প্রাথমিক শিক্ষার করুণ দশা

মাছুম বিল্লাহ

প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, অবৈতনিক করা হয়েছে, কিন্তু এই স্তরে শিক্ষার করুণ দশা যেন কাটছেই না। প্রাথমিক শিক্ষার এখনো এত করুণ হাল কেন? কোথাও শ্রেণীকক্ষে উপচে পড়া শিক্ষার্থী, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। কোথাও রাষ্ট্রীয় অর্থে নির্মিত হয়েছে সুবিশাল ভবন, রয়েছে শিক্ষক কিন্তু নেই শিক্ষার্থী। এমন কিছু সংবাদ আমরা অনেক আগেই জেনেছি কিন্তু পত্রিকার পাতায় বিস্তারিত দেখে আবারও অবাক হলাম।

পত্রিকার পাতায় দেখলাম খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ময়নাপুরে গ্রামে রয়েছে এমন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক চিত্র। সকালবেলা অ্যাসেম্বলিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের। জাতীয় সংগীত শেষে সবাই যার যার শ্রেণীকক্ষে চলে যাওয়ার কথা। পাঠদান শুরু হলে শোনা যাবে শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ। আর স্কুল শেষে ছুটির ঘণ্টা বাজলেই হৈ হৈ করে দৌড়ে বের হবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই বিদ্যালয়টিতে রয়েছে মাত্র একজন শিক্ষার্থী এবং এই একমাত্র শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন। বিদ্যালয়টির জরাজীর্ণ অবস্থা।

বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সবকিছুই আর সব বিদ্যালয়ের মতো হয়, ক্লাস, অ্যাসেম্বলি, বিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে ঘণ্টা বাজে। কিন্তু আমাদের একটিমাত্র বাচ্চা তাকে নিয়ে আর কি করা যায়। আমরা তাকে পাশে বসিয়ে মায়ের মতো পড়াই।’ দ্বিতীয় শ্রেণীর তিনটি বিষয় বাংলা, গণিত ও ইংরেজি। তিনজন শিক্ষক বিষয়গুলো ভাগ করে পড়ান। শিক্ষার্থীটি মোটামুটি ভালো। বিদ্যালয়টিতে যেন কোনো প্রাণ নেই। মনের দিক থেকে শিক্ষকদেরও মানতে ইচ্ছে করছে না এই পরিবেশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী শিশু নেই ময়নাপুর গ্রামে কারণ এখানে শিশু জন্মের হার কম।

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, ২০১৩ সালে সরকারিকরণ হয়। ময়নাপুর গ্রামটি হাওরের মধ্যে একটি দ্বীপ, চারদিকে পানি। গত চার পাঁচ বছরে কিছু নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে তারা কেউই এখন বিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্য হয়নি। পরিবারগুলোতে বাচ্চা নেয়ার হার কম, একটি করে সন্তান প্রায় সব পরিবারেই। ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ক্যাচমেন্ট এলাকা’ ব্যবস্থা চালু হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে যে বিদ্যালয় রয়েছে সেখানেই ভর্তি হতে পারে শিক্ষার্থীরা। অন্য এলাকায় চাইলেও ভর্তির সুযোগ নেই।

ডুমুরিায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জানান, ‘আমার কর্মজীবনে আমি কখনো এ রকম দেখিনি যে একটি বিদ্যালয়ে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। জায়াগটি দুর্গম। মাঝেমধ্যেই পানি ওঠে। তাই অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। রাস্তা তৈরি করে দ্বীপটির সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টির অবস্থান ডুমুরিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে, পাশর্^বর্তী জেলা যশোরের কেশবপুর লাগোয়া। বিদ্যালয়টি বন্ধ করে কেশবপুরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীটিকে স্থানান্তর করার প্রস্তাবটি অনুমোদনের অপেক্ষায়।’ তবে এই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে কাছের বিদ্যালয়টিও হবে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।

নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার ৮২ নম্বর ছাতারদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চলছে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। এখানে চতুর্থ শ্রেণীতে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণীতে কোন শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। স্থানীয়রা বলছেন যে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির মধ্যে দ্বন্দের কারণে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়ছে। বিদ্যালয়টি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে এক সময় অনেক শিক্ষার্থী ছিল। শিক্ষাদানের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থী কমতে থাকে। কিছু শিক্ষার্থী পাশের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ৬০ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে শিক্ষকরা সবাই মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়েও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।’ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, শিক্ষকরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না এবং ভালোভাবে পাঠদান করান না। যে কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। বগুড়ার শেরপুরে শ্যামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনজন শিক্ষক ও তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে পাঠদান। তবে কাগজে কলমে ৫৫ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন, তবে উপস্থিত থাকেন তিনজন। শিক্ষার্থী না থাকায় অলসভাবে সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষকরা। নিয়ম মোতাবেক বিদ্যালয় পরিচালিত না হওয়ায় অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদেও অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন বলে কেউ কেউ বলছেন। দিন দিন বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় আসতে শুরু হয়েছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এই হলো এক ধরনের চিত্র। আর এক করুন চিত্র দেখা যায় শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে । করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার হার নির্ণয় করতে দুই ধরনের গবেষণা চালিয়েছে ব্র্যাক। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ^বিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডসন ও ইউএসএআইডির সাবেক জেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্ট শহিদুল ইসলাম।

করোনাকালীন ও করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন। সেখানে দেখা যায় ২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাক্ষরতা দক্ষতা ছিল ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী এটি এখন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। পড়তে লিখতে এবং সংখ্যা চিনতে পারে এবং সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে বলে গবেষক দল জানান। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর সাক্ষরতা দক্ষতা কমেছে।

এমনকি গত পাঁচ বছরে যেখানে বাড়বে বলে মনে করা হয়েছিল সেখানে বরং ৭ শতাংশের বেশি কমেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুল খোলার প্রথম মাসে প্রাথমিকের প্রায় ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৭৯ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফেরেনি, যা প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। করোনাকালে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের কারণে এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৮০ জন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্র্যাকের গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় আরও পাওয়া গেছে যে, ২০৩০ সালের যে এসডিজি টার্গেট তা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। ২০০৮-এর শিক্ষার হার ২০২১-এ দেখা যাচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে শিক্ষায় আমরা ১৩ বছর পিছিয়ে আছি। তাই আগামী ৮ বছরে আমাদের ২১ বছর আগাতে হবে। এর জন্য শিক্ষা-সংক্রান্ত মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করা প্রয়োজন তবে, তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক এবং শিক্ষাবান্ধব।

তবে বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একটু ভিন্ন, এখানে রয়েছে ইনোভেটিভ আইডিয়া। প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ও পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া শিশুদেও জন্য ২০১৪সালে ব্র্যাক ‘ব্রিজ স্কুল’ চালু করে। যারা কখনো স্কুলে যায়নি বা প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছিটকে পড়েছে তাদের নিয়ে অনানুষ্ঠনিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। যাদের কিছু সাক্ষরতা ও সংখ্যার জ্ঞান আছে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে তাদের ব্রিজ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করে যোগ্যতা অনুযায়ী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ব্রিজ মডেলে প্রাথমিকের পাঁচ বছরের কোর্স অনুসরন করে পুনরাবৃত্তি কমিয়ে স্বল্পতম সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এ মডেলে দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য চারমাসের ব্রিজ কোর্স আয়োজন করা হয়।

ব্র্যাক ব্রিজের এ কোর্স কতটা কার্যকর তা বুঝতে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায় যে, প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমিয়ে এনেছে ব্রিজ স্কুল। সমীক্ষা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ^বিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডসন। দেখা যায় মহামারীর শুরুর দিকে প্রাথমিকে ২০২০ সালে ৯৬ দশমিক ২শতাংশ শিক্ষাথী অংশ নিলেও ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মহামারীর আগে প্রাক-প্রাথমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেশি থাকলেও মহামারী শুরুর পর সে হার কমেছে।

গবেষক স্টিফেন হেইনম্যান জানান, তিনি ৬৫টি দেশে কাজ করছেন এবং বহু বিদ্যালয় দেখেছেন। ব্রিজ স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মনোরম। এখানকার চারমাসের কোর্সটি বিশে^ অনন্য। কেননা, এটি ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে। দেশের যে এলাকায় যে ধরনের বিদ্যালয় প্রয়োজন সে রকম মডেল আবিষ্কার করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় মিনিমাইজ করবে।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টও, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশে]

সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২ , ২০ আষাড় ১৪২৮ ২৪ জিলহজ ১৪৪৩

প্রাথমিক শিক্ষার করুণ দশা

মাছুম বিল্লাহ

প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, অবৈতনিক করা হয়েছে, কিন্তু এই স্তরে শিক্ষার করুণ দশা যেন কাটছেই না। প্রাথমিক শিক্ষার এখনো এত করুণ হাল কেন? কোথাও শ্রেণীকক্ষে উপচে পড়া শিক্ষার্থী, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। কোথাও রাষ্ট্রীয় অর্থে নির্মিত হয়েছে সুবিশাল ভবন, রয়েছে শিক্ষক কিন্তু নেই শিক্ষার্থী। এমন কিছু সংবাদ আমরা অনেক আগেই জেনেছি কিন্তু পত্রিকার পাতায় বিস্তারিত দেখে আবারও অবাক হলাম।

পত্রিকার পাতায় দেখলাম খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ময়নাপুরে গ্রামে রয়েছে এমন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক চিত্র। সকালবেলা অ্যাসেম্বলিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের। জাতীয় সংগীত শেষে সবাই যার যার শ্রেণীকক্ষে চলে যাওয়ার কথা। পাঠদান শুরু হলে শোনা যাবে শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ। আর স্কুল শেষে ছুটির ঘণ্টা বাজলেই হৈ হৈ করে দৌড়ে বের হবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই বিদ্যালয়টিতে রয়েছে মাত্র একজন শিক্ষার্থী এবং এই একমাত্র শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন। বিদ্যালয়টির জরাজীর্ণ অবস্থা।

বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সবকিছুই আর সব বিদ্যালয়ের মতো হয়, ক্লাস, অ্যাসেম্বলি, বিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে ঘণ্টা বাজে। কিন্তু আমাদের একটিমাত্র বাচ্চা তাকে নিয়ে আর কি করা যায়। আমরা তাকে পাশে বসিয়ে মায়ের মতো পড়াই।’ দ্বিতীয় শ্রেণীর তিনটি বিষয় বাংলা, গণিত ও ইংরেজি। তিনজন শিক্ষক বিষয়গুলো ভাগ করে পড়ান। শিক্ষার্থীটি মোটামুটি ভালো। বিদ্যালয়টিতে যেন কোনো প্রাণ নেই। মনের দিক থেকে শিক্ষকদেরও মানতে ইচ্ছে করছে না এই পরিবেশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী শিশু নেই ময়নাপুর গ্রামে কারণ এখানে শিশু জন্মের হার কম।

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, ২০১৩ সালে সরকারিকরণ হয়। ময়নাপুর গ্রামটি হাওরের মধ্যে একটি দ্বীপ, চারদিকে পানি। গত চার পাঁচ বছরে কিছু নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে তারা কেউই এখন বিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্য হয়নি। পরিবারগুলোতে বাচ্চা নেয়ার হার কম, একটি করে সন্তান প্রায় সব পরিবারেই। ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ক্যাচমেন্ট এলাকা’ ব্যবস্থা চালু হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে যে বিদ্যালয় রয়েছে সেখানেই ভর্তি হতে পারে শিক্ষার্থীরা। অন্য এলাকায় চাইলেও ভর্তির সুযোগ নেই।

ডুমুরিায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জানান, ‘আমার কর্মজীবনে আমি কখনো এ রকম দেখিনি যে একটি বিদ্যালয়ে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। জায়াগটি দুর্গম। মাঝেমধ্যেই পানি ওঠে। তাই অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। রাস্তা তৈরি করে দ্বীপটির সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টির অবস্থান ডুমুরিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে, পাশর্^বর্তী জেলা যশোরের কেশবপুর লাগোয়া। বিদ্যালয়টি বন্ধ করে কেশবপুরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীটিকে স্থানান্তর করার প্রস্তাবটি অনুমোদনের অপেক্ষায়।’ তবে এই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে কাছের বিদ্যালয়টিও হবে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।

নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার ৮২ নম্বর ছাতারদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চলছে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। এখানে চতুর্থ শ্রেণীতে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণীতে কোন শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। স্থানীয়রা বলছেন যে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির মধ্যে দ্বন্দের কারণে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়ছে। বিদ্যালয়টি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে এক সময় অনেক শিক্ষার্থী ছিল। শিক্ষাদানের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থী কমতে থাকে। কিছু শিক্ষার্থী পাশের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ৬০ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে শিক্ষকরা সবাই মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়েও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।’ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, শিক্ষকরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না এবং ভালোভাবে পাঠদান করান না। যে কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। বগুড়ার শেরপুরে শ্যামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনজন শিক্ষক ও তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে পাঠদান। তবে কাগজে কলমে ৫৫ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন, তবে উপস্থিত থাকেন তিনজন। শিক্ষার্থী না থাকায় অলসভাবে সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষকরা। নিয়ম মোতাবেক বিদ্যালয় পরিচালিত না হওয়ায় অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদেও অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন বলে কেউ কেউ বলছেন। দিন দিন বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় আসতে শুরু হয়েছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এই হলো এক ধরনের চিত্র। আর এক করুন চিত্র দেখা যায় শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে । করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার হার নির্ণয় করতে দুই ধরনের গবেষণা চালিয়েছে ব্র্যাক। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ^বিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডসন ও ইউএসএআইডির সাবেক জেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্ট শহিদুল ইসলাম।

করোনাকালীন ও করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন। সেখানে দেখা যায় ২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাক্ষরতা দক্ষতা ছিল ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী এটি এখন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। পড়তে লিখতে এবং সংখ্যা চিনতে পারে এবং সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে বলে গবেষক দল জানান। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর সাক্ষরতা দক্ষতা কমেছে।

এমনকি গত পাঁচ বছরে যেখানে বাড়বে বলে মনে করা হয়েছিল সেখানে বরং ৭ শতাংশের বেশি কমেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে স্কুল খোলার প্রথম মাসে প্রাথমিকের প্রায় ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৭৯ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফেরেনি, যা প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। করোনাকালে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের কারণে এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৮০ জন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্র্যাকের গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় আরও পাওয়া গেছে যে, ২০৩০ সালের যে এসডিজি টার্গেট তা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। ২০০৮-এর শিক্ষার হার ২০২১-এ দেখা যাচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে শিক্ষায় আমরা ১৩ বছর পিছিয়ে আছি। তাই আগামী ৮ বছরে আমাদের ২১ বছর আগাতে হবে। এর জন্য শিক্ষা-সংক্রান্ত মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করা প্রয়োজন তবে, তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক এবং শিক্ষাবান্ধব।

তবে বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একটু ভিন্ন, এখানে রয়েছে ইনোভেটিভ আইডিয়া। প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ও পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া শিশুদেও জন্য ২০১৪সালে ব্র্যাক ‘ব্রিজ স্কুল’ চালু করে। যারা কখনো স্কুলে যায়নি বা প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছিটকে পড়েছে তাদের নিয়ে অনানুষ্ঠনিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। যাদের কিছু সাক্ষরতা ও সংখ্যার জ্ঞান আছে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে তাদের ব্রিজ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করে যোগ্যতা অনুযায়ী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ব্রিজ মডেলে প্রাথমিকের পাঁচ বছরের কোর্স অনুসরন করে পুনরাবৃত্তি কমিয়ে স্বল্পতম সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এ মডেলে দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য চারমাসের ব্রিজ কোর্স আয়োজন করা হয়।

ব্র্যাক ব্রিজের এ কোর্স কতটা কার্যকর তা বুঝতে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায় যে, প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমিয়ে এনেছে ব্রিজ স্কুল। সমীক্ষা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ^বিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডসন। দেখা যায় মহামারীর শুরুর দিকে প্রাথমিকে ২০২০ সালে ৯৬ দশমিক ২শতাংশ শিক্ষাথী অংশ নিলেও ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মহামারীর আগে প্রাক-প্রাথমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেশি থাকলেও মহামারী শুরুর পর সে হার কমেছে।

গবেষক স্টিফেন হেইনম্যান জানান, তিনি ৬৫টি দেশে কাজ করছেন এবং বহু বিদ্যালয় দেখেছেন। ব্রিজ স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মনোরম। এখানকার চারমাসের কোর্সটি বিশে^ অনন্য। কেননা, এটি ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে। দেশের যে এলাকায় যে ধরনের বিদ্যালয় প্রয়োজন সে রকম মডেল আবিষ্কার করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় মিনিমাইজ করবে।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টও, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশে]