বাজেট বরাদ্দ এবং আদিবাসী

মিথুশিলাক মুরমু

দেশের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত আদিবাসীদের জিজ্ঞাসা করুন, তারা বাজেট সম্পর্কে সামান্যতম ওয়াকিবহাল নন। বাজেটে কী আছে, কী নেই এটি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই; তারা শুধুই উপলব্ধি করছে পরিবারের স্বচ্ছলতা ধরে রাখার যুদ্ধে ক্রমশই পরাজিত হচ্ছে। রাস্তার পাশের বাকরখানি দোকানে গিয়েও বোঝা যায় বাজেট উপস্থাপনের পরই বেড়েছে দাম, ৫ টাকার বাকরখানি এখন ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাট-বাজারের দোকানেও বাজেটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাজেট সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব, সেটি হোক পরিবার, নগর, শহর কিংবা দেশের। প্রশ্ন হচ্ছেÑ বাজেট কী আদিবাসীদের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছে, আশ^স্ত করতে পেরেছে! নাকি যে অবস্থানে রয়েছে, সেখান থেকে নীচের দিকেই ধাবিত হচ্ছে; পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে!

অর্থমন্ত্রীর লিখিত বাজেট ২০২২-২০২৩ ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের বক্তৃতায় ১৫৯। নম্বরে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছি। ...স্কুলগামী বেদে, অনগ্রসর ও তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।’ ১৯৪-এ গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণে উল্লেখ করেছেনÑ ‘মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ কর্মসূচির আওতায় আশ্রয়ণ ২ প্রকল্পের ডিজাইন ও প্রাক্কলিত ব্যয়ে গৃহহীন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত পরিবারের জন্য গৃহনির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পরিবারসমূহকে গৃহ প্রদান করা হয়েছে।’ এছাড়া লিখিত বক্তৃতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমনÑ ছিন্নমূল মানুষ, বেদে সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। বিগত কয়েকটি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা সতর্কভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ১১ জনু ২০২০ খ্রিস্টাব্দে উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতাতে ‘বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’, ‘চা শ্রমিক’ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে একটিবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দটি উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে বর্ণিত হয়েছে, ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’। আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কী ‘অনগ্রসর’ শব্দের মধ্যে আদিবাসীদের তথা ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ে’র অন্তর্ভুক্তি করেছেন! ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর’ শব্দাবলী পবিত্র সংবিধানের কোথাও উল্লেখিত নেই।

বাজেট ঘোষণার পরই প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের উন্নয়নের কল্পরেখা মেলানোর প্রচেষ্টা করেছি। অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, আদিবাসীদের আবাসস্থলগুলো দারিদ্র্যতার হার বেশ উঁচুতেই রয়েছেÑ রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে ৬৪ ও ৬৩ শতাংশ; দিনাজপুর জেলাতে এই হার ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় আয় থেকেও অনেক কম। পাবর্ত্যাঞ্চলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ এবং সমতলের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ কম।

মহামারী কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের জীবন-যাত্রা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কোভিডের আগে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিলো, সে সময়কালে আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোতে দারিদ্র্যতার হার ছিল সর্বাংশে ৬০ শতাংশের ওপরে। কোভিড, কর্মহীনতা, মজুরিস্বল্পতা, বৈষম্য, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি আদিবাসীদের দারিদ্র্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। বোধকরি, আদিবাসীদের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যতার মাত্রা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দরা দাবি করেছেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার খাস পুকুর রয়েছে। এ খাস পুকুর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমরা চাই এ পুকুর উদ্ধার করা হোক। পুকুরপাড়ে যে আদিবাসীরা আছে তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হোক। আদিবাসীদের কবরস্থানের এখন ভয়াবহ সংকট।’ সমতলের আদিবাসীরা কার্যত ভূমিহীন। যে সমস্ত আদিবাসীর অল্প স্বল্প জায়গা-জমি রয়েছে, সেগুলোতেও এখন ঝামেলা দেখা দিচ্ছে, মূলত, ভূমি সমস্যাগুলো জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীরা মানবসত্তার মর্যাদা ও মানব উন্নয়নের সম্ভাব্য সব মাপকাঠিতেই অতিদরিদ্র, অনগ্রসর, প্রান্তিক, পিছিয়েপড়া ও বহিস্থ মানুষ।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায়ই আদিবাসীদের স্থানান্তর করে। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা বন্দরের জন্য একটি আদিবাসী রাখাইন পল্লী অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকার ভূমি অধিগ্রহণ করেছে কিন্তু মাত্র ছয়টি আদিবাসী রাখাইন পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এক সময়ের স্বচ্ছল রাখাইন পরিবারগুলো এখন ভূমিহীন। কলাপাড়া ইউনিয়নে ২২৭টি পল্লীর মধ্যে টিকে আছে মাত্র ২৬টি রাখাইন পল্লী। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় ইপিজেড নির্মিত হলে উচ্ছেদিত হবে ৫টি আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম। খাগড়াছড়িতে ইকো পার্ক নির্মিত হতে যাচ্ছে চাকমা-ত্রিপুরাদের অভয়ারণ্যতে। ফলস্বরূপ আদিবাসীরা আরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, ভূমিহীন ও দারিদ্র্যতাপূর্ণ জীবনকেই নিয়তি বা ভাগ্য বলে বরণ করে নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকার যদি একটু সহানুভতি দেখাতেন, সহনশীল হতেন; আদিবাসীদের প্রতি দয়াপূর্ণ আচরণ করতেন, তাহলে আদিবাসীরা দুরবস্থা কাটিয়ে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হতে পারতেন।

গবেষকগণ দেখানোর চেষ্টা করেছেন ২০২১-২০২২ বাজেটের বরাদ্দনুযায়ী, ৩০ লাখ আদিবাসীর জন্যে কমপক্ষে ৪ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা, যার মাথাপিছু ভাগ পড়বে ১৫ হাজার ৬৪৭ টাকা মাত্র। জাতীয় বরাদ্দের তুলনায় আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তিনগুণ হওয়া আবশ্যিক, তাহলে কিছুটা জাতীয় উন্নয়নের সীমারেখাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৩০ লাখ আদিবাসীর জন্য মোট বরাদ্দ হওয়া উচিত ১৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা যা প্রস্তাব অপেক্ষা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৪ শতাংশের সমপরিমাণ। উপস্থাপিত বাজেটে ২ হাজার ৬৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোর শিরোনামের মধ্যে ‘পারিবারিক কৃষি’, ‘গ্রামীণ নারী’ কিংবা কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার, আদিবাসী (সংবিধান অনুযায়ীÑ ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’) শব্দাবলী অনুপস্থিত। হিসাবের জায়গাটিতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সদ্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর বাজেট ভাষণে বেশ কয়েকবারই আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে উন্নয়নের রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন।

এক নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। রক্তের বহমান স্রোতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম, আদিবাসী, দলিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ফোটা ফোটা রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। সেই চেতনা থেকেই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্টের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংবিধান তথা উল্লেখিত সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নইলে এক দিকে উন্নয়নের জোয়ার বইবে, অন্যদিকে আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত হবে। এটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, স্বপ্ন হতে পারে না।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষান্ত বলেছেন, ‘২০৩০-এ এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ, ২০৩১-এ উচ্চমধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, ২০৪১ সালে একটি জ্ঞানভিত্তিক, সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালে নিরাপদ বদ্বীপ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের অন্তর মন প্রথিত সোনার বাংলার সুবর্ণ রেখাটি আমরা স্পর্শ করব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু বঙ্গের কোটি কোটি মানুষের বন্ধু হতে পেরেছিলেন, অন্তর, হৃদয়ের ব্যথা-বেদনা আঁচ করতে পারতেন; তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আর এই অধিকারের মধ্যেই রয়েছে, দায়-দায়িত্ব, নৈতিকতা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার এবং উন্নয়ন।

[লেখক : কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২ , ১৬ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলকদ ১৪৪৩

বাজেট বরাদ্দ এবং আদিবাসী

মিথুশিলাক মুরমু

দেশের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত আদিবাসীদের জিজ্ঞাসা করুন, তারা বাজেট সম্পর্কে সামান্যতম ওয়াকিবহাল নন। বাজেটে কী আছে, কী নেই এটি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই; তারা শুধুই উপলব্ধি করছে পরিবারের স্বচ্ছলতা ধরে রাখার যুদ্ধে ক্রমশই পরাজিত হচ্ছে। রাস্তার পাশের বাকরখানি দোকানে গিয়েও বোঝা যায় বাজেট উপস্থাপনের পরই বেড়েছে দাম, ৫ টাকার বাকরখানি এখন ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাট-বাজারের দোকানেও বাজেটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাজেট সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব, সেটি হোক পরিবার, নগর, শহর কিংবা দেশের। প্রশ্ন হচ্ছেÑ বাজেট কী আদিবাসীদের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছে, আশ^স্ত করতে পেরেছে! নাকি যে অবস্থানে রয়েছে, সেখান থেকে নীচের দিকেই ধাবিত হচ্ছে; পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে!

অর্থমন্ত্রীর লিখিত বাজেট ২০২২-২০২৩ ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের বক্তৃতায় ১৫৯। নম্বরে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছি। ...স্কুলগামী বেদে, অনগ্রসর ও তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।’ ১৯৪-এ গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণে উল্লেখ করেছেনÑ ‘মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ কর্মসূচির আওতায় আশ্রয়ণ ২ প্রকল্পের ডিজাইন ও প্রাক্কলিত ব্যয়ে গৃহহীন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত পরিবারের জন্য গৃহনির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পরিবারসমূহকে গৃহ প্রদান করা হয়েছে।’ এছাড়া লিখিত বক্তৃতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমনÑ ছিন্নমূল মানুষ, বেদে সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। বিগত কয়েকটি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা সতর্কভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ১১ জনু ২০২০ খ্রিস্টাব্দে উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতাতে ‘বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’, ‘চা শ্রমিক’ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে একটিবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দটি উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে বর্ণিত হয়েছে, ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’। আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কী ‘অনগ্রসর’ শব্দের মধ্যে আদিবাসীদের তথা ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ে’র অন্তর্ভুক্তি করেছেন! ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর’ শব্দাবলী পবিত্র সংবিধানের কোথাও উল্লেখিত নেই।

বাজেট ঘোষণার পরই প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের উন্নয়নের কল্পরেখা মেলানোর প্রচেষ্টা করেছি। অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, আদিবাসীদের আবাসস্থলগুলো দারিদ্র্যতার হার বেশ উঁচুতেই রয়েছেÑ রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে ৬৪ ও ৬৩ শতাংশ; দিনাজপুর জেলাতে এই হার ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় আয় থেকেও অনেক কম। পাবর্ত্যাঞ্চলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ এবং সমতলের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ কম।

মহামারী কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের জীবন-যাত্রা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কোভিডের আগে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিলো, সে সময়কালে আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোতে দারিদ্র্যতার হার ছিল সর্বাংশে ৬০ শতাংশের ওপরে। কোভিড, কর্মহীনতা, মজুরিস্বল্পতা, বৈষম্য, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি আদিবাসীদের দারিদ্র্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। বোধকরি, আদিবাসীদের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যতার মাত্রা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দরা দাবি করেছেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার খাস পুকুর রয়েছে। এ খাস পুকুর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমরা চাই এ পুকুর উদ্ধার করা হোক। পুকুরপাড়ে যে আদিবাসীরা আছে তাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হোক। আদিবাসীদের কবরস্থানের এখন ভয়াবহ সংকট।’ সমতলের আদিবাসীরা কার্যত ভূমিহীন। যে সমস্ত আদিবাসীর অল্প স্বল্প জায়গা-জমি রয়েছে, সেগুলোতেও এখন ঝামেলা দেখা দিচ্ছে, মূলত, ভূমি সমস্যাগুলো জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীরা মানবসত্তার মর্যাদা ও মানব উন্নয়নের সম্ভাব্য সব মাপকাঠিতেই অতিদরিদ্র, অনগ্রসর, প্রান্তিক, পিছিয়েপড়া ও বহিস্থ মানুষ।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায়ই আদিবাসীদের স্থানান্তর করে। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা বন্দরের জন্য একটি আদিবাসী রাখাইন পল্লী অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকার ভূমি অধিগ্রহণ করেছে কিন্তু মাত্র ছয়টি আদিবাসী রাখাইন পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এক সময়ের স্বচ্ছল রাখাইন পরিবারগুলো এখন ভূমিহীন। কলাপাড়া ইউনিয়নে ২২৭টি পল্লীর মধ্যে টিকে আছে মাত্র ২৬টি রাখাইন পল্লী। গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় ইপিজেড নির্মিত হলে উচ্ছেদিত হবে ৫টি আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম। খাগড়াছড়িতে ইকো পার্ক নির্মিত হতে যাচ্ছে চাকমা-ত্রিপুরাদের অভয়ারণ্যতে। ফলস্বরূপ আদিবাসীরা আরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, ভূমিহীন ও দারিদ্র্যতাপূর্ণ জীবনকেই নিয়তি বা ভাগ্য বলে বরণ করে নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকার যদি একটু সহানুভতি দেখাতেন, সহনশীল হতেন; আদিবাসীদের প্রতি দয়াপূর্ণ আচরণ করতেন, তাহলে আদিবাসীরা দুরবস্থা কাটিয়ে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হতে পারতেন।

গবেষকগণ দেখানোর চেষ্টা করেছেন ২০২১-২০২২ বাজেটের বরাদ্দনুযায়ী, ৩০ লাখ আদিবাসীর জন্যে কমপক্ষে ৪ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা, যার মাথাপিছু ভাগ পড়বে ১৫ হাজার ৬৪৭ টাকা মাত্র। জাতীয় বরাদ্দের তুলনায় আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তিনগুণ হওয়া আবশ্যিক, তাহলে কিছুটা জাতীয় উন্নয়নের সীমারেখাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৩০ লাখ আদিবাসীর জন্য মোট বরাদ্দ হওয়া উচিত ১৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা যা প্রস্তাব অপেক্ষা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৪ শতাংশের সমপরিমাণ। উপস্থাপিত বাজেটে ২ হাজার ৬৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোর শিরোনামের মধ্যে ‘পারিবারিক কৃষি’, ‘গ্রামীণ নারী’ কিংবা কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার, আদিবাসী (সংবিধান অনুযায়ীÑ ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’) শব্দাবলী অনুপস্থিত। হিসাবের জায়গাটিতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সদ্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর বাজেট ভাষণে বেশ কয়েকবারই আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে উন্নয়নের রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন।

এক নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। রক্তের বহমান স্রোতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম, আদিবাসী, দলিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ফোটা ফোটা রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে। সেই চেতনা থেকেই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্টের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংবিধান তথা উল্লেখিত সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নইলে এক দিকে উন্নয়নের জোয়ার বইবে, অন্যদিকে আদিবাসী-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত হবে। এটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, স্বপ্ন হতে পারে না।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষান্ত বলেছেন, ‘২০৩০-এ এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ, ২০৩১-এ উচ্চমধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, ২০৪১ সালে একটি জ্ঞানভিত্তিক, সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালে নিরাপদ বদ্বীপ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের অন্তর মন প্রথিত সোনার বাংলার সুবর্ণ রেখাটি আমরা স্পর্শ করব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু বঙ্গের কোটি কোটি মানুষের বন্ধু হতে পেরেছিলেন, অন্তর, হৃদয়ের ব্যথা-বেদনা আঁচ করতে পারতেন; তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আর এই অধিকারের মধ্যেই রয়েছে, দায়-দায়িত্ব, নৈতিকতা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার এবং উন্নয়ন।

[লেখক : কলামিস্ট]