ধ্রুপদী সাহিত্যের পরিমণ্ডল

সরকার মাসুদ

কাকে বলে ক্লাসিক লেখক? একজন কবি বা গধ্যশিল্পী যিনি বহুযুগ ধরে অগণন পাঠকের প্রশংসায় দীপ্যমান এবং নিজের রচনারীতির অনন্যতায় ভাস্বর হয়ে আছেন, তিনিই ক্লাসিক লেখক হিসেবে গণ্য। এই বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন যেমন শত শত বছর আগে প্রয়াত একজন লেখক তেমনি ষাট-সত্তর ছর আগে মৃত লেখকও। ‘উচ্চ’ অর্থে ‘ক্লাসিক’ শব্দটার প্রথম ব্যবহারকারী হচ্ছে রোমানরা। আর্থিক ও আভিজাত্যিক দিক থেকে সমাজে যারা সর্বোচ্চ হিসেবে বিবেচিত হতেন রোমনারা তাদেরই বলতো ‘ক্লাসিকাল’।

যতদূর জানি, প্রাচীন গ্রিকদের সামনে অনুসরণ করার মতো কোনও ক্লাসিক ছিল না। গ্রিকদের নিজেদের রচনা-সম্ভাবরই ছিল অত্যন্ত উঁচু দরের। গ্রিকরাই উত্তরকালে রোমানদের কাছে ধ্রুপদী লেখকের মর্যাদা পান। তারা যথেষ্ট শ্রম ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ গ্রিক লেককদের অনুকরণ শুরু করেন। বহু বছরের অনুকরণ পর্যায় শেষে তাদের সাহিত্যেও উচ্চমানের উৎকর্ষ নিয়ে আসেন সিসেরো, বার্জিল-এর মতো লেখকরা। তারপর রোমানরা যে অনেক শতাব্দী প্রায় একচেটিয়াভাবে ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজত্ব করে গেছে তার মূলে ছিল ওই ‘উচ্চ’ হওয়ার বাসনা ও লিখনশৈলীর অনন্যতার দিকে অখণ্ড মনোযোগ। আধুনিককালে গ্রিসের কবি নিকোস কাজানজাকিস যে ‘জোরবা দ্য গ্রীক’ নামে মহা উপন্যাস লিখলেন কিংবা ওয়েস্টইন্ডিজের কবি ডেরেক ওয়ালকট লিখলেন ‘ওমেরস’ নামের পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার মহাকাব্য, তা হয়তো সম্ভব হতো না ‘ইলিয়াড’, ‘অডিসি’, ‘প্যারাডাইস লস্ট’ বা শেকসপিয়রের রচনাসমগ্রের মতো অত্যুচ্চ দৃষ্টান্ত সামনে না থাকলে।

ক্লাসিক সাহিত্য আমাদের বিশেষ পছন্দের বস্তু। আমরা যখন তা পাঠ করি, পাঠ করি প্রধানত তার ধ্রুপদীত্বকেই। এই পছন্দের পেছনে অনেক কিছু আছে। মানুষের ভাবুক সত্তাকে সমৃদ্ধ করবার ক্ষমতা, উচ্চস্তরের সৃজনশীলতার দীপ্যমানতা, উত্তরসূরি লেখক ও পাঠকের মধ্যকার পূর্বাপর পারম্পর্য ও আরও কিছু জিনিস। ক্লাসিকের সমৃদ্ধ পরিমণ্ডলে থাকে মার্জিত রুচি, বিশেষ জ্ঞানবত্তা, সংযম ও শৃঙ্খলা। থাকে যুক্তিও, এমনকি কবিতার ক্ষেত্রেও। কেননা কবিকল্পনার উচ্চ স্বাধীনতা যদি যুক্তিকে নাকচ করে দেয় তাহলে সেই কাব্য বড় জোর ‘ভালো’ হতে পারে, ক্লাসিকের মর্যাদা সে কখনোই পাবে না। ধ্রুপদী সাহিত্যে আমরা ভাষা ও চিন্তার যে ধরনের সমন্বয় লক্ষ করি, যেরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিব্যক্তি, প্রাসঙ্গিক শব্দ বা বাক্যের প্রয়োগ দেখে থাকি তাতে আমার মনে হয়, ওই সার্বিক মান-এর জন্য সবার আগে লেখক নিজের কাছেই ঋণী; যেহেতু তিনি পণ ও শ্রমস্বীকার করে ওই রুচি অর্জন করেছেন। রুচি কেবল একটা বড় ব্যাপার নয়, নিয়ামকও বটে। সুরুচি অর্জন ব্যতিরেকে সুলিখিত সাহিত্য কখনোই সম্ভব নয়। এবং ধ্রুপদী সাহিত্যমাত্রই সুলিখিত রচনা।

সেকালের গুরুস্থানীয় লেখকদের (Old masters) সাহিত্যকর্ম গুরুত্বপূর্ণ তাদের প্রাচীনত্বের জন্যও। কিন্তু এটাই প্রধান কারণ নয়। ওই সকল গ্রন্থ বা রচনাকর্মের তাৎপর্য বুঝি রচনাশৈলীর উচ্চ শক্তিকে, সজীবতায়। ফলে আমরা এসব রচনার প্রতি গভীর ও অনুপম এক আকর্ষণ বোধ করি। আর এও অনুধাবন করি যে, শুধুমাত্র অমামুলি প্রতিভার জোরে একটি মহাকাব্য কিংবা এপিকমাত্রার একটি মহাউপন্যাস লেখা সম্ভব নয় যদি-না সেই লেখক হন কর্মযোগী। প্রসঙ্গত হোমারকে মনে পড়লো। মানবমনের সরস উচ্ছলতা এবং জগত-সংসারের অনন্ত বৈচিত্র্য হোমারের কাব্যের বিশিষ্ট দিক। এই হোমারও কিন্তু একটা আধাবর্বর যুগে প্রকৃত কর্মযোগী লেখকের প্রাণবন্ত ভাবমূর্তি ধারণ করেন। হোমারের পর সাহিত্যাঙ্গনে বড় ক্লাসিক লেখক হচ্ছেন ইসমাইলাস কিংবা সফোক্লিস। উভয়েই প্রাচীনত্বের প্রভায় ও মননসঞ্চারী সৃজনশীল বৃদ্ধিবৃত্তির মহিমায় দীপ্ত। হোমার, সফোফ্লিস, শেকসপিয়ার, মিলটন- যার কথাই বলি না কেন, বিষয় ভাবনা, অর্থসুষমা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা প্রয়োগের দিক থেকে একজন আরেকজনের থেকে আলাদা হলেও একটা বিষয়ে মিল আছে; সেটা হচ্ছে এরা প্রত্যেকেই সুরুচির ধারক এবং প্রত্যেকেই সৌন্দর্য আর যৌক্তিকতার মানদণ্ডসর্বস্ব কাব্যচিন্তার সংকীর্ণ গণ্ডিকে প্রবলভাবে নাড়া দিতে পেরেছেন।

ধ্রুপদী সাহিত্য রচনার কোনও এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট প্রণালী নেই। কাব্যপ্রেরণা, হৃদয়াবেগ ইত্যাদি অর্থহীন এমনটা ভাবা ভুল। আবার শুধু ভাবগাম্ভীর্য, পরিমিতি নির্ভুলতা ও আভিজাত্যের ধারণা কাজে লাগাতে পারলেই ক্লাসিক লেখক হওয়া যাবে এটাও ঠিক নয়। বরং এইসব ধ্যান-ধারণার পাশাপাশি যদি স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় আক্রান্ত হতে পারেন কোনো লেখক তাহলে তার লেখা দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা বেশি। যাবতীয় গুণপনা নিয়েও একজন লেখক নিশ্চিত হতে পারেননা কতদিন লোকে তার লেখা পড়বে। কেননা ওই যে অষফঁং ঐীঁষবু বলেছিলেন ‘সমকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যও পঞ্চাশ বছর পর ম্লান হয়ে যায়’- সেই উক্তির সারবত্তা তো আমরা উপলব্ধি করছি।

কিন্তু এমনও তো হয়েছে, আজ যারা ক্লাসিক লেখকের মর্যাদায় আসীন তাঁদের অনেকেই জীবৎকালে ও জীবদ্দশার কিছুকাল পরেও যোগ্য সম্মান পাননি। শেকসপিয়ারের রচনা অবশ্যই ধ্রুপদী সাহিত্য। অথচ আলেকজান্ডার পোপের যুগে তিনি ক্লাসিক লেখকরূপে আদৃত হননি। ড্রাইডেন, পোপরাই তখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে গণ্য হতেন। এরাও ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করেছেন; কিন্তু এদের স্থান আজ পেছনের সারিতে। রবার্ট ব্রাউনিভ জীবিত থাকার সময় তার স্ত্রীর কবিতা লোকে বেশি পছন্দ করতো। এবং কে না জানেন, রবীন্দ্রনাথ সে সময় তার অমর কাব্যসমূহ রচনা করে চলেছেন তখন তার কবিতা জনসমাজে সেভাবে আদর পায়নি, বরঞ্চ জনপ্রিয় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার মতো অন্য গৌণ কবিরা। আবার সুকবি অনেকেই ছিলেন; দূর অতীতের ইংরেজি কাব্যের ক্ষেত্রে যেমন গোল্ডস্মিথ বা লর্ড বায়রন। কিন্তু এদের কবি-ভাবমূর্তি কখনোই মিলটন বা টেনিসনের সমতুল্য হবে না। বাংলা সাহিত্যে দেখছি তিরিশের প্রজন্মের প্রায় সকলেই সুকবি। কিন্তু একজন জীবনানন্দ, এমনকি বিষ্ণু দে’র তুলনায় অন্যরা বেশ খাটো।

রাজা-বাদশাদের প্রাসাদগুলো যারা দেখেছেন, একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, সেগুলোর আকৃতি বড় বা মাঝারি যা-ই হোক না কেন ওইসব স্থাপনার নির্মাণশৈলী মোটামুটি এক রকমের। খুব কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে সূক্ষ্ম পার্থক্য চোখে পড়বে। কিন্তু দূর থেকে সব একই রকমের। ক্লাসিক সাহিত্য সম্বন্ধেও একই রকম কথা বলা চলে। মিলটনের ‘প্যারডাইস লস্ট’ বড় আকৃতির রাজপ্রাসাদ, মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ মাঝারি মাপের প্রাসাদের সমতুল্য। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ কিংবা মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ও তো প্রাসাদোপম কথাসাহিত্য বলে মনে হয়।

একেকটা যুগ আসে একেক ধরনের সাহিত্য রচনার অনুকূল পরিবেশ নিয়ে। মিলটন-পোপদের সময়ে তাই লেখা হয়েছে মহাকাব্য। শেলি-কিটসরা লিখছেন ওড। আবার টেনিসন-ব্রাউনিডরা অভ্যস্ত হয়েছিলেন ‘ড্রামাটিক মনোলগ’-এ যেখানে একজন কল্পিত শ্রোতা সামনে বসে আছেন এমন ভঙ্গিতে কবিতা লেখা হতো। এইসব কবির সকলেই বড় মাপের প্রতিভা লালন করেছেন নিজেদের ভেতর। কিন্তু মহৎ লেখকের ভেতরেও বড়-মাঝারি শ্রেণি-বিভাজন আছে। গ্যেটে ও শেকসপিয়ার এক মাপের নন। তেমনি ওয়ালীউল্লাহ ও ইলিয়াসকে আমরা একই পাত্রে রাখতে পারি না। তা সত্ত্বেও এরা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত তাতে সন্দেহ কি?

ক্লাসিক সাহিত্য পুরনো বন্ধু, পুরনো স্ত্রীর মতো পরীক্ষিত। তাই এর মান নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। কারণ আমরা জানি, শুধু মিল্টন বা মধুসূদনের মহাকবিতা নয়, কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’-এর মতো ছোট মাপের ক্লাসিকও তার নিজত্বের জায়গায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ- সাবলীল সৃজন প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর তাতে স্পষ্ট। সব ভাষাতেই মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন কয়েকজন লেখক। মাঝারি মানের লেখকরাই অজস্র। তাদের সবার লেখায় রূপমাধুরী ও শিল্পিতা যতোভাবে ধরা দিয়েছে এতখানি বৈচিত্র্য ক্লাসিক লেখকদের সাহিত্যেও নেই। তবু ধ্রুপদী সাহিত্যের গুণকীর্তন আমাদের করতেই হবে যেহেতু তা কেবল বৃহতের ধারণা ও নির্মল অনুভূতি উপহার দেয় না, চিরন্তন আনন্দের উৎসও হয়ে থাকে এবং রুচির মানদণ্ডকে নতুন করে বিচার করতে সাহায্য করে।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

ধ্রুপদী সাহিত্যের পরিমণ্ডল

সরকার মাসুদ

image

শিল্পী : ফিলিপ ডোয়ার্ড

কাকে বলে ক্লাসিক লেখক? একজন কবি বা গধ্যশিল্পী যিনি বহুযুগ ধরে অগণন পাঠকের প্রশংসায় দীপ্যমান এবং নিজের রচনারীতির অনন্যতায় ভাস্বর হয়ে আছেন, তিনিই ক্লাসিক লেখক হিসেবে গণ্য। এই বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন যেমন শত শত বছর আগে প্রয়াত একজন লেখক তেমনি ষাট-সত্তর ছর আগে মৃত লেখকও। ‘উচ্চ’ অর্থে ‘ক্লাসিক’ শব্দটার প্রথম ব্যবহারকারী হচ্ছে রোমানরা। আর্থিক ও আভিজাত্যিক দিক থেকে সমাজে যারা সর্বোচ্চ হিসেবে বিবেচিত হতেন রোমনারা তাদেরই বলতো ‘ক্লাসিকাল’।

যতদূর জানি, প্রাচীন গ্রিকদের সামনে অনুসরণ করার মতো কোনও ক্লাসিক ছিল না। গ্রিকদের নিজেদের রচনা-সম্ভাবরই ছিল অত্যন্ত উঁচু দরের। গ্রিকরাই উত্তরকালে রোমানদের কাছে ধ্রুপদী লেখকের মর্যাদা পান। তারা যথেষ্ট শ্রম ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ গ্রিক লেককদের অনুকরণ শুরু করেন। বহু বছরের অনুকরণ পর্যায় শেষে তাদের সাহিত্যেও উচ্চমানের উৎকর্ষ নিয়ে আসেন সিসেরো, বার্জিল-এর মতো লেখকরা। তারপর রোমানরা যে অনেক শতাব্দী প্রায় একচেটিয়াভাবে ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজত্ব করে গেছে তার মূলে ছিল ওই ‘উচ্চ’ হওয়ার বাসনা ও লিখনশৈলীর অনন্যতার দিকে অখণ্ড মনোযোগ। আধুনিককালে গ্রিসের কবি নিকোস কাজানজাকিস যে ‘জোরবা দ্য গ্রীক’ নামে মহা উপন্যাস লিখলেন কিংবা ওয়েস্টইন্ডিজের কবি ডেরেক ওয়ালকট লিখলেন ‘ওমেরস’ নামের পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার মহাকাব্য, তা হয়তো সম্ভব হতো না ‘ইলিয়াড’, ‘অডিসি’, ‘প্যারাডাইস লস্ট’ বা শেকসপিয়রের রচনাসমগ্রের মতো অত্যুচ্চ দৃষ্টান্ত সামনে না থাকলে।

ক্লাসিক সাহিত্য আমাদের বিশেষ পছন্দের বস্তু। আমরা যখন তা পাঠ করি, পাঠ করি প্রধানত তার ধ্রুপদীত্বকেই। এই পছন্দের পেছনে অনেক কিছু আছে। মানুষের ভাবুক সত্তাকে সমৃদ্ধ করবার ক্ষমতা, উচ্চস্তরের সৃজনশীলতার দীপ্যমানতা, উত্তরসূরি লেখক ও পাঠকের মধ্যকার পূর্বাপর পারম্পর্য ও আরও কিছু জিনিস। ক্লাসিকের সমৃদ্ধ পরিমণ্ডলে থাকে মার্জিত রুচি, বিশেষ জ্ঞানবত্তা, সংযম ও শৃঙ্খলা। থাকে যুক্তিও, এমনকি কবিতার ক্ষেত্রেও। কেননা কবিকল্পনার উচ্চ স্বাধীনতা যদি যুক্তিকে নাকচ করে দেয় তাহলে সেই কাব্য বড় জোর ‘ভালো’ হতে পারে, ক্লাসিকের মর্যাদা সে কখনোই পাবে না। ধ্রুপদী সাহিত্যে আমরা ভাষা ও চিন্তার যে ধরনের সমন্বয় লক্ষ করি, যেরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিব্যক্তি, প্রাসঙ্গিক শব্দ বা বাক্যের প্রয়োগ দেখে থাকি তাতে আমার মনে হয়, ওই সার্বিক মান-এর জন্য সবার আগে লেখক নিজের কাছেই ঋণী; যেহেতু তিনি পণ ও শ্রমস্বীকার করে ওই রুচি অর্জন করেছেন। রুচি কেবল একটা বড় ব্যাপার নয়, নিয়ামকও বটে। সুরুচি অর্জন ব্যতিরেকে সুলিখিত সাহিত্য কখনোই সম্ভব নয়। এবং ধ্রুপদী সাহিত্যমাত্রই সুলিখিত রচনা।

সেকালের গুরুস্থানীয় লেখকদের (Old masters) সাহিত্যকর্ম গুরুত্বপূর্ণ তাদের প্রাচীনত্বের জন্যও। কিন্তু এটাই প্রধান কারণ নয়। ওই সকল গ্রন্থ বা রচনাকর্মের তাৎপর্য বুঝি রচনাশৈলীর উচ্চ শক্তিকে, সজীবতায়। ফলে আমরা এসব রচনার প্রতি গভীর ও অনুপম এক আকর্ষণ বোধ করি। আর এও অনুধাবন করি যে, শুধুমাত্র অমামুলি প্রতিভার জোরে একটি মহাকাব্য কিংবা এপিকমাত্রার একটি মহাউপন্যাস লেখা সম্ভব নয় যদি-না সেই লেখক হন কর্মযোগী। প্রসঙ্গত হোমারকে মনে পড়লো। মানবমনের সরস উচ্ছলতা এবং জগত-সংসারের অনন্ত বৈচিত্র্য হোমারের কাব্যের বিশিষ্ট দিক। এই হোমারও কিন্তু একটা আধাবর্বর যুগে প্রকৃত কর্মযোগী লেখকের প্রাণবন্ত ভাবমূর্তি ধারণ করেন। হোমারের পর সাহিত্যাঙ্গনে বড় ক্লাসিক লেখক হচ্ছেন ইসমাইলাস কিংবা সফোক্লিস। উভয়েই প্রাচীনত্বের প্রভায় ও মননসঞ্চারী সৃজনশীল বৃদ্ধিবৃত্তির মহিমায় দীপ্ত। হোমার, সফোফ্লিস, শেকসপিয়ার, মিলটন- যার কথাই বলি না কেন, বিষয় ভাবনা, অর্থসুষমা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা প্রয়োগের দিক থেকে একজন আরেকজনের থেকে আলাদা হলেও একটা বিষয়ে মিল আছে; সেটা হচ্ছে এরা প্রত্যেকেই সুরুচির ধারক এবং প্রত্যেকেই সৌন্দর্য আর যৌক্তিকতার মানদণ্ডসর্বস্ব কাব্যচিন্তার সংকীর্ণ গণ্ডিকে প্রবলভাবে নাড়া দিতে পেরেছেন।

ধ্রুপদী সাহিত্য রচনার কোনও এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট প্রণালী নেই। কাব্যপ্রেরণা, হৃদয়াবেগ ইত্যাদি অর্থহীন এমনটা ভাবা ভুল। আবার শুধু ভাবগাম্ভীর্য, পরিমিতি নির্ভুলতা ও আভিজাত্যের ধারণা কাজে লাগাতে পারলেই ক্লাসিক লেখক হওয়া যাবে এটাও ঠিক নয়। বরং এইসব ধ্যান-ধারণার পাশাপাশি যদি স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় আক্রান্ত হতে পারেন কোনো লেখক তাহলে তার লেখা দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা বেশি। যাবতীয় গুণপনা নিয়েও একজন লেখক নিশ্চিত হতে পারেননা কতদিন লোকে তার লেখা পড়বে। কেননা ওই যে অষফঁং ঐীঁষবু বলেছিলেন ‘সমকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যও পঞ্চাশ বছর পর ম্লান হয়ে যায়’- সেই উক্তির সারবত্তা তো আমরা উপলব্ধি করছি।

কিন্তু এমনও তো হয়েছে, আজ যারা ক্লাসিক লেখকের মর্যাদায় আসীন তাঁদের অনেকেই জীবৎকালে ও জীবদ্দশার কিছুকাল পরেও যোগ্য সম্মান পাননি। শেকসপিয়ারের রচনা অবশ্যই ধ্রুপদী সাহিত্য। অথচ আলেকজান্ডার পোপের যুগে তিনি ক্লাসিক লেখকরূপে আদৃত হননি। ড্রাইডেন, পোপরাই তখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে গণ্য হতেন। এরাও ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা করেছেন; কিন্তু এদের স্থান আজ পেছনের সারিতে। রবার্ট ব্রাউনিভ জীবিত থাকার সময় তার স্ত্রীর কবিতা লোকে বেশি পছন্দ করতো। এবং কে না জানেন, রবীন্দ্রনাথ সে সময় তার অমর কাব্যসমূহ রচনা করে চলেছেন তখন তার কবিতা জনসমাজে সেভাবে আদর পায়নি, বরঞ্চ জনপ্রিয় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার মতো অন্য গৌণ কবিরা। আবার সুকবি অনেকেই ছিলেন; দূর অতীতের ইংরেজি কাব্যের ক্ষেত্রে যেমন গোল্ডস্মিথ বা লর্ড বায়রন। কিন্তু এদের কবি-ভাবমূর্তি কখনোই মিলটন বা টেনিসনের সমতুল্য হবে না। বাংলা সাহিত্যে দেখছি তিরিশের প্রজন্মের প্রায় সকলেই সুকবি। কিন্তু একজন জীবনানন্দ, এমনকি বিষ্ণু দে’র তুলনায় অন্যরা বেশ খাটো।

রাজা-বাদশাদের প্রাসাদগুলো যারা দেখেছেন, একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, সেগুলোর আকৃতি বড় বা মাঝারি যা-ই হোক না কেন ওইসব স্থাপনার নির্মাণশৈলী মোটামুটি এক রকমের। খুব কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে সূক্ষ্ম পার্থক্য চোখে পড়বে। কিন্তু দূর থেকে সব একই রকমের। ক্লাসিক সাহিত্য সম্বন্ধেও একই রকম কথা বলা চলে। মিলটনের ‘প্যারডাইস লস্ট’ বড় আকৃতির রাজপ্রাসাদ, মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ মাঝারি মাপের প্রাসাদের সমতুল্য। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ কিংবা মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ও তো প্রাসাদোপম কথাসাহিত্য বলে মনে হয়।

একেকটা যুগ আসে একেক ধরনের সাহিত্য রচনার অনুকূল পরিবেশ নিয়ে। মিলটন-পোপদের সময়ে তাই লেখা হয়েছে মহাকাব্য। শেলি-কিটসরা লিখছেন ওড। আবার টেনিসন-ব্রাউনিডরা অভ্যস্ত হয়েছিলেন ‘ড্রামাটিক মনোলগ’-এ যেখানে একজন কল্পিত শ্রোতা সামনে বসে আছেন এমন ভঙ্গিতে কবিতা লেখা হতো। এইসব কবির সকলেই বড় মাপের প্রতিভা লালন করেছেন নিজেদের ভেতর। কিন্তু মহৎ লেখকের ভেতরেও বড়-মাঝারি শ্রেণি-বিভাজন আছে। গ্যেটে ও শেকসপিয়ার এক মাপের নন। তেমনি ওয়ালীউল্লাহ ও ইলিয়াসকে আমরা একই পাত্রে রাখতে পারি না। তা সত্ত্বেও এরা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত তাতে সন্দেহ কি?

ক্লাসিক সাহিত্য পুরনো বন্ধু, পুরনো স্ত্রীর মতো পরীক্ষিত। তাই এর মান নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। কারণ আমরা জানি, শুধু মিল্টন বা মধুসূদনের মহাকবিতা নয়, কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’-এর মতো ছোট মাপের ক্লাসিকও তার নিজত্বের জায়গায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ- সাবলীল সৃজন প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর তাতে স্পষ্ট। সব ভাষাতেই মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন কয়েকজন লেখক। মাঝারি মানের লেখকরাই অজস্র। তাদের সবার লেখায় রূপমাধুরী ও শিল্পিতা যতোভাবে ধরা দিয়েছে এতখানি বৈচিত্র্য ক্লাসিক লেখকদের সাহিত্যেও নেই। তবু ধ্রুপদী সাহিত্যের গুণকীর্তন আমাদের করতেই হবে যেহেতু তা কেবল বৃহতের ধারণা ও নির্মল অনুভূতি উপহার দেয় না, চিরন্তন আনন্দের উৎসও হয়ে থাকে এবং রুচির মানদণ্ডকে নতুন করে বিচার করতে সাহায্য করে।