হবিগঞ্জের শফি উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড, ৩ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মো. শফি উদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একজন খালাস পেয়েছেন। মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন তাজুল ইসলাম, মো. জাহেদ মিয়া, ছালেক মিয়া। আর খালাস পেয়েছেন সাব্বির আহমেদ।

গতকাল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম।

গত ১৭ মে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল মামলাটির রায়ের জন্য অপেক্ষায় রেখেছিলেন। পরে গত মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন বলেন, ‘এ রায়ের কপি পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে যাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি এবং একজনকে খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে আমরা চিন্তা করবো।’

রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান। উচ্চ আদালতে আপিলের কথাও জানিয়েছেন তিনি। জাহেদ মিয়াসহ চার আসামির পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন এতে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আশা করছি, উচ্চ আদালত থেকে তারা খালাস পাবেন।

যদিও খালাস পাওয়া সাব্বির আহমেদের আইনজীবী এমএইচ তামিম বলেন, রায়ে সাব্বির আহমেদ ন্যায়বিচার পেয়েছেন। পলাতক থেকেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এজন্য ট্রাইব্যুনালের ওপর আমি এবং আমার মক্কেল কৃতজ্ঞ।

২০১৬ সালের ২২ মার্চ তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। পরে জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া এবং তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ এ মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। একই বছর ৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ আনতে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশন।

২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ওই বছরের ২৪ মার্চ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ চলে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ মামলায় ৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ১৭ মে।

যে দুই অভিযোগে শাস্তি

১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ২টায় আসামি মো. শফি উদ্দিন সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এন এ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশপাশের আরও ১০-১২টি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে এবং গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে আসামি মো. শফি উদ্দিনসহ অন্যান্য রাজাকার ও একদল পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস কামালের বাবা মো. ইদ্রিস মিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহানের বাবা আবদুল জব্বারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২ , ১৭ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলকদ ১৪৪৩

মানবতাবিরোধী অপরাধ

হবিগঞ্জের শফি উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড, ৩ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত ধর্ষণ, হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মো. শফি উদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একজন খালাস পেয়েছেন। মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন তাজুল ইসলাম, মো. জাহেদ মিয়া, ছালেক মিয়া। আর খালাস পেয়েছেন সাব্বির আহমেদ।

গতকাল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম।

গত ১৭ মে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল মামলাটির রায়ের জন্য অপেক্ষায় রেখেছিলেন। পরে গত মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন বলেন, ‘এ রায়ের কপি পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে যাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি এবং একজনকে খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে আমরা চিন্তা করবো।’

রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান। উচ্চ আদালতে আপিলের কথাও জানিয়েছেন তিনি। জাহেদ মিয়াসহ চার আসামির পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন এতে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আশা করছি, উচ্চ আদালত থেকে তারা খালাস পাবেন।

যদিও খালাস পাওয়া সাব্বির আহমেদের আইনজীবী এমএইচ তামিম বলেন, রায়ে সাব্বির আহমেদ ন্যায়বিচার পেয়েছেন। পলাতক থেকেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এজন্য ট্রাইব্যুনালের ওপর আমি এবং আমার মক্কেল কৃতজ্ঞ।

২০১৬ সালের ২২ মার্চ তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। পরে জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া এবং তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ এ মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। একই বছর ৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ আনতে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশন।

২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ওই বছরের ২৪ মার্চ এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ চলে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ মামলায় ৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ১৭ মে।

যে দুই অভিযোগে শাস্তি

১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ২টায় আসামি মো. শফি উদ্দিন সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এন এ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশপাশের আরও ১০-১২টি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে এবং গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে আসামি মো. শফি উদ্দিনসহ অন্যান্য রাজাকার ও একদল পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস কামালের বাবা মো. ইদ্রিস মিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহানের বাবা আবদুল জব্বারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।