ধারাবাহিক উপন্যাস : পঁতাল্লিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঊননব্বই.

বিধ্বস্ত হৃদয়ে নিয়ে সম্রাট দরবার হল থেকে তাঁর প্রাসাদ কক্ষে ফিরে এলেন। সম্রাজ্ঞী পুত্রদের নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন।

মুরাসাকি গেলেন মিচিনাগার দরবারে। সেখানে বিজয়ীদের উল্লাস ধ্বনিত হচ্ছে। মিচিনাগার লোকজন তাঁকে চেনে, সম্মান করে। মিচিনাগার দরবারে যাবার ব্যবস্থা করে দিল।

মুরাসাকি বললেন, একান্তে কথা বলতে চাই।

মিচিনাগার ইশারায় দরবার খালি হলো। মুরাসাকি বললেন, আপনি আমার সব অনুরোধই রেখেছেন, আমি তাঁর জন্য কৃতজ্ঞ। এখন একটি অনুরোধ রাখতে হবে।

কী অনুরোধ? বলে মিচিনাগা চিন্তিত হলেন।

মুরাসাকি বললেন, সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর সুরক্ষা। তাঁদের পাশে কেউ নেই।

আর কিছু?

না, এটুকুই। বলে মুরাসাকি চলে এলেন। তাঁর পৌঁছুবার আগে নিরাপত্তাদানকারী একটি বাহিনী প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। তা দেখে মুরাসাকি প্রাসাদে প্রবেশ না করে নিজের দপ্তরে চলে এলেন। নিজের সবকিছু গোছগাছ করে চলে গেলেন ইশিয়ামা ঢেরায়।

বিকেলে আবার গেলেন প্রাসাদে। কোনো ঝামেলা হয়নি। সব ঠিকঠাক আছে। সম্রাট সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজই প্রাসাদ ত্যাগ করবেন। জগৎ সংসারের প্রতি তাঁর একটা অনীহাভাবের জন্ম হয়েছে, যা কিছু ঘটে গেছে তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। সম্রাজ্ঞীও যেন কেমন সবকিছুতে খেই হারিয়ে ফেলছেন। এরই মধ্যে জানা গেল ইশিয়ামা ঢেরার অভিজাত এলাকায় সম্রাটের নিজস্ব যে প্রাসাদ রয়েছে, তাতে এরা উঠবেন।

তবে এখানে যে লোকবল রয়েছে, তা সামান্য, সবাই পালিয়েছে। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে কথা বলে মুরাসাকি নিজের লোকদের ডাকিয়ে আনালেন। তাঁর কন্যা এবং নিজে তদারকি করে সম্রাটের নিজস্ব মালামাল ইশিয়ামায় পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।

সম্রাট সেখানে গিয়ে রাজকীয় বাহিনীর সকল নিরাপত্তাকর্মীকে বিদায় করে দিলেন। সাম্রাজ্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। তিনি এতটাই মানসিক আঘাত পেয়েছেন যে, নিদারুণভাবে ভেঙে পড়েছেন। সম্রাজ্ঞীর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ। দুজন প্রিন্স যাতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দায়িত্ব নিলেন মুরাসাকি। ছোটটি একেবারে ছোট। বড়টি একটু মেজাজী। তাঁর ওপরই প্রভাব বেশি পড়বে। তাই তাঁর প্রতি দিলেন বাড়তি নজর। মুরাসাকি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, তবে স্নেহশীলা। তাই প্রিন্সরা তাঁকে গ্রহণ করেছে।

সম্রাট দরবারে আর যাবেন না। পরদিন সকালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করে দিলেন। তাঁরপরই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বৌদ্ধশ্রমনের ‘দীক্ষা’ নেবেন। এবং তাই করলেন তিন দিনের মাথায়। বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন দূরের এক পাহাড়ি প্যাগোডায়।

তাতে সম্রাজ্ঞী শোশি আরও ভেঙে পড়লেন। মুরাসাকির পক্ষে সবদিক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। তিনি কবি ইঝোমি শিকিবুকে সংবাদ পাঠালেন। ইঝোমি যেন কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়লেন। নির্জীব প্রাক্তন সম্রাট ইচিজোর ইশিয়ামার প্রাসাদ এখন আবার প্রাণ চঞ্চল। সম্রাজ্ঞীও স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। তাঁর দুই লেডি-ইন-ওয়েটিংয়ের ভূমিকায় তিনি কৃতজ্ঞ। এই দুঃসময়ে কেউ পাশে ছিল না। এরা সবকিছু আগলে রেখেছেন। বিশেষ করে দুই প্রিন্সকে।

কিন্তু কয়েক দিন পরই সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি এলো। ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র ৯ দিনের মাথায় সম্রাট ইচেজো বৌদ্ধ প্যাগোডায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

আবার শোকের ছায়া নেমে এলো। জীবনের স্পন্দন যেন থেমে গেল। ইচিজো বেশকিছু শিন্টু শ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডা স্থাপন করেন এবং কয়েকটি বিখ্যাত শ্রাইন ও প্যাগোডায় রাজকীয় সফরের ব্যবস্থা করেন। তাতে বৌদ্ধ এবং শিন্টু পুরোহিতরা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

মৃত্যুর পর রাজকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নতুন সম্রাট এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা ছুটে এলেন। ক্ষমতার লড়াই ভেতরে যাই হয়ে থাকুক বাইরে লোকদের দেখাতে হবে সম্রাটের জন্য তাঁরা কত অন্তপ্রাণ।

সম্রাজ্ঞী শোশি তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুই প্রিন্সকে নিয়ে। তাঁর দুই পাশে দুই নারী কবি। সম্রাট এবং মিচিনাগাকে ফিরে যেতে হবে। না হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বন্ধ থাকবে।

সম্রাট এবং মন্ত্রী ফিরে গেলেন। হাজার হাজার বৌদ্ধভান্তে এবং শিন্টুপুরোহিত একত্রিত হয়েছেন। তাঁরাই দায়িত্ব নিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার। কাঠ ও নানা রঙের বস্ত্রাবৃত্ত একটি যাদি প্রতীম চমৎকার অবকাঠামোর ভেতর মরদেহ রেখে মিছিল সহকারে শবযাত্রা শুরু হলো। ব্যানার এবং ফ্যাস্টুনের সাজসজ্জায় ব্যাপারটি যেন এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। হেইয়ানকিয়োর লাখো মানুষ এ শবযাত্রায় সামিল হয়েছে। পুরোহিতরা মন্ত্র এবং সূত্র পাঠ করছেন।

আর এই শবযাত্রার মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সম্রাজ্ঞী শোশি। তাঁর দুই পাশে দুই লেখক ও কবি মুরাসাকি শিকিবু এবং ইজোমি শিকিবু। তাঁদের পরনে শোকের পোশাক। এই শোক যেন শক্তি। তাঁদের চোখেমুখে বিপ্লবের ভাব। (সমাপ্ত)

কৈফিয়ৎ

২০১৩ সালে মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জাপানে ছিলাম। শিল্পায়নে এফডিআই বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে সরকারি সফল হলেও আমার উৎসাহের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল জাপানের ঐতিহ্য এবং শিল্প-সাহিত্য। তাই জাপানি শিল্প-সাহিত্যের খোঁজে নানা জায়গায় গেছি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল উজিতে ‘গেঞ্জি মিউজিয়াম’। বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস মুরাসাকি শিকিবুর ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’কে কেন্দ্র করে এই মিউজিয়াম। মুরাসাকি সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা ছিল। মিউজিয়ামে গিয়ে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। পড়ালেখা করে তাঁর ওপর একটি গল্প লিখি। তারপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ। তখনো চরিত্রটি যেন দাবি করছে আরও বড় কিছু লিখ। এ সময় তিনি এবং তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা এবং ডায়েরি পড়ার সুযোগ লাভ ঘটে। এ সুবাদে শিকিবু উপন্যাস লেখা।

চারজন কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে এই উপন্যাস। তাঁদের জন্ম এবং মৃত্যু সন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক এবং অস্পষ্টতা রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং সম্রাট ইচিজোর মাতা সেনশির মৃত্যু নিয়েও। প্রায় লেখায়ই বলা হয়েছে তেইশি ১০০১ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তা কতটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। কেননা, তাঁর দরবারের কবি এবং বিখ্যাত ‘পিলুবুক’ রচয়িতা সেই শোনাগনকে বলা হয় মুরাসাকির প্রতিদ্বন্দ্বী (রাইভাল)। মুরাসাকি অপর সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে যোগ দেন ১০০৫ সালে। দুই সম্রাজ্ঞীর মধ্যে নানা প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ১০০১ সালে তেইশির মৃত্যু হলে তা কী করে সম্ভব? পণ্ডিতেরা (বিন প্রমুখ) মনে করেন, মুরাসাকিকে রাজপ্রাসাদে আনাই হয়েছিল সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং সেই শোনাগনের জনপ্রিয় বই ‘দ্য পিলুবুক’ এর মুখোমুখি ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’কে দাঁড়া করানোর জন্য। ততদিনে গেঞ্জিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

সম্রাট ইচিজোর ওপর তাঁর মাতা সেনশির প্রবল প্রভাব ছিল। প্রবল প্রতাপশালী এই ভদ্রমহিলা সাম্রাজ্যের সব খোঁজখবর রাখতেন এবং বড় বড় পদে তাঁর লোক নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতেন। এ নিয়ে আরেক প্রতাপশালী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাঁধে। এরা পরস্পরের ভাই ও বোন। লেডি সেনশি বিদগ্ধ রমণী ছিলেন। ঋদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার অধিকারী ছিলেন। মিচিনাগা চাইতেন তাঁর কন্যা সম্রাজ্ঞী শোশি সেনশির মতোই বিদগ্ধ রমণীতে পরিণত হোন। আর তা সম্ভব ছিল মুরাসাকির সান্নিধ্যে।

মুরাসাকি রাজপ্রাসাদের রাজকীয় পাথরচাপাভাবটা পছন্দ করতেন না। সেনশি প্রভাবশালী এবং বিদগ্ধ ঋদ্ধ রমণী হলেও তাঁর দরবার ছিল রাজকীয় পাথরচাপা ভারমুক্ত। সেনশি তাঁর গেঞ্জি মনোগাতারির উৎসাহী পাঠক এবং উৎসাহদাতা ছিলেন বলে সেখানে তাঁর যাতায়াত ছিল উন্মক্ত। বিভিন্ন লেখায় পাওয়া গেছে সেনশি ১০০২ সালে মারা গেছেন। তা গ্রহণযোগ্য নয় এজন্য যে, মুরাসাকি সম্রাটের প্রাসাদেই লেডি-ইন-ওয়েটিং হয়ে গেছেন ১০০৫ সালে। তা না হলে সেনশির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নানা লেখকের কথায় এই সাক্ষাতের কথা আছে। ওয়ালে স্পষ্টই বলেছেন, তিনি (মুরাসাকি) সেখানে শুধু লেডি সেনশিকে পছন্দ করতেন। তাঁর ঘরে কড়াকড়ি ছিল না। ছিল না রাজকীয় পাথরচাপা ভাব। লেডি সেনশি মারা গেছেন তাঁর পুত্র ইচিজোর সিংহাসন ত্যাগ তথা মৃত্যুর পর (১০১১ সালের পর)। ইতিহাস গ্রন্থ ‘ওকাগামি’ (মহা আয়না)তে দেখা যায়, সেনশি মারা গেছেন উজির মিসাসাফিতে। সেখানে ফুজিওয়ারা সমাধিতে তাঁর পবিত্র হাড়গোড় এবং দেহভষ্ম সমাধিস্থ করা হয়। এ কথার সমর্থন রয়েছে ‘এইগা মনোগাতারি’তেও। ১০০২ সালে সেনশিপুত্র সম্রাট ইচিজো মায়ের প্রভাব বলয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। এ সময় সেনশির মৃত্যু হলে তাঁর সমাধি কিয়োটোর রাজকীয় সমাধিতে হওয়ার কথা, উজিতে নয়। শুধু তাই নয়, গ্রন্থ দুটোয় উল্লেখ আছে, মিচিনাগা তাঁর দেহভষ্ম এবং হাড়গোড় সম্মানের সঙ্গে সংরক্ষণ করেন। পুত্র বেঁচে থাকতে কেন বৈরিভাবাপন্ন ভাই তা করবেন? পরে প্রমাণিত হয়েছে যে, মিচিনাগা নন, সম্রাট মারা যাওয়ায়, সেনশির এক ভ্রাতুষ্পুত্র ফুজিওয়ারা নো কানেতাকা সৎকারের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিলেন। এই কানেতাকার আরেক পরিচয় তিনি মুরাসাকির কন্যা কবি দাইনিনো-সানমির স্বামী। এই সুবাদে এই সৎকার কার্যে মুরাসাকির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। উজিতে মুরাসাকির যাওয়া-আসার প্রমাণ রয়েছে গেঞ্জির শেষ দশ অধ্যায় উজির পটভূমিতে লেখার মধ্যে।

‘শিকিবু’ উপন্যাসটি লিখতে নানা প্রবন্ধ/গ্রন্থসূত্রের সহায়তা নেয়া হয়েছে। সচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়েছে মুরাসাকি ও ইঝোমি শিকিবুর লেখা নিজস্ব ডায়েরির ওপর। কখনো কখনো মনে হবে ডায়েরিগুলোই বুঝি উপন্যাস হয়ে উঠেছে। একটি অপরিচিত দেশ, সংস্কৃতি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একাদশ শতকের গল্প বলতে গিয়ে অনেক ক্লেশ স্বীকার করতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে পাঠকের কথাও। যাদের গল্প বলা হয়েছে, ইতিহাসে তাঁরা বিখ্যাত ব্যক্তি। পাঠক-গবেষকরা এসব বিষয় বিবেচনায় আনলে হয়ত ক্ষেত্র বিশেষে লেখকের দায়মুক্তি ঘটবে। -লেখক

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : পঁতাল্লিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঊননব্বই.

বিধ্বস্ত হৃদয়ে নিয়ে সম্রাট দরবার হল থেকে তাঁর প্রাসাদ কক্ষে ফিরে এলেন। সম্রাজ্ঞী পুত্রদের নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন।

মুরাসাকি গেলেন মিচিনাগার দরবারে। সেখানে বিজয়ীদের উল্লাস ধ্বনিত হচ্ছে। মিচিনাগার লোকজন তাঁকে চেনে, সম্মান করে। মিচিনাগার দরবারে যাবার ব্যবস্থা করে দিল।

মুরাসাকি বললেন, একান্তে কথা বলতে চাই।

মিচিনাগার ইশারায় দরবার খালি হলো। মুরাসাকি বললেন, আপনি আমার সব অনুরোধই রেখেছেন, আমি তাঁর জন্য কৃতজ্ঞ। এখন একটি অনুরোধ রাখতে হবে।

কী অনুরোধ? বলে মিচিনাগা চিন্তিত হলেন।

মুরাসাকি বললেন, সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর সুরক্ষা। তাঁদের পাশে কেউ নেই।

আর কিছু?

না, এটুকুই। বলে মুরাসাকি চলে এলেন। তাঁর পৌঁছুবার আগে নিরাপত্তাদানকারী একটি বাহিনী প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। তা দেখে মুরাসাকি প্রাসাদে প্রবেশ না করে নিজের দপ্তরে চলে এলেন। নিজের সবকিছু গোছগাছ করে চলে গেলেন ইশিয়ামা ঢেরায়।

বিকেলে আবার গেলেন প্রাসাদে। কোনো ঝামেলা হয়নি। সব ঠিকঠাক আছে। সম্রাট সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজই প্রাসাদ ত্যাগ করবেন। জগৎ সংসারের প্রতি তাঁর একটা অনীহাভাবের জন্ম হয়েছে, যা কিছু ঘটে গেছে তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। সম্রাজ্ঞীও যেন কেমন সবকিছুতে খেই হারিয়ে ফেলছেন। এরই মধ্যে জানা গেল ইশিয়ামা ঢেরার অভিজাত এলাকায় সম্রাটের নিজস্ব যে প্রাসাদ রয়েছে, তাতে এরা উঠবেন।

তবে এখানে যে লোকবল রয়েছে, তা সামান্য, সবাই পালিয়েছে। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে কথা বলে মুরাসাকি নিজের লোকদের ডাকিয়ে আনালেন। তাঁর কন্যা এবং নিজে তদারকি করে সম্রাটের নিজস্ব মালামাল ইশিয়ামায় পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।

সম্রাট সেখানে গিয়ে রাজকীয় বাহিনীর সকল নিরাপত্তাকর্মীকে বিদায় করে দিলেন। সাম্রাজ্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। তিনি এতটাই মানসিক আঘাত পেয়েছেন যে, নিদারুণভাবে ভেঙে পড়েছেন। সম্রাজ্ঞীর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ। দুজন প্রিন্স যাতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দায়িত্ব নিলেন মুরাসাকি। ছোটটি একেবারে ছোট। বড়টি একটু মেজাজী। তাঁর ওপরই প্রভাব বেশি পড়বে। তাই তাঁর প্রতি দিলেন বাড়তি নজর। মুরাসাকি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, তবে স্নেহশীলা। তাই প্রিন্সরা তাঁকে গ্রহণ করেছে।

সম্রাট দরবারে আর যাবেন না। পরদিন সকালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্বাক্ষর করে দিলেন। তাঁরপরই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বৌদ্ধশ্রমনের ‘দীক্ষা’ নেবেন। এবং তাই করলেন তিন দিনের মাথায়। বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন দূরের এক পাহাড়ি প্যাগোডায়।

তাতে সম্রাজ্ঞী শোশি আরও ভেঙে পড়লেন। মুরাসাকির পক্ষে সবদিক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। তিনি কবি ইঝোমি শিকিবুকে সংবাদ পাঠালেন। ইঝোমি যেন কোমরে কাপড় বেঁধে নেমে পড়লেন। নির্জীব প্রাক্তন সম্রাট ইচিজোর ইশিয়ামার প্রাসাদ এখন আবার প্রাণ চঞ্চল। সম্রাজ্ঞীও স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। তাঁর দুই লেডি-ইন-ওয়েটিংয়ের ভূমিকায় তিনি কৃতজ্ঞ। এই দুঃসময়ে কেউ পাশে ছিল না। এরা সবকিছু আগলে রেখেছেন। বিশেষ করে দুই প্রিন্সকে।

কিন্তু কয়েক দিন পরই সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি এলো। ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র ৯ দিনের মাথায় সম্রাট ইচেজো বৌদ্ধ প্যাগোডায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

আবার শোকের ছায়া নেমে এলো। জীবনের স্পন্দন যেন থেমে গেল। ইচিজো বেশকিছু শিন্টু শ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডা স্থাপন করেন এবং কয়েকটি বিখ্যাত শ্রাইন ও প্যাগোডায় রাজকীয় সফরের ব্যবস্থা করেন। তাতে বৌদ্ধ এবং শিন্টু পুরোহিতরা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

মৃত্যুর পর রাজকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নতুন সম্রাট এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগা ছুটে এলেন। ক্ষমতার লড়াই ভেতরে যাই হয়ে থাকুক বাইরে লোকদের দেখাতে হবে সম্রাটের জন্য তাঁরা কত অন্তপ্রাণ।

সম্রাজ্ঞী শোশি তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুই প্রিন্সকে নিয়ে। তাঁর দুই পাশে দুই নারী কবি। সম্রাট এবং মিচিনাগাকে ফিরে যেতে হবে। না হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বন্ধ থাকবে।

সম্রাট এবং মন্ত্রী ফিরে গেলেন। হাজার হাজার বৌদ্ধভান্তে এবং শিন্টুপুরোহিত একত্রিত হয়েছেন। তাঁরাই দায়িত্ব নিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার। কাঠ ও নানা রঙের বস্ত্রাবৃত্ত একটি যাদি প্রতীম চমৎকার অবকাঠামোর ভেতর মরদেহ রেখে মিছিল সহকারে শবযাত্রা শুরু হলো। ব্যানার এবং ফ্যাস্টুনের সাজসজ্জায় ব্যাপারটি যেন এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। হেইয়ানকিয়োর লাখো মানুষ এ শবযাত্রায় সামিল হয়েছে। পুরোহিতরা মন্ত্র এবং সূত্র পাঠ করছেন।

আর এই শবযাত্রার মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সম্রাজ্ঞী শোশি। তাঁর দুই পাশে দুই লেখক ও কবি মুরাসাকি শিকিবু এবং ইজোমি শিকিবু। তাঁদের পরনে শোকের পোশাক। এই শোক যেন শক্তি। তাঁদের চোখেমুখে বিপ্লবের ভাব। (সমাপ্ত)

কৈফিয়ৎ

২০১৩ সালে মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জাপানে ছিলাম। শিল্পায়নে এফডিআই বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে সরকারি সফল হলেও আমার উৎসাহের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল জাপানের ঐতিহ্য এবং শিল্প-সাহিত্য। তাই জাপানি শিল্প-সাহিত্যের খোঁজে নানা জায়গায় গেছি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল উজিতে ‘গেঞ্জি মিউজিয়াম’। বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস মুরাসাকি শিকিবুর ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’কে কেন্দ্র করে এই মিউজিয়াম। মুরাসাকি সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা ছিল। মিউজিয়ামে গিয়ে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। পড়ালেখা করে তাঁর ওপর একটি গল্প লিখি। তারপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ। তখনো চরিত্রটি যেন দাবি করছে আরও বড় কিছু লিখ। এ সময় তিনি এবং তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা এবং ডায়েরি পড়ার সুযোগ লাভ ঘটে। এ সুবাদে শিকিবু উপন্যাস লেখা।

চারজন কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে এই উপন্যাস। তাঁদের জন্ম এবং মৃত্যু সন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক এবং অস্পষ্টতা রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং সম্রাট ইচিজোর মাতা সেনশির মৃত্যু নিয়েও। প্রায় লেখায়ই বলা হয়েছে তেইশি ১০০১ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তা কতটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। কেননা, তাঁর দরবারের কবি এবং বিখ্যাত ‘পিলুবুক’ রচয়িতা সেই শোনাগনকে বলা হয় মুরাসাকির প্রতিদ্বন্দ্বী (রাইভাল)। মুরাসাকি অপর সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে যোগ দেন ১০০৫ সালে। দুই সম্রাজ্ঞীর মধ্যে নানা প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। ১০০১ সালে তেইশির মৃত্যু হলে তা কী করে সম্ভব? পণ্ডিতেরা (বিন প্রমুখ) মনে করেন, মুরাসাকিকে রাজপ্রাসাদে আনাই হয়েছিল সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং সেই শোনাগনের জনপ্রিয় বই ‘দ্য পিলুবুক’ এর মুখোমুখি ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’কে দাঁড়া করানোর জন্য। ততদিনে গেঞ্জিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

সম্রাট ইচিজোর ওপর তাঁর মাতা সেনশির প্রবল প্রভাব ছিল। প্রবল প্রতাপশালী এই ভদ্রমহিলা সাম্রাজ্যের সব খোঁজখবর রাখতেন এবং বড় বড় পদে তাঁর লোক নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতেন। এ নিয়ে আরেক প্রতাপশালী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাঁধে। এরা পরস্পরের ভাই ও বোন। লেডি সেনশি বিদগ্ধ রমণী ছিলেন। ঋদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার অধিকারী ছিলেন। মিচিনাগা চাইতেন তাঁর কন্যা সম্রাজ্ঞী শোশি সেনশির মতোই বিদগ্ধ রমণীতে পরিণত হোন। আর তা সম্ভব ছিল মুরাসাকির সান্নিধ্যে।

মুরাসাকি রাজপ্রাসাদের রাজকীয় পাথরচাপাভাবটা পছন্দ করতেন না। সেনশি প্রভাবশালী এবং বিদগ্ধ ঋদ্ধ রমণী হলেও তাঁর দরবার ছিল রাজকীয় পাথরচাপা ভারমুক্ত। সেনশি তাঁর গেঞ্জি মনোগাতারির উৎসাহী পাঠক এবং উৎসাহদাতা ছিলেন বলে সেখানে তাঁর যাতায়াত ছিল উন্মক্ত। বিভিন্ন লেখায় পাওয়া গেছে সেনশি ১০০২ সালে মারা গেছেন। তা গ্রহণযোগ্য নয় এজন্য যে, মুরাসাকি সম্রাটের প্রাসাদেই লেডি-ইন-ওয়েটিং হয়ে গেছেন ১০০৫ সালে। তা না হলে সেনশির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নানা লেখকের কথায় এই সাক্ষাতের কথা আছে। ওয়ালে স্পষ্টই বলেছেন, তিনি (মুরাসাকি) সেখানে শুধু লেডি সেনশিকে পছন্দ করতেন। তাঁর ঘরে কড়াকড়ি ছিল না। ছিল না রাজকীয় পাথরচাপা ভাব। লেডি সেনশি মারা গেছেন তাঁর পুত্র ইচিজোর সিংহাসন ত্যাগ তথা মৃত্যুর পর (১০১১ সালের পর)। ইতিহাস গ্রন্থ ‘ওকাগামি’ (মহা আয়না)তে দেখা যায়, সেনশি মারা গেছেন উজির মিসাসাফিতে। সেখানে ফুজিওয়ারা সমাধিতে তাঁর পবিত্র হাড়গোড় এবং দেহভষ্ম সমাধিস্থ করা হয়। এ কথার সমর্থন রয়েছে ‘এইগা মনোগাতারি’তেও। ১০০২ সালে সেনশিপুত্র সম্রাট ইচিজো মায়ের প্রভাব বলয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। এ সময় সেনশির মৃত্যু হলে তাঁর সমাধি কিয়োটোর রাজকীয় সমাধিতে হওয়ার কথা, উজিতে নয়। শুধু তাই নয়, গ্রন্থ দুটোয় উল্লেখ আছে, মিচিনাগা তাঁর দেহভষ্ম এবং হাড়গোড় সম্মানের সঙ্গে সংরক্ষণ করেন। পুত্র বেঁচে থাকতে কেন বৈরিভাবাপন্ন ভাই তা করবেন? পরে প্রমাণিত হয়েছে যে, মিচিনাগা নন, সম্রাট মারা যাওয়ায়, সেনশির এক ভ্রাতুষ্পুত্র ফুজিওয়ারা নো কানেতাকা সৎকারের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিলেন। এই কানেতাকার আরেক পরিচয় তিনি মুরাসাকির কন্যা কবি দাইনিনো-সানমির স্বামী। এই সুবাদে এই সৎকার কার্যে মুরাসাকির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। উজিতে মুরাসাকির যাওয়া-আসার প্রমাণ রয়েছে গেঞ্জির শেষ দশ অধ্যায় উজির পটভূমিতে লেখার মধ্যে।

‘শিকিবু’ উপন্যাসটি লিখতে নানা প্রবন্ধ/গ্রন্থসূত্রের সহায়তা নেয়া হয়েছে। সচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়েছে মুরাসাকি ও ইঝোমি শিকিবুর লেখা নিজস্ব ডায়েরির ওপর। কখনো কখনো মনে হবে ডায়েরিগুলোই বুঝি উপন্যাস হয়ে উঠেছে। একটি অপরিচিত দেশ, সংস্কৃতি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একাদশ শতকের গল্প বলতে গিয়ে অনেক ক্লেশ স্বীকার করতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে পাঠকের কথাও। যাদের গল্প বলা হয়েছে, ইতিহাসে তাঁরা বিখ্যাত ব্যক্তি। পাঠক-গবেষকরা এসব বিষয় বিবেচনায় আনলে হয়ত ক্ষেত্র বিশেষে লেখকের দায়মুক্তি ঘটবে। -লেখক