জন্মের জটাজাল ছিঁড়ে মন তার অবাধ উড়ালে

কামরুল ইসলাম

যা কিছু অর্ধেক ফুটে অপেক্ষা করছে, আমি তা ফুটাবই। এই পণ করে আমি মনের দিকে তাকালাম। অতঃপর জঙ্গলের জগৎ-কাঁপানো ডাক শুনলাম। সে কী অভিমানী ডাক! আমার ভেতরের কোথাও টান পড়ল। আমি ঘর হতে বের হলাম। তখন বিকেলের বুক চিরে কারা যেন রক্ত বের করছে। বিকেল মরে গেলে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যা দেখতে যে কিছুটা মৃত্যুর মতো, তা আমি সারাজীবনই বিশ্বাস করেছি। জঙ্গলে নেমে এলো বিষাদ ও শোক, কয়েকশো চিলের কান্না ভেজা চোখের তীরে যেন কোনো হারানো বালুচর, যেখানে কারো মাথার খুলির মধ্যে বসে কোনো কবির প্রেতাত্মা ছবি আঁকছে। গাছে গাছে বেজে উঠল পখপাখালির সম্মিলিত প্রার্থনা। আহা, আমি গাছ হয়ে জন্মালে আমার শূন্য বুক পাখিদের সঙ্গম ও গোপন গানে ভরে উঠত। আর আমি বটবৃক্ষ হলে চাঁদ ও রাতের প্রেমটুকু সমস্ত শরীরে জড়িয়ে রাখতাম। আবাসিক ইঁদুরের মতো ভয়ে ও আনন্দে যাদের দিন কাটে, আমি কি তাদেরই মতো, কিংবা নাটুয়া বিলের ধার দিয়ে অন্তিম শয়ানে যাবার আগে যে বুড়ো জেলে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে হেঁটে যেতে থাকে অন্ধকার ঝোপের দিকে, তার চোখ এসে ভর করে আমার চোখে। জঙ্গলের অঢেল নৈঃশব্দ্য আমাকে টানে, এই টানে কোনো অনিদ্র কামনার বেদনা নেই, অহিংস পালকের ছায়ার গুঞ্জনে বোঝা যায় কিছু অসময়ের মৃত্যুর খবর।

জঙ্গলের সব গাছ স্পর্শ করে আমি এ-ও বুঝেছি, ওই জঙ্গলেই আমার দ্রোহী মনকে ছেড়ে দিতে হবে। পাতাদের ভাষা সে শিখে আসুক, মগডালের কবিতাখানি আয়ত্বে আনুক। আর ওই যে পুরনো পুকুরের চারপাশে ঘন গাছপালার বসতি, ওখানেও আমার মন কিছুদিন কাটিয়ে আসলে সে বুঝবে আগাছার ইন্দ্রজাল বলতে কী বোঝায়। প্রকৃতির ছন্দের ভেতরে সে ডুব খেলতে শিখতো। তার সুপ্রিমো চেহারার আলোয় সে শুদ্ধ হতে পারতো।

নদীর নির্জন পাড়ে সন্ধ্যাটুকু কাটাতে পারলে গোধূলির নীরব অঙ্গার মেখে মন তার বেহালাটায় সাঁঝবাতি জ্বালাতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ পিয়ানোর চেয়ে বেহালাই বেশি পছন্দ করতেন। দুপুরের যুবতী রোদ মাজায় বেঁধে একদিন মন তুমি দেখতে যাবে নদীর মোহনায় পড়ে থাকা জেলেনির ফেলে যাওয়া প্রেম। নদীর রক্তের খোঁজ পেলে জানতে পারবে মাছের আঁশের মন্ত্রে কীভাবে ভেসে আসে পৃথিবীর গোপন নিশ্বাস। মনকে মুক্ত করে, রোগমুক্ত করে, আবার বাঁধতে না পারলে আমি কীভাবে ফুটাব তাদের, যারা অর্ধেক ফুটে অপেক্ষা করছে- এমন চিন্তায় যখন জানালা খুলে মনকে ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন স্ত্রী এসে বললেন, ছেড়ে তো দিচ্ছো, যদি আর ফিরে না আসে, তখন কী করবে! আমি কোনো কিছু না বলে জানালা বন্ধ করে দিলাম। একটি বিরাম চিহ্ন বল্লমের মতো ধেয়ে এসে আমার বক্ষ ভেদ করে রক্ত ঝরিয়ে গেল। যারা অর্ধেক ফুটে বসে আছে, তারা বসেই থাক। একদিন অন্য কেউ এসে তাদের ফুটাবে। সুযোগ নিয়ে মনও আর রাজি হলো না। সে বলল, আমার বয়স হয়েছে, আমি তো রবীন্দ্রনাথের মন নিয়া পৃথিবীতে আসি নাই।

**

সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম, আমি একটি বৃদ্ধাশ্রমের সামনের পুরনো জামগাছতলে দাঁড়িয়ে আছি। আশ্রমের আশেপাশে কোনো লোকজন দেখলাম না। ভেতরে ঢুকবার পথে কয়েকটি রক্তাক্ত সাদা কবুতর পড়ে আছে আর তার মধ্যে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গনছে। আকাশের চারদিকে কালো মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে আসলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার এইভাবে মৃত পাখিদের ভেতরে শুয়ে থাকবার কারণ কী। সে খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, গত তিন দিন আগে তার মন তাকে ছেড়ে গেছে, এখন সে মরতে পারলে পাখিগুলি বেঁচে উঠবে। সে আরো বলল, মুকুট পরিহিত এক পুরোহিতের অপেক্ষায় আছে সে। ওই পুরোহিত এলেই সে তার মরণকে বুঝিয়ে দিতে পারবে। বৃদ্ধের কথার কোনো অর্থই আমি বুঝলাম না। দেখলাম প্রচণ্ড ঝড় উঠছে। আশ্রমের মাথার ওপরে অন্ধকার ঘন হয়ে জটলা পাকাচ্ছে আর তার মধ্যে সেই পুরোহিতকে দেখলাম প্রস্ফুটিত ছাতার মতো সোনার মুকুট পরে ধীরে ধীরে নামছে। এই দৃশ্য দেখে আমার মন আমাকে হাত ধরে এক অচেনা পুরনো রেলওয়ে প্লাটফর্মের দিকে টেনে নিয়ে গেল। জনশূন্য প্লাটফর্ম থেকে এখন আমি কীভাবে বাড়ি ফিরব, তা নিয়ে মনের সাথে কথা বলতে চাইলাম। মন নিশ্চুপ হয়ে রইল। দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনগুলি দ্রুত যাওয়া-আসা করছে, একটিও এখানে থামছে না। বজ্রের আলোয় লক্ষ করলাম প্লাটফর্মের পূর্বপ্রান্ত হতে সোনার মুকুট পরিহিত সেই পুরোহিত আমার দিকেই হেঁটে আসছে। আমি ভয়ে আমার মনকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মন কেন জানি না, সে তখন হিসেবে বসল কত বছর, কত মাস, কত দিন, কত ঘণ্টা, কত মিনিট সে আমার সাথে বসবাস করছে। মন একদিন কেঁদে উঠত, মন একদিন ব্যাকুল হতো, সে আমাকে কত অজানা বনভূমির সৌন্দর্য দেখিয়েছে, কিন্তু আজ সে যে আচরণ করছে, তাতে মিশে আছে মাঝ নদীতে নৌকাডুবির পরের হাহাকার। হাহাকারও বিবিধ নিয়মে চারপাশের বাতাস কাঁপিয়ে ক্রমশ নিজের চেহারা-সুরতে কাঁটাঝোঁপের নীরব সন্ত্রাস ছড়াতে থাকে।

মনের ভেতর পুরনো দিঘি-পাড়ের বজ্রাহত তালগাছগুলো পাতাদের দুঃখ-কষ্ট সন্ধ্যার আঁধারে ছড়াতে থাকলে আমার মনে পড়ে আভা নামের সেই মেয়েটিকে, যে একটি ছোট খাল পাড়ি দিয়ে আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তে আসত। সে না আসলে আমরা মন-মরা হয়ে খালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মেয়েটি সাইকেল চালাতে পারত। আমরা অনেকদিন খাল পাড়ি দিয়ে তাদের গ্রামে যেতাম। ধুলোর রাস্তায় অনেকদিন সে আমাদের কারো-না-কারো শরীরে সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত। তার সেই হাসি দেখে আমরা আমাদের শরীরের আঘাতটা বেমালুম ভুলে যেতাম। একদিন হঠাৎ সাইকেলসহ খালে পড়ে গিয়ে মেয়েটির মৃত্যু হলো। আমরা কয়েক বন্ধু কিছুদিন খালপাড়ের অন্ধকারে বসে জলের ভেতর চাঁদের বিষাদ মুখ দেখে চোখের জল ফেলতাম। এতোদিন পরেও মন যেন মেয়েটিকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মন আমার বার বার ছিঁড়ে-পুড়ে, সবকিছু ভুলো যেতে লাগল। এরকম উদ্ধত, উদাসীন মনের সাথে বসবাস বেশ কঠিন হয়ে পড়ল। মেয়েটি পাখি হতে চাইত, আহা পাখি! আমরা এখন কোথাও পাখির পালক পড়ে থাকতে দেখলে মেয়েটির কথা ভাবি। পালকটিকে সযতেœ বুকে চেপে ধরি, অনুভব করি কচি ডানার উড়াল, এক অনাবিল আকাশ-ভরা উষ্ণতা!

***

শেষরাতের দিকে প্লাটফর্মের চারদিকে বিড়ালের চোখের মতো সব আলো। তারই মধ্যে কে যেন ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গেল। কোথায় গেল তা-ও বুঝলাম না। মুকুট পরিহিত সেই পুরোহিত আমাদের দিকে না এসে বিশ্রামকক্ষের ভেতরে ঢুকে গেল। ডাউন ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেলাম। আমার মন উঠে দাঁড়ালে আমাদের মধ্যে এক অকুতোভয় মেঘ এসে ঢুকলো যেন। সে মেঘ বড় বয়স্ক, বৃষ্টির ভার নেই তার, কিছুটা ভেসে যাওয়া স্বভাবের। ট্রেন আস্তে আস্তে স্টেশনে থামল, কিন্তু কোনো বগিতে কোনো যাত্রী দেখলাম না। দু-একটি বগি বন্ধও দেখলাম। মন বলল যে, ওইসব বগিতে যাত্রী থাকলে থাকতেও পারে। মন আমাকে কিছুটা টানাহেঁচড়া করেই একটি জনশূন্য কামরায় উঠে পড়লো। ট্রেন চলতে শুরু করলে দেখলাম দরজার কাছে কয়েকজন লোক ফিসফিস করে কথা বলছে। আমার ভয় হলো। সেই কয়জন লোকের মধ্যে পুরোহিতকে দেখলাম না। মন বলল, পুরোহিত হয়তো অন্য কোনো বগিতে উঠেছে। ট্রেন সবেগেই চলতে লাগল। ওই লোকগুলো আমাদের দিকে না এসে পুবের কামরার দিকে চলে গেলে মন বলল, আমরা এখন এক জঙ্গল পার হচ্ছি। মনকে কাছে পেতে চাইলেও মন দূরে সরে যেতে লাগল। মনে পড়ল দ্যাশের কথা। দ্যাশ মানে সেই গোলাবাড়ি গ্রাম। কুলুপাড়া। চোখে ঠুসি পরা বলদেরা ঘানি টানছে। এই পাড়া পার হলে বাঁধ, বাঁধের নিচে ছোট নদী। নদী পার হলে বিশাল মাঠ। মাঠের নিচে বড় গাঙ। আহা, কত দিন আমরা বালকেরা বড় গাঙের পাড়ে গিয়ে সকালে-বিকালে বসে থেকেছি। সেই গ্রাম, কুলু পাড়া একদিন নদী-ভাঙনের খপ্পরে হারিয়ে যায়। কত কিছু মনে হতে লাগল। এ ট্রেন কোথায় থামবে, জানতে চাইলে মন কোনো কথাই বলল না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষে আমার চিরকালের সখা, আমার অন্ধকারের একমাত্র সাথী আমার মন, খুবই আস্তে করে বলল, এই ট্রেন যেখানে যাবে সেখান থেকে আর ফিরবে না। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের মুখ সমুখে ভেসে উঠল। আমি দেখলাম, আমার মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে কাদাপানির রাস্তায় কারো ছায়া দেখার জন্য ব্যকুলভাবে তাকিয়ে আছে। স্মরণে আসছে, কৈশোরে আমরা নদীর চরে বদন খেলতে যেতাম। খেলা শেষ হলেও আমরা ফিরতাম না। কখনো কাশবনের ভেতরে ঢুকে আমরা সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে হো হো করো হেসে উঠতাম। মা যখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকত, তখন টের পেতাম, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার বিষাদমাখা সৌন্দর্যের মধ্যে মায়ের ডাক প্রকৃতিকে নতুন করে চিনতে শেখায়।

***

এক অদম্য তন্দ্রার মধ্যে ঢুলু ঢুলু চোখে দেখলাম­­- ট্রেনটি সেই ব্রিজ থেকে যেন একবুক কুয়াশাসহ নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে এক গভীর খাদে, সবকিছু ওলটপালট করে, আমার মন তা আমলে নিল না। ক্ষুধার্ত ধূসর কচ্ছপের মতো মন আমার এক নিঃশব্দ যাত্রার প্রস্তুতিতে কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠলে আমি দূরের জানালায় নিভু নিভু হারিকেনের আলো দেখলাম। দেখলাম কেউ যেন তার নিঃসঙ্গ অপেক্ষার মানচিত্র ছিঁড়ে ঝড়ো-বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে, আর কালো টুপি-পরা অসংখ্য মানুষ সুপুরিবাগানের কিনার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এরা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানে না।

অজ¯্র কচি সবুজ পাতাসহ একটি নিঃসঙ্গ কলাবাগান শ্রাবণের সন্ধ্যাসমেত নিচে নেমে যাচ্ছে। নীরব একটি বাড়ির পাশে একটি ছোট পাহাড়ের টিলা, তার ওপর দাঁড়িয়ে কেউ নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিচে ধাবমান ট্রেনের দিকে ছুড়ে ফেলছে। সেই হৃৎপিণ্ডের কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে আমার সাদা শার্র্টে পড়ল। একটি কুয়াশার নদীতে যে লোহার পুরনো ব্রিজ, তার ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলছে। মন অস্থির হয়ে উঠলে আমি ক্রমশ ঘুমের দিকে হেলে পড়লাম। আর সেই মুকুট পরিহিত পুরোহিত স্মিতহাস্যে, পায়ের ওপর পা তুলে আমার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। আমার মনে হলো গোলাবাড়ি গ্রামের সমস্ত সাঁঝবাতি অনেক আগেই নিভে গেছে। বানের জলে ভেসে আসা আউশ ধানের শিষগুলো আমাদের ছোট নদীর কিনারে এসে পাক খাচ্ছে, যেন কারো ভালোবাসার হাতের জন্য তারা প্রহর গনছে। আমার চোখ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলে মন আমার ঘুম-নেশার ছিদ্রপথ দিয়া কোথায় পালিয়ে গেল আর টেরও পেলাম না। মন আমাকে চিরকালের জন্য ছুটি দিয়ে চলে যাচ্ছে, একটি হলুদ সর্ষেক্ষেতের ভেতর গভীর অন্ধকার চারদিক ডানা মেলে নেমে এলো। অনন্ত গভীরে ভাসছে সত্য ও তার ডালপালা, পরিব্যাপ্ত তরঙ্গমালা তা গ্রহণ করছে, নির্ঘুম আকাশ তা দেখছে, জাগ্রত মেঘের ভেতরে পরিণত ঘুম বরফ-খণ্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমি কি ভাবছি পৃথিবীর সকল শব্দই রহস্যের জালে মোড়ানো? অ্যান আনপ্রেডিক্টেবল পাথ ইজ স্প্রাউটিং ইন নাথিংনেস, কোথাও ভেতরে কোনোকিছু ছিঁড়ে যাওয়ার কষ্ট অনুভব করলাম। মাকড়সা-জালে ভরে আছে আকাশ। সেই জালে আটকে মন অকারণ আমার শরীরের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমি এক অচেনা ছন্দের মধ্যে ডুবে গিয়ে অসাড় দেহ নিয়ে ভেসে যাচ্ছি শূন্য থেকে শূন্যে। আভা কিংবা ওফেলিয়া আমার মনহীন উড়ন্ত দেহের চারপাশে সাইকেলের বেল বাজিয়ে চক্রাকারে ঘুরছে। জন্মদিনের ক্রন্দন, মা-জননীর ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠা দেহ আর ভাদ্র-রাতের চরম গরমের মধ্যে অনুভব করি- কী সামান্য মানুষ আমি কিংবা কোনো মানুষই নই। এক নির্মম অর্থহীনতার মধ্যে আমার মানবজীবন বর্ষার জল-হাওয়ায় নেচে-ওঠা মানকচুপাতার সানন্দ চোখের কাছে হেরে যায়। একটি ছায়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় দুনিয়ার শেষ মন্ত্র, দুলে ওঠে সাগরের লোনা জল, পূর্ণিমার চিরায়ত মুখ। বিশাল কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। ছায়াটি হেসে ওঠে অন্ধকারে। তার হাসির ভেতর ভেসে ওঠে আমার শতচ্ছিন্ন কৈশোরের সলিলকি। ছায়াটি আমার বুকের মধ্যে জ্বেলে দেয় রঙধনুর কুচি কুচি মায়া। যেন এক স্বপ্নহীন অন্ধ সাঁকো, যেন এক রক্তমাখা ধারালো বটির ছায়া, উড়তে থাকে শূন্য থেকে শূন্যে, মহাশূন্যের জরায়ুর দিকে, যখন জন্মের জটাজাল ছিঁড়ে মন তার অবাধ উড়ালে...

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

জন্মের জটাজাল ছিঁড়ে মন তার অবাধ উড়ালে

কামরুল ইসলাম

image

শিল্পী : পল ক্লে

যা কিছু অর্ধেক ফুটে অপেক্ষা করছে, আমি তা ফুটাবই। এই পণ করে আমি মনের দিকে তাকালাম। অতঃপর জঙ্গলের জগৎ-কাঁপানো ডাক শুনলাম। সে কী অভিমানী ডাক! আমার ভেতরের কোথাও টান পড়ল। আমি ঘর হতে বের হলাম। তখন বিকেলের বুক চিরে কারা যেন রক্ত বের করছে। বিকেল মরে গেলে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যা দেখতে যে কিছুটা মৃত্যুর মতো, তা আমি সারাজীবনই বিশ্বাস করেছি। জঙ্গলে নেমে এলো বিষাদ ও শোক, কয়েকশো চিলের কান্না ভেজা চোখের তীরে যেন কোনো হারানো বালুচর, যেখানে কারো মাথার খুলির মধ্যে বসে কোনো কবির প্রেতাত্মা ছবি আঁকছে। গাছে গাছে বেজে উঠল পখপাখালির সম্মিলিত প্রার্থনা। আহা, আমি গাছ হয়ে জন্মালে আমার শূন্য বুক পাখিদের সঙ্গম ও গোপন গানে ভরে উঠত। আর আমি বটবৃক্ষ হলে চাঁদ ও রাতের প্রেমটুকু সমস্ত শরীরে জড়িয়ে রাখতাম। আবাসিক ইঁদুরের মতো ভয়ে ও আনন্দে যাদের দিন কাটে, আমি কি তাদেরই মতো, কিংবা নাটুয়া বিলের ধার দিয়ে অন্তিম শয়ানে যাবার আগে যে বুড়ো জেলে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে হেঁটে যেতে থাকে অন্ধকার ঝোপের দিকে, তার চোখ এসে ভর করে আমার চোখে। জঙ্গলের অঢেল নৈঃশব্দ্য আমাকে টানে, এই টানে কোনো অনিদ্র কামনার বেদনা নেই, অহিংস পালকের ছায়ার গুঞ্জনে বোঝা যায় কিছু অসময়ের মৃত্যুর খবর।

জঙ্গলের সব গাছ স্পর্শ করে আমি এ-ও বুঝেছি, ওই জঙ্গলেই আমার দ্রোহী মনকে ছেড়ে দিতে হবে। পাতাদের ভাষা সে শিখে আসুক, মগডালের কবিতাখানি আয়ত্বে আনুক। আর ওই যে পুরনো পুকুরের চারপাশে ঘন গাছপালার বসতি, ওখানেও আমার মন কিছুদিন কাটিয়ে আসলে সে বুঝবে আগাছার ইন্দ্রজাল বলতে কী বোঝায়। প্রকৃতির ছন্দের ভেতরে সে ডুব খেলতে শিখতো। তার সুপ্রিমো চেহারার আলোয় সে শুদ্ধ হতে পারতো।

নদীর নির্জন পাড়ে সন্ধ্যাটুকু কাটাতে পারলে গোধূলির নীরব অঙ্গার মেখে মন তার বেহালাটায় সাঁঝবাতি জ্বালাতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ পিয়ানোর চেয়ে বেহালাই বেশি পছন্দ করতেন। দুপুরের যুবতী রোদ মাজায় বেঁধে একদিন মন তুমি দেখতে যাবে নদীর মোহনায় পড়ে থাকা জেলেনির ফেলে যাওয়া প্রেম। নদীর রক্তের খোঁজ পেলে জানতে পারবে মাছের আঁশের মন্ত্রে কীভাবে ভেসে আসে পৃথিবীর গোপন নিশ্বাস। মনকে মুক্ত করে, রোগমুক্ত করে, আবার বাঁধতে না পারলে আমি কীভাবে ফুটাব তাদের, যারা অর্ধেক ফুটে অপেক্ষা করছে- এমন চিন্তায় যখন জানালা খুলে মনকে ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন স্ত্রী এসে বললেন, ছেড়ে তো দিচ্ছো, যদি আর ফিরে না আসে, তখন কী করবে! আমি কোনো কিছু না বলে জানালা বন্ধ করে দিলাম। একটি বিরাম চিহ্ন বল্লমের মতো ধেয়ে এসে আমার বক্ষ ভেদ করে রক্ত ঝরিয়ে গেল। যারা অর্ধেক ফুটে বসে আছে, তারা বসেই থাক। একদিন অন্য কেউ এসে তাদের ফুটাবে। সুযোগ নিয়ে মনও আর রাজি হলো না। সে বলল, আমার বয়স হয়েছে, আমি তো রবীন্দ্রনাথের মন নিয়া পৃথিবীতে আসি নাই।

**

সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম, আমি একটি বৃদ্ধাশ্রমের সামনের পুরনো জামগাছতলে দাঁড়িয়ে আছি। আশ্রমের আশেপাশে কোনো লোকজন দেখলাম না। ভেতরে ঢুকবার পথে কয়েকটি রক্তাক্ত সাদা কবুতর পড়ে আছে আর তার মধ্যে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গনছে। আকাশের চারদিকে কালো মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে আসলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার এইভাবে মৃত পাখিদের ভেতরে শুয়ে থাকবার কারণ কী। সে খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, গত তিন দিন আগে তার মন তাকে ছেড়ে গেছে, এখন সে মরতে পারলে পাখিগুলি বেঁচে উঠবে। সে আরো বলল, মুকুট পরিহিত এক পুরোহিতের অপেক্ষায় আছে সে। ওই পুরোহিত এলেই সে তার মরণকে বুঝিয়ে দিতে পারবে। বৃদ্ধের কথার কোনো অর্থই আমি বুঝলাম না। দেখলাম প্রচণ্ড ঝড় উঠছে। আশ্রমের মাথার ওপরে অন্ধকার ঘন হয়ে জটলা পাকাচ্ছে আর তার মধ্যে সেই পুরোহিতকে দেখলাম প্রস্ফুটিত ছাতার মতো সোনার মুকুট পরে ধীরে ধীরে নামছে। এই দৃশ্য দেখে আমার মন আমাকে হাত ধরে এক অচেনা পুরনো রেলওয়ে প্লাটফর্মের দিকে টেনে নিয়ে গেল। জনশূন্য প্লাটফর্ম থেকে এখন আমি কীভাবে বাড়ি ফিরব, তা নিয়ে মনের সাথে কথা বলতে চাইলাম। মন নিশ্চুপ হয়ে রইল। দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনগুলি দ্রুত যাওয়া-আসা করছে, একটিও এখানে থামছে না। বজ্রের আলোয় লক্ষ করলাম প্লাটফর্মের পূর্বপ্রান্ত হতে সোনার মুকুট পরিহিত সেই পুরোহিত আমার দিকেই হেঁটে আসছে। আমি ভয়ে আমার মনকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মন কেন জানি না, সে তখন হিসেবে বসল কত বছর, কত মাস, কত দিন, কত ঘণ্টা, কত মিনিট সে আমার সাথে বসবাস করছে। মন একদিন কেঁদে উঠত, মন একদিন ব্যাকুল হতো, সে আমাকে কত অজানা বনভূমির সৌন্দর্য দেখিয়েছে, কিন্তু আজ সে যে আচরণ করছে, তাতে মিশে আছে মাঝ নদীতে নৌকাডুবির পরের হাহাকার। হাহাকারও বিবিধ নিয়মে চারপাশের বাতাস কাঁপিয়ে ক্রমশ নিজের চেহারা-সুরতে কাঁটাঝোঁপের নীরব সন্ত্রাস ছড়াতে থাকে।

মনের ভেতর পুরনো দিঘি-পাড়ের বজ্রাহত তালগাছগুলো পাতাদের দুঃখ-কষ্ট সন্ধ্যার আঁধারে ছড়াতে থাকলে আমার মনে পড়ে আভা নামের সেই মেয়েটিকে, যে একটি ছোট খাল পাড়ি দিয়ে আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়তে আসত। সে না আসলে আমরা মন-মরা হয়ে খালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মেয়েটি সাইকেল চালাতে পারত। আমরা অনেকদিন খাল পাড়ি দিয়ে তাদের গ্রামে যেতাম। ধুলোর রাস্তায় অনেকদিন সে আমাদের কারো-না-কারো শরীরে সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত। তার সেই হাসি দেখে আমরা আমাদের শরীরের আঘাতটা বেমালুম ভুলে যেতাম। একদিন হঠাৎ সাইকেলসহ খালে পড়ে গিয়ে মেয়েটির মৃত্যু হলো। আমরা কয়েক বন্ধু কিছুদিন খালপাড়ের অন্ধকারে বসে জলের ভেতর চাঁদের বিষাদ মুখ দেখে চোখের জল ফেলতাম। এতোদিন পরেও মন যেন মেয়েটিকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মন আমার বার বার ছিঁড়ে-পুড়ে, সবকিছু ভুলো যেতে লাগল। এরকম উদ্ধত, উদাসীন মনের সাথে বসবাস বেশ কঠিন হয়ে পড়ল। মেয়েটি পাখি হতে চাইত, আহা পাখি! আমরা এখন কোথাও পাখির পালক পড়ে থাকতে দেখলে মেয়েটির কথা ভাবি। পালকটিকে সযতেœ বুকে চেপে ধরি, অনুভব করি কচি ডানার উড়াল, এক অনাবিল আকাশ-ভরা উষ্ণতা!

***

শেষরাতের দিকে প্লাটফর্মের চারদিকে বিড়ালের চোখের মতো সব আলো। তারই মধ্যে কে যেন ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গেল। কোথায় গেল তা-ও বুঝলাম না। মুকুট পরিহিত সেই পুরোহিত আমাদের দিকে না এসে বিশ্রামকক্ষের ভেতরে ঢুকে গেল। ডাউন ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেলাম। আমার মন উঠে দাঁড়ালে আমাদের মধ্যে এক অকুতোভয় মেঘ এসে ঢুকলো যেন। সে মেঘ বড় বয়স্ক, বৃষ্টির ভার নেই তার, কিছুটা ভেসে যাওয়া স্বভাবের। ট্রেন আস্তে আস্তে স্টেশনে থামল, কিন্তু কোনো বগিতে কোনো যাত্রী দেখলাম না। দু-একটি বগি বন্ধও দেখলাম। মন বলল যে, ওইসব বগিতে যাত্রী থাকলে থাকতেও পারে। মন আমাকে কিছুটা টানাহেঁচড়া করেই একটি জনশূন্য কামরায় উঠে পড়লো। ট্রেন চলতে শুরু করলে দেখলাম দরজার কাছে কয়েকজন লোক ফিসফিস করে কথা বলছে। আমার ভয় হলো। সেই কয়জন লোকের মধ্যে পুরোহিতকে দেখলাম না। মন বলল, পুরোহিত হয়তো অন্য কোনো বগিতে উঠেছে। ট্রেন সবেগেই চলতে লাগল। ওই লোকগুলো আমাদের দিকে না এসে পুবের কামরার দিকে চলে গেলে মন বলল, আমরা এখন এক জঙ্গল পার হচ্ছি। মনকে কাছে পেতে চাইলেও মন দূরে সরে যেতে লাগল। মনে পড়ল দ্যাশের কথা। দ্যাশ মানে সেই গোলাবাড়ি গ্রাম। কুলুপাড়া। চোখে ঠুসি পরা বলদেরা ঘানি টানছে। এই পাড়া পার হলে বাঁধ, বাঁধের নিচে ছোট নদী। নদী পার হলে বিশাল মাঠ। মাঠের নিচে বড় গাঙ। আহা, কত দিন আমরা বালকেরা বড় গাঙের পাড়ে গিয়ে সকালে-বিকালে বসে থেকেছি। সেই গ্রাম, কুলু পাড়া একদিন নদী-ভাঙনের খপ্পরে হারিয়ে যায়। কত কিছু মনে হতে লাগল। এ ট্রেন কোথায় থামবে, জানতে চাইলে মন কোনো কথাই বলল না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষে আমার চিরকালের সখা, আমার অন্ধকারের একমাত্র সাথী আমার মন, খুবই আস্তে করে বলল, এই ট্রেন যেখানে যাবে সেখান থেকে আর ফিরবে না। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের মুখ সমুখে ভেসে উঠল। আমি দেখলাম, আমার মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে কাদাপানির রাস্তায় কারো ছায়া দেখার জন্য ব্যকুলভাবে তাকিয়ে আছে। স্মরণে আসছে, কৈশোরে আমরা নদীর চরে বদন খেলতে যেতাম। খেলা শেষ হলেও আমরা ফিরতাম না। কখনো কাশবনের ভেতরে ঢুকে আমরা সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে হো হো করো হেসে উঠতাম। মা যখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকত, তখন টের পেতাম, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার বিষাদমাখা সৌন্দর্যের মধ্যে মায়ের ডাক প্রকৃতিকে নতুন করে চিনতে শেখায়।

***

এক অদম্য তন্দ্রার মধ্যে ঢুলু ঢুলু চোখে দেখলাম­­- ট্রেনটি সেই ব্রিজ থেকে যেন একবুক কুয়াশাসহ নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে এক গভীর খাদে, সবকিছু ওলটপালট করে, আমার মন তা আমলে নিল না। ক্ষুধার্ত ধূসর কচ্ছপের মতো মন আমার এক নিঃশব্দ যাত্রার প্রস্তুতিতে কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠলে আমি দূরের জানালায় নিভু নিভু হারিকেনের আলো দেখলাম। দেখলাম কেউ যেন তার নিঃসঙ্গ অপেক্ষার মানচিত্র ছিঁড়ে ঝড়ো-বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে, আর কালো টুপি-পরা অসংখ্য মানুষ সুপুরিবাগানের কিনার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এরা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানে না।

অজ¯্র কচি সবুজ পাতাসহ একটি নিঃসঙ্গ কলাবাগান শ্রাবণের সন্ধ্যাসমেত নিচে নেমে যাচ্ছে। নীরব একটি বাড়ির পাশে একটি ছোট পাহাড়ের টিলা, তার ওপর দাঁড়িয়ে কেউ নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিচে ধাবমান ট্রেনের দিকে ছুড়ে ফেলছে। সেই হৃৎপিণ্ডের কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে এসে আমার সাদা শার্র্টে পড়ল। একটি কুয়াশার নদীতে যে লোহার পুরনো ব্রিজ, তার ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলছে। মন অস্থির হয়ে উঠলে আমি ক্রমশ ঘুমের দিকে হেলে পড়লাম। আর সেই মুকুট পরিহিত পুরোহিত স্মিতহাস্যে, পায়ের ওপর পা তুলে আমার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। আমার মনে হলো গোলাবাড়ি গ্রামের সমস্ত সাঁঝবাতি অনেক আগেই নিভে গেছে। বানের জলে ভেসে আসা আউশ ধানের শিষগুলো আমাদের ছোট নদীর কিনারে এসে পাক খাচ্ছে, যেন কারো ভালোবাসার হাতের জন্য তারা প্রহর গনছে। আমার চোখ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলে মন আমার ঘুম-নেশার ছিদ্রপথ দিয়া কোথায় পালিয়ে গেল আর টেরও পেলাম না। মন আমাকে চিরকালের জন্য ছুটি দিয়ে চলে যাচ্ছে, একটি হলুদ সর্ষেক্ষেতের ভেতর গভীর অন্ধকার চারদিক ডানা মেলে নেমে এলো। অনন্ত গভীরে ভাসছে সত্য ও তার ডালপালা, পরিব্যাপ্ত তরঙ্গমালা তা গ্রহণ করছে, নির্ঘুম আকাশ তা দেখছে, জাগ্রত মেঘের ভেতরে পরিণত ঘুম বরফ-খণ্ডে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমি কি ভাবছি পৃথিবীর সকল শব্দই রহস্যের জালে মোড়ানো? অ্যান আনপ্রেডিক্টেবল পাথ ইজ স্প্রাউটিং ইন নাথিংনেস, কোথাও ভেতরে কোনোকিছু ছিঁড়ে যাওয়ার কষ্ট অনুভব করলাম। মাকড়সা-জালে ভরে আছে আকাশ। সেই জালে আটকে মন অকারণ আমার শরীরের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমি এক অচেনা ছন্দের মধ্যে ডুবে গিয়ে অসাড় দেহ নিয়ে ভেসে যাচ্ছি শূন্য থেকে শূন্যে। আভা কিংবা ওফেলিয়া আমার মনহীন উড়ন্ত দেহের চারপাশে সাইকেলের বেল বাজিয়ে চক্রাকারে ঘুরছে। জন্মদিনের ক্রন্দন, মা-জননীর ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠা দেহ আর ভাদ্র-রাতের চরম গরমের মধ্যে অনুভব করি- কী সামান্য মানুষ আমি কিংবা কোনো মানুষই নই। এক নির্মম অর্থহীনতার মধ্যে আমার মানবজীবন বর্ষার জল-হাওয়ায় নেচে-ওঠা মানকচুপাতার সানন্দ চোখের কাছে হেরে যায়। একটি ছায়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় দুনিয়ার শেষ মন্ত্র, দুলে ওঠে সাগরের লোনা জল, পূর্ণিমার চিরায়ত মুখ। বিশাল কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। ছায়াটি হেসে ওঠে অন্ধকারে। তার হাসির ভেতর ভেসে ওঠে আমার শতচ্ছিন্ন কৈশোরের সলিলকি। ছায়াটি আমার বুকের মধ্যে জ্বেলে দেয় রঙধনুর কুচি কুচি মায়া। যেন এক স্বপ্নহীন অন্ধ সাঁকো, যেন এক রক্তমাখা ধারালো বটির ছায়া, উড়তে থাকে শূন্য থেকে শূন্যে, মহাশূন্যের জরায়ুর দিকে, যখন জন্মের জটাজাল ছিঁড়ে মন তার অবাধ উড়ালে...