অবসেশন

শাহানা আকতার মহুয়া

মানাভ ওরফে মানভীর ওরফে মান্নু অবাক চোখে পাশে বসা সোনালী নারীটিকে দেখে। খলবলে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। তার মধ্যে অলৌকিক রূপকল্পের মতো এক নারী নিঃশব্দে কাঁদছে পাশে বসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল চিবুক বেয়ে নেমে আসছে শ্যানন ফলসের মতো।

কী মনে করে মানাভ দু’হাত পেতে দেয় মন্দিরার চিবুকের ঠিক নিচে যেন জল গড়িয়ে এসে তার হাতের তালুতে জমে। মানাভ রোমান্টিক ছিল না কোনোকালেই, কিন্তু ভালবাসতে জানতো। নিকোলের সাথে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবার পরে আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি সে। ওহ্, নিকোল! হাইস্কুল সুইটহার্ট! কেন তুমি আমার সাথে অমন চিট করলে!!!

এই মেয়ে! এমন রাতে কাঁদো কেন?

ঠাণ্ডা কোকে চুমুক দিতে দিতে রোদশী মন্দিরাকে দেখে। কাঁদলে কি সব মেয়েদেরই এতো সুন্দর দেখায়? মনে করার চেষ্টা করে ক্রন্দনরতা নিকোলের মুখ। না, মনে পড়ে না। নিকোলের বিষণœ মুখ দেখেছে বটে কিন্তু মেয়েটাকে কোনোদিন সামনাসামনি কাঁদতে দেখেনি এমনকি সেই রাতে নিকোল মাথা নিচু করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে তার অপরাধবোধ ছিল কিন্তু জল ছিল না। নিকোল মেয়েটা কি তবে জন্মের পরেই একবার কেঁদেছিল তারপর আর কোনোদিন কাঁদেনি?

ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডা কাটে। এমন তুষারস্নাত সময়ে ঠাণ্ডা পানীয়তে চুমুক দেবার মজাই আলাদা।

মন্দিরা তখনো যেন এক তুমুল ঘোরে। জলচোখে অবাক তাকিয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত সফেদ মাঠের দিকে। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ তাতে ঢেলে দিয়েছে মায়ার জ্যোৎস্না। এ দেশে এবার দ্বিতীয় উইন্টার মন্দিরার। তুষারপাত দারুণ লাগে তার, জানালা খুলে মাঝরাতে তুষারপাত দেখে। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে! খেয়াল করে দেখেছে শীতকালে এখানে রাতে অন্ধকার নামে না। সাদা তুষারে আকাশের আলো প্রতিফলিত হয়ে রাতগুলোও সদ্যফোটা দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকে। সাত বছরের অরিত্রার সাথে নিজেও ছোটবাচ্চার মতো গড়াগড়ি দেয়, স্নোম্যান বানায় মজা করে, বরফের নরম বল ছুঁড়ে হেসে কুটোপাটি হয়।

মানাভের কাছে মন্দিরাও এক তুমুল ঘোর। মন্দিরা যেন তার ভালবাসা নয়। মন্দিরা তার কাছে এক পরাবাস্তব জগৎ, অন্যরকম আলো। মানাভ মূলত দর্শন বিষয়ক বই পড়তে পছন্দ করে, কবিতা ভালবাসে কিন্তু দুর্বোধ্য লাগে। মন্দিরা তার কাছে কবিতার মতোই। অনুভব করে কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে পারে না। মানাভ যতোটা ভাবে, নিজেকে ঠিক ততোখানি অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে পারে না। তাই কিছু কিছু মানুষের কাছে সে নিজেও দুর্বোধ্য। সেই দুর্বোধ্যতার প্রাচীর ভেঙে পঁচিশের মানাভের ভেতরে ঢুকে পড়েছে ছত্রিশের মন্দিরা। বয়স তাদের জন্য বাধা হয়ে ওঠেনি কেননা মন্দিরা তাকে বোঝে।

জলভরা চোখে মন্দিরা রিনঝিন করে হেসে উঠলে মানাভ ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। নতুন ইমিগ্রান্ট এই মেয়েটা কীভাবে মিশে গেল তার জীবনে- নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। নিকোলের সাথে ব্রেকাপ হয়ে যাবার পরে সব ছেড়ে দূরে দূরেই ছিল। নিজের ওপর বড্ড অভিমান হতো ওর, রাগ লাগতো নিজের ওপর- যে কোনো গাড়ির প্রতিটি অংশ সে বোঝে, নারীকে কেন বোঝে না!

শিখ বাবা আর পোলিশ মায়ের সন্তান মানাভ ভীষণ রকম পরিবারমুখী এবং যথেষ্ট রক্ষণশীলও বটে। এক রাতে পার্টিতে বেসামাল নিকোলকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে তারই বন্ধুর সাথে বেসামাল অবস্থায় দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় মানাভের। উফ্ফ্, কীভাবে পারলো নিকোল!!! হয়তো বিষয়টা কিছুই নয় অনেকের কাছে কিন্তু মানাভের কাছে অনেক কিছু। যা তার, তা শুধু তারই- সেখানে অন্য কারো ভাগ নেই। নারীদের প্রতি ঠিক ঘৃণা নয়, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল মানাভ।

শীতের বিকেল ৪টা মানেই ঘোর সন্ধ্যেবেলা। মন্দিরার কাজের পরে মানাভ পিক আপ করেছে। মেয়েটার ভেতরে মায়াময় এক জ্যোৎস্না আছে। মানাভের খুব ইচ্ছে করছিল শীতল এই জ্যোৎস্নার সাথে আজ মন্দিরার অন্দরের জ্যোৎস্না মিশিয়ে পান করতে।

উইলো গাছগুলো তুষারে মাখামাখি হয়ে সফেদ বুড়োদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে এতোই নীরবতা যে মনে হচ্ছিল মন্দিরার চোখের জল তোড়ে গড়িয়ে পড়লে টুপ করে শব্দ শোনা যাবে। মন্দিরা কাঁদছিল। তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিল। আনন্দে কাঁদছিল। অসহ্য সুন্দরের মাঝে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদছিল।

কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটে বলে-

আমাকে এখানে কেন এনেছো?

মানাভ ফিসফিস করে বলে-

- তোমাকে জ্যোৎস্নায় স্নান করিয়ে দেবো বলে এনেছি। নিজের হাতে। আকাশের জ্যোৎস্না মিশে যাবে তোমার শরীরের জ্যোৎস্নায়। আমি সেই জ্যোৎস্না আঁজলায় তুলে পান করবো।

মানাভের ঘোরলাগা চোখ দেখে, আচ্ছন্নতায় ঘেরা কথা শুনে একটু ভয় পায় মন্দিরা। ছেলেটাকে ভীষণ জ্যোৎস্নাকাতর লাগছে।

মন্দিরা বলে-

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, মানাভ। এমন অপার্থিব সুন্দর একটা রাত আমাকে দেখালে বলে...

কোকের ক্যানটা মন্দিরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছু না বলে উঠে যায় মানাভ। হয়তো গাড়ি থেকে কিছু আনতে গেছে।

তুষারের ওপরে আলতোভাবে বসে পড়ে মুগ্ধ মন্দিরা; তন্ময় হয়ে জ্যোৎস্নায় ডুবে থাকে। ভুলে যায় অরিত্রা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য।

পেছন থেকে মানাভ বলে- মন্দিরা চোখ বন্ধ করো।

মন্দিরা চোখ বন্ধ করে।

মানাভ সামনে এসে দাঁড়ায়।

-এবার চোখ খোলো মন্দিরা।

চোখ খুলে চমকে ওঠে মন্দিরা। ধবল তুষারের ওপর যেন দাঁড়িয়ে আছে পাথর খুঁদে বানানো এপোলো! মন্দিরার কেমন বিবশ লাগে নিজেকে; শিরশির করে ওঠে শরীর।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে মন্দিরার সামনে বসে মানাভ।

-এসো, তোমাকে স্নান করিয়ে দিই।

-না, আমার ঠাণ্ডা লাগবে।

-লাগবে না। পূর্ণিমায় ভিজবে না তুমি! তোমার তো কত উচ্ছ্বাস জ্যোৎস্নাকে নিয়ে।

-তা হোক।

আমি কল্পনায়, ভাবনায় জ্যোৎস্নাস্নান করি। আজ করলাম বাস্তবে। তার জন্য উন্মুক্ত হবার তো দরকার নেই। চলো আমরা ফিরে যাই।

-না, মানাভ। অরিত্রা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

-উঁহু, আজ আমরা সারারাত এখানে থাকবো। তোমার-আমার জন্য আজকের রাত হবে শ্রেষ্ঠ রাত। আমাকে ভালবাসো না তুমি?

-বাসি, ভালবাসি। তবে তা অন্যরকম ভালবাসা। শরীর দিয়ে শরীর ছোঁয়া মানেই ভালবাসা নয়, আমার অন্তর দিয়ে তোমার অন্তর ছুঁয়ে থাকি আমি...

-তোমার কাব্য আজ থাক। আজ আমরা পৃথিবীর গল্প বলবো।

-যেতে হবে মানাভ।

গ্রিক পুরাণের পাতা থেকে উঠে আসা এই মানাভকে উপেক্ষা করা বড় কঠিন। মন্দিরার শরীর শিথিল হয়ে যেতে থাকে কিন্তু নিজেকে ঝাড়া দিয়ে জাগিয়ে তোলে ফের।

-এভাবে তুমি যেতে পারো না। সারাজীবন পস্তাবে কিন্তু!

খরখরে গলায় মন্দিরা বলে:

-ভুল ভাবছো। তোমার জন্য আমার ভালবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

মানাভের গলায় ছলকে ওঠে অসহিষ্ণুতা:

-একটা রাতের জন্য তোমার ভালবাসা মরে যাবে কেন?

-যাবে, মানাভ মরে যাবে। একটা রাতের কারণে নিকোলের জন্য কি তোমার ভালবাসা মরে যায়নি?

মানাভের রাগ হয়। আবার অসহায় বোধ করে। মন্দিরা তাকে পেঁচিয়ে ফেলছে। খোঁচাচ্ছে। এতে রক্তপাত হচ্ছে না বরং বিরক্ত লাগছে। একটু শীত শীত লাগে তার।

মন্দিরা উঠে দাঁড়ায়:

চলো, আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসো। কাপড় পরে নাও, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

বলে ধবল তুষারের ওপর জেদি পা ফেলে হাঁটা দেয় মন্দিরা। পেছন থেকে ওর হেঁটে যাওয়া দেখে মানাভ। হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো প্রশ্রয় নেই, চলে যাবার ইচ্ছেটা তার স্পষ্ট। মানাভের পৌরুষে বড্ড লাগে। একবার ভাবে- যাক না, দেখি এই স্নো ভেঙে কতদূর যেতে পারে!

কিন্তু মন্দিরার জন্য তার খুব মায়া। কেমন এক নাম না জানা টান! এটাই কি তবে ভালবাসা? কনকনে ঠাণ্ডায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুকের ভেতরে হিমশীতল বাতাস টেনে নেয় মানাভ। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তার সহসাই মনে হয়- মন্দিরার এই ঋজুতা, এই উপেক্ষাটাকেই সে ভালবাসে।

যাক, মন্দিরা তবে তার পথে চলে যাক তবে এই অলৌকিক রাতে নয়।

মন্দিরা ততক্ষণে মিশে গেছে সুনসান রাতে।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

অবসেশন

শাহানা আকতার মহুয়া

image

শিল্পী : জেনি ফারম্যান

মানাভ ওরফে মানভীর ওরফে মান্নু অবাক চোখে পাশে বসা সোনালী নারীটিকে দেখে। খলবলে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। তার মধ্যে অলৌকিক রূপকল্পের মতো এক নারী নিঃশব্দে কাঁদছে পাশে বসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল চিবুক বেয়ে নেমে আসছে শ্যানন ফলসের মতো।

কী মনে করে মানাভ দু’হাত পেতে দেয় মন্দিরার চিবুকের ঠিক নিচে যেন জল গড়িয়ে এসে তার হাতের তালুতে জমে। মানাভ রোমান্টিক ছিল না কোনোকালেই, কিন্তু ভালবাসতে জানতো। নিকোলের সাথে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবার পরে আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি সে। ওহ্, নিকোল! হাইস্কুল সুইটহার্ট! কেন তুমি আমার সাথে অমন চিট করলে!!!

এই মেয়ে! এমন রাতে কাঁদো কেন?

ঠাণ্ডা কোকে চুমুক দিতে দিতে রোদশী মন্দিরাকে দেখে। কাঁদলে কি সব মেয়েদেরই এতো সুন্দর দেখায়? মনে করার চেষ্টা করে ক্রন্দনরতা নিকোলের মুখ। না, মনে পড়ে না। নিকোলের বিষণœ মুখ দেখেছে বটে কিন্তু মেয়েটাকে কোনোদিন সামনাসামনি কাঁদতে দেখেনি এমনকি সেই রাতে নিকোল মাথা নিচু করে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে তার অপরাধবোধ ছিল কিন্তু জল ছিল না। নিকোল মেয়েটা কি তবে জন্মের পরেই একবার কেঁদেছিল তারপর আর কোনোদিন কাঁদেনি?

ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডা কাটে। এমন তুষারস্নাত সময়ে ঠাণ্ডা পানীয়তে চুমুক দেবার মজাই আলাদা।

মন্দিরা তখনো যেন এক তুমুল ঘোরে। জলচোখে অবাক তাকিয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত সফেদ মাঠের দিকে। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ তাতে ঢেলে দিয়েছে মায়ার জ্যোৎস্না। এ দেশে এবার দ্বিতীয় উইন্টার মন্দিরার। তুষারপাত দারুণ লাগে তার, জানালা খুলে মাঝরাতে তুষারপাত দেখে। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে! খেয়াল করে দেখেছে শীতকালে এখানে রাতে অন্ধকার নামে না। সাদা তুষারে আকাশের আলো প্রতিফলিত হয়ে রাতগুলোও সদ্যফোটা দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকে। সাত বছরের অরিত্রার সাথে নিজেও ছোটবাচ্চার মতো গড়াগড়ি দেয়, স্নোম্যান বানায় মজা করে, বরফের নরম বল ছুঁড়ে হেসে কুটোপাটি হয়।

মানাভের কাছে মন্দিরাও এক তুমুল ঘোর। মন্দিরা যেন তার ভালবাসা নয়। মন্দিরা তার কাছে এক পরাবাস্তব জগৎ, অন্যরকম আলো। মানাভ মূলত দর্শন বিষয়ক বই পড়তে পছন্দ করে, কবিতা ভালবাসে কিন্তু দুর্বোধ্য লাগে। মন্দিরা তার কাছে কবিতার মতোই। অনুভব করে কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে পারে না। মানাভ যতোটা ভাবে, নিজেকে ঠিক ততোখানি অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে পারে না। তাই কিছু কিছু মানুষের কাছে সে নিজেও দুর্বোধ্য। সেই দুর্বোধ্যতার প্রাচীর ভেঙে পঁচিশের মানাভের ভেতরে ঢুকে পড়েছে ছত্রিশের মন্দিরা। বয়স তাদের জন্য বাধা হয়ে ওঠেনি কেননা মন্দিরা তাকে বোঝে।

জলভরা চোখে মন্দিরা রিনঝিন করে হেসে উঠলে মানাভ ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। নতুন ইমিগ্রান্ট এই মেয়েটা কীভাবে মিশে গেল তার জীবনে- নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। নিকোলের সাথে ব্রেকাপ হয়ে যাবার পরে সব ছেড়ে দূরে দূরেই ছিল। নিজের ওপর বড্ড অভিমান হতো ওর, রাগ লাগতো নিজের ওপর- যে কোনো গাড়ির প্রতিটি অংশ সে বোঝে, নারীকে কেন বোঝে না!

শিখ বাবা আর পোলিশ মায়ের সন্তান মানাভ ভীষণ রকম পরিবারমুখী এবং যথেষ্ট রক্ষণশীলও বটে। এক রাতে পার্টিতে বেসামাল নিকোলকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে তারই বন্ধুর সাথে বেসামাল অবস্থায় দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় মানাভের। উফ্ফ্, কীভাবে পারলো নিকোল!!! হয়তো বিষয়টা কিছুই নয় অনেকের কাছে কিন্তু মানাভের কাছে অনেক কিছু। যা তার, তা শুধু তারই- সেখানে অন্য কারো ভাগ নেই। নারীদের প্রতি ঠিক ঘৃণা নয়, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল মানাভ।

শীতের বিকেল ৪টা মানেই ঘোর সন্ধ্যেবেলা। মন্দিরার কাজের পরে মানাভ পিক আপ করেছে। মেয়েটার ভেতরে মায়াময় এক জ্যোৎস্না আছে। মানাভের খুব ইচ্ছে করছিল শীতল এই জ্যোৎস্নার সাথে আজ মন্দিরার অন্দরের জ্যোৎস্না মিশিয়ে পান করতে।

উইলো গাছগুলো তুষারে মাখামাখি হয়ে সফেদ বুড়োদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে এতোই নীরবতা যে মনে হচ্ছিল মন্দিরার চোখের জল তোড়ে গড়িয়ে পড়লে টুপ করে শব্দ শোনা যাবে। মন্দিরা কাঁদছিল। তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিল। আনন্দে কাঁদছিল। অসহ্য সুন্দরের মাঝে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদছিল।

কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটে বলে-

আমাকে এখানে কেন এনেছো?

মানাভ ফিসফিস করে বলে-

- তোমাকে জ্যোৎস্নায় স্নান করিয়ে দেবো বলে এনেছি। নিজের হাতে। আকাশের জ্যোৎস্না মিশে যাবে তোমার শরীরের জ্যোৎস্নায়। আমি সেই জ্যোৎস্না আঁজলায় তুলে পান করবো।

মানাভের ঘোরলাগা চোখ দেখে, আচ্ছন্নতায় ঘেরা কথা শুনে একটু ভয় পায় মন্দিরা। ছেলেটাকে ভীষণ জ্যোৎস্নাকাতর লাগছে।

মন্দিরা বলে-

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, মানাভ। এমন অপার্থিব সুন্দর একটা রাত আমাকে দেখালে বলে...

কোকের ক্যানটা মন্দিরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছু না বলে উঠে যায় মানাভ। হয়তো গাড়ি থেকে কিছু আনতে গেছে।

তুষারের ওপরে আলতোভাবে বসে পড়ে মুগ্ধ মন্দিরা; তন্ময় হয়ে জ্যোৎস্নায় ডুবে থাকে। ভুলে যায় অরিত্রা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য।

পেছন থেকে মানাভ বলে- মন্দিরা চোখ বন্ধ করো।

মন্দিরা চোখ বন্ধ করে।

মানাভ সামনে এসে দাঁড়ায়।

-এবার চোখ খোলো মন্দিরা।

চোখ খুলে চমকে ওঠে মন্দিরা। ধবল তুষারের ওপর যেন দাঁড়িয়ে আছে পাথর খুঁদে বানানো এপোলো! মন্দিরার কেমন বিবশ লাগে নিজেকে; শিরশির করে ওঠে শরীর।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে মন্দিরার সামনে বসে মানাভ।

-এসো, তোমাকে স্নান করিয়ে দিই।

-না, আমার ঠাণ্ডা লাগবে।

-লাগবে না। পূর্ণিমায় ভিজবে না তুমি! তোমার তো কত উচ্ছ্বাস জ্যোৎস্নাকে নিয়ে।

-তা হোক।

আমি কল্পনায়, ভাবনায় জ্যোৎস্নাস্নান করি। আজ করলাম বাস্তবে। তার জন্য উন্মুক্ত হবার তো দরকার নেই। চলো আমরা ফিরে যাই।

-না, মানাভ। অরিত্রা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

-উঁহু, আজ আমরা সারারাত এখানে থাকবো। তোমার-আমার জন্য আজকের রাত হবে শ্রেষ্ঠ রাত। আমাকে ভালবাসো না তুমি?

-বাসি, ভালবাসি। তবে তা অন্যরকম ভালবাসা। শরীর দিয়ে শরীর ছোঁয়া মানেই ভালবাসা নয়, আমার অন্তর দিয়ে তোমার অন্তর ছুঁয়ে থাকি আমি...

-তোমার কাব্য আজ থাক। আজ আমরা পৃথিবীর গল্প বলবো।

-যেতে হবে মানাভ।

গ্রিক পুরাণের পাতা থেকে উঠে আসা এই মানাভকে উপেক্ষা করা বড় কঠিন। মন্দিরার শরীর শিথিল হয়ে যেতে থাকে কিন্তু নিজেকে ঝাড়া দিয়ে জাগিয়ে তোলে ফের।

-এভাবে তুমি যেতে পারো না। সারাজীবন পস্তাবে কিন্তু!

খরখরে গলায় মন্দিরা বলে:

-ভুল ভাবছো। তোমার জন্য আমার ভালবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

মানাভের গলায় ছলকে ওঠে অসহিষ্ণুতা:

-একটা রাতের জন্য তোমার ভালবাসা মরে যাবে কেন?

-যাবে, মানাভ মরে যাবে। একটা রাতের কারণে নিকোলের জন্য কি তোমার ভালবাসা মরে যায়নি?

মানাভের রাগ হয়। আবার অসহায় বোধ করে। মন্দিরা তাকে পেঁচিয়ে ফেলছে। খোঁচাচ্ছে। এতে রক্তপাত হচ্ছে না বরং বিরক্ত লাগছে। একটু শীত শীত লাগে তার।

মন্দিরা উঠে দাঁড়ায়:

চলো, আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসো। কাপড় পরে নাও, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

বলে ধবল তুষারের ওপর জেদি পা ফেলে হাঁটা দেয় মন্দিরা। পেছন থেকে ওর হেঁটে যাওয়া দেখে মানাভ। হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো প্রশ্রয় নেই, চলে যাবার ইচ্ছেটা তার স্পষ্ট। মানাভের পৌরুষে বড্ড লাগে। একবার ভাবে- যাক না, দেখি এই স্নো ভেঙে কতদূর যেতে পারে!

কিন্তু মন্দিরার জন্য তার খুব মায়া। কেমন এক নাম না জানা টান! এটাই কি তবে ভালবাসা? কনকনে ঠাণ্ডায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুকের ভেতরে হিমশীতল বাতাস টেনে নেয় মানাভ। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তার সহসাই মনে হয়- মন্দিরার এই ঋজুতা, এই উপেক্ষাটাকেই সে ভালবাসে।

যাক, মন্দিরা তবে তার পথে চলে যাক তবে এই অলৌকিক রাতে নয়।

মন্দিরা ততক্ষণে মিশে গেছে সুনসান রাতে।