সড়ক বিপ্লবে দক্ষিণাঞ্চল

সজীব ওয়াফি

গত সপ্তাহের প্রথমদিকে মাওয়া হয়ে বরিশালে যাচ্ছিলাম। পদ্মা সেতু তখনো উদ্বোধন হয়নি। তবে হবে হবে একটা আমেজ। কাঁঠালবাড়ী ঘাটে উদ্বোধনী সমাবেশ মঞ্চ তৈরি হচ্ছিল, তৈরি হচ্ছিল অস্থায়ী কিছু তাবু ঘর। পাশাপাশি সমাপ্ত করা হচ্ছিল সেতুর শেষ সময়ের দুই পাড়ের নানা রকমের প্রস্তুতি। লঞ্চযোগে যখন পদ্মা পাড়ি দিচ্ছি প্রবল স্রোতের তীব্র ধাক্কায় যে কারও ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার ওপরে যেই না মাঝ নদীতে লঞ্চ নামলো সেই মুহূর্তে ঝড় শুরু হয়েছে, আকাশেও প্রচ- বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। লঞ্চ একবার এদিকে কাত হচ্ছে, তো আরেকবার ওদিকে কাত হচ্ছে। যাত্রীরাও এদিক সেদিক ছোটাছুটি করায় পরিস্থিতি আরও বেশি নাজুক। ঝড়বৃষ্টি কিছুটা কমলে, মুরব্বি গোছের মধ্যবয়স্ক টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত সহজ-সরল এক ভদ্রলোক নিশ্বাস নিয়ে বলেই ফেললেন, “এবারেই লঞ্চে শেষ যাচ্ছি, সেতুটা হওয়ায় ঝড় তুফানের মসিবত দিয়ে অন্তত মানুষজন মুক্তি পাবে।”

ভদ্রলোক কথা শেষ করতে দেরি, কিন্তু প্রতিউত্তর পেতে মোটেও দেরি নাই। তার কথা টেনে নিয়ে দুজন জানালো সেতু চালু হলেও তাতে নাকি সাধারণ মানুষ উঠতে দিবে না, একজন বললো সেতুর কাজই তো এখনো শেষ হয়নি, অন্য আরেকজন বললো ভারতের সুবিধার জন্য সরকার এই সেতু এত আগ্রহ নিয়ে করেছে। অন্য একজন আবার এ সমস্ত আলাপের বিরোধিতা করে ঝগড়া শুরু করে দিল। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম যে, এ সব আজগুবি তথ্য এরা পায় কই? এদের তথ্য দাতাই বা কারা? বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম ভাই জনসাধারণ যে সেতুতে চড়ে পদ্মা পার হতে পারবে না এই তথ্য কোথা থেকে শুনেছেন? জানালো সে একজনের কাছে শুনেছে, যার থেকে শুনেছে সে আবার নাকি মোবাইলে দেখেছে। এই হলো আমাদের তথ্য উৎসের আদ্যোপান্ত! কখনো শোনার শোনা, আবার কখনো গুজবের ডালপালা। অথচ আজব-গুজবে তর্কাতর্কি করা এ সব লোকগুলোই কিন্তু কিছুক্ষণ আগে লঞ্চে পানির ধাক্কায় বিপদ আশঙ্কায় মলিনমুখো হয়েছিল, বিপদ রক্ষার্থে স্মরণাপন্ন হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার।

গৌরচন্দ্রিকার মূলে প্রবেশের আগে একটু পূর্বেকার দিনগুলোতে ফেরা যাক। ২০১৪ সাল, আগস্টের প্রথম পক্ষ; পদ্মায় পানির প্রবল স্রোত এবং অস্বাভাবিক ঢেউ। ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরা প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়াঘাটের উদ্দেশ্য রওনা করে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। পদ্মায় পরা মাত্র উত্তাল ঢেউয়ে তলিয়ে যায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ফিটনেসবিহীন লঞ্চটি। মুহূর্তেই ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে মানুষের আহাজারিতে রূপান্তরিত হয় পদ্মা পাড়। পিনাক-৬ এর আগের লঞ্চে ঢাকায় ফেরার পথে ছিলাম আমরা আত্মীয়-স্বজনসহ। পেছনে তাকিয়ে আমরা শুধু দেখেছি মানুষের বাঁচার আকুতি কেমন হয়! সত্যি বলতে সেদিন আমাদের লঞ্চও প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা, অসহায়ের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের করার কিছুই ছিল না! তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটির মুষ্টিমেয়-সংখ্যক যাত্রী প্রাণে ফিরে আসলেও অধিকাংশেরই সেদিন সলিল সমাধি হয়েছে। অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, মেঘনা হয়ে ভেসে যাওয়া অনেকের লাশ আবার মিলেছে বরিশালের কোন উপকূলে। ভাগ্যক্রমে আগের লঞ্চে ওঠায় আমরা শুধু বেঁচে গেছি। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে শুধু সমালোচনাটাই করলেন, সেতু করতে মানুষের মাথা লাগবেসহ বিভিন্ন গুজব ছড়ালেন, সেতুটা যেন না হয় সে জন্য নানান মেকানিজম করলেন; মুহূর্তেই লাশ হয়ে যাওয়া আমাদের এতগুলো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আপনাদের হৃদয় কি এতটুকুও গলে না!

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় যোগাযোগ ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে তেমনি আর্থসামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। সঙ্গে সঙ্গে ২ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী এলাকার জিডিপি। পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ঢাকা শহরকে সম্ভব হবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে। তৈরি হবে টাইম ভ্যালু মানির কার্যকারিতা। অধিকতর সহজ হবে কৃষিপণ্যের পরিবহন ব্যবস্থায়। সরাসরি নতুনত্ব পাবে কমপক্ষে ২১ জেলার অর্থনৈতিক কর্মকা-। দূরের বরিশাল শহরে পৌঁছাবে গ্যাস এবং অপটিক্যাল ফাইবার লাইন। আরও খানিকটা অপেক্ষার পরে হয়তো ট্রেন ছুটবে পশ্চিমের দিগন্তে। কলকারখানা, স্কুল কলেজ, পর্যটন; মোটাদাগে বিশ্বায়ন এবং শিল্পায়নের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখবে দক্ষিণের জনগণ। কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। অথচ পূর্ববর্তী দিনগুলোতে যেই শরিয়তপুর-মাদারীপুরের অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর, অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল অবহেলিত; পরিচিত পেত চরাঞ্চল এবং দেশের সবচেয়ে বেশি নদীভাঙন এলাকা হিসেবে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম মোংলা এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর পুরোদমে চালু হওয়াও নির্ভর করছে পদ্মা সেতুর ওপর। সব চেয়ে বড় কথা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় আমাদের আর নামতে হচ্ছে না, থাকছে না কোন আত্মীয় স্বজন হারানোর ভয়।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন থাকতে পারে। বিরোধিতা থাকতে পারে টোল এবং ভাড়া নির্ধারণের পরিমাণ নিয়ে। কিন্তু এই স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারও ন্যূনতম কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং প্রতিবেশ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে এই নির্মাণযজ্ঞের বিরোধিতা করেছেন অথবা করছেন বা থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তা শুধু বাতুলতা। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা যে অনেকাংশে বেড়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। পদ্মা সেতু হয়তো ৪২টি পিলারের ওপরে দাঁড়ানো একটি নির্মাণ স্থাপনা, কিন্তু নানা চড়াই-উতরাইয়ে সব চেয়ে বৃহৎ যে পিলারটির উপরে গিয়ে ঠেকেছে তা হলো বাঙালির আত্মবিশ্বাস, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি।

ভালো কিছুর বিপরীতে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চিরাচরিত নিয়ম। সেই দিক থেকে পদ্মা পাড়াপাড়কে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-জীবিকা চলতো তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেই সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করার আহ্বান থাকবে। এমনকি সিলেটের বন্যা কিংবা চট্টগ্রামে রাসায়নিক ডিপোর আগুন যেমন দুঃসহ তেমনি মর্মান্তিক; পাশাপাশি অগ্রগতির কাক্সিক্ষত যাত্রাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে বয়সের দিক থেকে আজ ৫০ বছরে অতিক্রান্ত। এবার শুধু আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার প্রহর। দক্ষিণের সড়কে সেই হুইশেলই বাজছে, সড়ক যোগাযোগের বৈপ্লবিক হুইশেল। শত প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর এই স্পৃহা থেকেই সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন-

“শাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়:/ জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়। ”

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

মঙ্গলবার, ২৮ জুন ২০২২ , ১৪ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩

সড়ক বিপ্লবে দক্ষিণাঞ্চল

সজীব ওয়াফি

গত সপ্তাহের প্রথমদিকে মাওয়া হয়ে বরিশালে যাচ্ছিলাম। পদ্মা সেতু তখনো উদ্বোধন হয়নি। তবে হবে হবে একটা আমেজ। কাঁঠালবাড়ী ঘাটে উদ্বোধনী সমাবেশ মঞ্চ তৈরি হচ্ছিল, তৈরি হচ্ছিল অস্থায়ী কিছু তাবু ঘর। পাশাপাশি সমাপ্ত করা হচ্ছিল সেতুর শেষ সময়ের দুই পাড়ের নানা রকমের প্রস্তুতি। লঞ্চযোগে যখন পদ্মা পাড়ি দিচ্ছি প্রবল স্রোতের তীব্র ধাক্কায় যে কারও ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার ওপরে যেই না মাঝ নদীতে লঞ্চ নামলো সেই মুহূর্তে ঝড় শুরু হয়েছে, আকাশেও প্রচ- বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। লঞ্চ একবার এদিকে কাত হচ্ছে, তো আরেকবার ওদিকে কাত হচ্ছে। যাত্রীরাও এদিক সেদিক ছোটাছুটি করায় পরিস্থিতি আরও বেশি নাজুক। ঝড়বৃষ্টি কিছুটা কমলে, মুরব্বি গোছের মধ্যবয়স্ক টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত সহজ-সরল এক ভদ্রলোক নিশ্বাস নিয়ে বলেই ফেললেন, “এবারেই লঞ্চে শেষ যাচ্ছি, সেতুটা হওয়ায় ঝড় তুফানের মসিবত দিয়ে অন্তত মানুষজন মুক্তি পাবে।”

ভদ্রলোক কথা শেষ করতে দেরি, কিন্তু প্রতিউত্তর পেতে মোটেও দেরি নাই। তার কথা টেনে নিয়ে দুজন জানালো সেতু চালু হলেও তাতে নাকি সাধারণ মানুষ উঠতে দিবে না, একজন বললো সেতুর কাজই তো এখনো শেষ হয়নি, অন্য আরেকজন বললো ভারতের সুবিধার জন্য সরকার এই সেতু এত আগ্রহ নিয়ে করেছে। অন্য একজন আবার এ সমস্ত আলাপের বিরোধিতা করে ঝগড়া শুরু করে দিল। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম যে, এ সব আজগুবি তথ্য এরা পায় কই? এদের তথ্য দাতাই বা কারা? বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম ভাই জনসাধারণ যে সেতুতে চড়ে পদ্মা পার হতে পারবে না এই তথ্য কোথা থেকে শুনেছেন? জানালো সে একজনের কাছে শুনেছে, যার থেকে শুনেছে সে আবার নাকি মোবাইলে দেখেছে। এই হলো আমাদের তথ্য উৎসের আদ্যোপান্ত! কখনো শোনার শোনা, আবার কখনো গুজবের ডালপালা। অথচ আজব-গুজবে তর্কাতর্কি করা এ সব লোকগুলোই কিন্তু কিছুক্ষণ আগে লঞ্চে পানির ধাক্কায় বিপদ আশঙ্কায় মলিনমুখো হয়েছিল, বিপদ রক্ষার্থে স্মরণাপন্ন হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার।

গৌরচন্দ্রিকার মূলে প্রবেশের আগে একটু পূর্বেকার দিনগুলোতে ফেরা যাক। ২০১৪ সাল, আগস্টের প্রথম পক্ষ; পদ্মায় পানির প্রবল স্রোত এবং অস্বাভাবিক ঢেউ। ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরা প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়াঘাটের উদ্দেশ্য রওনা করে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। পদ্মায় পরা মাত্র উত্তাল ঢেউয়ে তলিয়ে যায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ফিটনেসবিহীন লঞ্চটি। মুহূর্তেই ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে মানুষের আহাজারিতে রূপান্তরিত হয় পদ্মা পাড়। পিনাক-৬ এর আগের লঞ্চে ঢাকায় ফেরার পথে ছিলাম আমরা আত্মীয়-স্বজনসহ। পেছনে তাকিয়ে আমরা শুধু দেখেছি মানুষের বাঁচার আকুতি কেমন হয়! সত্যি বলতে সেদিন আমাদের লঞ্চও প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা, অসহায়ের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের করার কিছুই ছিল না! তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটির মুষ্টিমেয়-সংখ্যক যাত্রী প্রাণে ফিরে আসলেও অধিকাংশেরই সেদিন সলিল সমাধি হয়েছে। অনেকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, মেঘনা হয়ে ভেসে যাওয়া অনেকের লাশ আবার মিলেছে বরিশালের কোন উপকূলে। ভাগ্যক্রমে আগের লঞ্চে ওঠায় আমরা শুধু বেঁচে গেছি। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে শুধু সমালোচনাটাই করলেন, সেতু করতে মানুষের মাথা লাগবেসহ বিভিন্ন গুজব ছড়ালেন, সেতুটা যেন না হয় সে জন্য নানান মেকানিজম করলেন; মুহূর্তেই লাশ হয়ে যাওয়া আমাদের এতগুলো মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আপনাদের হৃদয় কি এতটুকুও গলে না!

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় যোগাযোগ ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে তেমনি আর্থসামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। সঙ্গে সঙ্গে ২ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী এলাকার জিডিপি। পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানী ঢাকা শহরকে সম্ভব হবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে। তৈরি হবে টাইম ভ্যালু মানির কার্যকারিতা। অধিকতর সহজ হবে কৃষিপণ্যের পরিবহন ব্যবস্থায়। সরাসরি নতুনত্ব পাবে কমপক্ষে ২১ জেলার অর্থনৈতিক কর্মকা-। দূরের বরিশাল শহরে পৌঁছাবে গ্যাস এবং অপটিক্যাল ফাইবার লাইন। আরও খানিকটা অপেক্ষার পরে হয়তো ট্রেন ছুটবে পশ্চিমের দিগন্তে। কলকারখানা, স্কুল কলেজ, পর্যটন; মোটাদাগে বিশ্বায়ন এবং শিল্পায়নের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখবে দক্ষিণের জনগণ। কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। অথচ পূর্ববর্তী দিনগুলোতে যেই শরিয়তপুর-মাদারীপুরের অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর, অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল অবহেলিত; পরিচিত পেত চরাঞ্চল এবং দেশের সবচেয়ে বেশি নদীভাঙন এলাকা হিসেবে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম মোংলা এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর পুরোদমে চালু হওয়াও নির্ভর করছে পদ্মা সেতুর ওপর। সব চেয়ে বড় কথা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় আমাদের আর নামতে হচ্ছে না, থাকছে না কোন আত্মীয় স্বজন হারানোর ভয়।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন থাকতে পারে। বিরোধিতা থাকতে পারে টোল এবং ভাড়া নির্ধারণের পরিমাণ নিয়ে। কিন্তু এই স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারও ন্যূনতম কোন প্রশ্ন থাকার কথা নয়। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং প্রতিবেশ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যারা বিভিন্ন সময়ে এই নির্মাণযজ্ঞের বিরোধিতা করেছেন অথবা করছেন বা থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তা শুধু বাতুলতা। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা যে অনেকাংশে বেড়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। পদ্মা সেতু হয়তো ৪২টি পিলারের ওপরে দাঁড়ানো একটি নির্মাণ স্থাপনা, কিন্তু নানা চড়াই-উতরাইয়ে সব চেয়ে বৃহৎ যে পিলারটির উপরে গিয়ে ঠেকেছে তা হলো বাঙালির আত্মবিশ্বাস, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি।

ভালো কিছুর বিপরীতে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চিরাচরিত নিয়ম। সেই দিক থেকে পদ্মা পাড়াপাড়কে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-জীবিকা চলতো তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেই সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করার আহ্বান থাকবে। এমনকি সিলেটের বন্যা কিংবা চট্টগ্রামে রাসায়নিক ডিপোর আগুন যেমন দুঃসহ তেমনি মর্মান্তিক; পাশাপাশি অগ্রগতির কাক্সিক্ষত যাত্রাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে বয়সের দিক থেকে আজ ৫০ বছরে অতিক্রান্ত। এবার শুধু আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার প্রহর। দক্ষিণের সড়কে সেই হুইশেলই বাজছে, সড়ক যোগাযোগের বৈপ্লবিক হুইশেল। শত প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর এই স্পৃহা থেকেই সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন-

“শাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়:/ জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়। ”

[লেখক : প্রাবন্ধিক]