মোস্তাফা জব্বার
আট ॥
অ্যানিমেশন বিষয়ে আরও আলোচনা করার আগে আমি এই খাতে আমাদের ব্যাপক প্রবেশের জন্য কিছু কার্যকর প্রস্তাব পেশ করতে পারি।
প্রথমত, আমাদের চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল করা হোক। সেখানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক এ্যানিমেশন শেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত। আমি নিজে বিজয় ডিজিটালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে চারুকলার ছাত্রছাত্রীদেরকে মাত্র ৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিলে তারা চমৎকার অ্যানিটের হতে পারে। আমি নিজের ঘরে এটিও প্রমাণ করেছি যে সাধারণ ফ্লাশ জানা প্রশিক্ষককে দিয়েই এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়।
দ্বিতীয়ত, সারা দুনিয়ায় আমরা যেমন সফটওয়্যার ও সেবা খাতের বাজার খুঁজি তেমন করে এ্যানিমেশনের বাজারও খুঁজতে পারি। ভারত যদি এত বড় বাজার পেতে পারে- আমরা কেন পারি না।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশীয় বাজারকে সম্প্রসারিত করতে হবে। বিনোদন, শিক্ষামূলক মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার, শিশুদের জন্য ভিডিও এবং চলচ্চিত্র তৈরী ছাড়াও আমরা দেশের বিজ্ঞাপন শিল্পে এ্যানিমেশন দিয়ে নতুন মাত্রা তৈরী করতে পারি।
চতুর্থত, দেশের মেধাসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রটিকে আমরা সঠিকপথে প্রবাহিত করতে পারি। এখন যেভাবে পাইরেসির রাজত্ব চলছে সেটিকে পরিবর্তন করে অন্তত দেশীয় মেধাসম্পদের যাতে পাইরেসি না হয় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সার্বিকভাবে অ্যানিমেশনকে একটি সম্প্রসারণশীল খাত হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আমরা একদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের রপ্তানিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারি।
অ্যানিমেশনের গোড়ার কথা : আমরা যদি মানুষের প্রকাশের ভাষার দিকে তাকাই তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, চিত্রকলা হচ্ছে মানুষের প্রাচীনতম সৃজনশীলতা। এর জন্ম মানুষের লিখিত ভাষার আগে। প্রথমে মানুষ আঁকতে শেখে, পরে আসে লিখিত ভাষা। লিখিত ভাষার জন্ম বস্তুত চিত্রকলা থেকে। সেই চিত্রকলা থেকেই জন্ম নেয় ফটোগ্রাফি। অ্যানিমেশনের জন্মও সেই চিত্রকলা থেকেই।
আমরা সবাই জানি, গাছের বাকলে লতায়- পাতায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে দাগ কেটে, পাথরে খোদাই করে মানুষ ছবি আঁকতো। একসময়ে ধারালো অস্ত্র বিদায় নেয়। আমরা পাই তুলি। রঙের জন্ম কিন্তু সেই অনেক আগে থেকেই। প্রকৃতি থেকে নিংড়ে নিয়েছি আমরা সৌন্দর্য। আর তার প্রকাশ ঘটেছে রঙের বর্ণছটায়। মিডিয়ারও পরিবর্তন হয়েছে এরই মাঝে। গাছের বাকল, লতাপতা থেকে কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিক হয়ে কম্পিউটারের পর্দায় পৌঁছেছি আমরা। বলা যায় এসেছে প্রযুক্তি। একসময়ে যা অতি কষ্ট করে আঁকতে হতো তা-ই প্রযুক্তির বদৌলতে হুবহু ফ্রেমে বন্দী করা সম্ভব হলো। এর নাম দিলাম আমরা ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তি। আলোছায়ায় বন্দী করা ছাড়াও রাসায়নিক যৌগ দিয়ে বন্দী করলাম আমরা প্রতিকৃতি। এক সময়ে স্থির ফ্রেম হয়ে দাঁড়ালো সচল। নাম দিলাম চলচ্চিত্র।
মানুষ তো ওখানেও থেমে থাকেনি। সচল ছবিতে সে দিলো শব্দ। অবস্থা এখন এমন যে সচল ছবি আর শব্দকে বাদ দিলে আধুনিক মানুষকে ভাবা যায়না। অথচ ছবি আঁকা, ছবি তোলা, স্থির চিত্র বা সচল চিত্র কিংবা এর সঙ্গে শব্দের সংমিশ্রণÑ এসব একটি শেকড় থেকে উৎপন্ন হলেও এর প্রয়োগ, নান্দনিকতা, প্রভাব, বিস্তৃতি ইত্যাদি কিন্তু এক নয়। অ্যানিমেশন বলতে আমরা যাকে চিহ্নিত করি তাকে এই ভাবনা থেকে দূরে রাখা কঠিন। খুব সরাসরি বলতে গেলে একসময়ে কাগজে- বাকলে নানা উপকরণে আমরা যেসব হাস্যরসাত্মক, কল্প বা বৈজ্ঞানিক কাহিনীভিত্তিক ছবি আঁকতাম তাকে কার্টুন বলা হতো। পত্রিকার পাতায় এখনো আমরা সেই কার্টুন দেখি। কার্টুন বই বা কমিক সিরিজ এবং কার্টুন চিত্র দুয়েরই বোদ্ধা সমজদার হলো শিশু- কিশোর তরুণ তরুণীরা। ডিজনী পরিবারের কাছে এই দুনিয়া সেই কার্টুন জন্ম দেবার জন্য ঋণী।
অ্যানিমেশনের সূচনা নাগরিক সভ্যতার অধিবাসী সবার কাছেই পরিচিত। ছবিকে গতি প্রদান করাই হচ্ছে অ্যানিমেশন। তবে এতে ফটোগ্রাফি ব্যবহৃত না হয়ে অঙ্কিত চিত্র ব্যবহৃত হয়। সেজন্যেই আমরা ফটোগ্রাফির চলমানতাকে চলচ্চিত্র বা ভিডিও বলি। কিন্তু একে বলি এনিমেশন চিত্র বা কার্টুন চিত্র।
সচরাচর এক ধরনের অংকিত স্থির চিত্রকে বলা হয় কার্টুন। কালক্রমে স্থির কার্টুন চিত্র পায় গতি। হয়ে যায় কার্টুন চলচ্চিত্র। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমসাধ্য ছিলো কার্টুন দিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করা। লক্ষ লক্ষ শ্রম ঘণ্টায় তৈরী হয়েছে একেকটি কার্টুন চিত্র।
সেই সময়টি ছিলো আবার কেবল দ্বিমাত্রিকতার। উল্লেখ করা যেতে পারে কার্টুন চিত্রের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা ফটোগ্রাফির উপযুক্ত নয়। ফটোগ্রাফিতে যেখানে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন সেখানে কার্টুনে কল্পিত চরিত্র, কল্পিত দৃশ্য, কল্পিত ঘটনাপঞ্জি, হাস্য-রস সৃষ্টি কিংবা কল্পকাহিনীর জগত নিয়ে কার্টুন চিত্র বিকশিত হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে কার্টুন চিত্রে দুটি নতুন ধারা যুক্ত হয়েছেÑ ক) ত্রিমাত্রিকতা খ) বাস্তবতা।
এখন এমন কিছু কার্টুন চিত্র তৈরি হয়েছে যা পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র হিসেবেও সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছে।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রে বা সায়েন্স ফিকশন ভিত্তিক চলচ্চিত্রে বিশেষ দৃশ্য( যেমন মানুষের মাথা ফাঁক করে ফেলা- (টার্মিনেটর-টু), বিশেষ প্রাণী (যেমন- ডাইনোসর-জুরাসিস পার্ক বা গডজিলা), বিশেষ চরিত্র (সিন্দাবাদের ভূত-আলাদীনের দৈত্য) ইত্যাদির জন্য ফটোগ্রাফি অচল হয়ে পড়েছে। একসময়ে ক্যামেরার নানা কারসাজিতে এসব কাজ করা হতো। বস্তুত এই দায়িত্বটি পড়ে গিয়ে সম্পাদকদের ঘাড়ে। বলার অপেক্ষা রাখেনা ডিজিটাল যন্ত্র কম্পিউটার দৃপ্তপদে প্রবেশ করেছে এই জগতেও। বস্তুত অসম্ভবের রাজ্যেই কম্পিউটারের পদচারণা। একুশ শতকে আমরা যখন অ্যানিমেশন নিয়ে কথা বলছি তখন কার্টুন চিত্রের জগতের সবচেয়ে নতুনতম যে দুটি ধারা ত্রিমাত্রিকতা ও বাস্তবতা সেই দুটিতেই নিবিষ্ট হচ্ছি আমরা। কম্পিউটারে অ্যানিমেশন মানে এখন এমন যে ফটোগ্রাফিকে অতিক্রম করে বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, দ্বিমাত্রা, ত্রিমাত্রায় পৌঁছাতে হবে আমাদের।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমাদের হাতে এখন সেইসব হাতিয়ার আছে যা দিয়ে আমরা প্রবেশ করতে পারি স্বপ্নলোকে।
অ্যানিমেশন স্বপ্নলোকের এক বর্ণাঢ্য সিঁড়ি। আমি মনে করি একদিন সিনেমাটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি যে নামে যে মিডিয়াতেই সৃজনশীলতার ধারাটি বহমান তাকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেবে ত্রিমাত্রিক বাস্তব অ্যানিমেশন।
আসলে আমরা আমাদের চারপাশে নিজের চোখে যা দেখি তা ত্রিমাত্রিক। কিন্তু আমাদের হাতে যে প্রযুক্তি রয়েছে তা দুটি মাত্রায় প্রকাশ করে। ফটোগ্রাফির কথাই ধরুন। কোনকিছুকে হুবহু সে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তার প্রকাশ হচ্ছে দুটি মাত্রায়। সে দৈর্ঘ ও প্রস্থ দেখে, কিন্তু উচ্চতা বা অন্য কোন মাত্রা সে ধারণ করতে পারেনা। এমনকি আজকালের সাধারণ কম্পিউটার ত্রিমাত্রাকে সহজে ধারণ করতে পারে না। ত্রিমাত্রা তৈরি করার কম্পিউটার প্রযুক্তিও সুলভ নয়। কিন্তু এমন দিন খুব দূরে নয় যখন ত্রিমাত্রাই হবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রকাশ মাধ্যম। আর কম্পিউটার যাচ্ছেও সেদিকেই।
অ্যানিমেশন কেমন করে : আমরা জানতে চাইবো কম্পিউটার ব্যবহার করে কেমন করে এই অ্যানিমেশনের কাজগুলো সম্পন্ন করা যায় সেটি। তবে মনে রাখা ভালো এই সীমিত সময়ের মাঝে অ্যানিমেশন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যাবে তা অন্ধের হাতি দেখার মতো। একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনার প্রয়োজন আছে।
আসলে যেকোন কাজ করার জন্যই কি কাজটি করা হবে তা আগে জানা দরকার। প্রথমেই আলোচনা করা যাক চিত্রনাট্য নিয়ে।
ক) চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট : অ্যানিমেশন বা অন্য যেকোন সৃজনশীল কাজ শুরু করার আগে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো একটি চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট তৈরি করা। বস্তুত যেকোন কাজের জন্যই এই স্ক্রিপ্ট দরকার। স্ক্রিপ্ট হচ্ছে একটি কনসেপ্ট বা ধারণার সুবিন্যস্ত রূপ। এটি গল্প হতে পারে। নাটক হতে পারে। চলচ্চিত্র হতে পারে। হতে পারে কোন ছোটখাটো বিজ্ঞাপন।
তবে এটি মনে রাখতে হবে যে বস্তুত একটি চমৎকার স্ক্রিপ্ট না হলে একটি ভালো চলচ্চিত্র যেমন হতে পারেনা তেমনি অ্যানিমেশনও হতে পারেনা।
আরো একটি বিষয় এখানে মনে রাখতে হবে যে স্ক্রিপ্ট লেখককে আসলে অ্যানিমেশন কি জিনিস সে বিষয়ে ধারণা নিয়ে অ্যানিমেশনের স্ক্রিপ্ট লিখতে বসতে হবে। যিনি ভালো গল্প বা উপন্যাস লেখেন তিনিই যে ভালো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরী করতে পারেন তা নয়। এমনকি যিনি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে পারেন, তিনি টিভির চিত্রনাট্য হয়তো ভালো করে লিখতে জানেননা। অ্যানিমেশন আরো একটি উন্নত ব্যাপার। এমন অনেক প্রযুক্তি আছে যা ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করা যায়না কিন্তু এনিমেশনে পারা যায়। আবার যিনি হাতে এঁকে অ্যানিমেশনের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের সাহায্যে অ্যানিমেশন কেমন করে কি করা যায় তা ঠিকমতো জানেন না। দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন এবং ডিজাইন এসব বিষয়ে জ্ঞান থাকা চিত্রনাট্যকারের দরকার। এমনকি আমি মনে করি কম্পিউটারের সাহায্যে অ্যানিমেশনের কাজ করতে পারার জন্য অ্যানিমেশন সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং সহযোগী এপ্লিকেশনগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার।
ফলে অ্যানিমেশনের সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি বিষয়কে উপস্থাপন করার জন্য এনিমেশন প্রযুক্তি আগে জানতে হবে এবং তারপর চিত্রনাট্য লিখতে বসতে হবে। একজন নাটক বা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচয়িতাই যে একটি এনিমেশন প্রজেক্টের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারবেন তা বলা কঠিন।
তবে প্রায় ক্ষেত্রেই মৌলিক ধারণাটি খুবই প্রয়োজনীয়। আমি মনে করি প্রচলিত নাটক, প্রচলিত টিভি মাধ্যম, প্রচলিত চলচ্চিত্র, প্রচলিত ফটোগ্রাফি, প্রচলিত আলোক ব্যবস্থাপনা এসব জ্ঞান যাদের আছে তারা তাদের বিদ্যমান জ্ঞানকে আরো শাণিত না আপডেট করে অ্যানিমেশনের জন্য চিত্রনাট্য তৈরির কাজে হাত দিতে পারেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা অগোছালোভাবে কাজ শুরু করি। এটি আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস। এটি আসলে খুবই খারাপ অভ্যাস। প্রয়োজন হলো, কি করতে চাই, কেমন করে করতে চাই, কি দিয়ে করতে চাই তা কাজ শুরুর আগেই ঠিক করে নেয়া। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ধার্মিকভাবে যা ঠিক করলাম তাকেই স্থির অনুসরণ করতে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে যেকোন সময়েই বদলে যেতে হবে। চিত্রনাট্য থেকে আরম্ভ করে ডিজাইন, অ্যানিমেশন বা রেন্ডারিং সবকিছুতেই পরিবর্তন করতে হতে পারে।
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী]
মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০২২ , ১৪ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩
মোস্তাফা জব্বার
আট ॥
অ্যানিমেশন বিষয়ে আরও আলোচনা করার আগে আমি এই খাতে আমাদের ব্যাপক প্রবেশের জন্য কিছু কার্যকর প্রস্তাব পেশ করতে পারি।
প্রথমত, আমাদের চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল করা হোক। সেখানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক এ্যানিমেশন শেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত। আমি নিজে বিজয় ডিজিটালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে চারুকলার ছাত্রছাত্রীদেরকে মাত্র ৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিলে তারা চমৎকার অ্যানিটের হতে পারে। আমি নিজের ঘরে এটিও প্রমাণ করেছি যে সাধারণ ফ্লাশ জানা প্রশিক্ষককে দিয়েই এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়।
দ্বিতীয়ত, সারা দুনিয়ায় আমরা যেমন সফটওয়্যার ও সেবা খাতের বাজার খুঁজি তেমন করে এ্যানিমেশনের বাজারও খুঁজতে পারি। ভারত যদি এত বড় বাজার পেতে পারে- আমরা কেন পারি না।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশীয় বাজারকে সম্প্রসারিত করতে হবে। বিনোদন, শিক্ষামূলক মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার, শিশুদের জন্য ভিডিও এবং চলচ্চিত্র তৈরী ছাড়াও আমরা দেশের বিজ্ঞাপন শিল্পে এ্যানিমেশন দিয়ে নতুন মাত্রা তৈরী করতে পারি।
চতুর্থত, দেশের মেধাসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রটিকে আমরা সঠিকপথে প্রবাহিত করতে পারি। এখন যেভাবে পাইরেসির রাজত্ব চলছে সেটিকে পরিবর্তন করে অন্তত দেশীয় মেধাসম্পদের যাতে পাইরেসি না হয় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সার্বিকভাবে অ্যানিমেশনকে একটি সম্প্রসারণশীল খাত হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আমরা একদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের রপ্তানিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারি।
অ্যানিমেশনের গোড়ার কথা : আমরা যদি মানুষের প্রকাশের ভাষার দিকে তাকাই তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, চিত্রকলা হচ্ছে মানুষের প্রাচীনতম সৃজনশীলতা। এর জন্ম মানুষের লিখিত ভাষার আগে। প্রথমে মানুষ আঁকতে শেখে, পরে আসে লিখিত ভাষা। লিখিত ভাষার জন্ম বস্তুত চিত্রকলা থেকে। সেই চিত্রকলা থেকেই জন্ম নেয় ফটোগ্রাফি। অ্যানিমেশনের জন্মও সেই চিত্রকলা থেকেই।
আমরা সবাই জানি, গাছের বাকলে লতায়- পাতায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে দাগ কেটে, পাথরে খোদাই করে মানুষ ছবি আঁকতো। একসময়ে ধারালো অস্ত্র বিদায় নেয়। আমরা পাই তুলি। রঙের জন্ম কিন্তু সেই অনেক আগে থেকেই। প্রকৃতি থেকে নিংড়ে নিয়েছি আমরা সৌন্দর্য। আর তার প্রকাশ ঘটেছে রঙের বর্ণছটায়। মিডিয়ারও পরিবর্তন হয়েছে এরই মাঝে। গাছের বাকল, লতাপতা থেকে কাগজ, কাপড়, প্লাস্টিক হয়ে কম্পিউটারের পর্দায় পৌঁছেছি আমরা। বলা যায় এসেছে প্রযুক্তি। একসময়ে যা অতি কষ্ট করে আঁকতে হতো তা-ই প্রযুক্তির বদৌলতে হুবহু ফ্রেমে বন্দী করা সম্ভব হলো। এর নাম দিলাম আমরা ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তি। আলোছায়ায় বন্দী করা ছাড়াও রাসায়নিক যৌগ দিয়ে বন্দী করলাম আমরা প্রতিকৃতি। এক সময়ে স্থির ফ্রেম হয়ে দাঁড়ালো সচল। নাম দিলাম চলচ্চিত্র।
মানুষ তো ওখানেও থেমে থাকেনি। সচল ছবিতে সে দিলো শব্দ। অবস্থা এখন এমন যে সচল ছবি আর শব্দকে বাদ দিলে আধুনিক মানুষকে ভাবা যায়না। অথচ ছবি আঁকা, ছবি তোলা, স্থির চিত্র বা সচল চিত্র কিংবা এর সঙ্গে শব্দের সংমিশ্রণÑ এসব একটি শেকড় থেকে উৎপন্ন হলেও এর প্রয়োগ, নান্দনিকতা, প্রভাব, বিস্তৃতি ইত্যাদি কিন্তু এক নয়। অ্যানিমেশন বলতে আমরা যাকে চিহ্নিত করি তাকে এই ভাবনা থেকে দূরে রাখা কঠিন। খুব সরাসরি বলতে গেলে একসময়ে কাগজে- বাকলে নানা উপকরণে আমরা যেসব হাস্যরসাত্মক, কল্প বা বৈজ্ঞানিক কাহিনীভিত্তিক ছবি আঁকতাম তাকে কার্টুন বলা হতো। পত্রিকার পাতায় এখনো আমরা সেই কার্টুন দেখি। কার্টুন বই বা কমিক সিরিজ এবং কার্টুন চিত্র দুয়েরই বোদ্ধা সমজদার হলো শিশু- কিশোর তরুণ তরুণীরা। ডিজনী পরিবারের কাছে এই দুনিয়া সেই কার্টুন জন্ম দেবার জন্য ঋণী।
অ্যানিমেশনের সূচনা নাগরিক সভ্যতার অধিবাসী সবার কাছেই পরিচিত। ছবিকে গতি প্রদান করাই হচ্ছে অ্যানিমেশন। তবে এতে ফটোগ্রাফি ব্যবহৃত না হয়ে অঙ্কিত চিত্র ব্যবহৃত হয়। সেজন্যেই আমরা ফটোগ্রাফির চলমানতাকে চলচ্চিত্র বা ভিডিও বলি। কিন্তু একে বলি এনিমেশন চিত্র বা কার্টুন চিত্র।
সচরাচর এক ধরনের অংকিত স্থির চিত্রকে বলা হয় কার্টুন। কালক্রমে স্থির কার্টুন চিত্র পায় গতি। হয়ে যায় কার্টুন চলচ্চিত্র। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমসাধ্য ছিলো কার্টুন দিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করা। লক্ষ লক্ষ শ্রম ঘণ্টায় তৈরী হয়েছে একেকটি কার্টুন চিত্র।
সেই সময়টি ছিলো আবার কেবল দ্বিমাত্রিকতার। উল্লেখ করা যেতে পারে কার্টুন চিত্রের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা ফটোগ্রাফির উপযুক্ত নয়। ফটোগ্রাফিতে যেখানে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন সেখানে কার্টুনে কল্পিত চরিত্র, কল্পিত দৃশ্য, কল্পিত ঘটনাপঞ্জি, হাস্য-রস সৃষ্টি কিংবা কল্পকাহিনীর জগত নিয়ে কার্টুন চিত্র বিকশিত হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে কার্টুন চিত্রে দুটি নতুন ধারা যুক্ত হয়েছেÑ ক) ত্রিমাত্রিকতা খ) বাস্তবতা।
এখন এমন কিছু কার্টুন চিত্র তৈরি হয়েছে যা পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র হিসেবেও সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছে।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রে বা সায়েন্স ফিকশন ভিত্তিক চলচ্চিত্রে বিশেষ দৃশ্য( যেমন মানুষের মাথা ফাঁক করে ফেলা- (টার্মিনেটর-টু), বিশেষ প্রাণী (যেমন- ডাইনোসর-জুরাসিস পার্ক বা গডজিলা), বিশেষ চরিত্র (সিন্দাবাদের ভূত-আলাদীনের দৈত্য) ইত্যাদির জন্য ফটোগ্রাফি অচল হয়ে পড়েছে। একসময়ে ক্যামেরার নানা কারসাজিতে এসব কাজ করা হতো। বস্তুত এই দায়িত্বটি পড়ে গিয়ে সম্পাদকদের ঘাড়ে। বলার অপেক্ষা রাখেনা ডিজিটাল যন্ত্র কম্পিউটার দৃপ্তপদে প্রবেশ করেছে এই জগতেও। বস্তুত অসম্ভবের রাজ্যেই কম্পিউটারের পদচারণা। একুশ শতকে আমরা যখন অ্যানিমেশন নিয়ে কথা বলছি তখন কার্টুন চিত্রের জগতের সবচেয়ে নতুনতম যে দুটি ধারা ত্রিমাত্রিকতা ও বাস্তবতা সেই দুটিতেই নিবিষ্ট হচ্ছি আমরা। কম্পিউটারে অ্যানিমেশন মানে এখন এমন যে ফটোগ্রাফিকে অতিক্রম করে বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, দ্বিমাত্রা, ত্রিমাত্রায় পৌঁছাতে হবে আমাদের।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমাদের হাতে এখন সেইসব হাতিয়ার আছে যা দিয়ে আমরা প্রবেশ করতে পারি স্বপ্নলোকে।
অ্যানিমেশন স্বপ্নলোকের এক বর্ণাঢ্য সিঁড়ি। আমি মনে করি একদিন সিনেমাটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি যে নামে যে মিডিয়াতেই সৃজনশীলতার ধারাটি বহমান তাকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেবে ত্রিমাত্রিক বাস্তব অ্যানিমেশন।
আসলে আমরা আমাদের চারপাশে নিজের চোখে যা দেখি তা ত্রিমাত্রিক। কিন্তু আমাদের হাতে যে প্রযুক্তি রয়েছে তা দুটি মাত্রায় প্রকাশ করে। ফটোগ্রাফির কথাই ধরুন। কোনকিছুকে হুবহু সে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু তার প্রকাশ হচ্ছে দুটি মাত্রায়। সে দৈর্ঘ ও প্রস্থ দেখে, কিন্তু উচ্চতা বা অন্য কোন মাত্রা সে ধারণ করতে পারেনা। এমনকি আজকালের সাধারণ কম্পিউটার ত্রিমাত্রাকে সহজে ধারণ করতে পারে না। ত্রিমাত্রা তৈরি করার কম্পিউটার প্রযুক্তিও সুলভ নয়। কিন্তু এমন দিন খুব দূরে নয় যখন ত্রিমাত্রাই হবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রকাশ মাধ্যম। আর কম্পিউটার যাচ্ছেও সেদিকেই।
অ্যানিমেশন কেমন করে : আমরা জানতে চাইবো কম্পিউটার ব্যবহার করে কেমন করে এই অ্যানিমেশনের কাজগুলো সম্পন্ন করা যায় সেটি। তবে মনে রাখা ভালো এই সীমিত সময়ের মাঝে অ্যানিমেশন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যাবে তা অন্ধের হাতি দেখার মতো। একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনার প্রয়োজন আছে।
আসলে যেকোন কাজ করার জন্যই কি কাজটি করা হবে তা আগে জানা দরকার। প্রথমেই আলোচনা করা যাক চিত্রনাট্য নিয়ে।
ক) চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট : অ্যানিমেশন বা অন্য যেকোন সৃজনশীল কাজ শুরু করার আগে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো একটি চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট তৈরি করা। বস্তুত যেকোন কাজের জন্যই এই স্ক্রিপ্ট দরকার। স্ক্রিপ্ট হচ্ছে একটি কনসেপ্ট বা ধারণার সুবিন্যস্ত রূপ। এটি গল্প হতে পারে। নাটক হতে পারে। চলচ্চিত্র হতে পারে। হতে পারে কোন ছোটখাটো বিজ্ঞাপন।
তবে এটি মনে রাখতে হবে যে বস্তুত একটি চমৎকার স্ক্রিপ্ট না হলে একটি ভালো চলচ্চিত্র যেমন হতে পারেনা তেমনি অ্যানিমেশনও হতে পারেনা।
আরো একটি বিষয় এখানে মনে রাখতে হবে যে স্ক্রিপ্ট লেখককে আসলে অ্যানিমেশন কি জিনিস সে বিষয়ে ধারণা নিয়ে অ্যানিমেশনের স্ক্রিপ্ট লিখতে বসতে হবে। যিনি ভালো গল্প বা উপন্যাস লেখেন তিনিই যে ভালো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরী করতে পারেন তা নয়। এমনকি যিনি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে পারেন, তিনি টিভির চিত্রনাট্য হয়তো ভালো করে লিখতে জানেননা। অ্যানিমেশন আরো একটি উন্নত ব্যাপার। এমন অনেক প্রযুক্তি আছে যা ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করা যায়না কিন্তু এনিমেশনে পারা যায়। আবার যিনি হাতে এঁকে অ্যানিমেশনের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের সাহায্যে অ্যানিমেশন কেমন করে কি করা যায় তা ঠিকমতো জানেন না। দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন এবং ডিজাইন এসব বিষয়ে জ্ঞান থাকা চিত্রনাট্যকারের দরকার। এমনকি আমি মনে করি কম্পিউটারের সাহায্যে অ্যানিমেশনের কাজ করতে পারার জন্য অ্যানিমেশন সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং সহযোগী এপ্লিকেশনগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার।
ফলে অ্যানিমেশনের সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি বিষয়কে উপস্থাপন করার জন্য এনিমেশন প্রযুক্তি আগে জানতে হবে এবং তারপর চিত্রনাট্য লিখতে বসতে হবে। একজন নাটক বা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচয়িতাই যে একটি এনিমেশন প্রজেক্টের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারবেন তা বলা কঠিন।
তবে প্রায় ক্ষেত্রেই মৌলিক ধারণাটি খুবই প্রয়োজনীয়। আমি মনে করি প্রচলিত নাটক, প্রচলিত টিভি মাধ্যম, প্রচলিত চলচ্চিত্র, প্রচলিত ফটোগ্রাফি, প্রচলিত আলোক ব্যবস্থাপনা এসব জ্ঞান যাদের আছে তারা তাদের বিদ্যমান জ্ঞানকে আরো শাণিত না আপডেট করে অ্যানিমেশনের জন্য চিত্রনাট্য তৈরির কাজে হাত দিতে পারেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা অগোছালোভাবে কাজ শুরু করি। এটি আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস। এটি আসলে খুবই খারাপ অভ্যাস। প্রয়োজন হলো, কি করতে চাই, কেমন করে করতে চাই, কি দিয়ে করতে চাই তা কাজ শুরুর আগেই ঠিক করে নেয়া। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ধার্মিকভাবে যা ঠিক করলাম তাকেই স্থির অনুসরণ করতে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে যেকোন সময়েই বদলে যেতে হবে। চিত্রনাট্য থেকে আরম্ভ করে ডিজাইন, অ্যানিমেশন বা রেন্ডারিং সবকিছুতেই পরিবর্তন করতে হতে পারে।
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী]