অধ্যক্ষের পদ দখল ও দ্বন্দ্বে নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর নেপথ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ দখল এবং শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজের কয়েকজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এ তথ্য জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, ভারতের বিতর্কিত রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে ওই কলেজের একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্র তার ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছে, যেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কোনও দায় নেই। তবে স্বার্থান্বেষীরা ওই ঘটনায় ‘সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা’ তৈরি করে ওই শিক্ষককে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন।

ঘটনার পর থেকে স্বপন কুমার বাড়িতে থাকছেন না। তার মেয়ে জানান, ঘটনার পর থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

অনেকেই এই ঘটনায় অভিযোগ তুলেছেন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্থানীয় বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে। স্বপন কুমার বিশ্বাস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার আগে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন আকতার হোসেন।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আকতার হোসেন। তিনি ঘটনার দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন বলেও দাবি করেন। যদিও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সোমবার (২৭ জুন)অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ঘটনার নেপথ্যে আকতারকে দায়ী করা হয়।

ওই সভায় উপস্থিত অনেকেই বলেন, ‘আবারও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার মানসে আকতার হোসেন ঘটনার দিন কলেজ শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের কাজে লাগিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছেন’।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস, নড়াইল পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সভাপতি অচিন চক্রবর্তী, নড়াইল শাহাবাদ মাজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আনোয়ার হোসেন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মলয় নন্দীসহ বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং পেশাজীবীরা অংশ নেন।

সভায় জেলা প্রশাসক এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঘটনার দিন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘সহিংসতা এড়িয়ে সবাইকে নিরাপদ’ রাখা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়ার বিষয়টি ‘তারা দেখেননি’। এ সময় ‘কলেজ গেটের কাছে ছিলেন তারা’।

জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার জানান, ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি টিম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের অন্য তদন্ত টিম কাজ করছে। ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে বাড়িতে থাকছেন না তিনি। স্বপন কুমার বিশ্বাসের মা ও অনার্স পড়ুয়া মেয়ে বাড়িতে আছেন।

স্বপন কুমার বিশ্বাসের মেয়ে শ্যামা বলেন, ‘বাবা নড়াইল শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় আছেন। বাবা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।’

ওই শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর অভিযুক্ত ছাত্রের বাবাও বাড়িতে থাকছেন না। তবে তার মা ও ভাই বাড়িতে আছেন।

কী ঘটেছিলো সেদিন

পুলিশ ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্র নিজের ফেইসবুকে ভারতের সাবেক বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে পোস্ট দেন। এ পোস্ট দেয়ার পর গত ১৮ জুন সকালে কলেজে আসেন ওই শিক্ষার্থী। তখন কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।

বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের নজরে আসে। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে এক পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের পরামর্শে ওই ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন।

এর মধ্যে ‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোড়ে। ঘটনার সময় অন্তত ১০ জন ছাত্র-জনতা আহত হন।

এদিকে, অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ এনে বিক্ষুদ্ধ জনতা ঘটনার দিন ১৮ জুন বিকেলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং ওই শিক্ষার্র্থীর গলায় জুতার মালা পরিয়ে পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেইসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।

জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

৮ দিন পর মামলা, গ্রেপ্তার ৩

অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত, শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পোড়ানো এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে ঘটনার ৮ দিন পর মির্জাপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মুরসালিন বাদী হয়ে সোমবার দুপুরে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আড়পাড়া গ্রামের মালেক মুন্সীর ছেলে মির্জাপুর বাজারের মোবাইল ফোন মেকার শাওন (২৮), মির্জাপুর গ্রামের সৈয়দ মিলনের ছেলে অটোচালক রিমন (২২) এবং একই গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক মনিরুল ইসলামকে (২৭) মঙ্গলবার (২৮ জুন) দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শিক্ষক নিরাপদে রয়েছেন। তিনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ অবস্থানে আছেন।’

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যা বলছেন

স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সকালে কিছু ছাত্র আমাকে ঘটনাটি জানালে আমি তিন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষিশিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম এবং স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।’

তিনি বলেন, ‘কলেজের যেকোন অঘটন ঘটলে আমি সব থেকে আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও একইভাবে তাদের জানালাম। এরই মধ্যে কলেজে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করছি। তখন কিছু ছাত্র কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও পাশের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। তখন আমি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককে ফোন করে ডেকেছি। তবে কেউ সময়মতো আসেননি। এরপর জড়ো হওয়া লোকজনের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আমার মোটরসাইকেলসহ শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়।’

তিনি দাবি করেন, ‘পরে পুলিশ এসে আমাকে বলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনাকে আমাদের হেফাজতে নিতে হবে। তখন আমি পুলিশের কাছে একটি হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট চাই। তবে আমাকে হেলমেট দেয়া হয়নি। একটি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দেয়া হলেও পরে তা পুলিশ খুলে নেয়। পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেয়ার সময় পেছন থেকে অনেকে আঘাত করেন। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পায়ের কিছু জায়গায় কেটে যায়। তখন অনুভব করি, পেছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করছে।’

স্বপন কুমার আরও বলেন, ‘কলেজে গেলে নতুন করে আবার হামলা হয় কি না, সেই শঙ্কায় আছি। তারপরও কলেজে ফিরতে চাই। কারণ আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে, তাদের ভরণ-পোষণের খরচ আমাকে বহন করতে হয়। কলেজের চাকরিই আমার আয়ের উৎস।’

প্রশাসন যা বলছে

নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ৩০ জুন প্রতিবেদন জমা দেবে।

নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফেইসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’

নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক একটা ঘটনা এখানে ক্যানসার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত জনতা যেন আবারও উত্তেজিত না হয়, সেজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচিন চক্রবর্তী বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। শুনেছি অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কে, কারা জড়িত তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে আমি আশাবাদী।’ তিনি বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঈদুল আজহার পর কলেজ খুলবে।

image

নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও সাভারে শিক্ষক হত্যার বিরুদ্ধে গতকাল ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ব্যানারের মূল সোগ্লাগান ছিল ‘শিক্ষকের গলায় জুতার মালা নৈতিকতার অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িকতার ছড়াছড়ি এর শেষ কোথায়?’ -সংবাদ

আরও খবর
ইভিএম জনপ্রিয় ও সহজ করায় জোর আওয়ামী লীগের
শিক্ষক লাঞ্ছনা, বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, ঘাতকের গ্রেপ্তার দাবিতে আল্টিমেটাম
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে বাসের ধাক্কা, টোল প্লাজার বেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত
বন্যা ঝুঁকি, নেপথ্যে প্লাবন ভূমি ও হাওর দখল

বুধবার, ২৯ জুন ২০২২ , ১৫ আষাড় ১৪২৮ ২৭ জিলকদ ১৪৪৩

অধ্যক্ষের পদ দখল ও দ্বন্দ্বে নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা

প্রতিনিধি, নড়াইল

image

নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও সাভারে শিক্ষক হত্যার বিরুদ্ধে গতকাল ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ব্যানারের মূল সোগ্লাগান ছিল ‘শিক্ষকের গলায় জুতার মালা নৈতিকতার অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িকতার ছড়াছড়ি এর শেষ কোথায়?’ -সংবাদ

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর নেপথ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ দখল এবং শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজের কয়েকজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এ তথ্য জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, ভারতের বিতর্কিত রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে ওই কলেজের একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্র তার ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছে, যেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কোনও দায় নেই। তবে স্বার্থান্বেষীরা ওই ঘটনায় ‘সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা’ তৈরি করে ওই শিক্ষককে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন।

ঘটনার পর থেকে স্বপন কুমার বাড়িতে থাকছেন না। তার মেয়ে জানান, ঘটনার পর থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

অনেকেই এই ঘটনায় অভিযোগ তুলেছেন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্থানীয় বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে। স্বপন কুমার বিশ্বাস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার আগে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন আকতার হোসেন।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আকতার হোসেন। তিনি ঘটনার দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন বলেও দাবি করেন। যদিও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সোমবার (২৭ জুন)অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ঘটনার নেপথ্যে আকতারকে দায়ী করা হয়।

ওই সভায় উপস্থিত অনেকেই বলেন, ‘আবারও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার মানসে আকতার হোসেন ঘটনার দিন কলেজ শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের কাজে লাগিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছেন’।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস, নড়াইল পৌর মেয়র আঞ্জুমান আরা, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সভাপতি অচিন চক্রবর্তী, নড়াইল শাহাবাদ মাজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আনোয়ার হোসেন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মলয় নন্দীসহ বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং পেশাজীবীরা অংশ নেন।

সভায় জেলা প্রশাসক এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঘটনার দিন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘সহিংসতা এড়িয়ে সবাইকে নিরাপদ’ রাখা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়ার বিষয়টি ‘তারা দেখেননি’। এ সময় ‘কলেজ গেটের কাছে ছিলেন তারা’।

জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার জানান, ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি টিম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের অন্য তদন্ত টিম কাজ করছে। ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে বাড়িতে থাকছেন না তিনি। স্বপন কুমার বিশ্বাসের মা ও অনার্স পড়ুয়া মেয়ে বাড়িতে আছেন।

স্বপন কুমার বিশ্বাসের মেয়ে শ্যামা বলেন, ‘বাবা নড়াইল শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় আছেন। বাবা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।’

ওই শিক্ষার্থীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর অভিযুক্ত ছাত্রের বাবাও বাড়িতে থাকছেন না। তবে তার মা ও ভাই বাড়িতে আছেন।

কী ঘটেছিলো সেদিন

পুলিশ ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্র নিজের ফেইসবুকে ভারতের সাবেক বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে পোস্ট দেন। এ পোস্ট দেয়ার পর গত ১৮ জুন সকালে কলেজে আসেন ওই শিক্ষার্থী। তখন কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।

বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের নজরে আসে। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে এক পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের পরামর্শে ওই ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন।

এর মধ্যে ‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোড়ে। ঘটনার সময় অন্তত ১০ জন ছাত্র-জনতা আহত হন।

এদিকে, অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ এনে বিক্ষুদ্ধ জনতা ঘটনার দিন ১৮ জুন বিকেলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং ওই শিক্ষার্র্থীর গলায় জুতার মালা পরিয়ে পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেইসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।

জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

৮ দিন পর মামলা, গ্রেপ্তার ৩

অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত, শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পোড়ানো এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে ঘটনার ৮ দিন পর মির্জাপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মুরসালিন বাদী হয়ে সোমবার দুপুরে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আড়পাড়া গ্রামের মালেক মুন্সীর ছেলে মির্জাপুর বাজারের মোবাইল ফোন মেকার শাওন (২৮), মির্জাপুর গ্রামের সৈয়দ মিলনের ছেলে অটোচালক রিমন (২২) এবং একই গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক মনিরুল ইসলামকে (২৭) মঙ্গলবার (২৮ জুন) দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শিক্ষক নিরাপদে রয়েছেন। তিনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ অবস্থানে আছেন।’

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যা বলছেন

স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সকালে কিছু ছাত্র আমাকে ঘটনাটি জানালে আমি তিন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষিশিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম এবং স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।’

তিনি বলেন, ‘কলেজের যেকোন অঘটন ঘটলে আমি সব থেকে আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও একইভাবে তাদের জানালাম। এরই মধ্যে কলেজে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করছি। তখন কিছু ছাত্র কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও পাশের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। তখন আমি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককে ফোন করে ডেকেছি। তবে কেউ সময়মতো আসেননি। এরপর জড়ো হওয়া লোকজনের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আমার মোটরসাইকেলসহ শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়।’

তিনি দাবি করেন, ‘পরে পুলিশ এসে আমাকে বলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনাকে আমাদের হেফাজতে নিতে হবে। তখন আমি পুলিশের কাছে একটি হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট চাই। তবে আমাকে হেলমেট দেয়া হয়নি। একটি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দেয়া হলেও পরে তা পুলিশ খুলে নেয়। পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেয়ার সময় পেছন থেকে অনেকে আঘাত করেন। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পায়ের কিছু জায়গায় কেটে যায়। তখন অনুভব করি, পেছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করছে।’

স্বপন কুমার আরও বলেন, ‘কলেজে গেলে নতুন করে আবার হামলা হয় কি না, সেই শঙ্কায় আছি। তারপরও কলেজে ফিরতে চাই। কারণ আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে, তাদের ভরণ-পোষণের খরচ আমাকে বহন করতে হয়। কলেজের চাকরিই আমার আয়ের উৎস।’

প্রশাসন যা বলছে

নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ৩০ জুন প্রতিবেদন জমা দেবে।

নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফেইসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’

নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক একটা ঘটনা এখানে ক্যানসার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত জনতা যেন আবারও উত্তেজিত না হয়, সেজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচিন চক্রবর্তী বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। শুনেছি অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কে, কারা জড়িত তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে আমি আশাবাদী।’ তিনি বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঈদুল আজহার পর কলেজ খুলবে।