ভারতচন্দ্রের মৌন বিদ্রোহ

সৈয়দ জাহিদ হাসান

বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের কালপরিধি ছয়শত বছরের। এই ছয়শত বছরে অসংখ্য সাহিত্য-শিল্পী তাঁদের আবেগ-অনুভূতি-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন। মধ্যযুগের যে ক’জন কবি সাহিত্যের পাতায় ও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন তাঁদের অন্যতম হলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। কারো কারো মতে, ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি। ভারতচন্দ্র ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বর্ধমান বিভাগের ভুরসুট পরগণার পেঁড়ো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে। ভারতচন্দ্রের পিতা ছিলেন রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ রায়। তিনি জমিদার এবং বংশ মর্যাদায় ব্রাহ্মণ ছিলেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্র বলেছেন-

“ভুরিশিটে মহাকায় ভুপতি নরেন্দ্র রায়,

মুখটি বিখ্যাত দেশে দেশে

ভারত তনয় তাঁর অন্নদা মঙ্গল সার,

কহে কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।”

ভারতচন্দ্রের ছিল তীক্ষè বুদ্ধি আর তির্যক রস-বোধ। তাঁর ছন্দের জাদুতে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কথাকে তিনি এমন কৌশলে সাজাতেন যে সম্মোহিত হওয়া ছাড়া পাঠক-শ্রোতার আর কোনো উপায় থাকতো না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভারত প্রতিভায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘গুণাকর’ উপাধি দান করেন এবং কাব্য রচনার আদেশ দেন। এ প্রসঙ্গে ভারতচন্দ্র লিখেছেন-

‘কবি রায় গুণাকর খ্যাতি সমর্পিয়া,

ভারতেরে আজ্ঞা দিল গীতের লাগিয়া।’

রাজার আদেশ পেয়ে কবি রচনা করলেন তাঁর অমরগ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’। অন্নদামঙ্গলের রচনাকাল সম্পর্কে কবি বলেন-

‘বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা,

সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা॥’

অর্থাৎ, ব্রহ্ম=১, রস=৬, ঋষি=৭ এবং বেদ=৪ হলে অন্নদামঙ্গলের রচনাকাল দাঁড়ায় ১৬৭৪ শকাব্দ বা ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ।

ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। মঙ্গলকাব্যের যুগে জন্ম নিয়েও, এমনকি নিজে মঙ্গলকাব্য রচনা করেও তিনি ছিলেন আধুনিক মানসিকতার কবি। তাঁর কাব্যেই প্রথম মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগের সন্ধিলক্ষণ যুগপৎ আভাসিত হয়েছে। দেব-দেবী মাহাত্ম্য আর ভক্তিবাদের মোহে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল মধ্যযুগের কাব্য-কবিরা। ভারতচন্দ্রই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মধ্যযুগীয় কাব্যাদর্শের বিরুদ্ধে।

কতিপয় সমালোচকের অসম্ভব পরিশ্রমের ফলে অনেকের মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ভারতচন্দ্র অশ্লীল এবং কামপ্রবণ কবি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কামশাস্ত্রও ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন বিদ্যা এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পরতে পরতে এই কামশাস্ত্র প্রয়োগের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তাছাড়া ভারতচন্দ্র যে সময়ে কাব্যরচনা করেছেন সে সময়ে স্বামী-স্ত্রীর গুপ্ত দাম্পত্য জীবন খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করা অরুচিকর ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী হয়েও ভারতচন্দ্রের কাব্যে যখন কেউ অশ্লীলতা খুঁজে পান তখন আমাদের কাঁধে এসে দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাব্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার। ভারতচন্দ্রের কাব্যে কতখানি আছে অশ্লীলতা আর কতখানি আছে আর্ট তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার।

এ বিষয়ে বিগদ্ধ প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন- ‘যে দোষে প্রাচীন কবিরা প্রায় সকলেই সমান দোষী সে দোষের জন্য একা ভারতচন্দ্রকে তিরস্কার করার কারণ কী? এর প্রধান কারণ, ভারতচন্দ্রের কাব্য যত সুপরিচিত অপর কারো তত নয়। আর দ্বিতীয় কারণ, ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার ভিতর আর্ট আছে, অপরের আছে শুধু ন্যাচার। ভারতচন্দ্র যা দিয়ে তা ঢাকা দিতে গিয়েছিলেন তাতেই তা ফুটে উঠেছে। তাঁর ছন্দ ও অলংকারের প্রসাদেই তাঁর কথা কারো চোখ-কান এড়িয়ে যায় না। পাঠকের পক্ষে ও জিনিস উপেক্ষা করার পথ তিনি রাখেননি। তবে এক শ্রেণির পাঠক আছে যাদের কাছে ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতা ততটা চোখে পড়ে না যতটা পড়ে তাঁর আর্ট। তারপর ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতা গম্ভীর নয়, সহাস্য।

বহুদর্শী ভারতচন্দ্র ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর পড়াশোনা এবং জীবনাভিজ্ঞতা এত ব্যাপক ছিল যে, সেদিকে তাকালে বিস্ময় মানতে হয়। ভারতচন্দ্র নিজেই বলেছেন-

‘পড়িয়াছি যেই মতো লিখিবারে পারি।

কিন্তু সে সকল লোক বুঝিবারে ভারি॥

না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।

অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল॥’

ভাষার ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্র ছিলেন সর্বভুক। কোনো কিছু না ভেবে শুধু তাঁর রচনাকে রসাল ও প্রসাদগুণ সমৃদ্ধ করার জন্য যে কোনো ভাষার শব্দকেই তিনি সযতেœ ব্যবহার করেছেন। বলা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য প্রথা ভেঙে বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করেছেন। ভারতচন্দ্রের বহু কবিতা আছে যেখানে তিনি একই সাথে ব্যবহার করেছেন সংস্কৃতি, ফারসি, হিন্দি (উর্দু) ভাষা। তবে এ বিষয়ে আরেকজন কবির নাম স্মরণ করতেই হয়, তিনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরামও তাঁর কাব্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন। তাঁর কাব্যেও প্রচুর আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।

চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্রের অনন্যতা অসামান্য। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে যে সকল চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তারা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শিব-দুর্গা, ঈশ্বরী পাটনী, হীরা মালিনী, বিদ্যা, সুন্দর সকলেই অদ্বিতীয় সৃষ্টি। একজন নষ্টা নারীর যে সব বৈশিষ্ট্য থাকে হীরার মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। ভারতচন্দ্রের হীরার মতো নারী চরিত্র সমগ্র মঙ্গলকাব্যে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। হীরা চরিত্র বর্ণনায় কবি লিখেছেন-

কথায় হীরার ধার হীরা তার নাম।

দাঁত ছোলা মাজা দোলা হাস্য অবিরাম॥

গরা ভরা গুয়া পান পাকি মালা গলে।

কানে কড়ি কড়ে বাঁড়ী কথা কত ছলে॥

চূড়া বান্ধা চুল, পরিধান সাদা শাড়ী।

পুলের চুপড়ী কাঁখে ফিরে বাড়ি বাড়ী॥

আছিল বিস্তর ঠাট প্রথম বয়সে।

এবে বুড়া তবু কিছু গুঁড়া আছে শেষে॥

ছিটা ছোটা তন্ত্রমন্ত্র আসে কতগুলি।

চেঙ্গাড়া ভুলায়ে খায় চক্ষে দিয়া ঠুলি॥

বাতাসে পাতিয়া ফাঁদ কন্দল ভেজায়।

পড়শী না থাকে কাছে কন্দলের দায়॥

অথবা যখন আমরা শিব-দুর্গার কথোপকথন শুনি তখনও আমাদের মনে হয় না কোনো দেব-দেবীর কথোপকথন শুনছি। মনে হয় সংসার ভারাক্রান্ত কোনো অভাবগ্রস্ত বাঙালি গৃহস্থই তার দুর্দশাগ্রস্ত গৃহের বর্ণনা দিচ্ছেন। একটি উদাহরণ দিতে চাই-

বৃদ্ধকাল আপনার নাহি জানি রোজগার,

চাষবাস বাণিজ্য ব্যাপার।

সকলে নির্গুণ কয় ভুলায়ে সর্বস্ব লয়

নাম মাত্র রহিয়াছে সার॥

যত আনি তত নাই না ঘুচিল খাই খাই

কিবা সুখ এ ঘরে থাকিয়া

এত বলি দিগম্বর আরোহিয়া বৃষোপর

চলিলেন ভিক্ষার লাগিয়া॥

‘একই অঙ্গে এতরূপ নয়নে না ধরে’ এই কথাটি যে কবির বেলায় সবচেয়ে বেশি খাটে তিনি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ভারতচন্দ্র একই সাথে ছন্দ্ররাজ ও রসরাজ। তিনি তাঁর কাব্যে এত সব ছন্দ আর অলংকারের প্রয়োগ করেছেন যে তা রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার। তাঁর কাব্যের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আছে পয়ার, ভঙ্গ পয়ার, লঘু ত্রিপদী, নর্তক ত্রিপদী, দীর্ঘ চৌপদী, দিগক্ষরা, ভুজঙ্গ প্রয়াত, তূণক, তোটক প্রভৃতি ছন্দ। অলংকার হিসেবে ব্যবহার করেছেন- যমক, রূপক, অতিশয়োক্তি, ব্যাজস্তুতি, বিরোধাভাস, বিশেষোক্তি, অপ্রস্তুত প্রসংশা ইত্যাদি। আর রসের কথা বলতে গেলে অবশ্যই উচ্চারণ করতে হয়- শৃঙ্গার, বীর, হাস্য রসের নাম। হাস্যরসিক ভারতচন্দ্র চরম সংকটেও হাসতে পারতেন এটি তাঁর কাব্য পড়লেই টের পাওয়া যায়।

ভারতচন্দ্রের কাব্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার। তাঁর কাব্যে তিনি প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন তো অন্তর্ভুক্ত করেছেনই সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ব্রতী হয়েছেন প্রবাদ-প্রবচন রচনায়। তাঁর প্রবাদ-প্রবচনের কয়েকটি নমুনা দিতে চাই যা এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে-

‘পড়িয়ে ভেড়ার শৃঙ্গে ভাঙে হীরা ধার।’

অথবা,

‘লোভের নিকটে যদি ফাঁদ পাতা যায়

পশুপাখী সাপ মাছ কে কোথা এড়ায়।’

কিংবা,

‘নীচ যদি উচ্চ ভাষে

সুবুদ্ধি উড়ায় হেসে।’

অথবা,

যতন নহিলে নাহি মিলয়ে রতন।’ ইত্যাদি।

গ্রাম্যতার পর্যায় থেকে একক প্রচেষ্টায় যে কবি বিষয় বৈচিত্র্যকে নাগরিক রুচিতে উত্তীর্ণ করেছিলেন, তিনি অমর কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ভারতচন্দ্র বাংলার অহংকার, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম কবি। যে নক্ষত্র যত বেশি উজ্জ্বল তাঁর আলো ততবেশি নজর কাড়ে মানুষের। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই তাই বলতে হয়- ‘রাজসভা-কবি রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো। যেমন তাহার উজ্জ্বলতা, তেমনি তাহার কারুকার্য।’

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে আনুমানিক ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্র জন্ম করেন বলে মত দেন। ভারতচন্দ্র ছিলেন জমিদার পিতার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। জমিদার তনয় হয়েও ভারতচন্দ্রকে আমৃত্যু দারুণ অর্থকষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। শুধু অর্থ কষ্ট নয়, তাকে জেল-জুলুমও সহ্য করতে হয়েছে। ভারতচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁর পিতা অতিক্রম করছিলেন অর্থনৈতিক ভাটার কাল। বর্ধমান রাজার সাথে ভারতচন্দ্রের পিতা বিবাদে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হন। সংসারে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতচন্দ্র আশ্রয় নেন মাতুলালয়ে। মাতুলালয়ে থেকেই তিনি সংস্কৃত ভাষা শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি এক বালিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একদিকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা অন্যদিকে বিবাহ- এই দুটি কারণে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাগণ তাকে কটাক্ষ করেন। কেননা, সে সময়ে রাজ-ভাষা ছিল ফারসি। এই ফারসি ভাষা ছিল উপার্জনেরও একটি বিশেষ মাধ্যম। সুতরাং অর্থকরী ভাষা না শিখে পাণ্ডিত্যের ভাষা শিখেছিলেন বলে ভারতচন্দ্রের ভ্রাতাগণ তাকে গালমন্দ করেন। ভ্রাতাদের ভর্ৎসনায় অভিমান জমলো ভারতচন্দ্রের মনে। তিনি ঘর ছেড়ে হুগলির নিকটবর্তী দেবানন্দপুরের ফারসি ভাষাবিদ রামচন্দ্র মুনশীর বাড়িতে থেকে ফারসি ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন। বিশ বছর বয়সে ফারসি ভাষায় কৃতবিদ্য হয়ে ভারতচন্দ্র নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন এবং পরিবার কর্তৃক সসম্মানে আদৃত হন। ঠিক এই সময়ে তার পিতা বর্ধমান রাজার কাছ থেকে কিছু সম্পত্তি ইজারা প্রাপ্ত হন। যেহেতু ভারতচন্দ্র রাজভাষা ফারসি খুব ভালো জানতেন তাই তিনি পিতা ও ভ্রাতাগণ কর্তৃক বর্ধমান রাজার দরবারে মোক্তার রূপে প্রেরিত হন। কিন্তু বেশি দিন তিনি এই কাজ করতে পারলেন না। নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায়ে ব্যর্থ হলে বর্ধমান রাজা ভারতচন্দ্রের পিতার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন এবং ভারতচন্দ্রকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন।

কারাগার থেকে কৌশলে মুক্তিলাভ করে তিনি পালিয়ে যান কটকে। কটক থেকে তীর্থবাসী হয়ে রওনা হন শ্রীক্ষেত্রে। শ্রীক্ষেত্র থেকে সন্ন্যাসী বেশে বৃন্দাবনে যাবার কালে হুগলি খানাকুল পরগনার কৃষ্ণনগর গ্রামে তার ভায়রা ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে যান। তাঁর ভায়রা ভাই তাঁকে বাড়ি নিয়ে এলে বহুদিন পরে পতœীর সঙ্গে ভারতচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়। খানাকুলে কিছুদিন বাস করে ভারতচন্দ্র জীবিকার অন্বেষণে উপনীত হন চন্দন নগরের দেওয়ান ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কাছে। ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সহায়তায়ই ভারতচন্দ্র মাসিক ৪০ টাকায় নবদ্বীপপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি নিযুক্ত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি নিযুক্তির সময় ভারতচন্দ্রের বয়স ছিল ৪০ বছর।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

ভারতচন্দ্রের মৌন বিদ্রোহ

সৈয়দ জাহিদ হাসান

image

শিল্পীর চোখে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর

বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের কালপরিধি ছয়শত বছরের। এই ছয়শত বছরে অসংখ্য সাহিত্য-শিল্পী তাঁদের আবেগ-অনুভূতি-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন। মধ্যযুগের যে ক’জন কবি সাহিত্যের পাতায় ও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন তাঁদের অন্যতম হলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। কারো কারো মতে, ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি। ভারতচন্দ্র ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বর্ধমান বিভাগের ভুরসুট পরগণার পেঁড়ো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে। ভারতচন্দ্রের পিতা ছিলেন রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ রায়। তিনি জমিদার এবং বংশ মর্যাদায় ব্রাহ্মণ ছিলেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্র বলেছেন-

“ভুরিশিটে মহাকায় ভুপতি নরেন্দ্র রায়,

মুখটি বিখ্যাত দেশে দেশে

ভারত তনয় তাঁর অন্নদা মঙ্গল সার,

কহে কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।”

ভারতচন্দ্রের ছিল তীক্ষè বুদ্ধি আর তির্যক রস-বোধ। তাঁর ছন্দের জাদুতে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কথাকে তিনি এমন কৌশলে সাজাতেন যে সম্মোহিত হওয়া ছাড়া পাঠক-শ্রোতার আর কোনো উপায় থাকতো না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভারত প্রতিভায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘গুণাকর’ উপাধি দান করেন এবং কাব্য রচনার আদেশ দেন। এ প্রসঙ্গে ভারতচন্দ্র লিখেছেন-

‘কবি রায় গুণাকর খ্যাতি সমর্পিয়া,

ভারতেরে আজ্ঞা দিল গীতের লাগিয়া।’

রাজার আদেশ পেয়ে কবি রচনা করলেন তাঁর অমরগ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’। অন্নদামঙ্গলের রচনাকাল সম্পর্কে কবি বলেন-

‘বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা,

সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা॥’

অর্থাৎ, ব্রহ্ম=১, রস=৬, ঋষি=৭ এবং বেদ=৪ হলে অন্নদামঙ্গলের রচনাকাল দাঁড়ায় ১৬৭৪ শকাব্দ বা ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ।

ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। মঙ্গলকাব্যের যুগে জন্ম নিয়েও, এমনকি নিজে মঙ্গলকাব্য রচনা করেও তিনি ছিলেন আধুনিক মানসিকতার কবি। তাঁর কাব্যেই প্রথম মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগের সন্ধিলক্ষণ যুগপৎ আভাসিত হয়েছে। দেব-দেবী মাহাত্ম্য আর ভক্তিবাদের মোহে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল মধ্যযুগের কাব্য-কবিরা। ভারতচন্দ্রই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মধ্যযুগীয় কাব্যাদর্শের বিরুদ্ধে।

কতিপয় সমালোচকের অসম্ভব পরিশ্রমের ফলে অনেকের মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ভারতচন্দ্র অশ্লীল এবং কামপ্রবণ কবি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কামশাস্ত্রও ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন বিদ্যা এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পরতে পরতে এই কামশাস্ত্র প্রয়োগের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তাছাড়া ভারতচন্দ্র যে সময়ে কাব্যরচনা করেছেন সে সময়ে স্বামী-স্ত্রীর গুপ্ত দাম্পত্য জীবন খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করা অরুচিকর ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী হয়েও ভারতচন্দ্রের কাব্যে যখন কেউ অশ্লীলতা খুঁজে পান তখন আমাদের কাঁধে এসে দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাব্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার। ভারতচন্দ্রের কাব্যে কতখানি আছে অশ্লীলতা আর কতখানি আছে আর্ট তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার।

এ বিষয়ে বিগদ্ধ প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন- ‘যে দোষে প্রাচীন কবিরা প্রায় সকলেই সমান দোষী সে দোষের জন্য একা ভারতচন্দ্রকে তিরস্কার করার কারণ কী? এর প্রধান কারণ, ভারতচন্দ্রের কাব্য যত সুপরিচিত অপর কারো তত নয়। আর দ্বিতীয় কারণ, ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার ভিতর আর্ট আছে, অপরের আছে শুধু ন্যাচার। ভারতচন্দ্র যা দিয়ে তা ঢাকা দিতে গিয়েছিলেন তাতেই তা ফুটে উঠেছে। তাঁর ছন্দ ও অলংকারের প্রসাদেই তাঁর কথা কারো চোখ-কান এড়িয়ে যায় না। পাঠকের পক্ষে ও জিনিস উপেক্ষা করার পথ তিনি রাখেননি। তবে এক শ্রেণির পাঠক আছে যাদের কাছে ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতা ততটা চোখে পড়ে না যতটা পড়ে তাঁর আর্ট। তারপর ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতা গম্ভীর নয়, সহাস্য।

বহুদর্শী ভারতচন্দ্র ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর পড়াশোনা এবং জীবনাভিজ্ঞতা এত ব্যাপক ছিল যে, সেদিকে তাকালে বিস্ময় মানতে হয়। ভারতচন্দ্র নিজেই বলেছেন-

‘পড়িয়াছি যেই মতো লিখিবারে পারি।

কিন্তু সে সকল লোক বুঝিবারে ভারি॥

না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।

অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল॥’

ভাষার ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্র ছিলেন সর্বভুক। কোনো কিছু না ভেবে শুধু তাঁর রচনাকে রসাল ও প্রসাদগুণ সমৃদ্ধ করার জন্য যে কোনো ভাষার শব্দকেই তিনি সযতেœ ব্যবহার করেছেন। বলা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য প্রথা ভেঙে বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করেছেন। ভারতচন্দ্রের বহু কবিতা আছে যেখানে তিনি একই সাথে ব্যবহার করেছেন সংস্কৃতি, ফারসি, হিন্দি (উর্দু) ভাষা। তবে এ বিষয়ে আরেকজন কবির নাম স্মরণ করতেই হয়, তিনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরামও তাঁর কাব্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন। তাঁর কাব্যেও প্রচুর আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।

চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্রের অনন্যতা অসামান্য। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে যে সকল চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তারা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শিব-দুর্গা, ঈশ্বরী পাটনী, হীরা মালিনী, বিদ্যা, সুন্দর সকলেই অদ্বিতীয় সৃষ্টি। একজন নষ্টা নারীর যে সব বৈশিষ্ট্য থাকে হীরার মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। ভারতচন্দ্রের হীরার মতো নারী চরিত্র সমগ্র মঙ্গলকাব্যে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। হীরা চরিত্র বর্ণনায় কবি লিখেছেন-

কথায় হীরার ধার হীরা তার নাম।

দাঁত ছোলা মাজা দোলা হাস্য অবিরাম॥

গরা ভরা গুয়া পান পাকি মালা গলে।

কানে কড়ি কড়ে বাঁড়ী কথা কত ছলে॥

চূড়া বান্ধা চুল, পরিধান সাদা শাড়ী।

পুলের চুপড়ী কাঁখে ফিরে বাড়ি বাড়ী॥

আছিল বিস্তর ঠাট প্রথম বয়সে।

এবে বুড়া তবু কিছু গুঁড়া আছে শেষে॥

ছিটা ছোটা তন্ত্রমন্ত্র আসে কতগুলি।

চেঙ্গাড়া ভুলায়ে খায় চক্ষে দিয়া ঠুলি॥

বাতাসে পাতিয়া ফাঁদ কন্দল ভেজায়।

পড়শী না থাকে কাছে কন্দলের দায়॥

অথবা যখন আমরা শিব-দুর্গার কথোপকথন শুনি তখনও আমাদের মনে হয় না কোনো দেব-দেবীর কথোপকথন শুনছি। মনে হয় সংসার ভারাক্রান্ত কোনো অভাবগ্রস্ত বাঙালি গৃহস্থই তার দুর্দশাগ্রস্ত গৃহের বর্ণনা দিচ্ছেন। একটি উদাহরণ দিতে চাই-

বৃদ্ধকাল আপনার নাহি জানি রোজগার,

চাষবাস বাণিজ্য ব্যাপার।

সকলে নির্গুণ কয় ভুলায়ে সর্বস্ব লয়

নাম মাত্র রহিয়াছে সার॥

যত আনি তত নাই না ঘুচিল খাই খাই

কিবা সুখ এ ঘরে থাকিয়া

এত বলি দিগম্বর আরোহিয়া বৃষোপর

চলিলেন ভিক্ষার লাগিয়া॥

‘একই অঙ্গে এতরূপ নয়নে না ধরে’ এই কথাটি যে কবির বেলায় সবচেয়ে বেশি খাটে তিনি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ভারতচন্দ্র একই সাথে ছন্দ্ররাজ ও রসরাজ। তিনি তাঁর কাব্যে এত সব ছন্দ আর অলংকারের প্রয়োগ করেছেন যে তা রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার। তাঁর কাব্যের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আছে পয়ার, ভঙ্গ পয়ার, লঘু ত্রিপদী, নর্তক ত্রিপদী, দীর্ঘ চৌপদী, দিগক্ষরা, ভুজঙ্গ প্রয়াত, তূণক, তোটক প্রভৃতি ছন্দ। অলংকার হিসেবে ব্যবহার করেছেন- যমক, রূপক, অতিশয়োক্তি, ব্যাজস্তুতি, বিরোধাভাস, বিশেষোক্তি, অপ্রস্তুত প্রসংশা ইত্যাদি। আর রসের কথা বলতে গেলে অবশ্যই উচ্চারণ করতে হয়- শৃঙ্গার, বীর, হাস্য রসের নাম। হাস্যরসিক ভারতচন্দ্র চরম সংকটেও হাসতে পারতেন এটি তাঁর কাব্য পড়লেই টের পাওয়া যায়।

ভারতচন্দ্রের কাব্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার। তাঁর কাব্যে তিনি প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন তো অন্তর্ভুক্ত করেছেনই সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ব্রতী হয়েছেন প্রবাদ-প্রবচন রচনায়। তাঁর প্রবাদ-প্রবচনের কয়েকটি নমুনা দিতে চাই যা এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে-

‘পড়িয়ে ভেড়ার শৃঙ্গে ভাঙে হীরা ধার।’

অথবা,

‘লোভের নিকটে যদি ফাঁদ পাতা যায়

পশুপাখী সাপ মাছ কে কোথা এড়ায়।’

কিংবা,

‘নীচ যদি উচ্চ ভাষে

সুবুদ্ধি উড়ায় হেসে।’

অথবা,

যতন নহিলে নাহি মিলয়ে রতন।’ ইত্যাদি।

গ্রাম্যতার পর্যায় থেকে একক প্রচেষ্টায় যে কবি বিষয় বৈচিত্র্যকে নাগরিক রুচিতে উত্তীর্ণ করেছিলেন, তিনি অমর কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ভারতচন্দ্র বাংলার অহংকার, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম কবি। যে নক্ষত্র যত বেশি উজ্জ্বল তাঁর আলো ততবেশি নজর কাড়ে মানুষের। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই তাই বলতে হয়- ‘রাজসভা-কবি রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো। যেমন তাহার উজ্জ্বলতা, তেমনি তাহার কারুকার্য।’

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে আনুমানিক ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্র জন্ম করেন বলে মত দেন। ভারতচন্দ্র ছিলেন জমিদার পিতার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। জমিদার তনয় হয়েও ভারতচন্দ্রকে আমৃত্যু দারুণ অর্থকষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। শুধু অর্থ কষ্ট নয়, তাকে জেল-জুলুমও সহ্য করতে হয়েছে। ভারতচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁর পিতা অতিক্রম করছিলেন অর্থনৈতিক ভাটার কাল। বর্ধমান রাজার সাথে ভারতচন্দ্রের পিতা বিবাদে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হন। সংসারে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতচন্দ্র আশ্রয় নেন মাতুলালয়ে। মাতুলালয়ে থেকেই তিনি সংস্কৃত ভাষা শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি এক বালিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একদিকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা অন্যদিকে বিবাহ- এই দুটি কারণে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাগণ তাকে কটাক্ষ করেন। কেননা, সে সময়ে রাজ-ভাষা ছিল ফারসি। এই ফারসি ভাষা ছিল উপার্জনেরও একটি বিশেষ মাধ্যম। সুতরাং অর্থকরী ভাষা না শিখে পাণ্ডিত্যের ভাষা শিখেছিলেন বলে ভারতচন্দ্রের ভ্রাতাগণ তাকে গালমন্দ করেন। ভ্রাতাদের ভর্ৎসনায় অভিমান জমলো ভারতচন্দ্রের মনে। তিনি ঘর ছেড়ে হুগলির নিকটবর্তী দেবানন্দপুরের ফারসি ভাষাবিদ রামচন্দ্র মুনশীর বাড়িতে থেকে ফারসি ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন। বিশ বছর বয়সে ফারসি ভাষায় কৃতবিদ্য হয়ে ভারতচন্দ্র নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন এবং পরিবার কর্তৃক সসম্মানে আদৃত হন। ঠিক এই সময়ে তার পিতা বর্ধমান রাজার কাছ থেকে কিছু সম্পত্তি ইজারা প্রাপ্ত হন। যেহেতু ভারতচন্দ্র রাজভাষা ফারসি খুব ভালো জানতেন তাই তিনি পিতা ও ভ্রাতাগণ কর্তৃক বর্ধমান রাজার দরবারে মোক্তার রূপে প্রেরিত হন। কিন্তু বেশি দিন তিনি এই কাজ করতে পারলেন না। নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায়ে ব্যর্থ হলে বর্ধমান রাজা ভারতচন্দ্রের পিতার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন এবং ভারতচন্দ্রকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন।

কারাগার থেকে কৌশলে মুক্তিলাভ করে তিনি পালিয়ে যান কটকে। কটক থেকে তীর্থবাসী হয়ে রওনা হন শ্রীক্ষেত্রে। শ্রীক্ষেত্র থেকে সন্ন্যাসী বেশে বৃন্দাবনে যাবার কালে হুগলি খানাকুল পরগনার কৃষ্ণনগর গ্রামে তার ভায়রা ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে যান। তাঁর ভায়রা ভাই তাঁকে বাড়ি নিয়ে এলে বহুদিন পরে পতœীর সঙ্গে ভারতচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়। খানাকুলে কিছুদিন বাস করে ভারতচন্দ্র জীবিকার অন্বেষণে উপনীত হন চন্দন নগরের দেওয়ান ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কাছে। ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর সহায়তায়ই ভারতচন্দ্র মাসিক ৪০ টাকায় নবদ্বীপপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি নিযুক্ত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি নিযুক্তির সময় ভারতচন্দ্রের বয়স ছিল ৪০ বছর।