উদ্ভাবিত প্রক্রিয়া ও যন্ত্র এখন এতটাই সক্ষম যে এটি এখন নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঠ, বাঁশ, ঘাস, গাছের পাতা, তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট, খড়, ক্ষেতের আগাছা সবকিছুকেই জ¦ালানিতে রূপান্তর করতে সক্ষম।”

কাঠের গুঁড়া থেকে এ জ¦ালানি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য তিনি পাবনার নাটিয়াবাড়িতে নিজ গ্রামে ‘প্রযুক্তি’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন। কিন্তু হঠাৎ স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা তাকে নেশার মতো পেয়ে বসে। পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাবে ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পাল্লায় পড়ে কারখানাটি মোটা অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অবশেষে আর্থিক অনটনের কবলে পড়ে তিনি কারখানাটি নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ নেন। এর মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

খ্যাতিমান বিজ্ঞানি জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি পোস্ট প্রায়ই ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যায়। যতদূর জানি এর উৎস বেশ আগে অঞ্জনের একটি পোস্ট। ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ ছোটকাগজে (ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) তিনি বিজ্ঞানি জামালকে নিয়ে লেখেন: “কেমব্রিজ ভার্সিটির অধ্যাপকের পদ, সোয়া লাখ টাকা বেতন; সম্মানের লেভেলটা বুঝতে পারছেন তো? এই চাকরি অবলীলায় ছেড়ে দিয়ে এ দেশে চলে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাত্র তিন হাজার টাকার চাকরিতে। ভাবতে পারছেন? আপনি কিংবা আমি হলে এই লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করতে পারতাম? হকিংয়ের বন্ধু আর রুমমেট ড. জামাল নজরুল ইসলাম বিশ্বের রথী-মহারথীদের দৃষ্টি তাঁর দিকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন একটি চিন্তা আর একটি বই দিয়ে। তাঁর গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই পদার্থবিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।”

‘আমাদের বিজ্ঞানচর্চা’ শীর্ষক একটি লেখায় অঞ্জন লিখেছেন, “প্রতিদিনের হিসাবে আমাদের এই পৃথিবী ২.৫৭৩ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে। সেই হিসেবে আমরা ৫০ বছর পূর্বের থেকে ৪৭,০০০ মিলিয়ন কিলোমিটার বা ৪৭ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছি। এই দূরত্ব পেরিয়ে এসে আমরা এখন কোথায়? আমাদের অর্জন কি? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতক্ষণ একটা জাতির কৃষ্টি-কালচারের মধ্যে মিলেমিশে একাকার না হয় ততক্ষণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শুধুই বিজ্ঞান বইয়ের কিছু অধ্যায় মাত্র।”

মৃত্যুর মাত্র দেড় মাস আগে ১ এপ্রিল ঢাকায় ‘৪র্থ শিক্ষালোক লেখক-শিল্পী সম্মিলনে’ তার উপস্থাপিত প্রবন্ধ ‘বায়োম্যাস ফুয়েল : উচ্ছিষ্ট বস্তু থেকে তৈরি জ¦ালানি’ উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে। পরে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে।

অঞ্জনের কাছে বিজ্ঞানচর্চা কোনো সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় ছিলো না। তিনি বিজ্ঞানকে বুদ্ধির জিমন্যাস্টিকস মনে করতেন না। তাই তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান সমাজসচেতন মানুষ। সমাজ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানচর্চা যে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত একথা তিনি ভালোভাবে জানতেন। সেজন্য নিছক বিজ্ঞানচর্চা বাড়ানো নিয়ে তার মায়াকান্না ছিলো না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর যেখানে প্রত্যেকের সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হতে পারে। অমন একটা কাক্সিক্ষত সমাজকাঠোমোই শুধু লালন করতে পারে তরুণ শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন ও প্রতিভাকে।

এমন স্বপ্ন ও প্রতিভা নিয়েই অঞ্জন পৃথিবীতে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো তাকে লালন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই হয়তো তিনি অতি তাড়াতাড়ি আবার এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তার ‘প্রযুক্তি’ প্রকল্পটি সচেতন মহলের ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনা লাভ করতে পারেনি। আবার অর্থলোভমুক্ত ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মত্ত এই মেধাবী মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও কিছুদিন বেশ কিছু সংকটের মুখোমুখি হন, যা হয়তো তাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]

সোমবার, ২৭ জুন ২০২২ , ১৩ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলকদ ১৪৪৩

একজন বিজ্ঞানপ্রেমীর অকাল প্রয়াণ

আলমগীর খান

আজ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অভাব। আর এই সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট বিজ্ঞানশিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানবিষয়-উত্তীর্ণদের মাঝে, অর্থাৎ যারা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করে অর্জিত দক্ষতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেনÑযেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। বরং দেখা যায়, যারা কলা ও মানবিক বিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করে তারা বেশি বিজ্ঞানমনস্ক। এই অবস্থা থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয় যে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই যে নবম শ্রেণি থেকেই খুব মেধাবী বলে প্রমাণ দিতে সক্ষম ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানে ভর্তি করা হয়, আর তার প্রমাণ দিতে অক্ষমদের সাধারণত মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি করা হয়Ñতার ন্যূনতম যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

এ ট্র্যাজিক পরিস্থিতির একাধিক কারণ আছে। মূল কারণ হচ্ছে আমাদের স্কুল-কলেজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ বিজ্ঞানের দর্শন শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেই। তদুপরি মানবিক বিদ্যায় কিছু বৃহৎ জীবনদৃষ্টির উপস্থিতি থাকলেও তথাকথিত ‘বিজ্ঞানশিক্ষা’টা বড়ির মতো করে খেতে দেয়া হয়, তা-ও তেতো, অন্তত হোমিওপ্যাথির গ্লোবিউলের মতো মিষ্টিও নয়। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, ক্যাপসুল আকারে বিজ্ঞান গিলে গিলে আমাদের দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের মতো বড় বড় পেশাদার তৈরি হন। এইসব ক্যাপসুল কিছু দক্ষতা শেখায়। আগের দিনে যেসব দক্ষতা পরিবারিক অভিভাবক বা গুরুর কাছ থেকে শিখতে হতো সেসবÑতবে এখন সরকারি বা ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেÑএ থেকে বিযুক্ত হয় সামাজিক দায়বোধ, যা পূর্বে একইরূপ পেশাদার যথা বৈদ্য ও মিস্ত্রিদের থাকত।

তথাকথিত এসব অত্যাশ্চর্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের আদর্শ পরিণতি পায় উচ্চ-উপার্জনশীল কোনো পেশাদার হওয়ায়। বিজ্ঞান হচ্ছে অসীম কৌতূহল সৃষ্টি ও তা নিবৃত্তির অসীম যাত্রা। অথচ আমাদের তথাকথিত বিজ্ঞানশিক্ষায় যা করা হয়, তা হচ্ছে সেই অমূল্য কৌতূহলের রক্তাক্ত খুন। এ দেশে বিজ্ঞানশিক্ষা শিক্ষার্থীদের মনে শুধু অর্থ-কৌতূহল ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে না। নাবালক বয়স থেকেই বিজ্ঞান-পড়া এইসব অত্যাশ্চর্য মেধাবীরা সাধারণত বিজ্ঞানের জগৎ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরে যায়। তাদের উর্বর জাদুর মাথা থেকে কদাচিৎ আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মতো কিছু বেরোয়Ñসে অধ্যবসায়ও নেই বললে চলে। ঢাকার শহরে দুয়েকটা বাড়ি, ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়তে পাঠানো ও প্রতিষ্ঠা করা এবং মোটা ব্যাংক ব্যালান্সÑ জীবনের সার্থকতার মানে তাদের এই। যাদের কাছে তারা সেবা বিক্রি করে এই সার্থকতা অর্জন করে তারা অধিকাংশই তাদের সেবায় অসন্তুষ্ট। সামাজিক-নৈতিক দায়বোধ দূরে থাকুকÑ কাস্টোমার স্যাটিফ্যাকশন বা খরিদ্দারের তৃপ্তিও তাদের দায়বোধের সীমায় নেই।

এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ সম্প্রতি দেশ হারিয়েছে একজন তরুণ বিজ্ঞানিকে যিনি একজন মেধাবী প্রকৌশলী, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার এসব দোষত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন। সেটিই তার কাল হলো। গাড়ি-বাড়ি, ছেলেকে বিদেশে প্রতিষ্ঠা করা ও ব্যাংক ব্যালান্স ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনিÑ সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃষ্টির আড়ালে। তিনি লেখক, বিজ্ঞান-সাধক ও কাঠের গুঁড়া থেকে বিকল্প জ¦ালানির উদ্ভাবক আনোয়ারুল আজিম খান অঞ্জন। জন্ম ৩০ জুন ১৯৭৬ সালে পাবনায় বেড়া উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে। আর মৃত্যু সম্প্রতি ১৯ মে ঢাকায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত রোগে।

চাকরির দাসত্ব ও কেরানিগিরির জীবনকে পিছনে ফেলে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে ও শিক্ষাকর্মে। উচ্ছিষ্ট থেকে জ¦ালানি তৈরির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯-এ সরকারের পক্ষ থেকে ‘মেধা সম্পদ সুরক্ষা সম্মাননা’ লাভ করেন তিনি। এ জ¦ালানি সম্পর্কে তিনি শিক্ষালোকে (সিদীপের শিক্ষাবিষয়ক বুলেটিন) লিখেছেন, “এটি তৈরির সব যন্ত্রপাতির নক্সা থেকে সংযোজন সবই করেছি আমি, এই বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে। ... প্রথম গবেষণাটি ফেলনা কাঠের গুঁড়া থেকে হলেও আমার উদ্ভাবিত প্রক্রিয়া ও যন্ত্র এখন এতটাই সক্ষম যে এটি এখন নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঠ, বাঁশ, ঘাস, গাছের পাতা, তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট, খড়, ক্ষেতের আগাছা সবকিছুকেই জ¦ালানিতে রূপান্তর করতে সক্ষম।”

কাঠের গুঁড়া থেকে এ জ¦ালানি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য তিনি পাবনার নাটিয়াবাড়িতে নিজ গ্রামে ‘প্রযুক্তি’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন। কিন্তু হঠাৎ স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা তাকে নেশার মতো পেয়ে বসে। পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাবে ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পাল্লায় পড়ে কারখানাটি মোটা অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অবশেষে আর্থিক অনটনের কবলে পড়ে তিনি কারখানাটি নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ নেন। এর মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

খ্যাতিমান বিজ্ঞানি জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি পোস্ট প্রায়ই ফেসবুকে ঘুরতে দেখা যায়। যতদূর জানি এর উৎস বেশ আগে অঞ্জনের একটি পোস্ট। ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ ছোটকাগজে (ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা) তিনি বিজ্ঞানি জামালকে নিয়ে লেখেন: “কেমব্রিজ ভার্সিটির অধ্যাপকের পদ, সোয়া লাখ টাকা বেতন; সম্মানের লেভেলটা বুঝতে পারছেন তো? এই চাকরি অবলীলায় ছেড়ে দিয়ে এ দেশে চলে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাত্র তিন হাজার টাকার চাকরিতে। ভাবতে পারছেন? আপনি কিংবা আমি হলে এই লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করতে পারতাম? হকিংয়ের বন্ধু আর রুমমেট ড. জামাল নজরুল ইসলাম বিশ্বের রথী-মহারথীদের দৃষ্টি তাঁর দিকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন একটি চিন্তা আর একটি বই দিয়ে। তাঁর গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই পদার্থবিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।”

‘আমাদের বিজ্ঞানচর্চা’ শীর্ষক একটি লেখায় অঞ্জন লিখেছেন, “প্রতিদিনের হিসাবে আমাদের এই পৃথিবী ২.৫৭৩ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে। সেই হিসেবে আমরা ৫০ বছর পূর্বের থেকে ৪৭,০০০ মিলিয়ন কিলোমিটার বা ৪৭ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছি। এই দূরত্ব পেরিয়ে এসে আমরা এখন কোথায়? আমাদের অর্জন কি? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতক্ষণ একটা জাতির কৃষ্টি-কালচারের মধ্যে মিলেমিশে একাকার না হয় ততক্ষণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শুধুই বিজ্ঞান বইয়ের কিছু অধ্যায় মাত্র।”

মৃত্যুর মাত্র দেড় মাস আগে ১ এপ্রিল ঢাকায় ‘৪র্থ শিক্ষালোক লেখক-শিল্পী সম্মিলনে’ তার উপস্থাপিত প্রবন্ধ ‘বায়োম্যাস ফুয়েল : উচ্ছিষ্ট বস্তু থেকে তৈরি জ¦ালানি’ উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মাঝে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করে। পরে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে।

অঞ্জনের কাছে বিজ্ঞানচর্চা কোনো সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় ছিলো না। তিনি বিজ্ঞানকে বুদ্ধির জিমন্যাস্টিকস মনে করতেন না। তাই তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান সমাজসচেতন মানুষ। সমাজ, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানচর্চা যে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত একথা তিনি ভালোভাবে জানতেন। সেজন্য নিছক বিজ্ঞানচর্চা বাড়ানো নিয়ে তার মায়াকান্না ছিলো না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর যেখানে প্রত্যেকের সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হতে পারে। অমন একটা কাক্সিক্ষত সমাজকাঠোমোই শুধু লালন করতে পারে তরুণ শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন ও প্রতিভাকে।

এমন স্বপ্ন ও প্রতিভা নিয়েই অঞ্জন পৃথিবীতে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো তাকে লালন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই হয়তো তিনি অতি তাড়াতাড়ি আবার এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তার ‘প্রযুক্তি’ প্রকল্পটি সচেতন মহলের ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনা লাভ করতে পারেনি। আবার অর্থলোভমুক্ত ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মত্ত এই মেধাবী মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও কিছুদিন বেশ কিছু সংকটের মুখোমুখি হন, যা হয়তো তাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]