রথযাত্রা : সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের মিলন

গৌরমোহন দাস

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয়ে ৯ দিনব্যাপী চলে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব। আষাঢ়স্য দ্বিতীয়ায়ং রথং কুর্যাদবিশেষতঃ।/ আষাঢ় শুক্লৈকাদিশ্যাং জপ হোম মহোৎসব॥ (পদ্মপুরাণ) অর্থাৎ আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা অনুষ্ঠান করে শুক্লা একাদশীর দিন উল্টোরথ বা পুনযাত্রা করতে হবে। এই সময়ে জপ, হোম করা বিধেয়।

শুধু জগন্নাথদেবেরই রথযাত্রা নয়, ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে বিভিন্ন রথের কথা পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসে সূর্যের রথযাত্রা, চৈত্র মাসে শিবের রথযাত্রা, বুদ্ধের রথযাত্রা, কার্তিক মাসে দেবীর রথযাত্রা, কার্তিক মাসে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রা, শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ইত্যাদি। রং ধাতুর অর্থ ক্রীড়া করা, এর সঙ্গে ছত্রত্রয় যুক্ত হয়ে হয় ‘রথ’। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধার কুঞ্জে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পথে চন্দ্রাবলি আটকে দিল। ফলে দেরি হয়েছিল বলে শ্রীমতী রাধার কাছে যাওয়ার পর প্রসঙ্গত বলেছিলÑ ‘দেহ রথে যদি না-ই এলে প্রভু, মনোরথে কেন এলে না?’ আমরা আমাদের মনোরথকে নিয়ে যাব শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রায়।

শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব কে? জগন্নাথÑ জগতের নাথ। ‘যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ’। ‘জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথগামী ভবতু মে’ এখানে স্বামী মানে ঈশ্বর বা প্রভু, জগতের নাথ- জগন্নাথ। কিন্তু তার অসম্পূর্ণ মুখম-ল এবং হাত পা নেই। এ বিষয়ে আমাদের সর্ববৃহৎ পুরাণ স্কন্দ পুরাণের উৎকলখ-ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। প্রভু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে দেখালেনÑ আমি হাত পা রহিত হলেও অপ্রকৃত হস্তাদি দ্বারা ভক্তের সেবা গ্রহণ করব এবং বিশ্বজগতের কল্যাণ সাধন করব। তুমি পূজা কর। তখন স্বয়ং ব্রহ্মা, রাজার অনুরোধে প্রীত হয়ে ওই মূর্তিতে চক্ষু ও প্রাণদান করেন এবং নিজে পুরোহিত হয়ে মূর্তি প্রতিষ্ঠাপূর্বক পূজা করেন। হস্তপদাদি না থাকায় তাকে ‘ঠুটো জগন্নাথ’ বলা হয়ে থাকে। সেটা অজ্ঞতা মাত্র। রথযাত্রায় সহজলভ্য ফল কলা এবং অন্যান্য ফলাদি আস্তই ছুঁড়ে দেয়া হয়। স্বয়ং জগন্নাথ রথযাত্রায়, ভক্ত সঙ্গে থাকেন বলে ‘সবার মধ্যে আমিও প্রসাদ গ্রহণে অধিকারী’ হিসেবে আস্ত ফল ছুঁড়ে দেয়া হয়। আর তা এমনিই প্রসাদ হয়ে যায়। নিবেদনের প্রয়োজন হয় না।

আমাদের সমাজে অঙ্গহীন হাজারো মানুষ রয়েছে। তারা সমাজের অংশ। তারাও ভগবানের সৃষ্টি, ঈশ^রকে দেখার ও পূজার অধিকারী। কখনো তাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। আর তারাসহ বিভিন্ন ব্যস্ততায় যারা ভগবানকে দর্শনের সুযোগ পান না, মন্দিরে যেতে পারেন না, তাদের ভগবান নিজেই কৃপা করে দর্শন দিতে মন্দির ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। ভগবান-ভক্তের সঙ্গে মিলিত হন এ রথযাত্রায়। সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের মিলন! ফলে তখন ধনী-গরিব, ছোট-বড়, উঁচু-নিচু সব কিছু বলে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে ভগবান-ভক্তের মিলনানন্দ উপভোগে রথযাত্রায় একাকার হয়।

বলরাম, সুভদ্রা দেবী রথে করে গু-িচায় যান (প্রথম যে ঘরে মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল তার নাম গু-িচা)। দেবতাদেরও আমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করার মানসে পরবর্তী সময়ে তা ‘মাসির বাড়ি’ নামান্তরিত হয়। বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও আচার্য ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজীর মতে, শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব গু-িচা নামের একটি ছোট্ট গ্রামে যান। শহরের বাতাস বিষাক্ত, প্রাণ যায় যায়। গ্রামের বাতাস নির্মল, সজীবতায় প্রাণ ভরে যায়। সে কথায়ও শহরের কর্মব্যস্ত মানুষকে গ্রামের প্রতি ভালোবাসা অটুট রাখার শিক্ষা দেয়।

কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয়-বল্লীর ৩য় মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়Ñ‘আত্মানাং রথীনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। / বুদ্ধিং তু সারথীং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।’ অর্থাৎ জীবাত্মা রথী, শরীর রথ, বুদ্ধি সারথী, মন লাগাম, ইন্দ্রিয়রা অশ্ব বা ঘোড়া। ভোগ্য বিষয়ের দিকে যাতে তারা না দৌড়াতে পারে তারই জন্য বিবেকী বুদ্ধি সারথী, মন লাগাম এর জন্য দেহরথ পুনর্জন্ম বর্জিত হয়ে মুক্তির পথে পৌঁছায়। শ্রীরাম প্রসাদ গেয়েছিলেনÑ ‘আমি রথ, তুমি রথী, যেমনি চালাও এমনি চলি.. ..।’ রথযাত্রার পুণ্যে আমাদের সবার আত্মা মুক্তির রাজ্যে পৌঁছুক। শান্তিতে থাকুক সকলে। প্রণাম জানাই : নীলাচল নিবাসায় বিদ্যায়ঃ পরমাত্মনে।/ বলভদ্র সুভদ্রাহ্যানং জগন্নাথায়তে নমোঃ॥

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]

সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২ , ২০ আষাড় ১৪২৮ ২৪ জিলহজ ১৪৪৩

রথযাত্রা : সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের মিলন

গৌরমোহন দাস

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয়ে ৯ দিনব্যাপী চলে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব। আষাঢ়স্য দ্বিতীয়ায়ং রথং কুর্যাদবিশেষতঃ।/ আষাঢ় শুক্লৈকাদিশ্যাং জপ হোম মহোৎসব॥ (পদ্মপুরাণ) অর্থাৎ আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা অনুষ্ঠান করে শুক্লা একাদশীর দিন উল্টোরথ বা পুনযাত্রা করতে হবে। এই সময়ে জপ, হোম করা বিধেয়।

শুধু জগন্নাথদেবেরই রথযাত্রা নয়, ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে বিভিন্ন রথের কথা পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসে সূর্যের রথযাত্রা, চৈত্র মাসে শিবের রথযাত্রা, বুদ্ধের রথযাত্রা, কার্তিক মাসে দেবীর রথযাত্রা, কার্তিক মাসে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রা, শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ইত্যাদি। রং ধাতুর অর্থ ক্রীড়া করা, এর সঙ্গে ছত্রত্রয় যুক্ত হয়ে হয় ‘রথ’। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধার কুঞ্জে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পথে চন্দ্রাবলি আটকে দিল। ফলে দেরি হয়েছিল বলে শ্রীমতী রাধার কাছে যাওয়ার পর প্রসঙ্গত বলেছিলÑ ‘দেহ রথে যদি না-ই এলে প্রভু, মনোরথে কেন এলে না?’ আমরা আমাদের মনোরথকে নিয়ে যাব শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রায়।

শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব কে? জগন্নাথÑ জগতের নাথ। ‘যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ’। ‘জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথগামী ভবতু মে’ এখানে স্বামী মানে ঈশ্বর বা প্রভু, জগতের নাথ- জগন্নাথ। কিন্তু তার অসম্পূর্ণ মুখম-ল এবং হাত পা নেই। এ বিষয়ে আমাদের সর্ববৃহৎ পুরাণ স্কন্দ পুরাণের উৎকলখ-ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। প্রভু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে দেখালেনÑ আমি হাত পা রহিত হলেও অপ্রকৃত হস্তাদি দ্বারা ভক্তের সেবা গ্রহণ করব এবং বিশ্বজগতের কল্যাণ সাধন করব। তুমি পূজা কর। তখন স্বয়ং ব্রহ্মা, রাজার অনুরোধে প্রীত হয়ে ওই মূর্তিতে চক্ষু ও প্রাণদান করেন এবং নিজে পুরোহিত হয়ে মূর্তি প্রতিষ্ঠাপূর্বক পূজা করেন। হস্তপদাদি না থাকায় তাকে ‘ঠুটো জগন্নাথ’ বলা হয়ে থাকে। সেটা অজ্ঞতা মাত্র। রথযাত্রায় সহজলভ্য ফল কলা এবং অন্যান্য ফলাদি আস্তই ছুঁড়ে দেয়া হয়। স্বয়ং জগন্নাথ রথযাত্রায়, ভক্ত সঙ্গে থাকেন বলে ‘সবার মধ্যে আমিও প্রসাদ গ্রহণে অধিকারী’ হিসেবে আস্ত ফল ছুঁড়ে দেয়া হয়। আর তা এমনিই প্রসাদ হয়ে যায়। নিবেদনের প্রয়োজন হয় না।

আমাদের সমাজে অঙ্গহীন হাজারো মানুষ রয়েছে। তারা সমাজের অংশ। তারাও ভগবানের সৃষ্টি, ঈশ^রকে দেখার ও পূজার অধিকারী। কখনো তাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। আর তারাসহ বিভিন্ন ব্যস্ততায় যারা ভগবানকে দর্শনের সুযোগ পান না, মন্দিরে যেতে পারেন না, তাদের ভগবান নিজেই কৃপা করে দর্শন দিতে মন্দির ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। ভগবান-ভক্তের সঙ্গে মিলিত হন এ রথযাত্রায়। সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের মিলন! ফলে তখন ধনী-গরিব, ছোট-বড়, উঁচু-নিচু সব কিছু বলে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে ভগবান-ভক্তের মিলনানন্দ উপভোগে রথযাত্রায় একাকার হয়।

বলরাম, সুভদ্রা দেবী রথে করে গু-িচায় যান (প্রথম যে ঘরে মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল তার নাম গু-িচা)। দেবতাদেরও আমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করার মানসে পরবর্তী সময়ে তা ‘মাসির বাড়ি’ নামান্তরিত হয়। বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও আচার্য ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজীর মতে, শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব গু-িচা নামের একটি ছোট্ট গ্রামে যান। শহরের বাতাস বিষাক্ত, প্রাণ যায় যায়। গ্রামের বাতাস নির্মল, সজীবতায় প্রাণ ভরে যায়। সে কথায়ও শহরের কর্মব্যস্ত মানুষকে গ্রামের প্রতি ভালোবাসা অটুট রাখার শিক্ষা দেয়।

কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয়-বল্লীর ৩য় মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়Ñ‘আত্মানাং রথীনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। / বুদ্ধিং তু সারথীং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।’ অর্থাৎ জীবাত্মা রথী, শরীর রথ, বুদ্ধি সারথী, মন লাগাম, ইন্দ্রিয়রা অশ্ব বা ঘোড়া। ভোগ্য বিষয়ের দিকে যাতে তারা না দৌড়াতে পারে তারই জন্য বিবেকী বুদ্ধি সারথী, মন লাগাম এর জন্য দেহরথ পুনর্জন্ম বর্জিত হয়ে মুক্তির পথে পৌঁছায়। শ্রীরাম প্রসাদ গেয়েছিলেনÑ ‘আমি রথ, তুমি রথী, যেমনি চালাও এমনি চলি.. ..।’ রথযাত্রার পুণ্যে আমাদের সবার আত্মা মুক্তির রাজ্যে পৌঁছুক। শান্তিতে থাকুক সকলে। প্রণাম জানাই : নীলাচল নিবাসায় বিদ্যায়ঃ পরমাত্মনে।/ বলভদ্র সুভদ্রাহ্যানং জগন্নাথায়তে নমোঃ॥

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি]