গত এক দশকের জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। গতকাল বাজেটের মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনার সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করেন। কোন সরকারের আমলেই ‘নির্বাচন কমিশনসহ কোন কমিশনই স্বাধীন ছিল না’ বলে মন্তব্য করেন জাপার এক সদস্য। বর্তমান নির্বাচনকে ‘দন্তহীন বাঘ’ বলে আখ্যায়িত করেন জাপার আরেক সদস্য। জাপার সমালোচনায় তাল মিলিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ‘নির্দলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি জানান। বিরোধী দলের সদস্যদের সমালোচনার জবাব দেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। বিএনপির আমলে নির্বাচন কেমন হয়েছে, সে বিষয়গুলোও তুলে ধরেন তিনি। বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল হক সাফ জানিয়ে দেন, উচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে ‘নির্দলীয় সরকার’ আনার কোন সুযোগ নেই।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিলে ওই নির্বাচনে বিএনপি আসবে না বলে জানিয়েছে। এদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিদেশি পরাশক্তিগুলোও বরাবরই সরকারকে চাপ দিচ্ছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, এমন প্রত্যাশার কথা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একবার বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার বলছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব সরকারেরও নয়, ইসিরও নয়।
গতকাল সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত দায়যুক্ত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কিত মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বরাদ্দের দাবি নিষ্পত্তির সময় নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ আসে।
আইনমন্ত্রী ৪নং দাবিতে নতুন অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য ৭৪৯ কোটি টাকা মঞ্জুরি প্রস্তাব করেন। এই দাবিতে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও গণফোরামের মোট ১৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ হ্রাস করে এক টাকা মঞ্জুরির প্রস্তাব দেন। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের টাকা লাগবে। নির্বাচন কমিশন তার অর্থ ব্যয়ে পুরোপুরি স্বাধীন।’
ইসির সমালোচনা করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ।’ নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে তত্ত্বাবধায় সরকারের দাবি তত যৌক্তিকতা হারাবে, মন্তব্য করে ইসির অধীনে ‘নির্বাচনী পুলিশ’ গঠনের প্রস্তাব করেন এই বিরোধী দলের এই সদস্য।
জাতীয় পার্টির অন্য সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের ‘অনাস্থা তৈরি হয়েছে’ বলে দাবি করেন বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতাকে কটাক্ষ করে কমিশনের বরাদ্দকৃত অর্থ ‘প্রশাসন ও পুলিশকে’ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। হারুন বলেন, ‘এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে প্রশাসন।’ সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতা করে বলেন, ‘সাবেক সিইসি নূরুল হুদা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে। তাহলে তিনি কেন ইভিএমে নির্বাচন করলেন? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন কক্ষে থাকা ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ ইভিএম চায় না। আওয়ামী লীগ এক সময় বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন বিএনপিকে ছাড়া কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে? পারবেন না। বিএনপিকে কীভাবে নির্বাচনে আনবেন সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে অবশ্যই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। সেজন্য নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে।
বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘যখন দেশে নির্বাচন থাকে তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। যদি নির্বাচন না থাকে, দিনের ভোট রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে? এখন নির্বাচন মল্লযুদ্ধ। সিইসি বলেছেন, ভোটের মাঠে বিএনপিকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকতে হবে। ভোট কি যুদ্ধ? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এই ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়। পুলিশ প্রশাসনও এই ডাকাতি করে। এই ডাকাতির পর যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় ভবিষ্যতে ডাকাত আরও বাড়বে।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির এই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারেনি। তার হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারেনি। বারবার অনুরোধ করে তাকে এলাকা থেকে সরাতে পারেনি। যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না তারা জাতীয় নির্বাচনে ৩০০০ সংসদ সদস্যকে কীভাবে সামলাবেন?’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একটি পুরোনো খেলা আছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকলে তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু করা হয়। ২০১৪ সালেও এই খেলা দেখা গেছে।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘ইভিএমের কোন দোষ নেই। যারা ইভিএমে প্রভাব খাটায় ব্যালটেও তারা প্রভাব খাটাতে পারে। এ বিষয়টি বন্ধ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনসহ কোন কমিশনই স্বাধীন নয় অভিযোগ করে জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সব সরকারের আমলেই এটি হয়েছে, এটি চলতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ করে দিতে না পারে তাহলে নির্বাচন কমিশন ঢাকায় বসে কিছুই করতে পারবে না। সবাই নির্বাচনে জিততে চায়। এখানে কোন এথিকস (নীতিশাস্ত্র) মানে না। যেদিকে শক্তি বেশি থাকে, স্থানীয় প্রশাসনও সেদিকে চলে যায়।’
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল কারণ তারা (ইসি) সরকারের আজ্ঞাবহ। চারটি দল শুধু ইভিএমের পক্ষে আর বেশিরভাগই বিপক্ষে। আজ্ঞাবহ না হয়ে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইভিএম বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিরোধী দলের সদস্যদের আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখানকার আসনে বসে বলছেন নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি সংসদে গেলেন কীভাবে? এর জবাব উনি দেবেন।’
বিএনপি আমলে ভোটের চিত্র তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ওই সময় কারও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া লাগত না, ভোট হয়ে যেত। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন তাদের (বিএনপি) ছিল। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কী করেছে, এগুলো কি উনারা ভুলে গেছেন?’
নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এখন বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে, তাহলে উনারা ভোটে আসবে। এই সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্ববধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের এক সুতাও বাইরে সরকার যাবে না।
বিএনপি বার বার বলছে, তাদের নির্বাচনে আনতে হবে। তারা কি পাকিস্তানে থাকে যে সেখান থেকে ডেকে আনতে হবে? তারা তো বাংলাদেশে থাকে। উনারা নির্বাচন করতে চাইলেই নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে প্লেইং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) দরকার সেটা করা হবে। তার এ পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। সেটা করা হয়েছে।’
পরে আরেকটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তুলতে গিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির হারুন বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বলিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়াতে কোন কৃতিত্ব নেই। মাঠে মূল প্লেয়ার দুটা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলকেই মাঠে রাখতে হবে।’
শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২ , ১৭ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলকদ ১৪৪৩
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
গত এক দশকের জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। গতকাল বাজেটের মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনার সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করেন। কোন সরকারের আমলেই ‘নির্বাচন কমিশনসহ কোন কমিশনই স্বাধীন ছিল না’ বলে মন্তব্য করেন জাপার এক সদস্য। বর্তমান নির্বাচনকে ‘দন্তহীন বাঘ’ বলে আখ্যায়িত করেন জাপার আরেক সদস্য। জাপার সমালোচনায় তাল মিলিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ‘নির্দলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি জানান। বিরোধী দলের সদস্যদের সমালোচনার জবাব দেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। বিএনপির আমলে নির্বাচন কেমন হয়েছে, সে বিষয়গুলোও তুলে ধরেন তিনি। বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল হক সাফ জানিয়ে দেন, উচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে ‘নির্দলীয় সরকার’ আনার কোন সুযোগ নেই।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দিলে ওই নির্বাচনে বিএনপি আসবে না বলে জানিয়েছে। এদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিদেশি পরাশক্তিগুলোও বরাবরই সরকারকে চাপ দিচ্ছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, এমন প্রত্যাশার কথা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একবার বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার বলছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব সরকারেরও নয়, ইসিরও নয়।
গতকাল সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত দায়যুক্ত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কিত মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বরাদ্দের দাবি নিষ্পত্তির সময় নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ আসে।
আইনমন্ত্রী ৪নং দাবিতে নতুন অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য ৭৪৯ কোটি টাকা মঞ্জুরি প্রস্তাব করেন। এই দাবিতে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও গণফোরামের মোট ১৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ হ্রাস করে এক টাকা মঞ্জুরির প্রস্তাব দেন। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের টাকা লাগবে। নির্বাচন কমিশন তার অর্থ ব্যয়ে পুরোপুরি স্বাধীন।’
ইসির সমালোচনা করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ।’ নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে তত্ত্বাবধায় সরকারের দাবি তত যৌক্তিকতা হারাবে, মন্তব্য করে ইসির অধীনে ‘নির্বাচনী পুলিশ’ গঠনের প্রস্তাব করেন এই বিরোধী দলের এই সদস্য।
জাতীয় পার্টির অন্য সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের ‘অনাস্থা তৈরি হয়েছে’ বলে দাবি করেন বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতাকে কটাক্ষ করে কমিশনের বরাদ্দকৃত অর্থ ‘প্রশাসন ও পুলিশকে’ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। হারুন বলেন, ‘এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে প্রশাসন।’ সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতা করে বলেন, ‘সাবেক সিইসি নূরুল হুদা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে। তাহলে তিনি কেন ইভিএমে নির্বাচন করলেন? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন কক্ষে থাকা ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ ইভিএম চায় না। আওয়ামী লীগ এক সময় বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন বিএনপিকে ছাড়া কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে? পারবেন না। বিএনপিকে কীভাবে নির্বাচনে আনবেন সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে অবশ্যই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। সেজন্য নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে।
বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘যখন দেশে নির্বাচন থাকে তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। যদি নির্বাচন না থাকে, দিনের ভোট রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে? এখন নির্বাচন মল্লযুদ্ধ। সিইসি বলেছেন, ভোটের মাঠে বিএনপিকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকতে হবে। ভোট কি যুদ্ধ? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এই ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়। পুলিশ প্রশাসনও এই ডাকাতি করে। এই ডাকাতির পর যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় ভবিষ্যতে ডাকাত আরও বাড়বে।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির এই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারেনি। তার হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারেনি। বারবার অনুরোধ করে তাকে এলাকা থেকে সরাতে পারেনি। যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না তারা জাতীয় নির্বাচনে ৩০০০ সংসদ সদস্যকে কীভাবে সামলাবেন?’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একটি পুরোনো খেলা আছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকলে তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু করা হয়। ২০১৪ সালেও এই খেলা দেখা গেছে।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘ইভিএমের কোন দোষ নেই। যারা ইভিএমে প্রভাব খাটায় ব্যালটেও তারা প্রভাব খাটাতে পারে। এ বিষয়টি বন্ধ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনসহ কোন কমিশনই স্বাধীন নয় অভিযোগ করে জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সব সরকারের আমলেই এটি হয়েছে, এটি চলতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ করে দিতে না পারে তাহলে নির্বাচন কমিশন ঢাকায় বসে কিছুই করতে পারবে না। সবাই নির্বাচনে জিততে চায়। এখানে কোন এথিকস (নীতিশাস্ত্র) মানে না। যেদিকে শক্তি বেশি থাকে, স্থানীয় প্রশাসনও সেদিকে চলে যায়।’
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল কারণ তারা (ইসি) সরকারের আজ্ঞাবহ। চারটি দল শুধু ইভিএমের পক্ষে আর বেশিরভাগই বিপক্ষে। আজ্ঞাবহ না হয়ে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইভিএম বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বিরোধী দলের সদস্যদের আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখানকার আসনে বসে বলছেন নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি সংসদে গেলেন কীভাবে? এর জবাব উনি দেবেন।’
বিএনপি আমলে ভোটের চিত্র তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ওই সময় কারও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া লাগত না, ভোট হয়ে যেত। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন তাদের (বিএনপি) ছিল। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কী করেছে, এগুলো কি উনারা ভুলে গেছেন?’
নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এখন বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে, তাহলে উনারা ভোটে আসবে। এই সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্ববধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের এক সুতাও বাইরে সরকার যাবে না।
বিএনপি বার বার বলছে, তাদের নির্বাচনে আনতে হবে। তারা কি পাকিস্তানে থাকে যে সেখান থেকে ডেকে আনতে হবে? তারা তো বাংলাদেশে থাকে। উনারা নির্বাচন করতে চাইলেই নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে প্লেইং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) দরকার সেটা করা হবে। তার এ পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। সেটা করা হয়েছে।’
পরে আরেকটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তুলতে গিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির হারুন বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বলিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়াতে কোন কৃতিত্ব নেই। মাঠে মূল প্লেয়ার দুটা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলকেই মাঠে রাখতে হবে।’