জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা

‘দেশে বড় ধরনের সশস্ত্র হামলার সক্ষমতা না থাকলেও’ থেমে নেই জঙ্গিদের তৎপরতা। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে আতঙ্কের কারণ জামিনে বেরিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা। পুলিশের ভাষ্য, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে এখন অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান পরবর্তী সময়ে জঙ্গি দমনে বিশেষায়িত ইউনিট এন্টি টেরোরিজম ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের পৃথক অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে এর মধ্যে ২ হাজার জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, ‘জঙ্গিদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত মনিটরিং এবং নতুন পুরাতন সব জঙ্গিদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এরফলে তারা হামলা বা নাশকতা করতে পারছে না’। তবে দেশে বড় হামলা বা আত্মঘাতি হামলার সক্ষমতা না থাকলে হামলার আতঙ্ক উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউই। কারণ হলি আর্টিজানে হামলার পর যেসব জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের বড় একটি অংশ এখন জামিনে আছে। আর জামিনে বেরিয়ে আসা জঙ্গিরা অনলাইন প্লাটফর্মে নিজেদের সংগঠিত করতে সক্রিয়।

সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিবিরোধী সব বাহিনীর কল্যাণে দেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশে বড় ধরনের কোন জঙ্গি হামলার হুমকি ও আশঙ্কা এখন দেখছি না। হলি আর্টিজান হামলার পর সব জঙ্গির সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সে ধরনের সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলোর আর নেই। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত হুমকি বিবেচনায় সবচেয়ে নিরাপদ দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ইনডেক্সে সব দেশ মিলে ৪০তম অবস্থানে আমরা। যেখানে ইংল্যান্ডের অবস্থান ২১-এ। যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ২৮তম অবস্থানে। তবে, তুষ্টির সুযোগ এখনও নেই। সিটিটিসিসহ সব বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তারা শারীরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। তবে, তারাও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগ নিয়েছে। তারা সাইবার স্পেসে তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা, ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালস পরিচালনা করা, সবকিছুই তারা অনলাইনে করার চেষ্টা করেছে। এখন আমাদের ২৪ ঘণ্টা সাইবার পেট্রলিং চলছে। এ তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা এখন সাইবার স্পেসেও নিরাপদ নয়। আমরা বিশ্বাস করি, অনলাইনে জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রচারণাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। আগের মতো আর তারা রেসপন্স পাচ্ছে না।

পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান মনির সংবাদ জানান, আমরা একেবারেই আত্মতুষ্টি নিয়ে বসে নেই। কারণ যেসব জঙ্গিরা পলাতক রয়েছে তারা এখনও হুমকি হয়ে আসে। তাদের গ্রেপ্তারের কাজ করে যাচ্ছে এটিইউ।

পুলিশের ভাষ্য, সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার মধ্যদিয়ে দেশে উগ্রবাদের কার্যক্রম শুরু ২০০৪ সালে। জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এ হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসে। জোট সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা ও ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ হুজিবি আলোচনায় আসে।

কিন্তু ২০১৩ সালে দেশের লেখক, ব্লগারদের টার্গেট কিলিংয়ের মধ্যদিয়ে ফের বড় আলোচনায় আসে উগ্রবাদ। জেএমবির নতুন ফরমেট নব্য জেএমবি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলাটি চালায় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। ওই জঙ্গি হামলায় দেশি- বিদেশি ২০ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়।

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদ নাছির উল্লাহ জানিয়েছেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সিসিটিসি চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত জেএমবির ৯৯ জন, নব্য জেএমবির ২০৪ জন, আনসার আল ইসলাম বা আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ১০৬ জন, হরকাতুল জিহাদের (হুজিবি) ১১০ জন, হিজবুত তাহরীরের ৩৩৪ জন এবং অন্য জঙ্গি সংগঠনের ৭৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে।

এন্টি টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পুলিশ সুপার মো. আসলাম খান জানিয়েছেন, ২০১৯ সাল থেকে অভিযান শুরু করে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৫৬ জন উগ্রবাদীকে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) ইমরান হোসেন জানিয়েছে, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সারাদেশে ৭৭৯টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে ৫৬টি অভিযান চালিয়েছে জঙ্গি আস্তানায়। এসব অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের এক হাজার ৬৭৮ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে।

জামিন পেয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা :

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে তাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হলেও ইতোমধ্যে বেশিরভাগ জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে গেছে। র‌্যাব, সিটিটিসি এবং এন্টি টেরোরিজম ইউনিট জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করলেও তারা জামিন পেয়ে যাওয়ায় একটি আতঙ্ক থেকে যায়।

সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, একজন জঙ্গিকে তিনি তিনবার উগ্রবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছেন। কিন্তু ওই জঙ্গি সন্ত্রাস দমন ট্রাইবুন্যাল থেকে তিনবারই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সিটিটিসি যত জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছে তার অধিকাংশ এখন জামিনে আছে। জামিনে থাকা জঙ্গিদের তারা নজরদারিতে রেখেছেন। কিন্তু জামিন পেয়ে গেলে সেই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করার জন্য কয়েক মাস সময় লেগে যায়।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজারের মতো জঙ্গি জামিন পেয়ে গেছেন। সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পেলেও সেই তথ্য তারা জানতে পারেন না। জেল থেকে তারা তথ্য নিচ্ছেন। যেসব জঙ্গিরা জামিন পেয়েছে তাদের মধ্যে অনেক বড় সারির জঙ্গি নেতাও রয়েছে।

বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়িয়ে যাওয়া জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা :

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব ব্যক্তিরা রেডিকালাইজড হয়ে উগ্রপন্থায় জড়িয়েছে তাদের ডি রেডিকাইলজড করার জন্য পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্প ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ডি রেডিকালাইজড অ্যান্ড রিহ্যাবিলেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি) প্রকল্পের মাধ্যমে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে যাওয়া জঙ্গিদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ৯ জন জঙ্গি আত্মসমপর্ণ করেছে র‌্যাবের কাছে।

র‌্যাব তাদের স্বাভাবিক জীবনে চলাচফেরার জন্য পুনর্বাসনের সহযোগিতা করছে। সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, সিটিটিসির সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

তিনি বলেন, উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া জঙ্গিদের ডি রেডিকালাইজড প্রোগ্রাম তারা হাতে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে এ প্রোগ্রাম অনুমোদন পেয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। এ প্রোগ্রামের জন্য সাইকাইট্রিস্ট, ধর্মীয় আলেম নিয়োগ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে জেলখানায় যেসব জঙ্গিরা গ্রেপ্তার আছেন তাদের ডি রেডিকালাইজডের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এরপর অন্য জঙ্গিদেরও একইভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২ , ১৭ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলকদ ১৪৪৩

জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা

সাইফ বাবলু

‘দেশে বড় ধরনের সশস্ত্র হামলার সক্ষমতা না থাকলেও’ থেমে নেই জঙ্গিদের তৎপরতা। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে আতঙ্কের কারণ জামিনে বেরিয়ে যাওয়া জঙ্গিরা। পুলিশের ভাষ্য, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে এখন অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান পরবর্তী সময়ে জঙ্গি দমনে বিশেষায়িত ইউনিট এন্টি টেরোরিজম ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের পৃথক অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে এর মধ্যে ২ হাজার জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে গেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, ‘জঙ্গিদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত মনিটরিং এবং নতুন পুরাতন সব জঙ্গিদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এরফলে তারা হামলা বা নাশকতা করতে পারছে না’। তবে দেশে বড় হামলা বা আত্মঘাতি হামলার সক্ষমতা না থাকলে হামলার আতঙ্ক উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউই। কারণ হলি আর্টিজানে হামলার পর যেসব জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের বড় একটি অংশ এখন জামিনে আছে। আর জামিনে বেরিয়ে আসা জঙ্গিরা অনলাইন প্লাটফর্মে নিজেদের সংগঠিত করতে সক্রিয়।

সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিবিরোধী সব বাহিনীর কল্যাণে দেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশে বড় ধরনের কোন জঙ্গি হামলার হুমকি ও আশঙ্কা এখন দেখছি না। হলি আর্টিজান হামলার পর সব জঙ্গির সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সে ধরনের সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলোর আর নেই। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত হুমকি বিবেচনায় সবচেয়ে নিরাপদ দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ইনডেক্সে সব দেশ মিলে ৪০তম অবস্থানে আমরা। যেখানে ইংল্যান্ডের অবস্থান ২১-এ। যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ২৮তম অবস্থানে। তবে, তুষ্টির সুযোগ এখনও নেই। সিটিটিসিসহ সব বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তারা শারীরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। তবে, তারাও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগ নিয়েছে। তারা সাইবার স্পেসে তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা, ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালস পরিচালনা করা, সবকিছুই তারা অনলাইনে করার চেষ্টা করেছে। এখন আমাদের ২৪ ঘণ্টা সাইবার পেট্রলিং চলছে। এ তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা এখন সাইবার স্পেসেও নিরাপদ নয়। আমরা বিশ্বাস করি, অনলাইনে জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রচারণাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। আগের মতো আর তারা রেসপন্স পাচ্ছে না।

পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান মনির সংবাদ জানান, আমরা একেবারেই আত্মতুষ্টি নিয়ে বসে নেই। কারণ যেসব জঙ্গিরা পলাতক রয়েছে তারা এখনও হুমকি হয়ে আসে। তাদের গ্রেপ্তারের কাজ করে যাচ্ছে এটিইউ।

পুলিশের ভাষ্য, সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার মধ্যদিয়ে দেশে উগ্রবাদের কার্যক্রম শুরু ২০০৪ সালে। জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এ হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসে। জোট সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা ও ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ হুজিবি আলোচনায় আসে।

কিন্তু ২০১৩ সালে দেশের লেখক, ব্লগারদের টার্গেট কিলিংয়ের মধ্যদিয়ে ফের বড় আলোচনায় আসে উগ্রবাদ। জেএমবির নতুন ফরমেট নব্য জেএমবি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলাটি চালায় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। ওই জঙ্গি হামলায় দেশি- বিদেশি ২০ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়।

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদ নাছির উল্লাহ জানিয়েছেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সিসিটিসি চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত জেএমবির ৯৯ জন, নব্য জেএমবির ২০৪ জন, আনসার আল ইসলাম বা আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ১০৬ জন, হরকাতুল জিহাদের (হুজিবি) ১১০ জন, হিজবুত তাহরীরের ৩৩৪ জন এবং অন্য জঙ্গি সংগঠনের ৭৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে।

এন্টি টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পুলিশ সুপার মো. আসলাম খান জানিয়েছেন, ২০১৯ সাল থেকে অভিযান শুরু করে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৫৬ জন উগ্রবাদীকে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) ইমরান হোসেন জানিয়েছে, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সারাদেশে ৭৭৯টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে ৫৬টি অভিযান চালিয়েছে জঙ্গি আস্তানায়। এসব অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের এক হাজার ৬৭৮ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে।

জামিন পেয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা :

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে তাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হলেও ইতোমধ্যে বেশিরভাগ জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে গেছে। র‌্যাব, সিটিটিসি এবং এন্টি টেরোরিজম ইউনিট জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করলেও তারা জামিন পেয়ে যাওয়ায় একটি আতঙ্ক থেকে যায়।

সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, একজন জঙ্গিকে তিনি তিনবার উগ্রবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছেন। কিন্তু ওই জঙ্গি সন্ত্রাস দমন ট্রাইবুন্যাল থেকে তিনবারই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সিটিটিসি যত জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছে তার অধিকাংশ এখন জামিনে আছে। জামিনে থাকা জঙ্গিদের তারা নজরদারিতে রেখেছেন। কিন্তু জামিন পেয়ে গেলে সেই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করার জন্য কয়েক মাস সময় লেগে যায়।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজারের মতো জঙ্গি জামিন পেয়ে গেছেন। সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পেলেও সেই তথ্য তারা জানতে পারেন না। জেল থেকে তারা তথ্য নিচ্ছেন। যেসব জঙ্গিরা জামিন পেয়েছে তাদের মধ্যে অনেক বড় সারির জঙ্গি নেতাও রয়েছে।

বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়িয়ে যাওয়া জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা :

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব ব্যক্তিরা রেডিকালাইজড হয়ে উগ্রপন্থায় জড়িয়েছে তাদের ডি রেডিকাইলজড করার জন্য পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্প ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ডি রেডিকালাইজড অ্যান্ড রিহ্যাবিলেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি) প্রকল্পের মাধ্যমে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে যাওয়া জঙ্গিদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকার ৯ জন জঙ্গি আত্মসমপর্ণ করেছে র‌্যাবের কাছে।

র‌্যাব তাদের স্বাভাবিক জীবনে চলাচফেরার জন্য পুনর্বাসনের সহযোগিতা করছে। সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানান, সিটিটিসির সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

তিনি বলেন, উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া জঙ্গিদের ডি রেডিকালাইজড প্রোগ্রাম তারা হাতে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে এ প্রোগ্রাম অনুমোদন পেয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। এ প্রোগ্রামের জন্য সাইকাইট্রিস্ট, ধর্মীয় আলেম নিয়োগ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে জেলখানায় যেসব জঙ্গিরা গ্রেপ্তার আছেন তাদের ডি রেডিকালাইজডের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এরপর অন্য জঙ্গিদেরও একইভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।