বন্যার পানি নামছে তবে মহাসংকটে লাখ লাখ মানুষ। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানো এসব বানভাসির চোখে এখন অন্ধকার। সরকারি পাশাপাশি সহায়তার জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। তবে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতায় বানভাসিদের হাহাকার কমছে না।
সিলেট প্রতিনিধি জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারাদেশের মানুষ। মানুষের অভূতপূর্ব সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে এই দুই জেলায়। সরকারের পক্ষ থেকেও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এই কাজে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনীও। পুলিশও তাদের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এত বিপুল ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মানুষের হাহাকার কমছে না। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরের রাহেলা খাতুনের কথাই ধরা যাক। ১৫ জুন, বন্যা শুরু হওয়ার দিন থেকেই পানিবন্দী তিনি। এর মধ্যে একদিন কিছু শুকনা খাবার ও একদিন রান্না করা খাবার পেয়েছেন কেবল।
এখন পর্যন্ত কোন সরকারি সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুলের দিনমজুর আফরোজ আহমদ। তিনি বলেন, ‘এলাকার ছেলেরা মিলে কিছু সাহায্য করছে। সরকারের কেউ বা কোন জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত আমাদের খোঁজও নেয়নি।’
বন্যায় পানিবন্দী থাকা ১০ দিনে মাত্র চার দিন ভাত খেয়েছেন জানিয়ে গোয়াইনঘাটের তোয়াকুল এলাকার ভ্যানচালক আবদুল করিম বলেন, ‘শুকনা খাবার অনেক পেয়েছি। কিন্তু চাল-ডাল পাচ্ছি না। ভাত না খেয়ে কত দিন থাকা যায়, ঘরের বাচ্চারা তো ভাত ছাড়া বুঝতেই চায় না।’ ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও বানভাসি মানুষের এত হাহাকার আর অভিযোগ কেন-এমন প্রশ্নে ‘কলের গাড়ি’ নাম দিয়ে সিলেটে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে আসা কলের গাড়ির অন্যতম সমন্বয়ক, সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয় না হওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। ‘ব্যক্তি উদ্যোগে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তারা কোন এলাকায় বেশি দুর্গত, কারা সহায়তা পাননি, তা জানেন না। হয়ত ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে বা পরিচিতজনদের তথ্যে তারা ত্রাণ বিতরণের এলাকা বাছাই করছেন।’
রজত মনে করেন, এই সমস্যা কাটাতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করা প্রয়োজন। তারা বেসরকারিভাবে বিতরণ করা ত্রাণ তদারকি করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন। সমন্বয়হীনতার উদাহরণ তুলে ধরে জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান করিম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ৪টি গ্রামে পানি ওঠেনি। এই গ্রামগুলোর পুরোটাই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আশপাশের গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে বন্যার্তরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাদের বেশিরভাগই একেবারে গরিব। কিন্তু এখানে যেহেতু পানি নেই এবং সরকার ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তাই এই এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়ে আসতে চায় না।’
গোয়ানঘাট উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বিপদে আছে মধ্যবিত্ত। তারা ত্রাণ পাচ্ছে না। আবার ঘরেও খাবার নেই। সবাই শুধু দরিদ্রদের সাহায্য করছে। আমাদেরও বলে দেয়া হয়েছে, সরকারি ত্রাণ গরিব মানুষদের দিতে। কিন্তু অবস্থাসম্পন্নরাও যে এখন সংকটে তা কেউ বুঝতেছে না।’
‘পুলিশ’র খানি পাইয়া ২ দিন পেট ভরিয়া খাইলাম’
সিলেটের বিয়ানীবাজার মুড়িয়া ইউনিয়নের ঘুঙ্গাদিয়া এলাকার বাসিন্দা কমলারুন বেগম (৭০)। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে উঠেছেন ঘুঙ্গাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে বন্যার পানি। এখানে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত রোববার বিয়ানীবাজার থানা পুলিশের পক্ষ থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এই খাবার পেয়ে অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন কমলারুন। বলেন ‘আমি জানতাম পুলিশের কাম চোর-ডাকাইত ধরা না, এখন দেখি তারা আমরারে খানি দিরা ত্রাণ ও দিরা। ওউ লাগাইয়া দুই বার আমরারে খানি দিলা পুলিশ হকলে। পয়লা বার আমি নৌকায় পুলিশ আওয়া দেখিয়া ডরাইছি। মনো করছি কারে ধরিয়া নিতা করি আইছন। পরে নৌকা কাছে আওয়ার পরে দেখি নৌকার মাঝে বড় ডেগ আর চাউলর বস্তা। আমার ভুল ভাঙিল পুলিশর কাম লইয়া। পুলিশ হকলর খানি পাইয়া পেট ভরিয়া খাইলাম আইজ দুই দিনে।’
বিভাগে বরাদ্দ ৫ কোটি টাকা
৩৭২০ মেট্রিক টন চাল
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সিলেট বিভাগের জন্য এপ্রিল থেকে জুন অবধি নগদ ৫ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া ৩ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়। এর বাইরে হাজার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারও বরাদ্দ ছিল।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে বানভাসি এলাকায় অনাহারি-অর্ধাহারি লোকের সংখ্যা বাড়ছে। লাখো মানুষ এখন ও ত্রাণের আশায় প্রহর গুনছেন। বন্যাকবলিত এলাকার ত্রাণ তৎপরতা খুব অপ্রতুল।
গত ১২ দিনে হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে বানভাসী মানুষের জীবনযাপনের। একবেলা খেলেও নেই বাকি বেলার কোন ভরসা, পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে প্রাণে বাঁচলেও খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে দিন কাটছে হাওরের মানুষের। গ্রামের হাটবাজার আগের মতো স্বাভাবিক না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতা থাকায় মালামাল পরিবহন খুব কষ্টের। চারদিকে পানি আর পানি। জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ দিনেও গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগ আগলে রাখার চেষ্টা করছেন।
সুনামগঞ্জের পৌর শহরের নিম্নাঞ্চল হাসন নগর ও ইকবাল নগর এলাকায় ঘুরে দেখা যায় বিভিন্ন উঁচু ভবন ও বিদ্যালয় কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন বানভাসি মানুষেরা। কেউ কেউ বাড়ি ফিরছিলেন কেউ এখনও আছেন। কিছু কিছু সংগঠন রান্না করা খিচুড়ি দিলেও দিনের বাকি দুই বেলা উপোস করে কাটাচ্ছেন তারা, রান্নার চুলাই জ্বলেনি। তাছাড়া সুপেয় পানি না থাকায় বন্যার পানিই খেয়েই দিন কাটছে তাদের। বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাদের মুখে শুধুমাত্র ক্ষোভ ঝাড়েন। তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ সরকারিভাবে তেমন কোন সহায়তা আসেনি তাদের কাছে। তবে বেসরকারিভাবে প্রচুর ত্রাণ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে কিন্ত এতে কোন সমন্বয় নেই। কেউ বার বার পাচ্ছে আবার কেউ একবার ও পায়নি।
সবজি ব্যবসায়ী আবদুল হক বলেন, এক সপ্তাহ ধরি আমার ঘরে পানি ছিল এখন নেমেছে। বোরো সিজনও মানুষের ধান কাটিয়া কিছু ধান পেয়েছিলাম, এগুলো মিলে দিয়ে খাওয়ার চাল করেছিলাম সব পানিতে নষ্ট অইগেছে, ঘরে চুলা জ¦ালানির মতো অবস্থা নাই, নিজে এক বেলা খাইয়া থাকলাম কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চার কান্দন দেখলে বুকটা ফাটি যায় এরারে কিছু দিতে পারতেছি না।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, এখনও চরম দুর্ভোগে রয়েছে প্লাবাতি হওয়া এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। মানুষের খাদ্যাভাবের পাশাপাশি গো-খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন এলাকার পানি নামছে ধীর গতিতে। ফলে এখনও অনেকের বাড়িঘরের চুলা জলমুক্ত হয়নি। মানুষ চিকিৎসার জন্য যেতে পারছে না হাসপাতালে। সব এলাকায় দেয়া হচ্ছে না স্বাস্ব্যসেবা। খাবার দিচ্ছে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন, ব্যাক্তিসহ সমাজসেবীরা। কিন্তু পানিবন্দীর সংখ্যায় সেই খাবার অপ্রতুল। সেখানেই ত্রাণ দিচ্ছে খবর পেয়ে মানুষ ছুটছে।
এমন অবস্থা জেলার প্রায় সবক’টি উপজেলাতে। জেলার সবক’টি উপজেলার মোট ৭৭টি প্লাবিত ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী থাকলেও সড়কসহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে নানাভাবে দুর্ভোগ প্রায় ১০ লাখ মানুষের।
মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০২২ , ১৪ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩
সংবাদ ডেক্স
বন্যার পানি নামছে তবে মহাসংকটে লাখ লাখ মানুষ। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানো এসব বানভাসির চোখে এখন অন্ধকার। সরকারি পাশাপাশি সহায়তার জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। তবে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতায় বানভাসিদের হাহাকার কমছে না।
সিলেট প্রতিনিধি জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারাদেশের মানুষ। মানুষের অভূতপূর্ব সহায়তায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে এই দুই জেলায়। সরকারের পক্ষ থেকেও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এই কাজে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনীও। পুলিশও তাদের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এত বিপুল ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও মানুষের হাহাকার কমছে না। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরের রাহেলা খাতুনের কথাই ধরা যাক। ১৫ জুন, বন্যা শুরু হওয়ার দিন থেকেই পানিবন্দী তিনি। এর মধ্যে একদিন কিছু শুকনা খাবার ও একদিন রান্না করা খাবার পেয়েছেন কেবল।
এখন পর্যন্ত কোন সরকারি সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুলের দিনমজুর আফরোজ আহমদ। তিনি বলেন, ‘এলাকার ছেলেরা মিলে কিছু সাহায্য করছে। সরকারের কেউ বা কোন জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত আমাদের খোঁজও নেয়নি।’
বন্যায় পানিবন্দী থাকা ১০ দিনে মাত্র চার দিন ভাত খেয়েছেন জানিয়ে গোয়াইনঘাটের তোয়াকুল এলাকার ভ্যানচালক আবদুল করিম বলেন, ‘শুকনা খাবার অনেক পেয়েছি। কিন্তু চাল-ডাল পাচ্ছি না। ভাত না খেয়ে কত দিন থাকা যায়, ঘরের বাচ্চারা তো ভাত ছাড়া বুঝতেই চায় না।’ ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম সত্ত্বেও বানভাসি মানুষের এত হাহাকার আর অভিযোগ কেন-এমন প্রশ্নে ‘কলের গাড়ি’ নাম দিয়ে সিলেটে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে আসা কলের গাড়ির অন্যতম সমন্বয়ক, সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয় না হওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। ‘ব্যক্তি উদ্যোগে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তারা কোন এলাকায় বেশি দুর্গত, কারা সহায়তা পাননি, তা জানেন না। হয়ত ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে বা পরিচিতজনদের তথ্যে তারা ত্রাণ বিতরণের এলাকা বাছাই করছেন।’
রজত মনে করেন, এই সমস্যা কাটাতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করা প্রয়োজন। তারা বেসরকারিভাবে বিতরণ করা ত্রাণ তদারকি করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন। সমন্বয়হীনতার উদাহরণ তুলে ধরে জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান করিম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ৪টি গ্রামে পানি ওঠেনি। এই গ্রামগুলোর পুরোটাই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আশপাশের গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে বন্যার্তরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাদের বেশিরভাগই একেবারে গরিব। কিন্তু এখানে যেহেতু পানি নেই এবং সরকার ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তাই এই এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়ে আসতে চায় না।’
গোয়ানঘাট উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বিপদে আছে মধ্যবিত্ত। তারা ত্রাণ পাচ্ছে না। আবার ঘরেও খাবার নেই। সবাই শুধু দরিদ্রদের সাহায্য করছে। আমাদেরও বলে দেয়া হয়েছে, সরকারি ত্রাণ গরিব মানুষদের দিতে। কিন্তু অবস্থাসম্পন্নরাও যে এখন সংকটে তা কেউ বুঝতেছে না।’
‘পুলিশ’র খানি পাইয়া ২ দিন পেট ভরিয়া খাইলাম’
সিলেটের বিয়ানীবাজার মুড়িয়া ইউনিয়নের ঘুঙ্গাদিয়া এলাকার বাসিন্দা কমলারুন বেগম (৭০)। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে উঠেছেন ঘুঙ্গাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে বন্যার পানি। এখানে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত রোববার বিয়ানীবাজার থানা পুলিশের পক্ষ থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এই খাবার পেয়ে অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন কমলারুন। বলেন ‘আমি জানতাম পুলিশের কাম চোর-ডাকাইত ধরা না, এখন দেখি তারা আমরারে খানি দিরা ত্রাণ ও দিরা। ওউ লাগাইয়া দুই বার আমরারে খানি দিলা পুলিশ হকলে। পয়লা বার আমি নৌকায় পুলিশ আওয়া দেখিয়া ডরাইছি। মনো করছি কারে ধরিয়া নিতা করি আইছন। পরে নৌকা কাছে আওয়ার পরে দেখি নৌকার মাঝে বড় ডেগ আর চাউলর বস্তা। আমার ভুল ভাঙিল পুলিশর কাম লইয়া। পুলিশ হকলর খানি পাইয়া পেট ভরিয়া খাইলাম আইজ দুই দিনে।’
বিভাগে বরাদ্দ ৫ কোটি টাকা
৩৭২০ মেট্রিক টন চাল
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সিলেট বিভাগের জন্য এপ্রিল থেকে জুন অবধি নগদ ৫ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া ৩ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়। এর বাইরে হাজার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারও বরাদ্দ ছিল।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে বানভাসি এলাকায় অনাহারি-অর্ধাহারি লোকের সংখ্যা বাড়ছে। লাখো মানুষ এখন ও ত্রাণের আশায় প্রহর গুনছেন। বন্যাকবলিত এলাকার ত্রাণ তৎপরতা খুব অপ্রতুল।
গত ১২ দিনে হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে বানভাসী মানুষের জীবনযাপনের। একবেলা খেলেও নেই বাকি বেলার কোন ভরসা, পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে প্রাণে বাঁচলেও খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে দিন কাটছে হাওরের মানুষের। গ্রামের হাটবাজার আগের মতো স্বাভাবিক না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতা থাকায় মালামাল পরিবহন খুব কষ্টের। চারদিকে পানি আর পানি। জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ দিনেও গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগ আগলে রাখার চেষ্টা করছেন।
সুনামগঞ্জের পৌর শহরের নিম্নাঞ্চল হাসন নগর ও ইকবাল নগর এলাকায় ঘুরে দেখা যায় বিভিন্ন উঁচু ভবন ও বিদ্যালয় কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন বানভাসি মানুষেরা। কেউ কেউ বাড়ি ফিরছিলেন কেউ এখনও আছেন। কিছু কিছু সংগঠন রান্না করা খিচুড়ি দিলেও দিনের বাকি দুই বেলা উপোস করে কাটাচ্ছেন তারা, রান্নার চুলাই জ্বলেনি। তাছাড়া সুপেয় পানি না থাকায় বন্যার পানিই খেয়েই দিন কাটছে তাদের। বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাদের মুখে শুধুমাত্র ক্ষোভ ঝাড়েন। তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ সরকারিভাবে তেমন কোন সহায়তা আসেনি তাদের কাছে। তবে বেসরকারিভাবে প্রচুর ত্রাণ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে কিন্ত এতে কোন সমন্বয় নেই। কেউ বার বার পাচ্ছে আবার কেউ একবার ও পায়নি।
সবজি ব্যবসায়ী আবদুল হক বলেন, এক সপ্তাহ ধরি আমার ঘরে পানি ছিল এখন নেমেছে। বোরো সিজনও মানুষের ধান কাটিয়া কিছু ধান পেয়েছিলাম, এগুলো মিলে দিয়ে খাওয়ার চাল করেছিলাম সব পানিতে নষ্ট অইগেছে, ঘরে চুলা জ¦ালানির মতো অবস্থা নাই, নিজে এক বেলা খাইয়া থাকলাম কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চার কান্দন দেখলে বুকটা ফাটি যায় এরারে কিছু দিতে পারতেছি না।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, এখনও চরম দুর্ভোগে রয়েছে প্লাবাতি হওয়া এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। মানুষের খাদ্যাভাবের পাশাপাশি গো-খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন এলাকার পানি নামছে ধীর গতিতে। ফলে এখনও অনেকের বাড়িঘরের চুলা জলমুক্ত হয়নি। মানুষ চিকিৎসার জন্য যেতে পারছে না হাসপাতালে। সব এলাকায় দেয়া হচ্ছে না স্বাস্ব্যসেবা। খাবার দিচ্ছে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন, ব্যাক্তিসহ সমাজসেবীরা। কিন্তু পানিবন্দীর সংখ্যায় সেই খাবার অপ্রতুল। সেখানেই ত্রাণ দিচ্ছে খবর পেয়ে মানুষ ছুটছে।
এমন অবস্থা জেলার প্রায় সবক’টি উপজেলাতে। জেলার সবক’টি উপজেলার মোট ৭৭টি প্লাবিত ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী থাকলেও সড়কসহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে নানাভাবে দুর্ভোগ প্রায় ১০ লাখ মানুষের।