সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা

মিথুশিলাক মুরমু

মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অগ্রপথিক আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সাঁওতালদের অভিধা করা হয়েছে বুনো, অরণ্যচারী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে; কিন্তু তাদের মধ্যেকার দেশপ্রেম চেতনার বীজ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলো। সাঁওতাল বিদ্রোহের ন্যায়ের জন্য লড়াই, আত্মত্যাগ, সর্বসাধারণের অংশায়ন পরবর্তীকালের আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছে। আজ থেকে ১৬৭ বছর পূর্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন চেতনাগত বোধ এবং দৈহিক শক্তিকে পুঁজি করে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা শিক্ষিত, সরকারি দায়িত্ববান এবং দেশি-বিদেশিদের মিশেল প্রশাসনের দুর্ভেদ্য বুহ্যকে ভেঙে দিয়েছে। অক্ষরজ্ঞানের শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে চেতনাগত শক্তি। সাঁওতালরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত কর্মচারীরা তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করছে, মানবতাকে করেছে লঙ্ঘন। সাঁওতালদের ‘সেন্স অব জাস্টিফিকেশন’ নিজ থেকেই জাগরিত হয়েছে। বিবেকের তাড়নায় সাঁওতালরা ক্রমশই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে; দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। সাঁওতাল বিদ্রোহ মূলত ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধিতা নয়, প্রশাসনের উচ্ছেদ নয়; হয়েছে চেতনার, ন্যায্যতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছেছে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট ফরেন মিশন সোসাইটি সর্বপ্রথম সাঁওতালদের ধর্মের কথা শুনিয়েছে, প্রতিষ্ঠা করেছে জলেশ্বর মিশন; বোধকরি ধর্ম প্রচার, স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ছিলো। একদিকে নিরক্ষর আদিবাসী সাঁওতাল অপরদিকে বিলেতি শিক্ষিত ও কাঠামোগত প্রশাসন দুটি যেন যোজন যোজন ফারাক। আদিবাসী সাঁওতালদের চেতনার আগুনে জলে উঠেছে প্রতিবেশী নিম্নশ্রেণীর কুমার, তেলী, কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরিব মুসলমান ও গরির হিন্দু জনসাধারণ মানুষেরাও; তারা সত্যের পক্ষাবলম্বন করে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ রিসোর্স ব্যবহারে কার্পণ্যবোধ করেনি; যার যা আছে তা নিয়েই চেতনাগত শক্তিকে শাণিত করেছে। কখনও কামররা অস্ত্র বানিয়ে দিয়েছে, আবার কখনও কামার, কুমার, কৃষকেরা সাঁওতালদের পাশে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য গড়ে তুলেছে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ শান্তিপূর্ণভাবে সূচিত হলেও কালক্রমে সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরোরা শান্তির পথটিতে টিকে থাকতে পারেনি। প্রশাসনের দাম্ভিকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অবজ্ঞাসূচক আচরণ প্রভৃতিতে আদিবাসীদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। দৈহিক শক্তিতে বলিয়ান আদিবাসী যুবরা খুব কাছ থেকে দেখেছে প্রশাসনের দৌরাত্ম; সময়ে-অসময়ে সাঁওতাল পল্লীতে এসে মাজহী, জগ-মাজহী, পারানিক, জগ-পারানিক, নায়কে ও গডেৎকে তটস্ত করতে। দেখেছে- প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থাকা মহাজন, ফড়িয়া, দালালরা ঋণ পরিশোধের নামে সহায়-সম্পত্তি করায়ত্ব করতে। সমাজের মুরুব্বিদের প্রতি নির্মম অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, এমনকি নারীদের শ্লীলতাহানীর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আদিবাসী সাঁওতালরা এরূপ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে স্রষ্টা ঠাকুরজিউের কাছে ক্রন্দন করেছে। অনেক অনেক চোখের জল ফেলেছে কিন্তু স্রষ্টা ঠাকুরজিউয়ের আবাসস্থল স্বর্গে বাঁচার আকুতি পৌঁছায়নি। জীবন পরিক্রমায় আদিবাসীরা ঠাকুরজিউয়ের স্থানকে সংকুচিত করেছে, তিনি যে ত্রিভুবনের ভুবনেশ্বর, তাঁর নাম দেবতাদের পূজা-অর্চনায় এক প্রকার নির্বাসিত হয়েছিলো। সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরো, জানো-ফুলমনিরা ঠাকুরজিউয়ের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন; ঠাকুরজিউ-ই মানুষের চেতনাকে বিকশিত করেন; স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে উজ্জীবিত করেন।

বছরের পর বছর সাঁওতাল তরুণরা দেখেছে- প্রশাসনের দুব্যর্বহার, অন্যায় আবদার এবং নিজ সমাজের শৃঙ্খলা ও ঐতিহ্যকে পায়ে দলে মুচড়ে পূর্বপুরুষের লালিত স্বপ্নের যেন সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শারীরিক শক্তিকে উদ্বেলিত করেছে। ব্যক্তি ও সমাজের শত্রু, জমির শত্রু, জঙ্গলের শত্রু যেন জাতির শত্রুতে পরিণত হয়েছে। যুবরা মাদল-নাগড়ার শব্দে উচ্চকণ্ঠিত হয়েছে, সমবেত হয়েছে; সমাজের ক্রান্তিলগ্নে নিজেদের বিলিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। সিদু-কানুর আহবানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার যুব ভগনাডিহিতে পৌঁছিয়েছে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু-কানুরা যুবদের হাতে তুলে দিয়েছিলো চেতনার মশাল, চেতনার আলোকচ্ছ্বটা বিচ্ছুরিত হতে থাকলো সাঁওতাল অধ্যুষিত দেওঘর, পাকুড়, মহেশপুর, বীরভূম, ভাগলপুর, সংগ্রামপুর, রাজমহলের বিস্তৃর্ণ এলাকায়। আদিবাসী সাঁওতালদের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো স্বদেশ স্বরাজের। যুগ-যুগান্তের নিষ্পেষিত জীবন স্বপ্ন, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ও পারস্পারিক ভালোবাসাকে বিবর্ণ করেছে। সিধু-কানুরা সরকারের অধীনস্তদের কাছে আর্জি জানিয়েছিলো, মহিষে টানা লাঙ্গল ৮ আনায় ও বলদে টানা লাঙ্গল ৪ আনা দেওয়ার; খাজনার পরিমাণ কীভাবে আদিবাসীদের অস্বস্তিতে ফেলেছিলো, সেটি কল্পনাতীত। হয়তো সেদিন তাদের এই প্রস্তাবনাটিও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পৌঁছায়নি।

সিধু ঘোষণা করেছিলেন- ‘আর সরকার আমাদের কথা না রাখলে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব, দেকোদের খতম করব এবং আমরাই রাজা হব।’ আদিবাসীদের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো, শান্তির অন্বেষীদের বেছে নিতে বাধ্য করেছিলো সশস্ত্র আন্দোলনে। বর্তমান সাঁওতাল পারগানা আদিবাসীদের লালরক্তে রঞ্জিত হয়েছে, বাঁচার দাবিতে প্রাণোৎসর্গ করেছে নারী-পুরুষ, যুব-পৌঢ় শিশুরাও। সাঁওতাল বিদ্রোহের পথ ধরেই সিপাহী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিলো বিদ্রোহীদের প্রেরণা, বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ঘটেছিলো পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে ঢাকা পর্যন্ত।

আদিবাসী সাঁওতালদের নৈতিকতা, বিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি অগাধ আস্থার চিত্র মেলে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহে। ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে ঠিক এভাবে- ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহে বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু ধরা পড়লো। ধৃত সিধু-কানুকে ঝিলিমিলি বাঙলায় (মন্তান্তরে) নিয়ে এসে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা এবং তাদের বিদ্রোহী সঙ্গী-সাথীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয়। ভিনদেশী সাহেবরা গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসা করতে থাকে- তুমিও কী খুন করেছ? মানুষ হত্যা করেছ? উত্তরে- গ্রেপ্তারকৃতদের একজন একজন করে সবাই বলেছিলো হ্যাঁ, আমি খুন করেছি, মানুষ হত্যা করেছি। এভাবেই আত্মস্বীকৃত খুনিদের একের পর এক ফাঁসিতে লটকানো হচ্ছিল। অনেকজনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর সাহেব তার চাপরাশিকে (সহযোগীকে) শিখিয়ে দিলেন- তুমি ওই সাঁওতালদের বলো তারা যেন মিথ্যা বলে; নইলে আর কতোজনকে ফাঁসিতে ঝোলাবো! অতঃপর চাপরাশি গ্রেপ্তারকৃতদের প্রত্যেককে শিখিয়ে দিলেন- যখন সাহেব তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে- তুমি কি খুন করেছ? মানুষ হত্যা করেছ? তখন বলবে- আমি খুন করিনি, মানুষ হত্যা করিনি। তাহলেই তোমরা বেঁচে যাবে, তোমাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হবে না।

আবার শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ- কয়েকজন সাঁওতাল ব্যক্তি চাপরাশির শেখানো মতোই বললে তারা ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে বেঁচে যায়। তাদের বেঁচে যাওয়া দেখে অন্যরা পারস্পারিক আলোচনায় মিলিত হলো। বললো- এটি তো মিথ্যা কথা, কিন্তু সত্যিই তো মিথ্যা কথা বলেও বাঁচা যায়। তখন থেকেই সাঁওতালদের মগজে এবং বিশ্বাসে মিথ্যা কথা বলার বীজ রোপিত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সিধু-কানুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিলো রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের কার্যাবলী বিঘ্নের জন্যেও নয়। ইংরেজরা সিধু-কানুকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলো সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য, বহু লোকের মৃত্যুর জন্য, বহু মেয়েকে বিধবা করার জন্য, বহু ছেলেমেয়েকে অনাথ করার জন্য, বহু লোককে আশ্রয়হীন করা ও কাঁদানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করল এবং এজন্য শাস্তি দিল অর্থাৎ ঝিলিমিলি মাঠে মহুয়া গাছে টাঙিয়ে ফাঁসি দিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে প্রবাহিত করা হলো ভিন্ন খাতে, তবে সেটি ধোপে টেকেনি। বিদ্রোহের সমাপ্তিতে বুদ্ধিদীপ্ত ইংরেজরা সাঁওতালদের চেতনায় আলোকিত হলেন, সৃষ্টি করলেন ৬টি নন-রেগুলেটেড জেলা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা।

চেতনা অমর এবং অবিনশ্বর। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা আমাদের উপমহাদেশের প্রতিটি বিদ্রোহ এবং শেষান্তে মহান মুক্তিযুদ্ধকেও সমৃদ্ধ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত রয়েছে- ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া {জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের} মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের তালিকায় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের নাম জলজল করছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০) থেকে তেভাগার কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭) পর্যন্ত প্রায় ১৭টি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। ...প্রত্যেকটি বিদ্রোহের ফলাফলে আদৌ বিবেচ্য নয়, আসল বিবেচ্য হচ্ছে এগুলোর চরিত্র এবং তা হলো- অসম অথচ সাহসিক বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ; যা সার্বিক অর্থে ছিল জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম। তাই শুধু যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলে ১৯৭১ সালে মুক্তির জন্য সংগ্রাম দুই শতাধিক বছরের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঐতিহাসিক ধারাকে ভুলে যেতে হয়।

[লেখক : কলামিস্ট]

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২ , ১৭ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলকদ ১৪৪৩

সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা

মিথুশিলাক মুরমু

মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অগ্রপথিক আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সাঁওতালদের অভিধা করা হয়েছে বুনো, অরণ্যচারী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে; কিন্তু তাদের মধ্যেকার দেশপ্রেম চেতনার বীজ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলো। সাঁওতাল বিদ্রোহের ন্যায়ের জন্য লড়াই, আত্মত্যাগ, সর্বসাধারণের অংশায়ন পরবর্তীকালের আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছে। আজ থেকে ১৬৭ বছর পূর্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন চেতনাগত বোধ এবং দৈহিক শক্তিকে পুঁজি করে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা শিক্ষিত, সরকারি দায়িত্ববান এবং দেশি-বিদেশিদের মিশেল প্রশাসনের দুর্ভেদ্য বুহ্যকে ভেঙে দিয়েছে। অক্ষরজ্ঞানের শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে চেতনাগত শক্তি। সাঁওতালরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত কর্মচারীরা তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করছে, মানবতাকে করেছে লঙ্ঘন। সাঁওতালদের ‘সেন্স অব জাস্টিফিকেশন’ নিজ থেকেই জাগরিত হয়েছে। বিবেকের তাড়নায় সাঁওতালরা ক্রমশই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে; দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। সাঁওতাল বিদ্রোহ মূলত ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধিতা নয়, প্রশাসনের উচ্ছেদ নয়; হয়েছে চেতনার, ন্যায্যতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছেছে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট ফরেন মিশন সোসাইটি সর্বপ্রথম সাঁওতালদের ধর্মের কথা শুনিয়েছে, প্রতিষ্ঠা করেছে জলেশ্বর মিশন; বোধকরি ধর্ম প্রচার, স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ছিলো। একদিকে নিরক্ষর আদিবাসী সাঁওতাল অপরদিকে বিলেতি শিক্ষিত ও কাঠামোগত প্রশাসন দুটি যেন যোজন যোজন ফারাক। আদিবাসী সাঁওতালদের চেতনার আগুনে জলে উঠেছে প্রতিবেশী নিম্নশ্রেণীর কুমার, তেলী, কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরিব মুসলমান ও গরির হিন্দু জনসাধারণ মানুষেরাও; তারা সত্যের পক্ষাবলম্বন করে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ রিসোর্স ব্যবহারে কার্পণ্যবোধ করেনি; যার যা আছে তা নিয়েই চেতনাগত শক্তিকে শাণিত করেছে। কখনও কামররা অস্ত্র বানিয়ে দিয়েছে, আবার কখনও কামার, কুমার, কৃষকেরা সাঁওতালদের পাশে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য গড়ে তুলেছে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ শান্তিপূর্ণভাবে সূচিত হলেও কালক্রমে সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরোরা শান্তির পথটিতে টিকে থাকতে পারেনি। প্রশাসনের দাম্ভিকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অবজ্ঞাসূচক আচরণ প্রভৃতিতে আদিবাসীদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। দৈহিক শক্তিতে বলিয়ান আদিবাসী যুবরা খুব কাছ থেকে দেখেছে প্রশাসনের দৌরাত্ম; সময়ে-অসময়ে সাঁওতাল পল্লীতে এসে মাজহী, জগ-মাজহী, পারানিক, জগ-পারানিক, নায়কে ও গডেৎকে তটস্ত করতে। দেখেছে- প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থাকা মহাজন, ফড়িয়া, দালালরা ঋণ পরিশোধের নামে সহায়-সম্পত্তি করায়ত্ব করতে। সমাজের মুরুব্বিদের প্রতি নির্মম অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, এমনকি নারীদের শ্লীলতাহানীর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আদিবাসী সাঁওতালরা এরূপ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে স্রষ্টা ঠাকুরজিউের কাছে ক্রন্দন করেছে। অনেক অনেক চোখের জল ফেলেছে কিন্তু স্রষ্টা ঠাকুরজিউয়ের আবাসস্থল স্বর্গে বাঁচার আকুতি পৌঁছায়নি। জীবন পরিক্রমায় আদিবাসীরা ঠাকুরজিউয়ের স্থানকে সংকুচিত করেছে, তিনি যে ত্রিভুবনের ভুবনেশ্বর, তাঁর নাম দেবতাদের পূজা-অর্চনায় এক প্রকার নির্বাসিত হয়েছিলো। সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরো, জানো-ফুলমনিরা ঠাকুরজিউয়ের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন; ঠাকুরজিউ-ই মানুষের চেতনাকে বিকশিত করেন; স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে উজ্জীবিত করেন।

বছরের পর বছর সাঁওতাল তরুণরা দেখেছে- প্রশাসনের দুব্যর্বহার, অন্যায় আবদার এবং নিজ সমাজের শৃঙ্খলা ও ঐতিহ্যকে পায়ে দলে মুচড়ে পূর্বপুরুষের লালিত স্বপ্নের যেন সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শারীরিক শক্তিকে উদ্বেলিত করেছে। ব্যক্তি ও সমাজের শত্রু, জমির শত্রু, জঙ্গলের শত্রু যেন জাতির শত্রুতে পরিণত হয়েছে। যুবরা মাদল-নাগড়ার শব্দে উচ্চকণ্ঠিত হয়েছে, সমবেত হয়েছে; সমাজের ক্রান্তিলগ্নে নিজেদের বিলিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। সিদু-কানুর আহবানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার যুব ভগনাডিহিতে পৌঁছিয়েছে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু-কানুরা যুবদের হাতে তুলে দিয়েছিলো চেতনার মশাল, চেতনার আলোকচ্ছ্বটা বিচ্ছুরিত হতে থাকলো সাঁওতাল অধ্যুষিত দেওঘর, পাকুড়, মহেশপুর, বীরভূম, ভাগলপুর, সংগ্রামপুর, রাজমহলের বিস্তৃর্ণ এলাকায়। আদিবাসী সাঁওতালদের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো স্বদেশ স্বরাজের। যুগ-যুগান্তের নিষ্পেষিত জীবন স্বপ্ন, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ও পারস্পারিক ভালোবাসাকে বিবর্ণ করেছে। সিধু-কানুরা সরকারের অধীনস্তদের কাছে আর্জি জানিয়েছিলো, মহিষে টানা লাঙ্গল ৮ আনায় ও বলদে টানা লাঙ্গল ৪ আনা দেওয়ার; খাজনার পরিমাণ কীভাবে আদিবাসীদের অস্বস্তিতে ফেলেছিলো, সেটি কল্পনাতীত। হয়তো সেদিন তাদের এই প্রস্তাবনাটিও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পৌঁছায়নি।

সিধু ঘোষণা করেছিলেন- ‘আর সরকার আমাদের কথা না রাখলে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব, দেকোদের খতম করব এবং আমরাই রাজা হব।’ আদিবাসীদের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো, শান্তির অন্বেষীদের বেছে নিতে বাধ্য করেছিলো সশস্ত্র আন্দোলনে। বর্তমান সাঁওতাল পারগানা আদিবাসীদের লালরক্তে রঞ্জিত হয়েছে, বাঁচার দাবিতে প্রাণোৎসর্গ করেছে নারী-পুরুষ, যুব-পৌঢ় শিশুরাও। সাঁওতাল বিদ্রোহের পথ ধরেই সিপাহী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিলো বিদ্রোহীদের প্রেরণা, বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ঘটেছিলো পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে ঢাকা পর্যন্ত।

আদিবাসী সাঁওতালদের নৈতিকতা, বিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি অগাধ আস্থার চিত্র মেলে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহে। ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে ঠিক এভাবে- ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহে বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু ধরা পড়লো। ধৃত সিধু-কানুকে ঝিলিমিলি বাঙলায় (মন্তান্তরে) নিয়ে এসে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা এবং তাদের বিদ্রোহী সঙ্গী-সাথীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয়। ভিনদেশী সাহেবরা গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসা করতে থাকে- তুমিও কী খুন করেছ? মানুষ হত্যা করেছ? উত্তরে- গ্রেপ্তারকৃতদের একজন একজন করে সবাই বলেছিলো হ্যাঁ, আমি খুন করেছি, মানুষ হত্যা করেছি। এভাবেই আত্মস্বীকৃত খুনিদের একের পর এক ফাঁসিতে লটকানো হচ্ছিল। অনেকজনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর সাহেব তার চাপরাশিকে (সহযোগীকে) শিখিয়ে দিলেন- তুমি ওই সাঁওতালদের বলো তারা যেন মিথ্যা বলে; নইলে আর কতোজনকে ফাঁসিতে ঝোলাবো! অতঃপর চাপরাশি গ্রেপ্তারকৃতদের প্রত্যেককে শিখিয়ে দিলেন- যখন সাহেব তোমাদের জিজ্ঞাসা করবে- তুমি কি খুন করেছ? মানুষ হত্যা করেছ? তখন বলবে- আমি খুন করিনি, মানুষ হত্যা করিনি। তাহলেই তোমরা বেঁচে যাবে, তোমাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হবে না।

আবার শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ- কয়েকজন সাঁওতাল ব্যক্তি চাপরাশির শেখানো মতোই বললে তারা ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে বেঁচে যায়। তাদের বেঁচে যাওয়া দেখে অন্যরা পারস্পারিক আলোচনায় মিলিত হলো। বললো- এটি তো মিথ্যা কথা, কিন্তু সত্যিই তো মিথ্যা কথা বলেও বাঁচা যায়। তখন থেকেই সাঁওতালদের মগজে এবং বিশ্বাসে মিথ্যা কথা বলার বীজ রোপিত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সিধু-কানুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিলো রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের কার্যাবলী বিঘ্নের জন্যেও নয়। ইংরেজরা সিধু-কানুকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলো সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য, বহু লোকের মৃত্যুর জন্য, বহু মেয়েকে বিধবা করার জন্য, বহু ছেলেমেয়েকে অনাথ করার জন্য, বহু লোককে আশ্রয়হীন করা ও কাঁদানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করল এবং এজন্য শাস্তি দিল অর্থাৎ ঝিলিমিলি মাঠে মহুয়া গাছে টাঙিয়ে ফাঁসি দিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে প্রবাহিত করা হলো ভিন্ন খাতে, তবে সেটি ধোপে টেকেনি। বিদ্রোহের সমাপ্তিতে বুদ্ধিদীপ্ত ইংরেজরা সাঁওতালদের চেতনায় আলোকিত হলেন, সৃষ্টি করলেন ৬টি নন-রেগুলেটেড জেলা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা।

চেতনা অমর এবং অবিনশ্বর। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা আমাদের উপমহাদেশের প্রতিটি বিদ্রোহ এবং শেষান্তে মহান মুক্তিযুদ্ধকেও সমৃদ্ধ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত রয়েছে- ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া {জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের} মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের তালিকায় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের নাম জলজল করছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০) থেকে তেভাগার কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭) পর্যন্ত প্রায় ১৭টি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। ...প্রত্যেকটি বিদ্রোহের ফলাফলে আদৌ বিবেচ্য নয়, আসল বিবেচ্য হচ্ছে এগুলোর চরিত্র এবং তা হলো- অসম অথচ সাহসিক বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ; যা সার্বিক অর্থে ছিল জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম। তাই শুধু যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলে ১৯৭১ সালে মুক্তির জন্য সংগ্রাম দুই শতাধিক বছরের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঐতিহাসিক ধারাকে ভুলে যেতে হয়।

[লেখক : কলামিস্ট]