গীতাঞ্জলি শ্রীর গল্প

মার্চ, মা এবং সাকুরা

অনুবাদ : ফজল হাসান

আমার মা জাপানে এসেছেন এবং চারদিকে প্রস্ফুটিত সাকুরার বিস্ফোরণ ঘটেছে। কোনোভাবে আমি জানতাম যে, যেদিন আমি তাকে আনতে বিমানবন্দরে যাব, সেদিন সবকিছু কেমন হবে। আমি আগমন লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছি এবং প্রচলিত নিয়মের বিপরীতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি সময় মতো পৌঁছেছে। বিমান থেকে যাত্রীরা হেলদোল ভঙ্গিতে নেমে আসছে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে খুঁজছি। যদি তিনি হারিয়ে যান, তাহলে নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে বিশাল বিমানের কোনো এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকবেন। লোকজন ঢাউস আকৃতির মালপত্র টেনে নিয়ে যাবে। দিল্লিতে পরিবারের লোকজন নিশ্চয়ই মাকে বিমানে তুলে দিবে এবং তার ব্যাগ চেক ইন করবে। কনভেয়ার বেল্ট থেকে স্যুটকেস তাকে নিজের হাতে তুলতে হবে। তিনি কী তার স্যুটকেস চিনতে পারবেন এবং অন্যসব স্যুটকেসের মাঝ থেকে তুলতে পারবেন? বিষয়টা এমন না যে, তিনি হঠাৎ করে এসব জিনিস দেখতে শুরু করবেন। কেননা এখন তার বয়স হয়েছে। সর্বোপরি তিনি আমাদের গাড়ির রঙ এবং নম্বর মনে রাখতে পারেন না। গাড়িটি পিতাজি অথবা ভাই সাহাব চালাতেন এবং তিনি পেছনের আসনে বসে থাকতেন।

এসব নানান চিন্তা আমার মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। একসময় আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার মা অল্পবয়সী এক ছেলের সঙ্গে লাউঞ্জে হাঁটছেন। ছেলেটি তার নিজের মালপত্র এবং মায়ের স্যুটকেস বোঝাই একটি ট্রলি ঠেলছে। তখন মা তার কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছিলেন। আমি লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলাম এবং মায়ের ঠিক সামনে দাঁড়ালাম, যেন তার পক্ষে কিছুতেই আমাকে হারানোর কোনো সুযোগ না থাকে।

আমাকে দেখতে পেয়ে মা আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তার চোখেমুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে এবং আমার সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই লাজুক হাসি চাপা হাসিতে বদলে যায়। আমি নিচু হয়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। তারপর মাথা তুলে যুবকটির দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘সে-ও প্রথমবারের মতো জাপানে এসেছে এবং খুবই নার্ভাস। আমি তাকে বলেছি যে, আমার ছেলে বিমানবন্দরে আসবে এবং সে এখানেই থাকে; তুমি তাকে যেকোনো ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারো।’

তখনই আমার মনে হয়েছে যে, বিষয়গুলো কীভাবে পূর্ণতা পাবে, যদিও সেসব বিষয়ের সঙ্গে আমার একটি যোগসূত্র ছিল। বোধোদয় হওয়ার পর আমি আজ সে কথাই বলছি। যাহোক, আমার তখন জানা উচিত ছিল যে, মা এসেছেন এবং সাকুরা এ বছর প্রস্ফুটিত হবে। মার্চ আসার সময় মা আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন, কিন্তু মার্চ পরে এসেছিল।

প্রথম কয়েক মাস আমি অফিস থেকে দিনে কয়েকবার মাকে ফোন করেছি- ‘মা, কী করছ?’ আর আমার প্রশ্নের একই ধরনের কয়েকটি উত্তর ছিল মায়ের কাছে: ‘বাছা, আমি তোর কুর্তায় বোতাম লাগিয়েছি, এখন আমি স্নান করতে যাব’ অথবা ‘বাছা, আমি তোর জন্য গাজরের হালুয়া বানিয়েছি, আমি এখন ওয়াশিং মেশিন চালু করব।’ বেশিরভাগ সময় আমি তাকে বলেছি, ‘মা, আজ খুব ঝলমলে সুন্দর দিন, তুমি কেন বাইরে যাচ্ছ না? তুমি যদি দূরে কোথাও যেতে না চাও, তাহলে বাসার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করো।’ কিন্তু প্রতিবারই তিনি বলেন, ‘না, আমি হারিয়ে যাব।’ আমি তার কণ্ঠস্বর শুনে অনায়াসে বলতে পারি যে, কথা বলার সময় তার ঠোঁট দুটি ছোট কোনো মেয়ের মতো বাঁকানো থাকে।

‘ওহ্, কী যে বলো মা!’ কিন্তু তার সামনে আমার তিরস্কার হারিয়ে যায়।

‘কে তোমাকে দূরে যেতে বলছে?’ আমি হয়তো মাকে বলব। ‘এই সেই রাস্তা, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুমি আমার সঙ্গে হাঁটতে যাও।’

‘উহ্, আহ্,’ তিনি বলবেন। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হবে যেন তার মেজাজ খানিকটা চড়া এবং তিনি উন্নাসিক।

আমি তাকে আরো বেশি তিরস্কার করে বলব, ‘তুমি নিদেন হলেও যা করতে পারো, তা হল সুপারমার্কেটে গিয়ে দুধ, দই এবং ফলের রস

আনতে পারো।’

‘কিন্তু ফিরে আসার সময় আমি কাউকে পথের দিক-নির্দেশনার কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না।’

‘তুমি যে পথ ধরে যাবে, শুধু সে পথেই ফিরে আসবে। বোকা মা আমার! আর তুমি যদি এমনই ভীতু হও, তাহলে বাসার ঠিকানাসহ আমার কার্ড রেখে দিতে পারো। যে কেউ তোমাকে পথ দেখিয়ে দিবে... শুধু দেখাবেই না, বরং তোমার হাত ধরবে এবং বাসার দরজা পর্যন্ত এসে তোমাকে পৌঁছে দিবে।’

‘এখন দেখ, তুই কি বলছিস! আমি কি অন্য কারোর হাত ধরে হাঁটব? আর আমি যদি দরজার তালা খুলতে না পারি, তবে? তুই তো ভাল করেই জানিস এখানে তালা কেমন। প্রথমে ডানে ঘুরাও এবং তারপর বামে... না, অবশ্যই না!’

‘মা, বাইরে ঘুরতে যাও,’ আমি তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলব।

‘না রে, বাছা!’ তিনি বলবেন। তিনি আপনমনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘আমি ঘরে ভাল আছি। তুই এলে আমি তোর সঙ্গে বাইরে যাব।’

কোনো এক সন্ধ্যায় আমি মায়ের সঙ্গে ছলচাতুরি করি; ‘দেখ, তোমার জন্য আমি অফিস থেকে সোজা বাসায় আসি এবং অন্য কোথাও যেতে পারি না। কারণ তুমি সারা দিন বাড়ি সম্পর্কে মিথ্যা বলেছ, আদৌ তুমি বাইরে যাওনি... সত্যি, এখন থেকে তোমাকে একাকী বাইরে যেতে হবে, এমনকি যদিও জায়গাটি বাসার আশেপাশে কোথাও হয়...’ তিনি উপদেশমূলক ভঙ্গিতে আঙুল তুলে আমার দিকে কঠোর স্থিরদৃষ্টিতে তাকাবেন; ‘দেখ বাছা, এখন এসব কিছু বলিস না, ভুলে যাস না যে, আমার এখন কত বয়স!’ আর সেসময় সেফটিপিন তার হাতের চুড়িতে আটকে যাওয়ায় তিনি রীতিমত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন।

যাহোক, ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে আসছে এবং গাছের প্রতিটি ডালে নতুন কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। মাছের দোকানের ছেলেটির সঙ্গে মা নড়বড়ে ইংরেজিতে আলাপ করা শুরু করেছেন। জাপানি ছেলেটি মার কাছে ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চায় তিনি কেমন করে মাছ রান্না করবেন এবং ভারতীয় মা আধো আধো ইংরেজিতে বলেন যে, তিনি মাছের চাটনি তৈরি করবেন এবং ওর কাছে এক বোয়াম পাঠাবেন। নড়বড়ে ইংরেজিতে তাদের কথাবার্তা শুনলে যেকোনো ইংরেজের মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠবে এবং তার মুখ চাটনিতে পরিণত হবে!

আর তারপর, হয়তো একবারের বেশি নয়, তবে নিশ্চিত একবার, আমি দেখেছি মাছের দোকানের ছেলেটি মায়ের বাজারের থলি বহন করেছিল এবং মা তার হাতের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে ওর আগে হেঁটে বাসায় ফিরেছেন। তিনি ব্যাগ থেকে চাবি বের করেছেন এবং তালার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন। প্রথমে বামে ঘুরান, পরে ডানে।

আমি একদিন বাসায় ফিরে দেখি পাশের বাসার ছেলেটি আগ্রহ নিয়ে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাচ্ছিল। ‘তুমি ভারতীয় খাবার পছন্দ করো,’ ছেলেটি আমাকে বলল এবং তা কেবল তার সীমিত ইংরেজির কারণেই সে আমাকে ‘আমি’-এর পরিবর্তে ‘তুমি’ বলেছে। মা হাসতে শুরু করেন এবং ছেলেটির গাল স্পর্শ করেন। মায়ের হাত দীর্ঘ সময় ছেলেটির গালে আটকে ছিল এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তাদের মধ্যে একধরনের রসিকতা আছে। কিন্তু তা থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। মা যেভাবে ছেলেটির গালে হাত রেখেছিলেন, সম্ভবত একটু বেশি সময়ের জন্য এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ দিয়ে, তা নজরে পড়ার পরপরই আমি আমার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিই। এ ঘটনাই তখন ঘটেছিল।

ছেলেটি চলে যাওয়ার পরে আমি মাকে বললাম, ‘মা, এ দেশের নিয়ম হল মাথা নিচু করে সম্মান দেখানো এবং তুমি দেখেছ ওরা কীভাবে করে।’ তারপর আমি বিব্রতকর নিস্তব্ধতার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমি আর কী বলতে পারতাম? আমি কীভাবে তাকে এখন এমন কিছু বলতে পারি, যা আগে কখনো বলিনি?

আমি যা বললাম, তা গ্রহণ করার উপায় ছিল মায়ের এবং তারপর তিনি বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যান, যা আমাকে বেশ নির্বাক করে দিয়েছে। এটা সত্যি ছিল যে আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা, দিনের বেলা শাড়ি এবং রাতে শোবার পোশাক পরা ছেড়ে দাও। আমার কুর্তা এবং পায়জামা পরলে তুমি আরো বেশি আরাম পাবে।’ যখন তিনি বিছানায় যাচ্ছিলেন, তখন আমি এসব কথা বলেছি। অবশ্যই আমি বেশি কিছু বলিনি এবং আমরা এ বিষয়েই কথা বলছিলাম, তাই নয় কী? যাহোক, দিনের বেলায় মা আমার কুর্তা এবং পায়জামা পরা শুরু করেন, প্রথমে একাকী এবং পরে ছেলেটির সম্মুখে, যে ভারতীয় খাবার গোগ্রাসে খাওয়ার জন্য নিয়মিত হাজির হত। মা আমার সুন্দর কুর্তা আর আলিগরী পায়জামা কেটে ছোট করে নিয়েছেন এবং সেগুলো পরা শুরু করেছেন। এসব পোশাকের উপর তিনি আমার উলের ওয়েস্টকোট পরেন।

‘বাইরে যাচ্ছ?’ তখনো আমি আমার প্রশ্ন শেষ করিনি যখন মা তার কুর্তার, আসলে আমার, উপরে তার পাশমিনা শাল জড়াচ্ছিলেন। তারপর তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘আমি মুক্ত জীবনের অনুভূতি পছন্দ করি! কী ধরনের পোশাক পরা যায় এবং কী ধরনের পরা যায় না, তা বলার জন্য কেউ না থাকাই ভাল।’ একটু থেমে তিনি আরো বললেন, ‘এখানে কেউ জানে না আমার পোশাক কেমন হওয়া উচিৎ।’

ঠিক আছে, আমি তা জানি। কিন্তু কথাটা তাকে বলার কোনো উপায় আমার ছিল না।

এখন আমি লক্ষ্য করছি যে, মা আমার সঙ্গে টোকিওতে ঘুরে বেড়ানোর সময় সমস্ত স্টেশনের নাম মুখস্থ করেছেন। এছাড়া তিনি মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন। ‘ওহ, তাহলে এখানে একটাই মাত্র বের হওয়ার পথ... ঠিক আছে, তবে তো ভালই হলো, হারিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। “দেগুচি” অর্থাৎ ‘প্রস্থান’, তিনি গর্ব করে বললেন। ‘এটা হলো নাকানো শিমবাসি, অর্থাৎ “এখানে বসো”, তিনি কথা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং নিজেকে বলতে থাকেন অবশ্যই তার কী করা প্রয়োজন। ‘নাকানো সাকাউই’। “অন্য দিকের দরজা খুলেছে, নেমে পড়ুন”,’ তিনি মকশো করার ভঙ্গিতে আবার বললেন। ‘শিনজুকুতে যাওয়ার ট্রেন ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে আছে... শুধু প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে উঠে পড়,’ তিনি আমাকে জানালেন। ‘আর তারপর তা সে ইয়োতসুয়া হোক বা ওরফে সাকা মিতসুকে হোক, অথবা গিনজা কিংবা টোকিও, বা ওতেমাচি, বা আচোনামাজু...’

তিনি শেষ শব্দটি উচ্চারণ করে আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। কেননা বলার সময় তিনি আচোনামাজু শব্দটি অত্যন্ত দ্রুত উচ্চারণ করেন এবং একসময় আমি শব্দটা তার সামনে বলেছিলাম। তবে কী আমি সত্যিই তার ত্রুটিপূর্ণ জাপানি উচ্চারণের জন্য তাকে তিরস্কার করছিলাম?

‘তুই যদি চাস, তবে সোজাসুজি ইকেবুকুরো শেষ স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারিস... তাহলে তো ভালই হয়!’ তিনি উৎসাহের সঙ্গে এমনভাবে চিৎকার করে উঠলেন, যেন আমি এ বিষয়ে তার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি এবং তিনি আমাকে বুঝিয়ে বিস্তারিত বলছেন, যদিও এ সম্পর্কে বলাটা তার পক্ষে মোটেও কঠিন কিছু নয়। আর তিনিই আমাকে এ কথা বলেছেন, ‘তুই যদি শিনজুকু গিওয়েন অথবা বাগিচায় যেতে চাস, তাহলে অবশ্যই শিনজুকুতে নামবি না, বরং দুই স্টেশন পরে শিনজুকু গিওয়েন মায়ে নেমে যাবি।’

‘আমি শিনজুকু গিওয়েনে যাচ্ছি,’ একদিন তিনি আমাকে অফিসে ফোন করে বলেছেন। ‘ছেলেটির সঙ্গে যাচ্ছি, যে আমার সাথে ভারত থেকে এসেছে, দুশ্চিন্তা করিস না।’

বিষয়টা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে, এমনকি ভীষণ চিন্তায় ফেলেছে। কোথা থেকে মা এসব ছেলেদের খুঁজে পেয়েছেন? কেন তিনি আলতো করে ওদের গালে চাপড় দেন? আমি বুঝতে পারি আমার কান গরম হতে শুরু করেছে। তোমার বয়স ভুলে যাওয়া আমার উচিত নয়, তুমি আমাকে তাই বলেছ, মা- আমার কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমি ভাবছিলাম।

আমরা প্রায় মার্চে পা রেখেছি।

এক সন্ধ্যায় মা আমাকে দারুণ উৎসাহের সঙ্গে অবহিত করেন, ‘আমি সাকুরার কুঁড়ি দেখেছি।’

‘তুমি কী নিয়ে বলছ?’ আমি খিটখিটে মেজাজে বললাম। ‘সাকুরার কুঁড়ি আসতে এখনো ঢের সময় বাকি আছে।’

‘ঠিক এ সময়ে কেমন করে সাকুরার কুঁড়ি ফুটবে?’ তিনি বললেন। আমার চেয়ে তার কণ্ঠস্বরে বেশি অবজ্ঞা ছিল। তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করছিল, যেন তাকে প্রথমে সেখানে যেতে হবে এবং তার চোখের সেই জ্বলন্ত আগুন সাকুরা গাছের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে হবে; তবেই সাকুরা প্রস্ফুটিত হতে পারে।

‘আমি বাড়িতে নেই, আছি কী?’ তিনিও হেসে উঠেন। ‘তবে তোদের পাড়ায় মাত্র একটি সাকুরা গাছ আছে,’ তিনি আমাকে বললেন। তাকে পাশের বাসার ছেলেটি বলেছে এবং গাছটি দেখিয়েছে।

‘আয়, চল যাই, দেখে আসি,’ তিনি বললেন। ট্র্যাফিক বাতি পেরিয়ে তিনি হাসতে শুরু করেন; ‘আমি এমন একজন ভিআইপি, যার জন্য বাতি সবুজ হয় এবং জনস্রোত থেমে যায়!’ তিনি ট্র্যাফিক বাতি বোতাম টিপে ধরেন এবং তারপর খোরগোশের মতো চঞ্চল গতিতে রাস্তা অতিক্রম করেন। ‘আয়, দেখে নেওয়া যাক সাকুরা দেখতে কেমন লাগে!’ তিনি বললেন এবং বলেই আমার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে খানিকটা লজ্জা পান। আর আমরা পাড়ার একমাত্র সাকুরা গাছ দেখার জন্য ছোট ছেলেমেয়েদের মতো বেরিয়ে পড়ি।

অবশেষে মার্চ মাস আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাতাস পাগলামি শুরু করেছে। সাকুরা শাখায় ঝাঁকুনি এবং প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য অস্থির কুঁড়ি সম্পর্কে টেলিভিশন অন্যান্য জরুরি বিষয় প্রচারের মাঝে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করছে।

‘হোক্কাইডোতে সাকুরা প্রস্ফুটিত হবে না। সেখানে এখনো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।’ মা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে ছবি দেখেছেন। তাই হয়তো তার চোখের সামনে নতুন কুঁড়ি নাচছে।

আমি হাসলাম। বললাম, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভাবছ যে, তুমি ওখানে না গেলে সাকুরার কুঁড়ি আসবে না।’ মা মাথাটা একটু পেছনে সরিয়ে নেন এবং আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙেন।

‘আমি সব জায়গায় যেতে চাই, দেখতে চাই সবকিছু। আমি হোক্কাইডোতেও যেতে চাই।’ আমার মনে হয়েছিল যে, মা সেসব কুঁড়ির জন্য আফসোস করছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন তিনি হোক্কাইডোতে না গেলে সাকুরা কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হবে না।

‘তোমাকে ছোট্ট মেয়ের মতো মনে হয়, আম্মা’, আমি স্নেহমাখা আদুরে গলায় বললাম।

তখনো তার হাত একই ভঙ্গিতে প্রসারিত। মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমার বয়স সত্তর বছর, বাছা। এখন আমি কী নিয়ে ভয় করব?’

মাথা ঝাঁকানোর জন্য তার কুর্তার হাতা ঘাড় থেকে সামান্য সরে গেছে এবং তখন দেখতে পেলাম তার হাতের ঝুলঝুলে মাংস।

আমার মায়ের বয়স সত্তর বছর। আমার বাবার দৃষ্টি খুব ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি মায়ের অবস্থা দেখতে পারেননি। সুতরাং তার জীবনের প্রথম বারের মতো তিনি পেছনে সবকিছু ফেলে বিনা বাধায় এখানে এসেছেন।

‘তুমি কি একাই এসেছ?’ আমি রীতিমত ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করি। একদিন তাকে আমার অফিসের বাইরে দেখতে পেয়ে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি।

আমি সাবওয়েতে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকি, কিন্তু তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটায় ব্যস্ত ছিলেন। হারজুকুতে তিনি প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত রৌপ্য আসন দেখে তারুণ্যের উদ্দীপনা নিয়ে জেগে উঠেছেন। তিনি আমার হাত ধরেন এবং দরজার দিকে লাফ দেন। তখনই দরজাটা বন্ধ হতে যাচ্ছিল। এমনকি তখন আমার জিজ্ঞেস করার কোনো সময়ও ছিল না যে, তিনি কী করতে চান। তবে এটি রীতিমত অলৌকিক ঘটনা ছিল যে, আমাকে ভেতরে রেখে তিনি একা নেমে যাননি। আমাদের উভয়েরই হাত দরজা ধরেছিল। তিনি আমাকে টানতে থাকেন এবং ইয়োইয়োগি পার্কের গেটের সামনে গিয়ে থামেন।

‘ডানে, নাকি বামে?’ তিনি বিড়বিড় করেন এবং তারপর বাম দিকে মোড় নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।

‘আমি চিনি, আমি চিনি’, আমার ভেতরের বৃদ্ধ মানুষটি হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বলল। ‘তিনি আগেও ওই ছেলেদের মধ্যে একজনের সঙ্গে এখানে এসেছেন, হয়তো একাধিকবার।’

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশ মেঘে ঢাকা এবং একসময় আমাদের সামনে সাকুরা গাছের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে। মা তাকিয়ে দেখছিলেন এবং আমাকেও দেখাচ্ছিলেন। আর তখনই কুঁড়িগুলো নড়তে শুরু করে। সেই সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে সাকুরা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে এবং চাঁদের আলোয় বালির গাঢ় গোলাপী শস্যের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমি ছাতা খুলি এবং আমরা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।

তারপর আমার হাতে করার মতো কিছুই ছিল না; মা আমার হাত পিছলে সরে যান, ঠিক বালির চকচকে শস্যের মতো। আমার পরিবার যখন দিল্লি থেকে ফোন করেছিল, তখন আমি কীভাবে ব্যাখ্যা করে বলব, তা জানতাম না। আমি বাসায় ছিলাম, কিন্তু মা কোথায়...?

মার্চ মাস, কেবল মার্চের মতোই ক্ষণস্থায়ী, ইতোমধ্যে চলে এসেছে। আর আমার মাকে অনুসরণ করে সমস্ত টোকিও যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই মায়ের মতো চিৎকার করছে, ‘সাকুরা, সাকুরা!’ ‘পরের সপ্তাহের জন্য সবুর করো... মাত্র আর চারটা দিন... রোববারের মধ্যেই সাকুরা পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হবে!’

প্রায়শই দেখা যায় যে, যারা ঘটনার প্রারম্ভে নিজেদের ভারসাম্যপূর্ণ বা বিচক্ষণ বলে দাবি করেন, তারা কোনো উৎসবের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার পরে মনের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। আমিও তাই এবং খুব শীঘ্রই নিজেকে মায়ের মতো গান গাইতে শুনি; তিনি তার সুরের মূর্ছনা যেন সমস্ত টোকিওতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

সমুদ্রের মতো স্ফীত হয়ে সাকুরা সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়েছে। টোকিওর অন্যদের মতো আমার মা তার মাথা পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ উপরের দিকে তুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে কেবলমাত্র পুরো প্রস্ফুটিত সাকুরার ঝাপসা সাদা ফুল দেখা যাচ্ছিল। তিনি শুধু হাঁটছিলেন। এটা স্পষ্ট যে, মানুষ যখন উপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটে, তখন তাদের পদক্ষেপ সমান হয় না। আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন সাকুরার উল্লাস আমাদের পদক্ষেপের সঙ্গে দুলছিল এবং সাকুরার সমস্ত আনন্দ যেন গাছের নিচে রাখা খাবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল এবং বোতলের ছিদ্র গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল।

চিডোরিগাফুচি পার্কে সাকুরা গাছে যত ফুল আছে, গাছের নিচে তত মানুষ। মা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, কারণ এ পার্কে এমন কিছু আছে, যা ব্যতিক্রম এবং উল্লেখযোগ্য। আজ টোকিওর অন্যসব এলাকা ফাঁকা হয়ে গেছে। এখানে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি এবং ফুলের ভিড়ে আকাশ যেন পেছনে সরে গেছে। শুধু ফুল আর মানুষ। লোকজন ইচ্ছে মতো বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলছে। কেউ কেউ ক্লোজআপ, আবার অনেকে এক হাত দিয়ে গাছ জড়িয়ে ধরেছে। উচ্ছ্বসিত অনেকেই গান গাইছে, খাওয়া-দাওয়া করছে, আনন্দে মেতে উঠেছে- সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে দিনটি উদযাপন করছে। মা হাঁটতে শুরু করেন এবং থেমে যান। তারপর মাত্র আরেকবার থামার জন্য পুনরায় হাঁটা শুরু করেন।

এক পাশে নদী এবং নদীর তীর ঘেঁষে সাকুরা। সামনের দিকে দালানকোঠা।

‘ওটা কী?’ মা দালানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

‘ফেয়ারমন্ট হোটেল’, আমি বললাম।

মা থামলেন এবং পাশের একটা হেলানো পাথরের উপর দাঁড়ালেন। সাকুরার একটা ডাল হেলে পড়েছে, যা তার ঠোঁটের খুবই কাছে।

‘আমি অনায়াসে চুমু খেতে পারি,’ মা বললেন। ইতোমধ্যে হয়তো তিনি খেয়েও ফেলেছেন।

সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তার এক হাত লোহার রেলিংয়ের উপর বিশ্রাম নিচ্ছিল। মায়ের চারপাশে আনন্দদায়ক শুভ্র সমুদ্র যেন ফেনায়িত বুদ্বুদ তৈরি করেছে।

‘আমি আশা করি ওটা আমার বাড়ি’, হোটেলের শীর্ষে একটা কক্ষের দিকে মা আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘আমি যদি ওখানে থাকতে পারতাম, তাহলে সাকুরার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, সবসময় এবং চিরকাল।’

তারপর একটা কিছু ঘটতে শুরু করে। সাকুরার ডালপালার মধ্যে দিয়ে আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যেতে থাকে; সাকুরা ফুলের সমুদ্র যেন উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। আর আমি অনুভব করছিলাম যে, আমরা আদৌ এখানে উপস্থিত নেই, বরং উড়ে গেছি হোটেলের সেই কক্ষের জানালায়, যা আমার মায়ের আকাক্সিক্ষত বাসস্থান। মায়ের সঙ্গে এ দৃশ্য দেখার সময় আমার মনে হয়েছে, আমরা সাকুরার পাপড়ির মতো ভেসে বেড়াচ্ছি।

আমি আমার একটা হাত রেলিংয়ে রাখা মায়ের কুঞ্চিত হাতের উপর রাখি।

মানুষের ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন আমাদের পেছনে উৎসব শুরু করেছে এবং তার সঙ্গে সবাই গাইছে আর নৃত্য পরিবেশনে মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি পেছন থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে মুখ খুলি এবং এক কাপ পানীয় মার দিকে এগিয়ে দেই। তিনি কাপে ঠোঁট স্পর্শ করেন। আমি আমার কাপ তুলে ধরি এবং মায়ের চোখের দিকে তাকাই। তার চোখ যেন সাকুরা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আমি বললাম, ‘কাম্পাই, চিয়ার্স!’ এবং বলেই আমি আমার আরেক হাত মায়ের দিকে এগিয়ে দেই। আমাদের চারপাশে প্রচণ্ড হাততালি এবং সাকুরার ঈষদচ্ছ আলোয় মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আমার হাত ধরে নাচতে শুরু করেন। প্রজাপতির মতো চারদিকে সাকুরার পাপড়ি উড়তে থাকে।

আর ফেয়ারমন্ট হোটেল এখন কোনো হোটেল নেই, বরং মায়ের আরেক জীবনের বাসস্থান। হোটেলের একটা জানালা খুলে যায় এবং মা এখন আর সত্তর বছর বয়সী নন, বরং একজন যুবতী, যিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আমাদের দেখছেন আমরা সাকুরা গাছের নিচে নাচছি এবং আনন্দে মেতে উঠেছি।

গল্পসূত্র:

‘মার্চ, মা এবং সাকুরা’ গল্পটি ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক বুকার বিজয়ী ভারতীয় লেখক গীতাঞ্জলী শ্রী-র ইংরেজিতে ‘মার্চ, মা অ্যান্ড সাকুরা’ ছোটগল্পের অনুবাদ। হিন্দি থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সারা রাই। গল্পটি উর্বশী বুটালিয়া সম্পাদিত এবং ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘কথা: শর্ট স্টোরিজ বাই ইন্ডিয়ান ওমেন’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

গীতাঞ্জলি শ্রীর গল্প

মার্চ, মা এবং সাকুরা

অনুবাদ : ফজল হাসান

image

আমার মা জাপানে এসেছেন এবং চারদিকে প্রস্ফুটিত সাকুরার বিস্ফোরণ ঘটেছে। কোনোভাবে আমি জানতাম যে, যেদিন আমি তাকে আনতে বিমানবন্দরে যাব, সেদিন সবকিছু কেমন হবে। আমি আগমন লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছি এবং প্রচলিত নিয়মের বিপরীতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি সময় মতো পৌঁছেছে। বিমান থেকে যাত্রীরা হেলদোল ভঙ্গিতে নেমে আসছে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে খুঁজছি। যদি তিনি হারিয়ে যান, তাহলে নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে বিশাল বিমানের কোনো এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকবেন। লোকজন ঢাউস আকৃতির মালপত্র টেনে নিয়ে যাবে। দিল্লিতে পরিবারের লোকজন নিশ্চয়ই মাকে বিমানে তুলে দিবে এবং তার ব্যাগ চেক ইন করবে। কনভেয়ার বেল্ট থেকে স্যুটকেস তাকে নিজের হাতে তুলতে হবে। তিনি কী তার স্যুটকেস চিনতে পারবেন এবং অন্যসব স্যুটকেসের মাঝ থেকে তুলতে পারবেন? বিষয়টা এমন না যে, তিনি হঠাৎ করে এসব জিনিস দেখতে শুরু করবেন। কেননা এখন তার বয়স হয়েছে। সর্বোপরি তিনি আমাদের গাড়ির রঙ এবং নম্বর মনে রাখতে পারেন না। গাড়িটি পিতাজি অথবা ভাই সাহাব চালাতেন এবং তিনি পেছনের আসনে বসে থাকতেন।

এসব নানান চিন্তা আমার মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। একসময় আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার মা অল্পবয়সী এক ছেলের সঙ্গে লাউঞ্জে হাঁটছেন। ছেলেটি তার নিজের মালপত্র এবং মায়ের স্যুটকেস বোঝাই একটি ট্রলি ঠেলছে। তখন মা তার কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছিলেন। আমি লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলাম এবং মায়ের ঠিক সামনে দাঁড়ালাম, যেন তার পক্ষে কিছুতেই আমাকে হারানোর কোনো সুযোগ না থাকে।

আমাকে দেখতে পেয়ে মা আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তার চোখেমুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে এবং আমার সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই লাজুক হাসি চাপা হাসিতে বদলে যায়। আমি নিচু হয়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। তারপর মাথা তুলে যুবকটির দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘সে-ও প্রথমবারের মতো জাপানে এসেছে এবং খুবই নার্ভাস। আমি তাকে বলেছি যে, আমার ছেলে বিমানবন্দরে আসবে এবং সে এখানেই থাকে; তুমি তাকে যেকোনো ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারো।’

তখনই আমার মনে হয়েছে যে, বিষয়গুলো কীভাবে পূর্ণতা পাবে, যদিও সেসব বিষয়ের সঙ্গে আমার একটি যোগসূত্র ছিল। বোধোদয় হওয়ার পর আমি আজ সে কথাই বলছি। যাহোক, আমার তখন জানা উচিত ছিল যে, মা এসেছেন এবং সাকুরা এ বছর প্রস্ফুটিত হবে। মার্চ আসার সময় মা আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন, কিন্তু মার্চ পরে এসেছিল।

প্রথম কয়েক মাস আমি অফিস থেকে দিনে কয়েকবার মাকে ফোন করেছি- ‘মা, কী করছ?’ আর আমার প্রশ্নের একই ধরনের কয়েকটি উত্তর ছিল মায়ের কাছে: ‘বাছা, আমি তোর কুর্তায় বোতাম লাগিয়েছি, এখন আমি স্নান করতে যাব’ অথবা ‘বাছা, আমি তোর জন্য গাজরের হালুয়া বানিয়েছি, আমি এখন ওয়াশিং মেশিন চালু করব।’ বেশিরভাগ সময় আমি তাকে বলেছি, ‘মা, আজ খুব ঝলমলে সুন্দর দিন, তুমি কেন বাইরে যাচ্ছ না? তুমি যদি দূরে কোথাও যেতে না চাও, তাহলে বাসার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করো।’ কিন্তু প্রতিবারই তিনি বলেন, ‘না, আমি হারিয়ে যাব।’ আমি তার কণ্ঠস্বর শুনে অনায়াসে বলতে পারি যে, কথা বলার সময় তার ঠোঁট দুটি ছোট কোনো মেয়ের মতো বাঁকানো থাকে।

‘ওহ্, কী যে বলো মা!’ কিন্তু তার সামনে আমার তিরস্কার হারিয়ে যায়।

‘কে তোমাকে দূরে যেতে বলছে?’ আমি হয়তো মাকে বলব। ‘এই সেই রাস্তা, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুমি আমার সঙ্গে হাঁটতে যাও।’

‘উহ্, আহ্,’ তিনি বলবেন। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হবে যেন তার মেজাজ খানিকটা চড়া এবং তিনি উন্নাসিক।

আমি তাকে আরো বেশি তিরস্কার করে বলব, ‘তুমি নিদেন হলেও যা করতে পারো, তা হল সুপারমার্কেটে গিয়ে দুধ, দই এবং ফলের রস

আনতে পারো।’

‘কিন্তু ফিরে আসার সময় আমি কাউকে পথের দিক-নির্দেশনার কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না।’

‘তুমি যে পথ ধরে যাবে, শুধু সে পথেই ফিরে আসবে। বোকা মা আমার! আর তুমি যদি এমনই ভীতু হও, তাহলে বাসার ঠিকানাসহ আমার কার্ড রেখে দিতে পারো। যে কেউ তোমাকে পথ দেখিয়ে দিবে... শুধু দেখাবেই না, বরং তোমার হাত ধরবে এবং বাসার দরজা পর্যন্ত এসে তোমাকে পৌঁছে দিবে।’

‘এখন দেখ, তুই কি বলছিস! আমি কি অন্য কারোর হাত ধরে হাঁটব? আর আমি যদি দরজার তালা খুলতে না পারি, তবে? তুই তো ভাল করেই জানিস এখানে তালা কেমন। প্রথমে ডানে ঘুরাও এবং তারপর বামে... না, অবশ্যই না!’

‘মা, বাইরে ঘুরতে যাও,’ আমি তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলব।

‘না রে, বাছা!’ তিনি বলবেন। তিনি আপনমনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘আমি ঘরে ভাল আছি। তুই এলে আমি তোর সঙ্গে বাইরে যাব।’

কোনো এক সন্ধ্যায় আমি মায়ের সঙ্গে ছলচাতুরি করি; ‘দেখ, তোমার জন্য আমি অফিস থেকে সোজা বাসায় আসি এবং অন্য কোথাও যেতে পারি না। কারণ তুমি সারা দিন বাড়ি সম্পর্কে মিথ্যা বলেছ, আদৌ তুমি বাইরে যাওনি... সত্যি, এখন থেকে তোমাকে একাকী বাইরে যেতে হবে, এমনকি যদিও জায়গাটি বাসার আশেপাশে কোথাও হয়...’ তিনি উপদেশমূলক ভঙ্গিতে আঙুল তুলে আমার দিকে কঠোর স্থিরদৃষ্টিতে তাকাবেন; ‘দেখ বাছা, এখন এসব কিছু বলিস না, ভুলে যাস না যে, আমার এখন কত বয়স!’ আর সেসময় সেফটিপিন তার হাতের চুড়িতে আটকে যাওয়ায় তিনি রীতিমত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন।

যাহোক, ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে আসছে এবং গাছের প্রতিটি ডালে নতুন কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। মাছের দোকানের ছেলেটির সঙ্গে মা নড়বড়ে ইংরেজিতে আলাপ করা শুরু করেছেন। জাপানি ছেলেটি মার কাছে ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চায় তিনি কেমন করে মাছ রান্না করবেন এবং ভারতীয় মা আধো আধো ইংরেজিতে বলেন যে, তিনি মাছের চাটনি তৈরি করবেন এবং ওর কাছে এক বোয়াম পাঠাবেন। নড়বড়ে ইংরেজিতে তাদের কথাবার্তা শুনলে যেকোনো ইংরেজের মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠবে এবং তার মুখ চাটনিতে পরিণত হবে!

আর তারপর, হয়তো একবারের বেশি নয়, তবে নিশ্চিত একবার, আমি দেখেছি মাছের দোকানের ছেলেটি মায়ের বাজারের থলি বহন করেছিল এবং মা তার হাতের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে ওর আগে হেঁটে বাসায় ফিরেছেন। তিনি ব্যাগ থেকে চাবি বের করেছেন এবং তালার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন। প্রথমে বামে ঘুরান, পরে ডানে।

আমি একদিন বাসায় ফিরে দেখি পাশের বাসার ছেলেটি আগ্রহ নিয়ে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাচ্ছিল। ‘তুমি ভারতীয় খাবার পছন্দ করো,’ ছেলেটি আমাকে বলল এবং তা কেবল তার সীমিত ইংরেজির কারণেই সে আমাকে ‘আমি’-এর পরিবর্তে ‘তুমি’ বলেছে। মা হাসতে শুরু করেন এবং ছেলেটির গাল স্পর্শ করেন। মায়ের হাত দীর্ঘ সময় ছেলেটির গালে আটকে ছিল এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তাদের মধ্যে একধরনের রসিকতা আছে। কিন্তু তা থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। মা যেভাবে ছেলেটির গালে হাত রেখেছিলেন, সম্ভবত একটু বেশি সময়ের জন্য এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ দিয়ে, তা নজরে পড়ার পরপরই আমি আমার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিই। এ ঘটনাই তখন ঘটেছিল।

ছেলেটি চলে যাওয়ার পরে আমি মাকে বললাম, ‘মা, এ দেশের নিয়ম হল মাথা নিচু করে সম্মান দেখানো এবং তুমি দেখেছ ওরা কীভাবে করে।’ তারপর আমি বিব্রতকর নিস্তব্ধতার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমি আর কী বলতে পারতাম? আমি কীভাবে তাকে এখন এমন কিছু বলতে পারি, যা আগে কখনো বলিনি?

আমি যা বললাম, তা গ্রহণ করার উপায় ছিল মায়ের এবং তারপর তিনি বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যান, যা আমাকে বেশ নির্বাক করে দিয়েছে। এটা সত্যি ছিল যে আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা, দিনের বেলা শাড়ি এবং রাতে শোবার পোশাক পরা ছেড়ে দাও। আমার কুর্তা এবং পায়জামা পরলে তুমি আরো বেশি আরাম পাবে।’ যখন তিনি বিছানায় যাচ্ছিলেন, তখন আমি এসব কথা বলেছি। অবশ্যই আমি বেশি কিছু বলিনি এবং আমরা এ বিষয়েই কথা বলছিলাম, তাই নয় কী? যাহোক, দিনের বেলায় মা আমার কুর্তা এবং পায়জামা পরা শুরু করেন, প্রথমে একাকী এবং পরে ছেলেটির সম্মুখে, যে ভারতীয় খাবার গোগ্রাসে খাওয়ার জন্য নিয়মিত হাজির হত। মা আমার সুন্দর কুর্তা আর আলিগরী পায়জামা কেটে ছোট করে নিয়েছেন এবং সেগুলো পরা শুরু করেছেন। এসব পোশাকের উপর তিনি আমার উলের ওয়েস্টকোট পরেন।

‘বাইরে যাচ্ছ?’ তখনো আমি আমার প্রশ্ন শেষ করিনি যখন মা তার কুর্তার, আসলে আমার, উপরে তার পাশমিনা শাল জড়াচ্ছিলেন। তারপর তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘আমি মুক্ত জীবনের অনুভূতি পছন্দ করি! কী ধরনের পোশাক পরা যায় এবং কী ধরনের পরা যায় না, তা বলার জন্য কেউ না থাকাই ভাল।’ একটু থেমে তিনি আরো বললেন, ‘এখানে কেউ জানে না আমার পোশাক কেমন হওয়া উচিৎ।’

ঠিক আছে, আমি তা জানি। কিন্তু কথাটা তাকে বলার কোনো উপায় আমার ছিল না।

এখন আমি লক্ষ্য করছি যে, মা আমার সঙ্গে টোকিওতে ঘুরে বেড়ানোর সময় সমস্ত স্টেশনের নাম মুখস্থ করেছেন। এছাড়া তিনি মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন। ‘ওহ, তাহলে এখানে একটাই মাত্র বের হওয়ার পথ... ঠিক আছে, তবে তো ভালই হলো, হারিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। “দেগুচি” অর্থাৎ ‘প্রস্থান’, তিনি গর্ব করে বললেন। ‘এটা হলো নাকানো শিমবাসি, অর্থাৎ “এখানে বসো”, তিনি কথা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং নিজেকে বলতে থাকেন অবশ্যই তার কী করা প্রয়োজন। ‘নাকানো সাকাউই’। “অন্য দিকের দরজা খুলেছে, নেমে পড়ুন”,’ তিনি মকশো করার ভঙ্গিতে আবার বললেন। ‘শিনজুকুতে যাওয়ার ট্রেন ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে আছে... শুধু প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে উঠে পড়,’ তিনি আমাকে জানালেন। ‘আর তারপর তা সে ইয়োতসুয়া হোক বা ওরফে সাকা মিতসুকে হোক, অথবা গিনজা কিংবা টোকিও, বা ওতেমাচি, বা আচোনামাজু...’

তিনি শেষ শব্দটি উচ্চারণ করে আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। কেননা বলার সময় তিনি আচোনামাজু শব্দটি অত্যন্ত দ্রুত উচ্চারণ করেন এবং একসময় আমি শব্দটা তার সামনে বলেছিলাম। তবে কী আমি সত্যিই তার ত্রুটিপূর্ণ জাপানি উচ্চারণের জন্য তাকে তিরস্কার করছিলাম?

‘তুই যদি চাস, তবে সোজাসুজি ইকেবুকুরো শেষ স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারিস... তাহলে তো ভালই হয়!’ তিনি উৎসাহের সঙ্গে এমনভাবে চিৎকার করে উঠলেন, যেন আমি এ বিষয়ে তার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি এবং তিনি আমাকে বুঝিয়ে বিস্তারিত বলছেন, যদিও এ সম্পর্কে বলাটা তার পক্ষে মোটেও কঠিন কিছু নয়। আর তিনিই আমাকে এ কথা বলেছেন, ‘তুই যদি শিনজুকু গিওয়েন অথবা বাগিচায় যেতে চাস, তাহলে অবশ্যই শিনজুকুতে নামবি না, বরং দুই স্টেশন পরে শিনজুকু গিওয়েন মায়ে নেমে যাবি।’

‘আমি শিনজুকু গিওয়েনে যাচ্ছি,’ একদিন তিনি আমাকে অফিসে ফোন করে বলেছেন। ‘ছেলেটির সঙ্গে যাচ্ছি, যে আমার সাথে ভারত থেকে এসেছে, দুশ্চিন্তা করিস না।’

বিষয়টা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে, এমনকি ভীষণ চিন্তায় ফেলেছে। কোথা থেকে মা এসব ছেলেদের খুঁজে পেয়েছেন? কেন তিনি আলতো করে ওদের গালে চাপড় দেন? আমি বুঝতে পারি আমার কান গরম হতে শুরু করেছে। তোমার বয়স ভুলে যাওয়া আমার উচিত নয়, তুমি আমাকে তাই বলেছ, মা- আমার কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমি ভাবছিলাম।

আমরা প্রায় মার্চে পা রেখেছি।

এক সন্ধ্যায় মা আমাকে দারুণ উৎসাহের সঙ্গে অবহিত করেন, ‘আমি সাকুরার কুঁড়ি দেখেছি।’

‘তুমি কী নিয়ে বলছ?’ আমি খিটখিটে মেজাজে বললাম। ‘সাকুরার কুঁড়ি আসতে এখনো ঢের সময় বাকি আছে।’

‘ঠিক এ সময়ে কেমন করে সাকুরার কুঁড়ি ফুটবে?’ তিনি বললেন। আমার চেয়ে তার কণ্ঠস্বরে বেশি অবজ্ঞা ছিল। তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করছিল, যেন তাকে প্রথমে সেখানে যেতে হবে এবং তার চোখের সেই জ্বলন্ত আগুন সাকুরা গাছের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে হবে; তবেই সাকুরা প্রস্ফুটিত হতে পারে।

‘আমি বাড়িতে নেই, আছি কী?’ তিনিও হেসে উঠেন। ‘তবে তোদের পাড়ায় মাত্র একটি সাকুরা গাছ আছে,’ তিনি আমাকে বললেন। তাকে পাশের বাসার ছেলেটি বলেছে এবং গাছটি দেখিয়েছে।

‘আয়, চল যাই, দেখে আসি,’ তিনি বললেন। ট্র্যাফিক বাতি পেরিয়ে তিনি হাসতে শুরু করেন; ‘আমি এমন একজন ভিআইপি, যার জন্য বাতি সবুজ হয় এবং জনস্রোত থেমে যায়!’ তিনি ট্র্যাফিক বাতি বোতাম টিপে ধরেন এবং তারপর খোরগোশের মতো চঞ্চল গতিতে রাস্তা অতিক্রম করেন। ‘আয়, দেখে নেওয়া যাক সাকুরা দেখতে কেমন লাগে!’ তিনি বললেন এবং বলেই আমার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে খানিকটা লজ্জা পান। আর আমরা পাড়ার একমাত্র সাকুরা গাছ দেখার জন্য ছোট ছেলেমেয়েদের মতো বেরিয়ে পড়ি।

অবশেষে মার্চ মাস আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাতাস পাগলামি শুরু করেছে। সাকুরা শাখায় ঝাঁকুনি এবং প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য অস্থির কুঁড়ি সম্পর্কে টেলিভিশন অন্যান্য জরুরি বিষয় প্রচারের মাঝে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করছে।

‘হোক্কাইডোতে সাকুরা প্রস্ফুটিত হবে না। সেখানে এখনো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।’ মা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনে ছবি দেখেছেন। তাই হয়তো তার চোখের সামনে নতুন কুঁড়ি নাচছে।

আমি হাসলাম। বললাম, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভাবছ যে, তুমি ওখানে না গেলে সাকুরার কুঁড়ি আসবে না।’ মা মাথাটা একটু পেছনে সরিয়ে নেন এবং আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙেন।

‘আমি সব জায়গায় যেতে চাই, দেখতে চাই সবকিছু। আমি হোক্কাইডোতেও যেতে চাই।’ আমার মনে হয়েছিল যে, মা সেসব কুঁড়ির জন্য আফসোস করছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন তিনি হোক্কাইডোতে না গেলে সাকুরা কুঁড়ি প্রস্ফুটিত হবে না।

‘তোমাকে ছোট্ট মেয়ের মতো মনে হয়, আম্মা’, আমি স্নেহমাখা আদুরে গলায় বললাম।

তখনো তার হাত একই ভঙ্গিতে প্রসারিত। মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমার বয়স সত্তর বছর, বাছা। এখন আমি কী নিয়ে ভয় করব?’

মাথা ঝাঁকানোর জন্য তার কুর্তার হাতা ঘাড় থেকে সামান্য সরে গেছে এবং তখন দেখতে পেলাম তার হাতের ঝুলঝুলে মাংস।

আমার মায়ের বয়স সত্তর বছর। আমার বাবার দৃষ্টি খুব ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি মায়ের অবস্থা দেখতে পারেননি। সুতরাং তার জীবনের প্রথম বারের মতো তিনি পেছনে সবকিছু ফেলে বিনা বাধায় এখানে এসেছেন।

‘তুমি কি একাই এসেছ?’ আমি রীতিমত ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করি। একদিন তাকে আমার অফিসের বাইরে দেখতে পেয়ে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি।

আমি সাবওয়েতে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকি, কিন্তু তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটায় ব্যস্ত ছিলেন। হারজুকুতে তিনি প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত রৌপ্য আসন দেখে তারুণ্যের উদ্দীপনা নিয়ে জেগে উঠেছেন। তিনি আমার হাত ধরেন এবং দরজার দিকে লাফ দেন। তখনই দরজাটা বন্ধ হতে যাচ্ছিল। এমনকি তখন আমার জিজ্ঞেস করার কোনো সময়ও ছিল না যে, তিনি কী করতে চান। তবে এটি রীতিমত অলৌকিক ঘটনা ছিল যে, আমাকে ভেতরে রেখে তিনি একা নেমে যাননি। আমাদের উভয়েরই হাত দরজা ধরেছিল। তিনি আমাকে টানতে থাকেন এবং ইয়োইয়োগি পার্কের গেটের সামনে গিয়ে থামেন।

‘ডানে, নাকি বামে?’ তিনি বিড়বিড় করেন এবং তারপর বাম দিকে মোড় নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।

‘আমি চিনি, আমি চিনি’, আমার ভেতরের বৃদ্ধ মানুষটি হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বলল। ‘তিনি আগেও ওই ছেলেদের মধ্যে একজনের সঙ্গে এখানে এসেছেন, হয়তো একাধিকবার।’

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশ মেঘে ঢাকা এবং একসময় আমাদের সামনে সাকুরা গাছের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে। মা তাকিয়ে দেখছিলেন এবং আমাকেও দেখাচ্ছিলেন। আর তখনই কুঁড়িগুলো নড়তে শুরু করে। সেই সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে সাকুরা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে এবং চাঁদের আলোয় বালির গাঢ় গোলাপী শস্যের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমি ছাতা খুলি এবং আমরা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।

তারপর আমার হাতে করার মতো কিছুই ছিল না; মা আমার হাত পিছলে সরে যান, ঠিক বালির চকচকে শস্যের মতো। আমার পরিবার যখন দিল্লি থেকে ফোন করেছিল, তখন আমি কীভাবে ব্যাখ্যা করে বলব, তা জানতাম না। আমি বাসায় ছিলাম, কিন্তু মা কোথায়...?

মার্চ মাস, কেবল মার্চের মতোই ক্ষণস্থায়ী, ইতোমধ্যে চলে এসেছে। আর আমার মাকে অনুসরণ করে সমস্ত টোকিও যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই মায়ের মতো চিৎকার করছে, ‘সাকুরা, সাকুরা!’ ‘পরের সপ্তাহের জন্য সবুর করো... মাত্র আর চারটা দিন... রোববারের মধ্যেই সাকুরা পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হবে!’

প্রায়শই দেখা যায় যে, যারা ঘটনার প্রারম্ভে নিজেদের ভারসাম্যপূর্ণ বা বিচক্ষণ বলে দাবি করেন, তারা কোনো উৎসবের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার পরে মনের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। আমিও তাই এবং খুব শীঘ্রই নিজেকে মায়ের মতো গান গাইতে শুনি; তিনি তার সুরের মূর্ছনা যেন সমস্ত টোকিওতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

সমুদ্রের মতো স্ফীত হয়ে সাকুরা সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়েছে। টোকিওর অন্যদের মতো আমার মা তার মাথা পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ উপরের দিকে তুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে কেবলমাত্র পুরো প্রস্ফুটিত সাকুরার ঝাপসা সাদা ফুল দেখা যাচ্ছিল। তিনি শুধু হাঁটছিলেন। এটা স্পষ্ট যে, মানুষ যখন উপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটে, তখন তাদের পদক্ষেপ সমান হয় না। আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন সাকুরার উল্লাস আমাদের পদক্ষেপের সঙ্গে দুলছিল এবং সাকুরার সমস্ত আনন্দ যেন গাছের নিচে রাখা খাবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল এবং বোতলের ছিদ্র গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল।

চিডোরিগাফুচি পার্কে সাকুরা গাছে যত ফুল আছে, গাছের নিচে তত মানুষ। মা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, কারণ এ পার্কে এমন কিছু আছে, যা ব্যতিক্রম এবং উল্লেখযোগ্য। আজ টোকিওর অন্যসব এলাকা ফাঁকা হয়ে গেছে। এখানে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি এবং ফুলের ভিড়ে আকাশ যেন পেছনে সরে গেছে। শুধু ফুল আর মানুষ। লোকজন ইচ্ছে মতো বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ছবি তুলছে। কেউ কেউ ক্লোজআপ, আবার অনেকে এক হাত দিয়ে গাছ জড়িয়ে ধরেছে। উচ্ছ্বসিত অনেকেই গান গাইছে, খাওয়া-দাওয়া করছে, আনন্দে মেতে উঠেছে- সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে দিনটি উদযাপন করছে। মা হাঁটতে শুরু করেন এবং থেমে যান। তারপর মাত্র আরেকবার থামার জন্য পুনরায় হাঁটা শুরু করেন।

এক পাশে নদী এবং নদীর তীর ঘেঁষে সাকুরা। সামনের দিকে দালানকোঠা।

‘ওটা কী?’ মা দালানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

‘ফেয়ারমন্ট হোটেল’, আমি বললাম।

মা থামলেন এবং পাশের একটা হেলানো পাথরের উপর দাঁড়ালেন। সাকুরার একটা ডাল হেলে পড়েছে, যা তার ঠোঁটের খুবই কাছে।

‘আমি অনায়াসে চুমু খেতে পারি,’ মা বললেন। ইতোমধ্যে হয়তো তিনি খেয়েও ফেলেছেন।

সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তার এক হাত লোহার রেলিংয়ের উপর বিশ্রাম নিচ্ছিল। মায়ের চারপাশে আনন্দদায়ক শুভ্র সমুদ্র যেন ফেনায়িত বুদ্বুদ তৈরি করেছে।

‘আমি আশা করি ওটা আমার বাড়ি’, হোটেলের শীর্ষে একটা কক্ষের দিকে মা আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘আমি যদি ওখানে থাকতে পারতাম, তাহলে সাকুরার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, সবসময় এবং চিরকাল।’

তারপর একটা কিছু ঘটতে শুরু করে। সাকুরার ডালপালার মধ্যে দিয়ে আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যেতে থাকে; সাকুরা ফুলের সমুদ্র যেন উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। আর আমি অনুভব করছিলাম যে, আমরা আদৌ এখানে উপস্থিত নেই, বরং উড়ে গেছি হোটেলের সেই কক্ষের জানালায়, যা আমার মায়ের আকাক্সিক্ষত বাসস্থান। মায়ের সঙ্গে এ দৃশ্য দেখার সময় আমার মনে হয়েছে, আমরা সাকুরার পাপড়ির মতো ভেসে বেড়াচ্ছি।

আমি আমার একটা হাত রেলিংয়ে রাখা মায়ের কুঞ্চিত হাতের উপর রাখি।

মানুষের ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন আমাদের পেছনে উৎসব শুরু করেছে এবং তার সঙ্গে সবাই গাইছে আর নৃত্য পরিবেশনে মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি পেছন থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে মুখ খুলি এবং এক কাপ পানীয় মার দিকে এগিয়ে দেই। তিনি কাপে ঠোঁট স্পর্শ করেন। আমি আমার কাপ তুলে ধরি এবং মায়ের চোখের দিকে তাকাই। তার চোখ যেন সাকুরা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আমি বললাম, ‘কাম্পাই, চিয়ার্স!’ এবং বলেই আমি আমার আরেক হাত মায়ের দিকে এগিয়ে দেই। আমাদের চারপাশে প্রচণ্ড হাততালি এবং সাকুরার ঈষদচ্ছ আলোয় মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আমার হাত ধরে নাচতে শুরু করেন। প্রজাপতির মতো চারদিকে সাকুরার পাপড়ি উড়তে থাকে।

আর ফেয়ারমন্ট হোটেল এখন কোনো হোটেল নেই, বরং মায়ের আরেক জীবনের বাসস্থান। হোটেলের একটা জানালা খুলে যায় এবং মা এখন আর সত্তর বছর বয়সী নন, বরং একজন যুবতী, যিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আমাদের দেখছেন আমরা সাকুরা গাছের নিচে নাচছি এবং আনন্দে মেতে উঠেছি।

গল্পসূত্র:

‘মার্চ, মা এবং সাকুরা’ গল্পটি ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক বুকার বিজয়ী ভারতীয় লেখক গীতাঞ্জলী শ্রী-র ইংরেজিতে ‘মার্চ, মা অ্যান্ড সাকুরা’ ছোটগল্পের অনুবাদ। হিন্দি থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সারা রাই। গল্পটি উর্বশী বুটালিয়া সম্পাদিত এবং ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘কথা: শর্ট স্টোরিজ বাই ইন্ডিয়ান ওমেন’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।