বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চল এগিয়ে যাবে দেশ

সাধন সরকার

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি! একসময় পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল! কিন্তু ইতিহাস বলে- বাঙালি জাতি স্বপ্নের সঙ্গে কখনো আপস করেনি। পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদীর ওপর পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ চ্যালেঞ্জের হলেও কখনো আশা হারায়নি বাংলাদেশ। বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু ‘পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প’।

করোনা-কালের মধ্যেও কাজ অব্যাহত রাখার ফলে স্বপ্নের সেতু বাস্তবে রূপ পেয়েছে। দেশের দীর্ঘতম ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ইতোমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে পদ্মাপাড়ের জীবন। খরস্রোতার দিক দিয়ে বিশ্বে আমাজানের পরেই পদ্মা নদীর অবস্থান। পানি প্রবাহের দিক দিয়ে পদ্মা শীর্ষে। এমন একটা নদীতে সেতু নির্মাণ করা বিশ^রেকর্ড বটে! পদ্মা পাড়ের দুই দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার নদী শাসন করা হয়েছে, যা সিঙ্গেল কন্ট্রাক্টে বিশ্বে সর্বোচ্চ। সংযোগ সড়ক মিলিয়ে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে দুই পাড়ের মানুষের জীবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

অন্ধকার-অশুভ শক্তি যতই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরুক না কেন সকল বাধা পেরিয়ে আলো আসবেই। বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের গৌরবকে মহিমান্বিত করার নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তো বটেই পুরো দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে যাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের মধ্য দিয়ে খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের মোট ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। পদ্মা নদীতে লঞ্চ ও ফেরি পারাপারে বিভিন্ন সময় নৌ-দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। স্বজন হারানো অনেকের তখন বলতে শোনা গেছে পদ্মায় যদি একটা সেতু থাকতো!

নদী পার হতে গিয়ে এখন আর কাউকে জীবন হারাতে হবে না। রাতে লঞ্চ পারাপার নিয়ে চিন্তা করারও দিন শেষ হলো। এখন আকাশ মেঘলা থাকলেও পদ্মা নদী পার হতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। ৬ মিনিটেই পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পার হওয়া যাবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে শিল্প, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। বাড়বে বিনিয়োগ, ঘটবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। ইতিমধ্যে পদ্মা পাড়ের দক্ষিণের জেলা ফরিদপুর বদলে গেছে। এই ফরিদপুর আর সেই ফরিদপুরের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল ফাঁরাক। ফরিদপুর ঘিরে হচ্ছে নতুন বিভাগ। মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে। আগের থেকে বন্দরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে, আগামীতে আরো বাড়বে। পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের নতুন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে দেশের দ্বিতীয় এই সমুদ্রবন্দর।

অদম্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্ষমতার স্বরূপ তুলে ধরেছে পদ্মা সেতু। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নয় পুরো দেশের সঙ্গে একটা সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এর মাধ্যমে। এ সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা-অর্থনীতিসব সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বাড়তি প্রায় ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। জাতীয়ভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় ১ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশ আরও স্বল্প ও অতি সহজে প্রতিবেশী দেশসমূহে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির প্রসার হয়েছে।

বুকভরা গর্ব আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি এখন বলতে পারবে-আমরাও পারি! পদ্মা সেতু নির্মাণ যেন স্বপ্নের সঙ্গে আপস না করা এক জয়ের গল্প। টুকরো টুকরো স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সর্বক্ষেত্রে এভাবেই মর্যাদার আসনে আসীন হবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

[লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী]

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২ , ১৭ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলকদ ১৪৪৩

বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চল এগিয়ে যাবে দেশ

সাধন সরকার

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি! একসময় পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল! কিন্তু ইতিহাস বলে- বাঙালি জাতি স্বপ্নের সঙ্গে কখনো আপস করেনি। পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদীর ওপর পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ চ্যালেঞ্জের হলেও কখনো আশা হারায়নি বাংলাদেশ। বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু ‘পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প’।

করোনা-কালের মধ্যেও কাজ অব্যাহত রাখার ফলে স্বপ্নের সেতু বাস্তবে রূপ পেয়েছে। দেশের দীর্ঘতম ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ইতোমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে পদ্মাপাড়ের জীবন। খরস্রোতার দিক দিয়ে বিশ্বে আমাজানের পরেই পদ্মা নদীর অবস্থান। পানি প্রবাহের দিক দিয়ে পদ্মা শীর্ষে। এমন একটা নদীতে সেতু নির্মাণ করা বিশ^রেকর্ড বটে! পদ্মা পাড়ের দুই দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার নদী শাসন করা হয়েছে, যা সিঙ্গেল কন্ট্রাক্টে বিশ্বে সর্বোচ্চ। সংযোগ সড়ক মিলিয়ে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে দুই পাড়ের মানুষের জীবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

অন্ধকার-অশুভ শক্তি যতই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরুক না কেন সকল বাধা পেরিয়ে আলো আসবেই। বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের গৌরবকে মহিমান্বিত করার নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তো বটেই পুরো দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে যাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের মধ্য দিয়ে খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের মোট ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। পদ্মা নদীতে লঞ্চ ও ফেরি পারাপারে বিভিন্ন সময় নৌ-দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। স্বজন হারানো অনেকের তখন বলতে শোনা গেছে পদ্মায় যদি একটা সেতু থাকতো!

নদী পার হতে গিয়ে এখন আর কাউকে জীবন হারাতে হবে না। রাতে লঞ্চ পারাপার নিয়ে চিন্তা করারও দিন শেষ হলো। এখন আকাশ মেঘলা থাকলেও পদ্মা নদী পার হতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। ৬ মিনিটেই পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পার হওয়া যাবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে শিল্প, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। বাড়বে বিনিয়োগ, ঘটবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। ইতিমধ্যে পদ্মা পাড়ের দক্ষিণের জেলা ফরিদপুর বদলে গেছে। এই ফরিদপুর আর সেই ফরিদপুরের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল ফাঁরাক। ফরিদপুর ঘিরে হচ্ছে নতুন বিভাগ। মোংলা বন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে। আগের থেকে বন্দরের রাজস্ব আদায় বেড়েছে, আগামীতে আরো বাড়বে। পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের নতুন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে দেশের দ্বিতীয় এই সমুদ্রবন্দর।

অদম্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্ষমতার স্বরূপ তুলে ধরেছে পদ্মা সেতু। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নয় পুরো দেশের সঙ্গে একটা সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এর মাধ্যমে। এ সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা-অর্থনীতিসব সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বাড়তি প্রায় ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। জাতীয়ভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় ১ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশ আরও স্বল্প ও অতি সহজে প্রতিবেশী দেশসমূহে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির প্রসার হয়েছে।

বুকভরা গর্ব আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি এখন বলতে পারবে-আমরাও পারি! পদ্মা সেতু নির্মাণ যেন স্বপ্নের সঙ্গে আপস না করা এক জয়ের গল্প। টুকরো টুকরো স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সর্বক্ষেত্রে এভাবেই মর্যাদার আসনে আসীন হবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

[লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী]