ভারতে মুসলমানদের কথা বললেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে

গৌতম রায়

মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর ভারতে বিগত ২০১৪ সাল থেকে নয়া আঙ্গিকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন শুরু হয়েছে, তার প্রতিবাদ যদি কেউ করেন প্রতিরোধের সংকল্প করেন, মুসলমান সমাজের পাশে দাঁড়ান, তাকেই এখন ভারতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতে হবে। গুজরাট গণহত্যার আগে থেকেই গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস তার হাজার রকমের শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতৃত্বে যে মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে তিস্তা শীতলবাদের মতো খুব হাতেগোনা মানুষজনই তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার থেকেছেন। রাজনৈতিক পরিম-লের বাইরে যারাই মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে অন্যায়, অবিচার ঘিরে সোচ্চার থেকেছেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির তাদেরকেই হয় ঘুষ দিয়ে বশীভূত করেছে, নতুবা ঘুষির ভয়ে পথচ্যুত করেছে।

তিস্তা শীতলবাদ এই ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং রাষ্ট্রশক্তির যৌথ আক্রমণের শিকার মুসলমান সমাজের হয়ে সাম্প্রতিক ভারতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নাগরিক সমাজের ভিতর থেকে তিস্তা, হর্ষ মান্দারের মতো হাতেগোনা মানুষজন আছেন, যারা প্রতিবাদী হয়েছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাজে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের দ্বারা বর্তমান সময়ে পরিচালিত ভারত সরকারের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী কাজ এবং মানসিকতাকে মেলে ধরবার ক্ষেত্রেও এসব মানুষদের অবদান ঐতিহাসিক।

সংখ্যালঘুর অধিকার ঘিরে ঠিক এ অবদান রাখা মানুষরাই এখন যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির ভারত রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। কারণ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের ওপর দীর্ঘ যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অত্যাচার সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শিবিরের দ্বারা সংঘটিত হয়ে চলেছে, তাকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে, তাকে আর ও ক্ষিপ্ত ,আর উগ্র করে তোলবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের বিভিন্ন ধরনের শাখা সংগঠন ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভূমিকা সব থেকে বেশি। এই আরএসএসের সমস্ত ধরনের কর্মকা-কে প্রতিহত করবার লক্ষ্যে বামপন্থী রাজনীতিকরা ব্যতীত এবং তিস্তা শীতলবাদ, হর্ষ মান্দার, মোহামামদ জুবেইয়ের দের মত হাতে গোনা কিছু ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষজন ছাড়া ভারতের আর কোনো রাজনৈতিক দল কোনরকম আন্তরিক প্রয়াস চালায় না।

ভোট রাজনীতির খাতিরে কংগ্রেস বা তার কিছু সাঙ্গবাঙ্গেরা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রসারিত করবার লক্ষ্যে যে অবস্থান নেওয়া দরকার, রাজনৈতিক কর্মকা- করা দরকার, তার ধারপাশ দিয়েও তারা হাঁটে না। প-িত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর থেকে কংগ্রেস দল নেহরু অনুসৃত প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে সরে গিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী তার রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে কখনো আরএসএসকে ব্যবহার করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। কখনো করেছেন পরোক্ষভাবে। আবার সেই আরএসএস যখন ইন্দিরার ওপর প্রভাব বিস্তার করবার চেষ্টা করেছে, সেই প্রভাবকে প্রতিহত করবার লক্ষ্যে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছেন ইন্দিরা আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করে।

গোটা ভারত জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসারণের লক্ষ্যে বুর্জোয়া রাজনীতিকদের বিভিন্ন শিবিরের, বিভিন্ন সময়ে টানা পোড়ে?ন, তার নিরিখেই কিন্তু আজকে তিস্তাদের গ্রেপ্তারের সমস্ত প্রেক্ষাপটটিকে আমাদের বিচার করতে হবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিধায়ক কেনাবেচার ভেতর দিয়ে নির্বাচনে ভোটারদের যে অভিমত, তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহারাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করল বিজেপি। সেই রাজ্যের শেষ বিধানসভা ভোটের পর বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ধব ঠাকরে যে কংগ্রেস এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপিকে নিয়ে সরকার পরিচালনা করছিলেন, সেই সরকারও যে খুব ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান অন্তর থেকে নিয়ে চলছিল, এই দাবি করতে পারা যায় না। উদ্ভব ঠাকুরের সেই সরকারের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ’৯২ সালের ডিসেম্বর এবং ৯৩ সালে জানুয়ারি মাসে গোটা মুম্বাই শহর জুড়ে মুসলমান সমাজের মানুষদের সর্বস্তরের উপর সম্প্রদায়িক হিন্দুদের যে ভয়াবহ অত্যাচার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুম্বাই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত সেই সময়ের শিবসেনা নেতা সঞ্জয় নিরুপম এখন কংগ্রেস দলের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা। শারদ পাওয়ারের রাজনৈতিক দল এনসিপির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যে সেদিন মুম্বাই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, এই কথা কখনোই বলতে পারা যায় না।

মুম্বাই দাঙ্গার পর শ্রীকৃষ্ণ কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশনকে কাজ করতে না দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ সম্প্রদায়িক এবং পরোক্ষ সম্প্রদায়িক, উভয় শিবিরে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেছিল। তা সত্ত্বেও ওই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত এবং প্রত্যক্ষভাবে মুসলমানদের জানমালের উপর অত্যাচারকারী, সম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের চিহ্নিত করে, তাদের শাস্তির যে সুপারিশ শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের প্রতিবেদনে করা হয়েছিল ,তাকে বাস্তবায়িত করবার লক্ষ্যে নয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক শক্তি, তার মধ্যে কংগ্রেসও আছে, মহারাষ্ট্রে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ,তারা কেউ বাস্তবায়িত করেনি।

একটা ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস গায়ে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মসিহা হিসেবে দেখানোর বহু চেষ্টা নানা সময় করে থাকেন। ‘হাজী বিবি’র চরিত্রে অসফল অভিনেত্রীর ভূমিকায় তার অভিনয় দেখতে দেখতে অত্যাচারিত মুসলমান সম্প্রদায়ের চোখ এখন ক্লান্ত। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কেন্দ্রে একাধিক সময়ে, একাধিক রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি যেমন কখনো কোন অবস্থাতেই শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করবার দাবি তোলেননি, আবার বিজেপি সরকারের মন্ত্রী থাকাকালীন তো তার পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর বা দাবি তোলার বাস্তব সমস্যার কথা আমরা বুঝতেই পারি।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আবার গুজরাট গণহত্যার কালে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বিজেপি নেতৃতাধীন সরকার এনডিএ নামক এক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ফলে কখনোই সংখ্যালঘুর উপর হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যে নারকীয় অত্যাচার চালাচ্ছে, তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যকর কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত করেননি।

সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের জানমাল নিরাপত্তার জন্য প্রকৃত দাবি জানানো, এমনকি তার নিজের রাজ্যে, তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর যে ধারাবাহিক অত্যাচার চলেছে, ধারাবাহিক দাঙ্গা চলেছে, সে সম্পর্কেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদৌ কোন দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেননি; মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে চলা সংঘটিত অপরাধকে প্রতিহত করবার জন্য তার প্রশাসন আদৌ কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

তিস্তা শীতলবাদেরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মোহাম্মদ জুবাইয়ের গ্রেপ্তার হওয়ার পর, বামপন্থীরা যেভাবে পথে নেমেছেন; দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- সেভাবে কিন্তু ভারতে আর কোন রাজনৈতিক দল আজ পর্যন্ত পথে নামেনি। এই গ্রেপ্তারি ও গুলির বেশ কিছুকাল পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার একটি সভা থেকে মামুলি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ব্যাস ওই পর্যন্তই। তার বাইরে কিন্তু তিস্তাদের মুক্ত করবার ক্ষেত্রে কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মসূচি, কূটনৈতিক কর্মকা- অংশগ্রহণ করতে তাকে আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি।

তিস্তার ওপর রাষ্ট্রশক্তির এই অত্যাচার, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হুমকির মাত্রাকে আরো বাঙানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রশক্তির একটা পদক্ষেপ । ভারতীয় নাগরিকদের যারাই সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের অত্যাচার ঘিরে সোচ্চার হবেন, প্রতিবাদ করবেন, প্রতিরোধের সংকল্প নেবেন, তাদেরই পরিণতি হবে তিস্তাদের মতো। এদিকে লক্ষ্য রেখেই রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু তাদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার নামিয়ে এনেছে। তাই তিস্তার গ্রেপ্তারি প্রতিবাদ করা, তিস্তার মুক্তি দাবি করা, তিস্তার ওপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করার দাবি, তিস্তাদের মতো মানুষদের ওপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় অত্যাচার বন্ধ করবার দাবি আজ সংখ্যালঘুর স্বাধিকার রক্ষার দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০২ জুলাই ২০২২ , ১৮ আষাড় ১৪২৮ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

ভারতে মুসলমানদের কথা বললেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে

গৌতম রায়

মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর ভারতে বিগত ২০১৪ সাল থেকে নয়া আঙ্গিকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন শুরু হয়েছে, তার প্রতিবাদ যদি কেউ করেন প্রতিরোধের সংকল্প করেন, মুসলমান সমাজের পাশে দাঁড়ান, তাকেই এখন ভারতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতে হবে। গুজরাট গণহত্যার আগে থেকেই গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস তার হাজার রকমের শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতৃত্বে যে মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে তিস্তা শীতলবাদের মতো খুব হাতেগোনা মানুষজনই তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার থেকেছেন। রাজনৈতিক পরিম-লের বাইরে যারাই মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে অন্যায়, অবিচার ঘিরে সোচ্চার থেকেছেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির তাদেরকেই হয় ঘুষ দিয়ে বশীভূত করেছে, নতুবা ঘুষির ভয়ে পথচ্যুত করেছে।

তিস্তা শীতলবাদ এই ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং রাষ্ট্রশক্তির যৌথ আক্রমণের শিকার মুসলমান সমাজের হয়ে সাম্প্রতিক ভারতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নাগরিক সমাজের ভিতর থেকে তিস্তা, হর্ষ মান্দারের মতো হাতেগোনা মানুষজন আছেন, যারা প্রতিবাদী হয়েছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাজে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের দ্বারা বর্তমান সময়ে পরিচালিত ভারত সরকারের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী কাজ এবং মানসিকতাকে মেলে ধরবার ক্ষেত্রেও এসব মানুষদের অবদান ঐতিহাসিক।

সংখ্যালঘুর অধিকার ঘিরে ঠিক এ অবদান রাখা মানুষরাই এখন যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির ভারত রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। কারণ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের ওপর দীর্ঘ যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অত্যাচার সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শিবিরের দ্বারা সংঘটিত হয়ে চলেছে, তাকে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে, তাকে আর ও ক্ষিপ্ত ,আর উগ্র করে তোলবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের বিভিন্ন ধরনের শাখা সংগঠন ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভূমিকা সব থেকে বেশি। এই আরএসএসের সমস্ত ধরনের কর্মকা-কে প্রতিহত করবার লক্ষ্যে বামপন্থী রাজনীতিকরা ব্যতীত এবং তিস্তা শীতলবাদ, হর্ষ মান্দার, মোহামামদ জুবেইয়ের দের মত হাতে গোনা কিছু ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষজন ছাড়া ভারতের আর কোনো রাজনৈতিক দল কোনরকম আন্তরিক প্রয়াস চালায় না।

ভোট রাজনীতির খাতিরে কংগ্রেস বা তার কিছু সাঙ্গবাঙ্গেরা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রসারিত করবার লক্ষ্যে যে অবস্থান নেওয়া দরকার, রাজনৈতিক কর্মকা- করা দরকার, তার ধারপাশ দিয়েও তারা হাঁটে না। প-িত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর থেকে কংগ্রেস দল নেহরু অনুসৃত প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে সরে গিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী তার রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে কখনো আরএসএসকে ব্যবহার করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। কখনো করেছেন পরোক্ষভাবে। আবার সেই আরএসএস যখন ইন্দিরার ওপর প্রভাব বিস্তার করবার চেষ্টা করেছে, সেই প্রভাবকে প্রতিহত করবার লক্ষ্যে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছেন ইন্দিরা আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করে।

গোটা ভারত জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসারণের লক্ষ্যে বুর্জোয়া রাজনীতিকদের বিভিন্ন শিবিরের, বিভিন্ন সময়ে টানা পোড়ে?ন, তার নিরিখেই কিন্তু আজকে তিস্তাদের গ্রেপ্তারের সমস্ত প্রেক্ষাপটটিকে আমাদের বিচার করতে হবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিধায়ক কেনাবেচার ভেতর দিয়ে নির্বাচনে ভোটারদের যে অভিমত, তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহারাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করল বিজেপি। সেই রাজ্যের শেষ বিধানসভা ভোটের পর বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ধব ঠাকরে যে কংগ্রেস এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপিকে নিয়ে সরকার পরিচালনা করছিলেন, সেই সরকারও যে খুব ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান অন্তর থেকে নিয়ে চলছিল, এই দাবি করতে পারা যায় না। উদ্ভব ঠাকুরের সেই সরকারের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ’৯২ সালের ডিসেম্বর এবং ৯৩ সালে জানুয়ারি মাসে গোটা মুম্বাই শহর জুড়ে মুসলমান সমাজের মানুষদের সর্বস্তরের উপর সম্প্রদায়িক হিন্দুদের যে ভয়াবহ অত্যাচার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুম্বাই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত সেই সময়ের শিবসেনা নেতা সঞ্জয় নিরুপম এখন কংগ্রেস দলের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা। শারদ পাওয়ারের রাজনৈতিক দল এনসিপির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যে সেদিন মুম্বাই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, এই কথা কখনোই বলতে পারা যায় না।

মুম্বাই দাঙ্গার পর শ্রীকৃষ্ণ কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশনকে কাজ করতে না দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ সম্প্রদায়িক এবং পরোক্ষ সম্প্রদায়িক, উভয় শিবিরে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেছিল। তা সত্ত্বেও ওই দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত এবং প্রত্যক্ষভাবে মুসলমানদের জানমালের উপর অত্যাচারকারী, সম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের চিহ্নিত করে, তাদের শাস্তির যে সুপারিশ শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের প্রতিবেদনে করা হয়েছিল ,তাকে বাস্তবায়িত করবার লক্ষ্যে নয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক শক্তি, তার মধ্যে কংগ্রেসও আছে, মহারাষ্ট্রে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ,তারা কেউ বাস্তবায়িত করেনি।

একটা ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস গায়ে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মসিহা হিসেবে দেখানোর বহু চেষ্টা নানা সময় করে থাকেন। ‘হাজী বিবি’র চরিত্রে অসফল অভিনেত্রীর ভূমিকায় তার অভিনয় দেখতে দেখতে অত্যাচারিত মুসলমান সম্প্রদায়ের চোখ এখন ক্লান্ত। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কেন্দ্রে একাধিক সময়ে, একাধিক রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি যেমন কখনো কোন অবস্থাতেই শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করবার দাবি তোলেননি, আবার বিজেপি সরকারের মন্ত্রী থাকাকালীন তো তার পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর বা দাবি তোলার বাস্তব সমস্যার কথা আমরা বুঝতেই পারি।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন নরসিংহ রাও মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আবার গুজরাট গণহত্যার কালে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বিজেপি নেতৃতাধীন সরকার এনডিএ নামক এক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ফলে কখনোই সংখ্যালঘুর উপর হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যে নারকীয় অত্যাচার চালাচ্ছে, তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যকর কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত করেননি।

সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের জানমাল নিরাপত্তার জন্য প্রকৃত দাবি জানানো, এমনকি তার নিজের রাজ্যে, তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর যে ধারাবাহিক অত্যাচার চলেছে, ধারাবাহিক দাঙ্গা চলেছে, সে সম্পর্কেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদৌ কোন দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেননি; মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে চলা সংঘটিত অপরাধকে প্রতিহত করবার জন্য তার প্রশাসন আদৌ কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

তিস্তা শীতলবাদেরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মোহাম্মদ জুবাইয়ের গ্রেপ্তার হওয়ার পর, বামপন্থীরা যেভাবে পথে নেমেছেন; দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- সেভাবে কিন্তু ভারতে আর কোন রাজনৈতিক দল আজ পর্যন্ত পথে নামেনি। এই গ্রেপ্তারি ও গুলির বেশ কিছুকাল পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার একটি সভা থেকে মামুলি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ব্যাস ওই পর্যন্তই। তার বাইরে কিন্তু তিস্তাদের মুক্ত করবার ক্ষেত্রে কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মসূচি, কূটনৈতিক কর্মকা- অংশগ্রহণ করতে তাকে আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি।

তিস্তার ওপর রাষ্ট্রশক্তির এই অত্যাচার, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হুমকির মাত্রাকে আরো বাঙানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রশক্তির একটা পদক্ষেপ । ভারতীয় নাগরিকদের যারাই সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের অত্যাচার ঘিরে সোচ্চার হবেন, প্রতিবাদ করবেন, প্রতিরোধের সংকল্প নেবেন, তাদেরই পরিণতি হবে তিস্তাদের মতো। এদিকে লক্ষ্য রেখেই রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু তাদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার নামিয়ে এনেছে। তাই তিস্তার গ্রেপ্তারি প্রতিবাদ করা, তিস্তার মুক্তি দাবি করা, তিস্তার ওপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করার দাবি, তিস্তাদের মতো মানুষদের ওপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় অত্যাচার বন্ধ করবার দাবি আজ সংখ্যালঘুর স্বাধিকার রক্ষার দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]